#অবন্তর_আসক্তি,৬১,৬২
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা [লেখিকা]
#পর্ব____৬১
শীত কাল চলছে হাল্কা হাল্কা শীত পরেছে। গ্রামে গাছপালা বেশি থাকে আর তেমন ঘনবসতি ও নয়। তাই বাতাসের ঠান্ডা আবেশ শহরের তুলনায় বেশি।
শীতে কাপুনি ধরে আসছে হাতের তালু দুটো একসাথে গষতে গষতে কিচেনে আসে বর্ষা। জ্বলন্ত চুলার পাশে হাত রাখে যাতে করে আগুনের উষ্ণ তাপে কিছুটা আরাম পায়।
মুন্নি বর্ষার উদ্দেশ্য বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে তোর এখন বাড়ির সকলকে ওর কথা বলে দেওয়া উচিত!’
বর্ষা হতবুদ্ধি চোখে মুন্নির দিকে তাকালো শুকনো ঠোঁট জোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলল, ‘ আমি চাইনা এখনই কেউ ওর ব্যাপারে জানুক৷ ’
বলে বর্ষা মুন্নির সামনে থেকে রুমে চলে যায়। মুন্নি রান্না শেষে ডাইনিং টেবিলে খাবার গুলো সাজিয়ে রেখে বর্ষাকে ডাকতে যায়। বর্ষার রাগ ভাঙ্গিয়ে সাথে করে নিয়ে আসে। চেয়ারে দু’জনে পাশাপাশি বসেছে বর্ষা আহ্লাদী স্বরে বলে, ‘ তাপ্পি আজকে তুমি আমাকে খাইয়ে দিবা প্লিজ। ’
মুন্নি মৃদুস্বরে বলল, ‘ আচ্ছা ঠিক আছে! ’
খাবার শেষে দু’জনে কিয়ৎক্ষণ টিভি দেখতে বসে। দেখার মতন তেমন কোনো কিছু না পেয়ে টিভি অফ করে দেয়। বাড়ির সকল লাইট নিভিয়ে ঘুমাতে চলে যায়।
এই রাতের অন্ধকারে চারপাশ থেকে নানান পশুপাখির ডাক ভেসে আসছে। পুরোদিন কাজ করে ক্লান্ত থাকায় বিছানার সাথে গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে যায় মুন্নি। এদিকে বর্ষার কোনো ভাবেই ঘুম আসছে না৷ বার বার এপাশ ওপাশ করছে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল টা হাতে নেয়। গ্যালারিতে এসে অভ্রর ছবি দেখতে লাগে কিয়ৎক্ষণ পর মোবাইল বুকের উপর রেখে সেও ঘুমিয়ে পরে।
রাত তখন গভীর, সময়ের অনুমান করা খুব কঠিন। রুমের মধ্যে লাল রঙের ড্রিমলাইট জ্বলছে বলে আবছা আবছা কম বেশি সবই দেখা যাচ্ছে। কোনো কিছুর শব্দ কানে আসতে ঘুম ভেঙে যায় বর্ষার পিটপিট করে চোখ জোড়া মেলে তাকায় আর দেখতে পায় একটা দানবের মতো ছায়ামূর্তি তার দিকে ধেঁয়ে আসছে। ভয়ে কপাল থেকে ঘাম জড়তে থাকে তার, এত বেশি ভয় পেয়েছে যে যার জন্য পাশে শুয়ে থাকা বোনটাকেও ডাকতে পারছে না বর্ষা। ছায়ামূর্তি টা একটু একটু তার দিকে এগিয়ে আসছে৷ বর্ষা মুখ খুলে আমতা আমতা করে বলল, ‘এই তাপ্পি উঠ না প্লিজ! ‘
মুন্নির কোনো হুঁশশ নেই, এদিকে বর্ষা আরেকবার তাকে ডাকতে যাবে তখন খেয়াল করল, ছায়ামূর্তি টা লাফ দিয়েছে আর লাফিয়ে তার উপরে পরতে যাচ্ছে। আচমকা চোখ মেলে তাকায় বর্ষা তৎপর বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বসল। তারাতাড়ি করে ফোনের লাইট অন করে তারপর পুরো রুমে চোখ বুলাতে লাগে হতবিহ্বল হয়ে যায় সে কারণ রুমের চার কোণায় কিছুই নেই। বুকের উপর হাত রেখে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে। পাশ ফিরে একবার মুন্নির দিকে তাকালো সে স্বাভাবিক ভাবেই ঘুমাচ্ছে খারাপ স্বপ্ন দেখছে ভাবতে ভাবতে ফোনে সময় চেক করলো। রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি পাঁচ মিনিট কম তিনটা বাজে। বিছানা থেকে নেমে বর্ষা আস্তে আস্তে ওয়াশরুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর অজু করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। ভালো মত ওড়না গায়ের সাথে বেঁধে নেয়। জায়নামাজ বিছিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে পরে। তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে বসে বসে তব্জি দিয়ে দোয়া কালাম পরতে লাগে। এতেই আধঘন্টার মতো সময় পাড় হয়ে যায়। তব্জি পাশে রেখে কোরআন শরীফ সামনে নিয়ে বসে। এক মনে কোরআন পড়তে থাকে। কোরআন পড়ায় এতটাই মগ্ন হয়ে পরেছিল যে সময়ের কোনো খেয়ালই ছিল না, দূর দিগন্ত থেকে কানে ভেসে আসে ফজরের আজান। কোরআন পড়া শেষ করে ফজরের নামাজ আদায় করতে দাঁড়িয়ে পরে। নামাজ শেষে আবারও তব্জি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় আর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মুন্নিকে ডাকতে লাগে, ‘ তাপ্পি উঠো ফজরের আজান দিছে অনেকক্ষণ উঠে নামাজ পরে নাও! ‘
মুন্নি কিয়ৎক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে, ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে যায়। তারপর নামাজ আদায় করে নেয়।
ইতিমধ্যে সূর্য তার স্নিগ্ধ আবেশ তুলে ধরেছে আকাশের বুকে। সকালের মিষ্টি রোদের আলো জানালা মেলে দিতে রুমে উপচে পরতে লাগলো। মুন্নি বর্ষার উদ্দেশ্য তারা দিয়ে বলল, ‘ আমি নাস্তা বানাচ্ছি! তুই বেলকনিতে গিয়ে ফুল গাছ গুলোতে পানি দিয়ে আয়। ’
বর্ষা ছোট করে বলে উঠল, ‘ আজ আমি নাস্তা বানাই? ‘
মুন্নি শাসিতকন্ঠে বলল, ‘ এই অবস্থাতে রান্না ঘরে একদমই যাবি না! যেটা বলেছি আপাতত শুধু ওটাই কর। ’
বর্ষা মুখ গম্ভীর করে বেলকনিতে চলে আসে, গাছগুলোতে পানি দিয়ে পাশেই চেয়ারে বসল, সদ্য উদয় হওয়া সূর্যটার দিকে এক মনে তাকিয়ে থেকে বর্ষা আবেগী হয়ে বলতে লাগল,
❝ হুট করেই চলে গেছো, কাছে থেকে দূরে বহুদূরে
বুঝিনা কিসের তরে থাকো কার কল্পনার ঘোরে!
স্বপ্ন দেখিয়ে ভেঙে দিয়েছো, দূরে বসে হয়তো খিলখিল হাসছে!
কিন্তু আমার মনের আয়নায় যে তুমি’ই স্বপ্ন হয়ে ভাসো!!
বিবর্ণতায় সাজাও ভূবন আমার, আচম্বিতে
বুকের মধ্যে উথাল ঊর্মির তোড়ে ফিরি সম্বিতে।
চোখের নদীতে বন্যা বয়ে যায় সেকি অভ্র বুঝে?
বুকের অথৈএ রক্ত চুয়ে চুয়ে সে’কি অভ্র খুঁজে?
অস্পৃশ্য ভালবাসায় ডুবে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি
মোহের টানে নাগালে কারো অস্তিত্ব ঠের পাচ্ছি! সে কে? নীলাম্বরে ভেসে থাকা একটুকরো অভ্র কি?!
অভ্র শুনো, আমিতে ভেসে থাকা অভ্র’র মন শুভ্র কি?
অস্থিরতায় কাটছে সময় তুমিহীন, আসোনি অভ্র
তোমার শুভ্র ডানায় নিয়ে আজও ভাসোনি আমায়!!
শেষ ট্রামে চলে গেলে অভ্র, হয়ে শেষ বর্ষাধারা
তোমার জন্য অস্থির মন হলো যে পাগলপাড়া!
নিপুণ ছোঁয়ায় তুমি ভেঙ্গে দিলে মনের দেয়াল
অভ্র তুমি তীরে বসে দূরে!
তোমাকে ভেবে ভরছি খাতা সব অজ্ঞান লেখায়
অস্থির সময় যেনো শুধু কষ্ট পেতেই শেখায়!!
অভ্র তোমার ডানায় ভর দিয়ে উড়তে ইচ্ছে নিবে! অভ্র তোমার শুভ্র ছোঁয়ায় হারাতে মন অস্থির দিবে??
গলে পড়ো অবিরাম চোখের পাতা ছুঁয়ে বুকেতে
আলিঙ্গনে আত্মহারা হতে চাই আবার সুখেতে।
অভ্র বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে দাও সর্বাঙ্গে শীতল ছোঁয়া
তোমার তরেতে গেলে যাকনা আজ এ মন খোয়া! ❞
বলতে বলতে চোখের কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরল, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গালে ল্যাপ্টে থাকা জলটা মুছে নেওয়ার সাথে সাথেই বর্ষা তলপেটে ধরে চিৎকার করতে লাগলো। বর্ষার চিৎকার রান্নাঘরে কাজ করতে থাকা মুন্নি শুনতে পেয়ে বারান্দার দিকে ছুটে আসতে লাগলো। ফ্লোরে বসে তলপেট ধরে কেঁদে উঠছে বর্ষা মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে নানান আকুতি মিনতি করছে সে। মুন্নি এসে বর্ষাকে ধরে রুমে নিয়ে গেলো বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসায়ে বলল, ‘ একটু কষ্ট হবে বোন দাঁতে কামড় দিয়ে সহ্য কর প্লিজ। আমি চুলায় পানি গরম বসিয়ে দিয়ে আসছি। ’
বলে মুন্নি তারাহুরো করে রান্না ঘরের দিকে রওনা দিলো। এদিকে মরন যন্ত্রণার সাথে বকিফ হচ্ছে বর্ষা। তার আত্মচিৎকারের গতি বেড়েই চলেছে। এই বুঝি এখনই আত্মা টা বেরিয়ে যাবে।
মুন্নি বড় গামলায় করে গরম পানি এনে ফ্লোরের উপরে রাখলো। বর্ষা মুন্নির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘ তাপ্পি, একটা মেয়ের সন্তান প্রসবের আগে এততত কষ্ট ও ব্যথা কেন হয়? ’
মুন্নি বর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ মা ডাক শোনা কি চারটি খানের কথা। মা কি মেয়েরা এমনি এমনি হয়রে পাগলী। ‘মা’ শব্দটি শুধু একটি অক্ষর,ধ্বনি, বা বাক্য নয়রে এই শব্দটি এটার মধ্যেই এক উপন্যাস। কখনো কখনো পুরো পৃথিবীটাই যেন হয়ে ওঠে ‘মা’। যিনি সর্বংসহা তিনিই মা। ত্যাগের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে যার বসবাস তিনি হচ্ছেন মা। একজন মানুষ ৪৫ ইউনিট ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। এর বেশি সহ্য করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একজন মা! প্রসবকালে ৫৭ ইউনিটের বেশি ব্যথা সহ্য করেন। বিজ্ঞান বলছে, এই ব্যথার যন্ত্রণা ১০টি হাড় একসঙ্গে ভেঙে যাওয়ার চেয়েও বেশি। পৃথিবীতে এই কষ্ট বা ব্যথা শুধু মা-ই সহ্য করতে পারেন, অন্য কেউ নন। মাতৃত্বই সব মায়া-মমতার শুরু এবং শেষ।
গর্ভে ধারণ করা মাত্রই মায়ের জীবন মৃত্যুর ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। দিন যত বাড়তে থাকে ঝুঁকিও তত বাড়ে। একজন মানুষের ভেতরে আরেকজন মানুষ ভাবা যায় আল্লাহর কত বড় নিয়ামত।
আমি এই নয় মাসে তোকে A to Z সব বলেছি ও বুঝিয়েছি তুই প্লিজ একটু সহ্য কর আল্লাহর উপর আস্থা রাখ তাছাড়া আমি তো আছি। আল্লাহ কবুল করলে আমিই তোর ডেলিভারি করবো ইন শা আল্লাহ।
__________________
সাত বছর পর-
দরজার সামনে গালে হাত দিয়ে বসে আছে বর্ষা। মুন্নি সকালে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়েছে যাওয়ার আগে বলে গেছে তারাতাড়ি ফিরবে।
দীর্ঘক্ষণ বাহিরে বসে অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে রুমের ভেতরে চলে যায়। রুমের মধ্যে একা একা কিয়ৎক্ষণ পায়চারি করে তারপর রান্না ঘরে চলে আসে। টুকটাক কাজ করতে কারতে বলতে লাগল, ‘ কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্ণব স্কুল থেকে চলে আসবে। আর এসেই বলবে আম্মু আমার খিদে পেয়েছে। অর্ণব যতক্ষণে না আসছে ততক্ষণে নাহয় আমি ওর জন্য পেন কেক বানাই। ও আসলে দেখে খুশি হয়ে যাবে। ’
ত্রিশ মিনিট পর, কেক বানিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখতে রাখতেই, কেউ একজন তার মিষ্টি মধুর কন্ঠে ডাকতে ডাকতে আসছে, ‘ আম্মু? আম্মু? আমি স্কুল থেকে এসে গেছি। ’
বর্ষা ডাইনিং টেবিলের কাছ থেকে সরে অর্ণবের কাছে ছুটে গেলো। হাঁটু ভাজ করে অর্ণবের সামনে বসে দুইহাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। কপালে এক চুমু একে দিয়ে বলল, ‘কেমন কাটালে স্কুলে আজকের দিন? ‘
অর্ণব ছোট্ট করে বলল, ‘ভালো! আজকে স্কুলে আমি অনেক কিছু শিখেছি। ’
‘ বর্ষা অর্ণবের গালে হাত রেখে বলল, তাই! অর্ণ আমি তোমার জন্য তোমার পছন্দের কেক বানিয়েছি খাবে? ’
অর্ণব মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে বলল, ‘ খাবো তো আম্মু! ‘
স্কুলের পোশাক পড়েই অর্ণব ছুটে গেলো টেবিলের কাছে একহাত বাড়িয়ে কেক নিতে নিলেই বর্ষা অর্ণবর হাতে চাপড় দিয়ে বলল, ‘ আগে যাও হাত ধুঁয়ে আসো। ‘
হাত ধুঁয়ে আসার পর অর্ণবকে কোলে বসিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগে বর্ষা। অর্ণব বর্ষার হাত ধরে মলিনকন্ঠে বলে, ‘ আম্মু একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ‘
বর্ষা অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ হুম করো। ‘
‘ অর্ণব বলল, আমার বাবা কোথায় আম্মু? আমার স্কুলের সবার বাবা আছে শুধু আমারই বাবা নেই। তাদের বাবা’রা তাদের রোজ স্কুল থেকে নিতে আসে আরও অনেক খেলনা কিনে দেয়। তাদের বাবা’রা তাদের অনেক ভালোবাসে। ‘
‘ আমিও তো তোমাকে খেলনা কিনে দেই বাবা। তোমাকে আমিও তো অনেক ভালোবাসি। ‘ অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল বর্ষা।
‘ কিন্তু তুমি তো আমার বাবা নও আম্মু! আমার বাবা কোথায়? ‘
‘ তোমার বাবা নেই অর্ণব! তোমাকে আমি জন্ম দিয়েছি তাই আমিই তোমার সব। ’
অর্ণব অভিমানে মাথা নিচু করে ফেললো। তখনই ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসলো মুন্নি। তাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল বৈকি বর্ষা শানিতকন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘ কি হয়েছে তাপ্পি? এত চিন্তিত কেনো দেখাচ্ছে তোমাকে সব কিছু ঠিক আছে তো? ’
মুন্নি বর্ষার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকন্ঠে বলল, ‘ তোকে এবার আমার সাথে গাজীপুর যেতেই হবে বর্ষা। বড়’মা মৃত্যু সজ্জায় আর তিনি শুধু একবারের জন্য তোকে দেখতে চাচ্ছে। ‘
বর্ষা আচমকা দাঁড়িয়ে পরল আর বলে উঠল, ‘ আমি যাবো। ‘
মুন্নি অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ অর্ণবকে দেখে বাড়ির সবাই ওর সম্পর্কে জানতে চাইবে তখন কি বলবি। আট বছর ধরে কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ করিসনি আর না তাদেরকে ওর কথা বলেছিস। শুধু ফোনে ফোনে যোগাযোগ রেখেছিস। অর্ণবকে দেখলে তো তারা প্রশ্ন করবেই। তখন তুই কি জবাব দিবি বর্ষা? ‘
বর্ষা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে অর্ণবকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,‘ আমি অর্ণবকে নিঝুমের বাড়িতে রেখে যাবো। নিঝুমের উপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে ও খেয়াল রাখবে আমার ছেলের। তুমি শুধু যত দ্রুত যাওয়ার ব্যবস্থা করো। ’
‘ তুই কি সারাজীবন অর্ণবকে সকলের থেকে আড়ালে রাখবি? কাউকেই বলবি না ওর কথা আর ওর ও তো অধিকার আছে পরিবারের সবার সাথে দেখা করার। ‘ বলল মুন্নি।
‘ আপাতত নয়, সময় হলে দেখা করিয়ে দেবো। এখনও সময় আসেনি। ‘
বলে বর্ষা চলে যেতে যাবে তখন মুন্নি আবারও বলল, ‘আরও একটা কথা বলার বাকি রয়ে গেছে?’
বর্ষা মুন্নির দিকে তাকিয়ে নির্মূলকন্ঠে বলল, ‘ হুম বলো! ‘
মুন্নি কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বলল, “ অভ্র তোর সাথে দেখা করতে চায়! কাব্যর সাথে কথা হয়েছে ওই বলেছে! ”
অভ্রর কথা শুনে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে বর্ষার। কোনো প্রত্যত্তর না করে এলোপাথাড়ি পা ফেলে রুমের দিকে চলে যায়। চক্ষু জোড়া জলে ছলছল করছে। এই বুঝি অশ্রু কণা গড়িয়ে পরবে।
চলবে?
#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_৬২ (অন্তিম_পর্ব)
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________________
“অভ্র তোর সাথে দেখা করতে চায়!” বাক্যটি বারবার কানের কাছে বেজে উঠছে বর্ষার। কপালে হাত রেখে গাড়ির জানালার সাথে হেলান দিয়ে মুন্নির বলা কথাটি বারবার ভাবছে সে মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগল, আমাকে ছেড়ে চলেই তো গিয়েছো অন্য কারো কাছে তাহলে আজ কেনো আবার আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছো অভ্র?’
তখনই অর্ণব বর্ষার একহাত ধরে বলল, আম্মু পানি খাবো!
অর্ণবের ডাকে হুঁশশ ফিরে আসে বর্ষার। অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘এখনই দিচ্ছি বাবা!’
-রাতেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখেছিল, সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনো রকম নাস্তা করে গাজীপুরের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরে। আট বছর ধরে এখানে বসবাস করছে ওরা তাই এখানকার অনেক গাড়ি চালক মুন্নির পরিচিত। রাতেই কল দিয়ে একজনকে বলে রেখেছিল তারা গাজীপুর যাবে এবং তাকেই নিয়ে যেতে হবে। সকালেই গাড়িচালক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার জায়গায় তার ছেলেকে পাঠায়। গাড়ি চালকের ছেলে মাস্টার্স পাস শুনে বেশ অবাক হয় বর্ষা। তবে ছেলেটা নিজেকে নিয়ে দ্বিধা বোধ করে না। তার বাবা যে একজন ড্রাইভার সে এটা গর্ব করে সবাইকে বলে কারণ, তার বাবা এই গাড়ি চালিয়েই তাকে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন। সবার সামনে নিজের পরিচয় দেয় সে তার বাবার সন্তান। মুন্নি মুগ্ধ হয় ছেলেটার সততা দেখে মুন্নি নিমজ্জিত হয়ে বলল,‘ আপনি আপনার বাবার ছেলে বুঝলাম। তো এই বাবার ছেলের নামটা কি জানতে পারি? ’
গাড়ি চালাতে চালাতে ছেলেটা ছোট্ট করে বলল, ‘ আমার নাম সোহরাব! ‘
বর্ষা অর্ণবকে বোতল দিয়ে পানি খাওয়াচ্ছে। মুন্নির সোহরাবের প্রতি ইন্টারেস্ট দেখে আঁড়চোখে মুন্নির দিকে তাকালো, ধাতস্থ কন্ঠে বিড়বিড় করে বলল, ‘ পছন্দ হয়েছে নাকি বাড়িতে বলবো? এক্কেবারে বিয়ে দিয়ে দিবে। ’
‘তাজ্জব, আমি জাস্ট নাম জিজ্ঞেস করেছি এখানে বিয়ে কোথা থেকে আসলো? তোর সামনে দেখা যাচ্ছে কারো সাথে কথা বলাও মুশকিল!’
বলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো মুন্নি। বর্ষা মুন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে দুইপাশে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ তোমার কিচ্ছু হবে না। যেমন ছিলে তেমন টাই রয়ে গেছো। ‘
.
.
.
চার ঘন্টা পর-
সোহরাবকে উদ্দেশ্য করে বর্ষা বলল, ‘ ভাইয়া গাড়িটা সামনের মোড়ে একটু দাঁড় করাবেন প্লিজ। ‘
সোহরাব কোনো প্রত্যত্তর না করে গলির মোড়ে গাড়ি ব্রেক করল। মুন্নিকে গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলে বর্ষা অর্ণবকে সঙ্গে করে নিয়ে গাড়ি থেকে নামে। দুইতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বাড়িটায় চোখ বুলিয়ে গেইট খুলে ভেতরে গেলো। দারওয়ান চাচা এ বাড়িতে এক যুগ ধরে দারওয়ানের চাকরি করছেন। কলেজে পড়া কালিন নিঝুমের সাথে বহুবার এ বাড়িতে যাতায়াত ছিল বর্ষার। দারওয়ান চাচাকে দেখে বর্ষা তার পাশে গিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন। প্রথমত তিনি বর্ষাকে চিনতে পারেনি পরে যখন বর্ষা তার পরিচয় দিলো তখন তিনি চিনতে পারেন ও বর্ষার সাথে টুকটাক কথা বলতে লাগেন। বর্ষা দারওয়ান চাচার উদ্দেশ্য বলল, ‘ চাচা নিঝুম বাড়িতে আছে? ’
দারওয়ান চাচা বলল, ‘ হো মা! নিঝুম মা’য় তো কালকেই শশুর বাড়ি থেকা আইছে। তুমি ভালা দিনেই আইছো। যাও উপরে যাও গেলেই তুমি দেখতে পারবা। ’
‘ আচ্ছা! ‘ বলে বর্ষা ভেতরের দিকে হাঁটা দিলো। কলিংবেল চাপতে দরজা খুলে দিলো নিঝুম হাতে তার একটা বাটি। এত বছর পর বর্ষাকে দেখে ইমোশনাল হয়ে পরে নিঝুম হাত থেকে বাটিটা ফ্লোরে পরে টুংটাং শব্দ তুলে। চোখ জোড়া ছলছল করছে। শুকনো ঢোক গিলে অস্ফুটস্বরে নিঝুম বলল, ‘বর্ বর্ষা?’
বলেই বর্ষাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো নিঝুম। এত বছর পর দেখা হলো তাই দু’জনের মধ্যে কেউই নিজেকে সামলাতে পারছে না! নিঝুম বর্ষাকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল, ‘ কতটা পালটে গেছিস তুই জান সেই আগের বর্ষা তো তুই তো নেই।’
বলতে বলতে নিঝুমের চোখ পরল বর্ষার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট রাজকুমারের উপর। অর্ণবকে দেখে মুগ্ধ হয় নিঝুম কোনো অংশে কম নয় সে। তাকে দেখেই যে কেউ বলে দিবে বাপের ছেলে। নিঝুম গভীর দৃষ্টিতে তাকালো অর্ণবের দিকে। কিয়ৎক্ষণ পর অর্ণবের গালে হাত দিয়ে গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বর্ষার উদ্দেশ্য শালিনকন্ঠে বলল, ‘ও কে বর্ষা? ওকে দেখতে একদম তোর অভ্র ভাইয়ার মতো। দেখে মনে হচ্ছে অভ্র ভাইয়ার কার্বনকপি। ’
বর্ষা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল, ‘ ওর নাম অর্ণব! আমার আর অভ্রর ছেলে। ‘
নিঝুমের চক্ষু জোড়া চড়কগাছ। হা করে বর্ষার দিকে তাকিয়ে রইল। বর্ষা নিঝুমের হাত দু’টি ধরে বলল, ‘ ওর সম্পর্কে মুন্নি আপু ছাড়া আর কেউ জানে না এখন তুই জানলি। আমাকে বাড়ি যেতে হবে বড়মার অবস্থা খুব খারাপ। আর ওকে আমি আমার সাথে নিতে পারবো না। তুই প্লিজ ওকে তোর কাছে একদিনের জন্য রাখবি? আমি রাতেই চলে আসবো প্লিজ না করিসনা আমার তুই ছাড়া আর কেউ নেই। ’
তখনি সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে নেমে আসলো পিয়ম। বর্ষাকে দেখে নিঝুমের শাড়ির আঁচলের পেছনে লুকিয়ে পরল পিয়ম। বর্ষা মৃদুস্বরে বলল, ‘ তোর মেয়ে? ‘
নিঝুম উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ হ্যাঁ! ‘
নিঝুম পিয়মের হাত ধরে বর্ষার সামনে দাঁড় করালো বর্ষা কিছুটা ঝুঁকে পিয়মের গালে হাত রাখলো তারপর বলল,‘ ভয় কেনো পাচ্ছো মামনি? আমি তোমার এক খালামনি! ‘ বলেই পিয়মের গুলুমুলু গালে চুমু দেয়। নিঝুমের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাইয়া কি করে? কোথায় সে? ’
নিঝুম বলল, ‘ ডুবাই এক প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে তিন বছর আগে এসেছিল। তিন চার মাস পর আসবে তখন আমাদের দু’জনকে সাথে নিয়ে যাবে। ’
‘ও তখন তো তাহলে আর চাইলেও দেখা হবে না!’ বলল বর্ষা।
‘ এত বছরেও তো হয়নি! ‘ অভিমানী স্বরে বলল নিঝুম।
বর্ষা নিঝুমের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ সরি আর হবে না! আচ্ছা আমি এখন যাই তুই ওর খেয়াল রাখিস। ‘
বলে বর্ষা অর্ণবের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে কপালে এসে পরা থাকা চুলগুলো আঙুল দ্বারা পেছনে ঢেলে দিয়ে বলল, ‘ বাবাই লক্ষী ছেলের মতো খালামনির কাছে থাকবে একটুও দুষ্টামি করবে না ওকে। আম্মু রাতেই চলে আসবো। ’
বলে বর্ষা উঠে যেতে নিলে অর্ণব বর্ষার হাত ধরে নেয় কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘ আম্মু আমিও তোমার সাথে যাবো। ‘
‘ বাবাই তুমি এখানে থাকো আমি তোমাকে আমার সাথে নিতে পারবো না। প্লিজ বুঝো আম্মু রাতেই চলে আসবো। ‘
বলে অর্ণবের হাত ছাড়িয়ে বর্ষা দরজার সামনে থেকেই চলে গেলো। এদিকে অর্ণব আম্মু আম্মু বলে কেঁদে উঠলো। নিঝুম অর্ণবকে কোলে নিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে উপরে চলে যায়।
বাহিরে এসে গাড়িতে উঠে বসতেই সোহরাব গাড়ি স্টার্ট দেয়।
.
.
.
নিঝুমের বাড়ি থেকে বর্ষাদের বাড়ি যেতে বিশ মিনিট সময় লাগে,
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামে বর্ষা ও মুন্নি। বাড়ির দিকে তাকিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে মুন্নির দিকে তাকায় বর্ষা। মুন্নি বর্ষার কাঁধের উপর হাত রেখে দুইবার চোখের পলক ফেলে। তারপর দু’জনে বাড়ির ভেতরে ঢুকে। বাড়ির সামনে থেকে আদিল বর্ষা ও মুন্নিকে দেখে চেঁচামেচি করতে লাগে, ‘ আম্মু, আব্বু, চাচি-আম্মু দেখো বর্ষা আপু আসছে। ’
আদিলের চেঁচামেচি শুনে বাড়ির সকলে একে একে বেরিয়ে আসতে লাগে। যে ছোট্ট আদিল এক সময় বর্ষার পেছনে লেগে থাকতো সে এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। বোন দূরে চলে যাওয়ায় বোনের গুরুত্ব সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে এক দৌঁড়ে বর্ষার সামনে চলে যায়। দুহাতে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কান্না জুড়ে দেয়। বর্ষা ও আদিলকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ পাগলের মতো কাঁদছিস কেন? ‘
আদিল কান্না ভেজা কন্ঠে বলল, ‘ তুই অনেক সার্থপর রে আপু! তোর কি একবারও আমাদের কথা মনে পরেনি? তুই জানিস তোকে আমরা কত মিস করছি। তুই কেমনে পারছিস আমাদের সাথে এমনটা করতে তোর কি একবারও আমাদের কথা মনে পরেনি? ‘
বর্ষা আদিলের উদ্দেশ্য কিছু বলতে যাবে তার আগেই কান্না করতে করতে ছুটে এসে বর্ষার গলা জড়িয়ে ধরে বর্ষার মা। হতবিহ্বল হয়ে যায় বর্ষা। সকলে সরু চোখে বর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের ফেকাসে চেহারাই বলে দিচ্ছে তাদের মনে আকাশ সমান অভিমান জমেছে। বর্ষার বাবা দূর থেকে বলল, ‘ মেয়েটা সবে মাত্র এসেছে ওকে বাড়ির ভেতরে আসতে দাও। কড়া রোদের মধ্যে উঠানে দাঁড় করিয়ে রাখছো কেন? ’
বর্ষা তার বাবার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকন্ঠে বলল, ‘ বাবা! ’
অভিমানী স্বরে সাগর খান প্রত্যত্তর করলেন, ‘ আমি কারো বাবা নই। আমার কোনো মেয়ে নেই। আমার যদি সত্যিই কোনো মেয়ে থাকতো তাহলে সে কোনো ভাবেই পারতো না আমাদের সাথে আট বছরের দূরত্ব তৈরি করতে। ’
বর্ষা তার বাবার কাছে গিয়ে পাশে দাঁড়ালো সাগর খানের দুইহাত ধরে বলল, ‘ আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা। ’
অন্য দিকে তিন্নি সকলের আড়ালে গিয়ে অভ্রর নাম্বারে ডায়াল করল। দুইবার রিং হতে কল রিসিভ করে অভ্র। এপাশ থেকে তিন্নি বলল, ‘ তুই কোথায় ভাইয়া? ‘
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে অভ্র জানালো, ‘ একটা কাজে আসছি। কেনো কিছু বলবি? ‘
তিন্নি ধীর কন্ঠে বলল, ‘ বর্ষা বাড়িতে আসছে। ‘
বর্ষার কথা শুনে ‘থ’ রয়ে যায় অভ্র। গাড়িতে অভ্র বাদে আরও চারজন ছিলো ড্রাইভ করছিলো মুরাদ অভ্র মুরাদের উদ্দেশ্য বলল, ‘ মুরাদ গাড়ি ঘুরাও আমরা নূর মঞ্জিলে যাবো।’
যেখানে যাওয়ার জন্য চারজনে বের হয়েছিল সেখানের উদ্দেশ্য বাকি দু’জনকে পাঠিয়ে নিজেরা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
তিন্নি বলল, ‘ তোর না আজ খুব ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে তাহলে কিভাবে আসবি? ‘
অভ্র গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যত্তর করল, ‘ এত বছর পর আমার রাগরাগিণী ফিরে আসছে। তার জন্য তো আমাকে আসতেই হবে। তার সামনে যে আমার ইম্পর্ট্যান্ট থেকে ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ও ফেঁকাসে। আমার কাছে যে তার থেকে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট আর কিছু নেই। তুই চিন্তা করিসনা আমি সন্ধ্যার আগে পৌঁছে যাবো। আর আমি যে আসছি সেটা কাউকে এখনই বলিস না। ‘ বলে কল কেটে দেয় অভ্র।
এদিকে সকলের মান অভিমান ভাঙাতে বেগ পেতে হয় বর্ষার। বোধগম্য হয়নি তার সকলে যে এত মান ও অভিমান করে আছে তার উপর। আর করবেই না কেনো? বাড়ির মেয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে বাড়ির বাহিরে থাকলে সকলেরই অভিমান হবে। তাছাড়া রাগ ও অভিমান সকলের উপরে করা যায় নাকি? যে অতন্ত্য আপন হয় তার উপরেই করা যায়। এত বছরে পুষে রাখা রাগ-অভিমান এত তারাতাড়ি মিটবে নাকি? উঁহু একদমই নয়, বর্ষা কোনো উপায় না পেয়ে সকলের সামনে কানে হাত দিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে পরে। সকলে হতভম্ব হয়ে যায় বর্ষার এমনকান্ডে। মাথা নিচু করে সকলের কাছে আবারও ক্ষমা চায়। এত বছর পর মেয়েকে দেখে যতটা না অভিমান বৃদ্ধি পেয়েছে তার থেকে বেশি ইমোশনাল হয়ে পরেছে।
বর্ষা একটা বারের জন্যও কেনো ফিরে আসেনি কেনো কারো সাথে সাক্ষাৎ করেনি৷ এত কিসের অভিমান তার? এটাই হচ্ছে সকলের প্রশ্ন। বর্ষার বাবা ও মা এগিয়ে আসলো বর্ষাকে দুইহাতে দু’জনে জড়িয়ে ধরলো। বাড়ির সকলেরই চোখের জল গড়িয়ে গালে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বর্ষা উঠে দাঁড়ালো ও দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ভাই-বোন, সকলের কাছে একে একে গিয়ে ক্ষমা চাইলো৷
সকলে বর্ষাকে দুইহাতে জড়িয়ে নিয়ে কপালে আলতো চুমু একে দেয়।
____________
মান অভিমানের পালা শেষ হলে বর্ষা ফজিলা খাতুনের রুমের দিকে পা বাড়ায়। অসুস্থ বেশি হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুটা পরিবর্তন দেখলে রোগী নিজেই বলেন, আমারে বাড়িতে নিয়া চল। এনো আমার ধম বন্ধ হইয়া আহে। ‘
রোগীর কথা ডাক্তার নিজেও শোনেন। এবং বাড়ির মুরব্বিদের সামনে গিয়ে বলে, আলহামদুলিল্লাহ পেসেন্ট আগের থেকে ভালো। উনি হাসপাতালে থাকতে চাচ্ছেন না, আপনারা বরং উনাকে বাড়ি নিয়ে যান। বাড়িতে গেলে হয়তো তিনি স্বস্তি পাবেন। ‘
মনোয়ারা বেগম সেদিনই তার মা’কে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। ও তার দেখাশোনায় জেনো কোনো কমতি না হয় তাই ২৪ঘন্টার জন্য দু’জন নার্স নিয়জিত করেছেন। যারা ২৪ঘন্টা তার সাথেই থাকেন। ফজিলা খাতুন যখন কিছুটা কথা বলতে পারলেন তখন তিনি সবার কাছে তার শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করলো আর সেটা হচ্ছে বর্ষাকে একবার দেখা।
রুমের মধ্যে খাটের দুইপাশে দু’জন নার্স দাঁড়িয়ে আছে৷ বর্ষা ছুটে তার বড়মার কাছে গেলো। বিছানায় ফজিলা খাতুনের হাতের কাছে বসে, তার একহাত ধরে নিজের হাতের উপর রেখে আসতে করে বলল, ‘ বড়মা? ‘
বর্ষার ডাক শুনে পিটপিট করে আসতে আসতে চোখ জোড়া মেলে তাকালেন ফজিলা খাতুন। বয়স্ক হয়েছেন শরীরে হাড় ছাড়া মাংস একদমই নেই। খাটের সাথে জেনো মিশে শুয়ে আছে। চোখ মেলে তাকিয়ে বর্ষাকে দেখেই চোখ জোড়া দিয়ে পানি ছেড়ে দিলেন ফজিলা। তা দেখে বর্ষা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল৷ ফজিলা খাতুনের হাত কপালের উপর ঠেকিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। বর্ষার দাদি রুমের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে কাঁদছে। তার মায়ের এমন অবস্থা দেখে তার যে বুক ফেঁটে যাচ্ছে। একমাত্র আল্লাহ জানেন এখন মনোয়ারা বেগমের মধ্যে কি চলছে?
ফজিলা খাতুন তেমন কথা বলতে পারেন না তার মুখে একটা দাঁত ও নেই। নাকে বাজিয়ে বাজিয়ে কোনো রকম বলল, ‘ আমার লক্ষী জী তুই আইছোস? ’
বর্ষা কান্নার জন্য কথা অব্ধি বলতে পারছে না। উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ হো বড় মা আমি আইছি দেহো তুমি আমারে। ‘
বর্ষার কান্না দেখে বাকিরা নিজেদের সামলে রাখতে পারছে না তারাও কান্না জুড়ে দেয়। একজন নার্স রাগী গলায় বলে উঠল, ‘ আপনারা রোগীর রুমে এসে এভাবে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? সকলে বের হন রোগীর অস্বস্তি হচ্ছে। আর তার সামনে এভাবে কাঁদছেনই বা কেনো? আপনারা জানেন আপনাদের এভাবে কান্নার জন্য রোগী তার মনোবল হারিয়ে ফেলবে। প্লিজ দয়া করে সকলে বাহিরে চলে যান। ‘
নার্সের ধমকা ধমকিতে সকলে রুম থেকে বের হয়। ফজিলা বর্ষার হাত শক্ত করে ধরে রাখায় সে যেতে পারে না। বর্ষা অস্ফুটস্বরে বলে উঠল, ‘ বড়মা তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে না? আমাকে মাফ করে দাও বড়মা আমি তোমার কাছে আগে আসতে পারি নাই। ’ কান্না করতে করতে বলল।
ফজিলা বর্ষার একহাত ধরে তার পেটের ডানপাশে রাখলো করুণকন্ঠে আমতাআমতা করে বলল, ‘ এই জায়গায় পুইড়া যাইতাছে জী পুইড়া যাইতাছে। মনে হইতাছে কেউ আগুনের কয়লা রাইখা দিছে। আমি মনে হয় আর বাঁচতাম না জী! ’
ফজিলা খাতুনের মুখে এমন কথা শুনে বর্ষা আরও জোরেজোরে কান্না করতে লাগে। এদিকে ফজিলা ও কাঁদছেন এতে করে উনার শরীর খারাপ হতে পারে ভেবে দ্বিতীয় নার্স বর্ষার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো আর কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘ ম্যাডাম এভাবে কাঁদবেন না। একবার আপনার বড়মার অবস্থা দেখুন ওভাবে উনি কাঁদতে থাকলে এতদিনে যতটা সুস্থ হয়েছিল আল্লাহ না করুক আবার অসুস্থ হয়ে পরে। আপনি প্লিজ নিজেকে সামলান ও আপনার বড়মা কে সান্ত্বনা দিন। ‘
বর্ষা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গালের উপরের জল মুছে বলল, ‘ তুমি চিন্তা করো না বড়মা। আল্লাহ তো আছেন আমরা সকলে তোমার জন্য দোয়া করছি। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাকে সুস্থ করে দিবেন। আল্লাহর বান্দা দুই হাত তুলে কিছু চাইলে তিনি কখনো ফিরিয়ে দেননা যদি তার বান্দার ক্ষেত্রে সেটা কল্যাণকর হয়। আমাদের সৃষ্টি কর্তা যে পরমকরুণাময় তিনি নিশ্চয়ই তোমাকে সুস্থ করে দিবেন। তুমি বিছানা থেকে আবারও উঠতে পারবে আবারও চলতে পারবে দেখো মিলিয়ে নিও আমার কথা। ‘
বলে বর্ষা ফজিলা খাতুনের কপালে এক চুম্বন একে দিলো। ফজিলা খাতুন বর্ষার কথায় আস্থা পেলেন আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হলো তিনি বললেন, ‘আমিন’
বর্ষা ফজিলা খাতুনের থেকে বিদায় নিয়ে রুম থেকে বাহিরে চলে যায়।
বাড়ির সকলে ভাবে বর্ষা তাদের কাছে একেবারে চলে আসছে। কিন্তু তাদের ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে বর্ষা বলল, ‘ আমি কিছুক্ষণ পরই চলে যাবো৷ আমি শুধু বড়মার সাথে দেখা করতে আসছি৷ এখানে থাকতে আসিনি আমাকে ফিরতে হবে আর সেটাও সন্ধ্যার আগে। ‘
বর্ষা চলে যাবে শুনে সকলে মুন্নির দিকে তাকালো ও তাকে নানান ভাবে জেরা করতে লাগলো। মুন্নি তাদের উদ্দেশ্য সন্তুষ্ট জনক কিছুই বলতে পারলো না। দুই তিন ঘন্টা পাড় হয়েছে ওরা বাড়িতে এসেছে। বাড়ির ভেতর ঢোকার পর সময়ের অনুমানই করতেই পারেনি মুন্নির মাথা থেকে সোহরাব এর কথা পুরো পুরি বেরিয়ে গেছিল সকলের উদ্দেশ্য বলল, ‘ আমাদের যে নিয়ে আসছে সোহরাব ওকে বাড়ির ভেতরে আসতে বলতে ভুলে গেছি। না জানি কতক্ষণ ধরে বাহিরে বসে আছে আমি ওকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসি তোমরা বসো আমি আসছি। ‘
বলে মুন্নি কোনো রকম তাদের সামনে থেকে চলে যায়। অর্ণব বর্ষার ছেলে বর্ষাই চায় না তার সম্পর্কে কাউকে বলতে সেখানে তার কিছুই করার নেই। মিথ্যে বলার থেকে কোনো কিছু না বলে সরে যাওয়াই উত্তম। বর্ষা আবারও চলে যাবে শুনে সকলের মন বেশ খারাপ হয়। বর্ষার বাবা বলেন, ‘যাবিই যখন কিছুদিন অন্তত থেকে যা।’
কিন্তু বর্ষা তাতে রাজি হয় না বর্ষা সকলের উদ্দেশ্য বলে, ‘ আমি কথা দিচ্ছি এর পর থেকে আমি মাঝেমধ্যে এসে তোমাদের সাথে দেখা করে যাবো। কিন্তু আমাকে আঁটকিয়ো না তোমরা আমার যেতেই হবে। ‘
তিন্নি ঢের বুঝতে পারছে বর্ষা অভ্রর আসার আগেই চলে যাবে কিন্তু অভ্রর না আসা অব্ধি যে বর্ষাকে আঁটকে রাখতেই হবে। ওতোপ্রোতো আর না ভেবে তিন্নি বলে উঠল, ‘ বর্ষা যাবিই যখন সন্ধ্যার পরে যা। তুই এসেছিস শুনে অভ্র আসছে তোর সাথে দেখা করতে। চলেই তো যাবি যাওয়ার আগে শেষবারের জন্য ওর সাথে দেখা করে যা। ’ বলল তিন্নি।
প্রথমত অভ্রর সামনে যেতে রাজি হচ্ছিল না বর্ষা। কেননা তার মনে ভয় সঞ্চয় হচ্ছিল, ‘অভ্র সামনে আসলে সে নিজেকে সামলাতে পারবে তো? যদি অভ্রর সামনে সে কোনোভাবে দূর্বল হয়ে যায়? না না, এটা কোনো ভাবেই হতে দেবে না বর্ষা, অভ্র সে তো হিয়ার। তার উপরে ওর যে কোনো অধিকার অবশিষ্ট নেই। ’ মনে মনে ভাবতে লাগে বর্ষা।
বর্ষার বাড়ি ছাড়ার পেছনে বাড়ির অনেকে অভ্রকে দ্বায়ী করে। অভ্র আসবে শুনে তারা উঠে তাদের রুমে চলে যায়। আর যারা অভ্রকে সাপোর্ট করে তারা বসে বর্ষাকে রাজি করাতে লাগে সে জেনো অভ্রর সাথে দেখা করে।
বহুবছর পর, সেই অনুভূতিটা আবারও হচ্ছে, যেটা প্রথম অনুভব করে ছিল বর্ষা অভ্রর প্রতি, ওই আগন্তুক চিঠিবাজের চিঠি পড়ে, তখন সে জানতো না আগন্তুক চিঠিবাজ অভ্র। কিন্তু অনুভূতি হয়েছিল সত্য এখন আবারও সে অনুভূতি টা হচ্ছে। বর্ষা তার হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। খুব জোরে জোরে বিট করছে। দুইহাত কচলাতে লাগল বর্ষা এক ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ হুম আমি অপেক্ষা করবো তার আসার। কিন্তু আবার এমনটা জেনো না হয়, আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত পাড় করে দিলাম আর সে আসলোই না। ‘
বলে বর্ষা সকলের সামনে থেকে চলে গেলো।
চলবে