অপরাহ্ন পর্ব ২

0
234

অপরাহ্ন

( সতর্কতা : অত্যন্ত পরিণত মনের পাঠকের জন্য )

( পর্ব ২ )

আপনারা পোষা বিড়াল দেখেছেন? গৃহিনী যখন নিজের কাজে ব্যাস্ত, বিড়ালটার দিকে একবার ফিরেও তাকাচ্ছেনা, তখনো দেখবেন বিড়াল কেমন পায়ের কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। কুই কুই করে বলতে চায়, একবার তাকাও, আমাকে একটু আদর করো।

আমার অবস্থা হয়ে গেল তেমন সেই দ্বিতীয় দিন থেকে। রাতে আমি অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছি সেটা পুষিয়ে নিতে ভোরে উঠে রান্নাঘরে গেলাম, মা ছিল সেখানে, বললাম, বৌয়ের চা নাস্তা দাও, ঘরে নিয়ে যাই। মা একটু অবাক হলেও হেসে ফেললেন।

কিন্তু সেটাই নিয়ম হয়ে গেল এরপর। এখন চিন্তা করে দেখলে নিজেই অবাক হয়ে যাই, কিন্তু ওকে আমি অবিকল দেবীর মত পূজা করতে শুরু করি। ওদের বাড়িতে দুদিন থাকার নিয়ম, কিন্তু ওকে পৌঁছে দেবার পরে ও ঠোঁট ফুলিয়ে বায়না করে, তুমি বাসায় চলে যাও, দুদিন বাপ মার সাথে থাকি। আমি মুখ চুন করে ফিরে এসেছিলাম। সেইরাতে একা বিছানায় শুয়ে কি প্রচন্ড মন খারাপ হয়েছিল বলার মত না।

ওকে যেদিন নিতে যাই, সেদিন আরেকটা বিশেষ রকম খারাপ দিন ছিল আমার জন্য। মনে হচ্ছিলো, সবাই আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে বুঝি। আর মুখ ফিরিয়ে হাসছে! হারাবার ভয়ে আমি এতো অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার হাত পা কাঁপছিল। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিলো, কেউ বলবে, তুমি একাই যাও। এমন লোকের কাছে মেয়ে দেবোনা আর!

বিয়ের সাতদিন পর থেকেই কর্মক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন করি আমরা দুজনেই। আমি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নিশ্চিত করতাম, যেন সানজিদার নাস্তা তৈরী থাকে। পারলে ও বিছানা থেকে নামার আগে খাটের পাশে একটা জোড়া পরিষ্কার স্যান্ডেল এগিয়ে দিতাম যেন পৃথিবীর কোন ময়লা ওকে স্পর্শ না করে। বাথরুমের বাইরে সটান দাঁড়িয়ে থাকতাম, বলা যায়না, কিছু প্রয়োজন হয়ে পরলে?

আর হ্যাঁ, রাতে বিছানায় আমি মাপা দূরত্ব বজায় রাখতাম। ঘুমাতে যেতাম সে ঘুমিয়ে যাবার অনেক পরে। তার কারণ এই না যে, আমার ইচ্ছে হতোনা। বরং ভয় পেতাম। একটু দূরে শুয়ে থাকা মানবীকে বারবার দেবী বলে ভ্রম হত। যেন ছুতে গেলে ভস্ম করে দেবে আমাকে। আমি পারবোনা। আমার পরাজিত সৈনিক মাথা নিচু করে ফিরে আসবে আবার।

দিনের বেলা দুজনেই যার যার কাজের জায়গায় ব্যাস্ত থাকতাম, দেখা হতোনা, কিন্তু আমি প্রথম প্রেমে পরা কিশোরের মত মনে মনে সারাদিন ওর কথাই ভাবতাম। আসলে প্রেমে পরার মত বলার কিছু নেই, সত্যি সত্যিই ভয়ানক প্রেমে পরে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির লাগত সারাটাক্ষন, ফেরার পথে ট্রাফিক জ্যামে দুনিয়াশুদ্ধ সবাইকে গালি দিতাম মনে মনে, এতো তাড়া থাকতো ফেরবার!

আমার মনে আছে, ঠিক বাইশ দিনের মাথায় আমি আবার একটু বাঁধনহারা হয়ে গেলাম।

দীর্ঘসময় চেয়ারে বসে সানজিদাকে দেখছিলাম বিছানায় শুয়ে মুঠোফোনে ব্যাস্ত থাকতে। কি যেন দেখে আর একটু পরে পরে হেসে ওঠে। আমি সাহসী মানুষের মত তার গা ঘেঁষে শুয়ে পরলাম, উঁকি দিয়ে বললাম, ” কি দেখে হাসো এতো? আমাকে দেখাও? ”

সে একটু সরে গিয়ে দেখাল, একটা লোক বিভিন্নভাবে রাস্তায় লোকজনদের বোকা বানাচ্ছে, এটা দেখে এতো হাসির কি আছে আমি বুঝলাম না। আমি বরং ওর শরীরের উপর হাত রাখলাম।

ও নিজেও হয়ত জানতো এমন কিছু হতে পারে, বাধা দিলোনা কিন্তু হেসে বললো, ” হবে তো? ”

হত কিনা জানিনা, এই মুচকি হাসি আর ওই কথার পরে হলোনা। আমি, আমার মন এবং আমার শরীর, সবাই ভীষণ অভিমানী হয়ে জন্মেছি।

সানজিদা বিরক্ত হয়ে বললো, ” এখন এর জন্য কি আমাকে গোসল করতে হবে নাকি? আচ্ছা গুগল করে দেখি তো?কাজের কাজ কিছু হলেও কথা ছিল। শুধু শুধু রাত করে গা ভিজাতে ইচ্ছে করে কারো? ”

ফলে আমি নিজেকে আবার ওর পায়ের নিচে আবিষ্কার করলাম।

দিনের পর দিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম হতোনা কোন, দৃষ্টিকটু ভাবে ব্যাস্ত হয়ে পরতাম স্ত্রীকে খুশি করতে।

” সানজিদা, এটা খাবে? সানজিদা ওটা খাবে? সানজিদা সারাদিন কাজ করেছ, বিশ্রাম নেবে? ”

বোনকে বলতাম, ” দেখ তোর ভাবীর মাথায় তেল দিয়ে দিবি কিনা? ভালোমতো মেসেজ করে দিস।”

” সানজিদা শাড়ি কিনবে? জামা কিনবে? বাবার বাড়ি যাবে?”

দিনে সে বাসায় থাকেনা, এক রাতে খাবার পরে দেখলাম রান্নাঘরে বাসন কোসন ধুচ্ছে। আমি অবলীলায় চিৎকার করে বললাম, ” তোমার এসব করতে হবে কেন শুনি? মা করেনি এতদিন? নাহার কিসের এতো ব্যাস্ত, পড়াশোনা কদ্দুর কি করছে জানিনা আমি? ”

ওইদিন সানজিদা পর্যন্ত বলে বসল, ” মা, ও কি বলছে, ওকে ধরেন। আমি এর কিছুই জানিনা ”

কিন্তু সে জানত। তার ঠোঁটের কোনায় লেগে থাকা ব্যাঙ্গের হাসিটা কেবল আমি দেখতে পেয়েছিলাম।

বিছানায় গিয়ে দেখি সে হাত পারি ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো জায়গা জুড়ে, আহ্লাদি গলায় বললো, বিশেষ বিশেষ দিনে আমি একা ঘুমাবো। কয়েকদিন ম্যানেজ করতে পারবে না?

আমি বালিশ কাঁথা নিয়ে বসার ঘরে চললাম। নাটক সিনেমার মত মেঝেতে ঘুমাতে আমি আবার পারিনা, পিঠে ব্যাথা হয়। শুয়ে শুয়ে শুনলাম মা খুন খুন করে কাঁদছে তার ঘরের ভেতর। বাবা চলে যাবার পরে আমি ঠিক করেছিলাম, মাকে কখনো কষ্ট দেবোনা। আজকে সানজিদার কারণে তিনি কষ্ট পেলেন। তখন দ্বিতীয়বারের মত সানজিদাকে মেরে ফেলবার কথা ভাবলাম।

***

” আপনার কোন সমস্যা নেই” ডাক্তার হাসিমুখে বললেন, ” সম্পূর্ণ সুস্থ ও সবল মানুষ আপনি”

ওনার সামনে পিঠ কুঁজো করে বসেছিলাম আমি, নিজেকে আজকাল সত্যিই হ্যাঞ্চ ব্যাক অফ নটরডেমের মত মনে হয়, কুৎসিত, কুঁজো, কেউ ভালোবাসেনা এমন। কথা শুনে অবশ্য একটু সোজা হয়ে বসলাম।

” আপনি ঠিক জানেন তো?” বিড়বিড় করে বললাম, অনেকটা স্বগোতোক্তির মত, ” তাহলে? ”

” তাহলে এটা মানসিক সমস্যা ”

আবার নড়ে বসলাম, ” আপনার ধারণা আমি পাগল? ”

অমায়িক হাসলেন আবার ভদ্রলোক, ” আপনার মত শিক্ষিত মানুষের কাছে এই উপসংহার আশা করিনি। সমস্যা মানসিক মানে আপনি পাগল এটা কি বললেন? ”

” আমি কি করবো তাই বলেন? ”

” সময় দিতে হবে ”

” সময়? ” আমি আকাশ থেকে পরলাম, ” ডাক্তার সাহেব, তিন মাস হতে চলল, আর কত সময়? ”

” সেই সময়ের কথা বলছিনা। লম্বা ভূমিকার কথা বলছি। প্রলগ। তাড়াহুড়ো করে সবটা উপন্যাস পড়তে চাইবেন না। সময় নিয়ে ভূমিকা পড়ুন। কিছু বুঝলেন? ”

ডাক্তার না হয়ে উনার হয়ত সাহিত্যিক হওয়া উচিৎ ছিল। কিংবা কে জানে ডাক্তার হয়েও হয়ত উনি ভালো ভূমিকা লেখেন। মরিয়া হয়ে বললাম, ” কোন ওষুধ দেয়া যায়না? ”

কাঁধ ঝাঁকলেন, ” আমি মনে করিনা তার দরকার আছে। বলছেন লিখে দিচ্ছি। তবে বলে রাখি, মন না ঠিক হলে কিছু ঠিক হবেনা। আপনি বরং স্ত্রীর সাথে কথা বলেন। তিনি না চাইলে কিছুই হবেনা”

আমি কথা বললাম। সানজিদা হেসে বললো, ” এমনিই তোমাকে স্বান্তনা দেবার জন্য বলেছে হয়ত “।

তবু আমি ওর উপর রাগ করতে পারলাম না। অনেক খানি সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেললাম, তোমার কি বিয়েতে মত ছিলোনা?

” ছিল ” স্বভাব সুলভ ঠোঁট উল্টানো, ” কিন্তু প্রথম রাতে গরিলার মত কেউ কাছে আসতে চাইবে, এটা জানতাম না। তাও যদি কিছু করার মুরোদ থাকতো …. হিহিহিহি… হিহি.. ”

লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করল, প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, ” আমার অফিস থেকে একটা কাজ পরেছে গাজীপুর। আগামী কয়েকটা মাস মাসে সাতদিন করে যেতে হবে। ওরা বলেছে থাকতে চাইলে খরচ দেবে। আর না চাইলে গাড়ি দেবে যেতে আসতে। এই মাসটা তুমি যাবে আমার সাথে? এক সপ্তাহ… ”

” আমি এখন ছুটি পাবোনা।”

” তাহলে গাড়িটাই দিতে বলি। নাকি? ”

” তোমার ইচ্ছা “।

***

বছর খানেক আগের এক দিন। এই প্রজেক্টের কাজ তখন সবে শুরু হয়েছে। সেদিনও খুব সকালে রওয়ানা হয়েছিলাম, রাস্তা নীরব, ড্রাইভারকে বললাম, আমি চালাই, তুমি একটু দেখিয়ে পড়িয়ে দাও।

কিন্তু সে একটু পরেই নাক ডেকে ঘুমাতে লাগল, আমারো চোখ লেগে এসেছিল। এই রাস্তায় সাধারণ যান বাহনের চেয়ে ট্রাকের আনাগোনা বেশি, কোত্থেকে কখনো এক ট্রাক দানবের মত সামনে এসে পরল জানিনা। জলিল দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে পাশের জঙ্গলে নামিয়ে দিল। আমরা প্রাণে বেঁচে গেলাম।

উত্তেজনা সামলাতে জলিল একটু দূরে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজ সারতে লাগল। আর আমি গাড়ির কাচ নামিয়ে চারদিকটা দেখতে থাকলাম।

কি নীরব একটা জায়গা! রাস্তা থেকে বোঝার উপায় নেই, এখানে অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছ গাছালি রীতিমতো জঙ্গলের রূপ নিয়েছে। আমার দৃষ্টি কাড়লো একটু দূরে গাছের আড়াল থেকে দেখা যাওয়া একটা পুরনো, ভাঙা টেবিল ফ্যান। কি আশ্চর্য! কে এই বিরান জায়গায় একটা অকেজো টেবিল ফ্যান রেখে গেছে!? এই বিষয়টা আমার মনে গেথে গিয়েছিল অজানা কারণে।

তারপর থেকে ওই রাস্তা দিয়ে যাবার সময় প্রতিদিন নেমে গিয়ে ওই ফ্যানটাকে একবার দেখে আসতাম। কোন নড়চড় নেই, চারপাশের পৃথিবীতে কি ঘটছে কোন হুশ নেই, একটা ফ্যান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরেও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতাম।

সেই প্রজেক্ট আবার শুরু হল আমাদের বিয়ের তিন মাসের মাথায়, আবার আমি গাড়ি পেলাম। প্রথম দিন যখন যাচ্ছি, অভ্যাস বশত গাড়ি থামিয়ে আবার আমার প্ৰিয় ফ্যানটাকে খুজলাম। আর কি আশ্চর্য! এখনো সেটা একই জায়গায়, একই ভাবে পরে আছে। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত অদ্ভূত শিহরণে ভরে গেল। তাহলে কি এই জায়গায় কেউ যায়না? আমি ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম।

( চলবে )

আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1653980575116963/?mibextid=Nif5oz

পরের পর্ব

https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1655968744918146/?mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here