অবন্তর_আসক্তি #পর্ব_২২,২৩

0
928

#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_২২,২৩
#শারমিন_আক্তার_পর্ব
২২

‘ তুই কি ভাবছিস? ‘ পাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলল নিভ।

নিভের কথায় ঘোর কাটলো বর্ষার, দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে বিমূঢ় কন্ঠে বলল, ‘ কিছু না। ‘

বর্ষার কথার পিঠে মলিন হাসলো নিভ কথার প্রশংস পাল্টিয়ে বলল,’ তুই এমন ছিলি না। আজ থেকে চার মাস আগের বর্ষার সাথে তোর এখন কোনো মিল নেই। কিছুটা পাল্টেছে তবে সেটা তুই বুঝতে পারছিস না। ‘

বর্ষা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ‘ মানে? ‘

‘ মানে হচ্ছে তুই খুব তারাতাড়ি বুঝতে পারবি। ‘

‘ হেঁয়ালি না করে সোজাসাপ্টা বল কি বলতে চাচ্ছিস? ‘

‘ তুই খুব সহজ সরল বর্ষা দেখিস তুই খুব শীগ্রই কারো প্রেমে পরবি। ‘

‘ আজাইরা কথাবার্তা কম বলবি যত্তসব। ‘ বলেই পানিতে ইটের কোণা ঢিল ছুঁড়ে মারল।

*

এত মাস পর তাদের প্রিয় বন্ধু নিভ এসেছে তাদের সঙ্গে দেখা করতে৷ সে খুশিতে বাকিরা প্লান করে কলেজ ছুটির পর আজ সকলে বাহিরে ঘুরবে প্রথমে সকলে তাদের সব থেকে প্রিয় জায়গা নীল লেকে যাবে। সেখানে কতক্ষণ বসে আড্ডা দিবে লেকের স্বচ্ছ নিলাভ পানিতে পা ঝুলিয়ে তিড়ে বসে থাকবে। এদিকে সকলে এতক্ষণ তাই করছিল কিন্তু কয়েক মিনিট হলো ওরা সকলে উঠে গেছে। রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক ফুচকা ওয়ালা তা দেখেই বাকিরা ছুটে চলে যায় ফুচকা খেতে। এসেছে পর থেকেই বর্ষাকে বিষন্নতায় দেখা যায়। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে বর্ষা৷ পাশ থেকে নিভ কয়েকবার ডাক দিলেও বর্ষা তা শুনতে পায়নি। সে ভাবছে অনেক গম্ভীর কিছু। বর্ষার চোখে মুখে স্পষ্ট সে চোখ কাউকে খুঁজে তাকে না দেখেই চোখে বিষন্নতা অবসাদ ঘটেছে। নিভের কথাগুলো সত্য হলেও বর্ষা মুখের উপর নাকচ করে দিয়ে নিভকে ভুল প্রমাণিত করার চেষ্টা করে উঠে চলে যায়।

রাস্তার মাঝে লোক জনের ভীড়ে আচমকা কেউ একজন হাত ধরে টান মারে। প্রথমত বিষয়টা বর্ষা স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। বর্ষা ভাবে রাস্তার এত ভিড়ে ঠেলাঠেলির কারণে কারো সাথে হাতে গষা লেগেছে হয়তো। কলেজ ছুটির পর, সবার সাথে বর্ষাও রওনা দেয়। রাস্তায় যেদিক দিয়ে লেকে যেতে হয়। সেদিক টায় আজ অনেক ভীড়। আর এত মানুষের মধ্যে দিয়ে ঠেলেঠুলে যেতে চায়নি। শুধু নিঝুম, ও আহিতার জোরাজুরিতে যেতে হয়েছে৷
ভিড় ঠেলে বাহিরে আসতে বর্ষা খেয়াল করল তার হাত টনটন করছে। হাতের দিকে। তাকাতে দেখল সেই আগের ন্যায় চুইঙ্গাম দিয়ে হাতে একটা হলুদ কালারের পেপার লাগানো। ভ্রু খানিক কুঞ্চিত করে তাকালো হাতের দিকে কিছুক্ষণ পরক্ষণে সকলের আড়ালে চিরকুট টা ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। বর্ষা বসে বসে এটাই ভাবছিল। বেস্ট ফ্রেন্ড গুলা সব সময় ফেসের রিয়াকশন দেখেই সামনে থাকা বন্ধুটার মন খারাপের কারণ বুঝতে পারে। নিভের দিকটায় ও তাই হলো।

সে দেখেই বলে ফেলল বর্ষার মন খারাপের কারণ সে খুব শীগ্রই প্রেমে পরবে। তবে যথাযথ ইগনোর করে বর্ষা তার সামনে থেকে উঠে চলে যায়। যার মন যাকে চায়, সে সামনে থাকলে এমনিতেই চোখে মুখে ভালোলাগা ফুটে উঠে। আর সে সামনে না থাকলে আঁখি জোড়া শুধু তাকে এক নজর দেখার জন্য ছোটাছুটি করে। মরুভূমিতে এক ফোটা পানির জন্য এক জন পিপাসক ব্যাকুল হয়ে উঠে। তেমনই এই আঁখি জোড়া তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে যায়। চারদিকে শুধু তারই অস্তিত্ব সন্ধান করে।

। সবাই বসে ফুচকা খাচ্ছিল মনের আনন্দে শুধু বিষন্নতায় ডুবে আছে বর্ষা।

দশ মিনিটের মাথা সেখানে আরও একজন সুঠাম দেহের লোক এসে উপস্থিত হলো সে সকলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,’ হেয়, গাইস! আমাকে রেখে একা একা ফুচকা খাচ্ছো নট ফেয়ার। ‘ অভিমানী স্বরে বলল।

মুরাদ ভ্রু কুঁচকালো। নিঝুম হা হয়ে তাকিয়ে বলল,

‘ তুমি ফুচকা খাও? ‘

লোকটা একটা চেয়ার টেনে বসে পরল, ধীর কন্ঠে বলল, ‘ কেনো আমার ফুচকা খাওয়া নিষেধ নাকি? ‘

‘ আদ্রিক তুমি ভুল বুঝছো। নিঝুম আসলে সেভাবে বলতে চাইনি। ও বলতে চেয়েছে যে, ‘ আহিতা কথা বলতেছিল তখন ওকে থামিয়ে দিয়ে আদ্রিক বলল,

‘ সে ও যাই বলতে চাকনা কেন তাতে আমার কিচ্ছু যায় না আসে না। এখন তো আমি শুধু ফুচকা খাবো৷ এই মামা এক প্লেট ফুচকা দিয়ো তো। ‘ আহিতার উদ্দেশ্য বলা কথাগুলো শেষ হলে ফুচকাওয়ালা কে ফুচকা দিতে বলল। এক নজর বর্ষার দিকে তাকালো তবে সে নিশ্চুপ নিরব পাবলিক হয়ে বসে আছে।

ফুচকা ওয়ালা ফুচকা দিয়ে যেতেই আদ্রিক খাওয়া শুরু করল। ফাঁকে ফাঁকে বারবার বর্ষাকে খোঁচাচ্ছে এই বলে, ‘ অনেক টেস্ট একবার খেয়ে দেখো ভালো লাগবে। ‘

কিন্তু আদ্রিক এটা জানে না যে, বর্ষার ফুচকা পছন্দ না। বর্ষা শুধু আইসক্রিম পছন্দ করে।
বারবার আদ্রিক এক কথা বলে বর্ষাকে তিক্ত করছে। রাগে রক্তবর্ণ চোখে আদ্রিকের দিকে তাকাতে আদ্রিক সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘ তোমার অনেক রাগ বর্ষা, যেমন টা রাগ রাগিনী। ‘

আদ্রিক কথা ইয়ার্কি করে বললেও বর্ষা কথাটা সিরিয়াসলি নিয়ে নেয়। কাউকে কিছু না বলে রাগে কটমট করে উঠে উল্টোদিকে প্রদক্ষিন করে।

নিভ কঠোর কন্ঠে বলল,’ বর্ষা ফুচকা পছন্দ করে না তুমি ওকে ওভাবে বিরক্ত না করলেই পারতে। ‘

‘ সরি। আমি জানতাম না বর্ষার ফুচকা পছন্দ না। ‘ মিনমিন কন্ঠে বলে।

‘ এজন্যই আগে থেকে সব জেনে নেওয়া ভালো। ‘

*

রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে বর্ষা। মনে হচ্ছে এই ব্যস্ত শহরে সব কিছুই ছুটে চলেছে শুধু তারই মস্তিষ্ক শূন্য।

রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। খানিকক্ষণ বাদে বাদে গাড়ির হন বেজে উঠছে। রাস্তার পাশে সরু রাস্তায় ঝালমুড়ি ওয়ালা ঝালমুড়ি বানাচ্ছে। তার লাঠি ঘুরানোর শব্দ সাথে কিছুটা দূরে মানুষের কোলাহল। রাস্তার কিনারে ফেরিওয়ালারা বসে আছে। তাদের ঘিরে কতশত মানুষের ভিড়, কিছু মানুষ ফেরিওয়ালার জিনিসগুলো হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আবারও রেখে দিচ্ছে তো অন্য কিছু মানুষ হাতিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছে দাম জিজ্ঞেস করছে আবারও তা আগের জায়গায় রেখে দিছে। আরও কিছু মানুষ জিনিস পছন্দ হলে টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। পাশের দোকানে চায়ের কাপ নাড়ানো শব্দ হচ্ছে। চতুর্দিক থেকে মানুষের নানান কথা ভেসে আসছে। এসব কিছুই বর্ষার আকস্মিক হৃদয়ে প্রভাব ফেলতে, আনমনে মাটির দিকে তাকিয়ে সে হেঁটে চলেছে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। মনে মনে ভাবছে, কে এই চিঠিবাজ যে এত সাবধানে চিঠি দিয়ে যাচ্ছে আর বর্ষা ভ্রু নাক্ষে টের পাচ্ছে না। তখনই তার মনে হলো তার এভাবে একা আসা ঠিক হয়নি। বর্ষার কি তার বন্ধুদের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত? উঁহু, যাওয়া ঠিক হবে না এতক্ষণে হয়তো তারা চলে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পেরিয়ে চলে আসছে বর্ষা। সে খেয়ালই করেনি কখন সে গ্রামের পথে হাঁটা শুরু করেছে। চারদিকে বড় বড় গাছ পালা। একসাথে একসারি তে তালগাছ রাস্তার পাশে। রাস্তার দু’পাশে অনেক বড় ধান ক্ষ্যাত যার কোনো শেষ নেই। মাঠে মাঠে গরু বেঁধে রাখা হয়ে তারা ঘাস খাচ্ছে। অন্য দিকে বাঁধনহারা ছাগল খোলা অবস্থায় এদিক সেদিক লাফিয়ে চলেছে৷ গাছের উপরে পাখিরা বাসা বেঁধেছে। এখনো বৈশাখ মাস শেষ হয়নি ধান গুলো পাকেনি তারা সবুজ রঙে নিজেদের সাজিয়ে রেখেছে। কিছুকিছু চাষীরা ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে খুব সতর্কতার সাথে হেঁটে চলেছে। হাতে তাদের কিছু রয়েছে। যা তারা ক্ষেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে।

বর্ষা সব দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো বুক চিরে এক ভারী দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসল। নিজেকে সংযত করে নিলো। তার এখন ইচ্ছে করছে গ্রামের রাস্তার পাশে ঘাসের উপর বসে চিঠিটা খুলে পরতে।

দ্বিতীয় বার চিন্তা ভাবনা না করে বর্ষা বসে পরল প্রাণোচ্ছল সবুজ ঘাসের উপরে, কাঁধ থেকে ব্যাগ টা খুলে মাটিতে ঘাসের উপর রাখল। ব্যাগের চেইন খুলে তার ভেতর থেকে হলুদ কালারের কাগজ বের করল। চিঠিটার দিকে একনজরে তাকিয়ে আছে। এই যুগেও মানুষ চিঠি দেয়। ভাবতেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে বর্ষা৷ তবে কবি লেখকের লেখা দারুণ, কাগজের ভাজ খুলে চোখের সামনে ধরল তাতে লেখা রয়েছে কিছু আবেগপ্রবণ কথা। বর্ষা ভারী নিঃশ্বাস নিয়ে পড়তে শুরু করল।

?
________
‘হুটহাট চলে যাও, কাছে থেকে দূরে বহুদূরে
বুঝিনা কিসের তরে থাকো কোন কল্পনার ঘোরে!!

স্বপ্ন দেখাও টুটাও, দূরে বসে খিলখিল হাসো
মনের আয়নায় যে তুমি মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ভাসো!!

বিবর্ণতায় সাজাও ভূবন আমার, আচম্বিতে
বুকের মধ্যে উথাল ঊর্মির তোড়ে ফিরি সম্বিতে।

চোখের নদীতে বন্যা বয়ে যায় সেকি বর্ষা বুঝে?
বুকের অথৈ-এ রক্ত চুয়ে চুয়ে সেকি বর্ষা খুঁজে!

অস্পৃশ্য ভালবাসায় ডুবে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি
মোহের টানে নাগালে কারো অস্তিত্ব ঠের পাচ্ছি!

সে কে? নীলাম্বরে ভেসে থাকা একটুকরো বর্ষা কি!
বর্ষা শুনো, তীরে ভেসে থাকা বর্ষার মন শুভ্র কি?

অস্থিরতায় কাটছে সময় তুমিহীন, আসোনি
তোমার শুভ্র বর্ষার ডানায় নিয়ে আজো ভাসোনি!!

শেষ ট্রামে চলে গেলে বর্ষা, হয়ে শেষ বর্ষাধারা
তোমার জন্য অস্থির মন হলো যে পাগলপাড়া!

নিপুণ ছোঁয়ায় তুমি ভেঙ্গে দিলে মনের দেয়াল
বর্ষা তুমি তীরে বসে দূরে ঐ কি জানি কি খেয়াল!

তোমাকে ভেবে ভরছি খাতা সব অজ্ঞান লেখায়
অস্থির সময় যেনো শুধু কষ্ট পেতেই শেখায়!

বর্ষা তোমার ডানায় ভর দিয়ে উড়ি ইচ্ছে নিবে?
শুভ্র বর্সার স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় হারাতে মন অস্থির দিবে?

গলে পড়ো অবিরাম চোখের পাতা ছুঁয়ে বুকেতে
আলিঙ্গনে আত্মহারা হতে চাই আবার সুখেতে।

বর্ষা বৃষ্টি হয়ে ঝরো, দাও সর্বাঙ্গে শীতল ছোঁয়া
তোমার তরেতে গেলে যাকনা আজ এ মন খোয়া! ‘
_________
?

তোমার এই চিঠি যে করে দিচ্ছে আমাকে পাগল পাড়া। আমার মনকে করে দিয়েছে উদাসীন। সে যে কাউকে খুঁজে কারো সঙ্গ পেতে সে বড্ড কাঁদে।

হেই চিঠিবাজ তোমার চিঠির প্রতি টা লেখার আড়ালে আমি কেনো তাকে খুঁজে পাই তুমি কি তা বলতে পারো?
আমার চোখ দু’টো এখন সারাক্ষণ ছুঁইছুঁই করে শুধু একটা নজর তাকে দেখার জন্য, তাকে দেখিলে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব হয়। শান্তির ধারা বয়ে যায় নদীর স্রোতে বাসা পদ্মর মতো।
আমার মন আমাকে বলে, আমার সে, আমার তাকে লাগবে। রগের শিরায় শিরায় শিহরন জাগ্রিত হয়। প্রতিটা শিহরণ শুধু তারই ছোঁয়া পেতে চায়। ইচ্ছা করে তারে দেখি আমি পরান ভরিয়া। আমার অন্তর আত্মা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে অনেক কিছু। তাহলে কি আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি? প্রশ্ন হচ্ছে সে কি গ্রহণ করবে আমাকে? ইচ্ছে করে তাকে ধরে বন্ধি করে রাখি আমার মনের খাঁচায়। বলতে বলতে বর্ষা সবুজ শ্যামল ঘাসের উপর শুয়ে পরল। মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।

#চলবে?

#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_২৩
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
______
অপ্রত্যাশিত দু’জনেই এক বড় ষড়যন্ত্রের শিকার হলো। যা কখনো ভাবেইনি তাদের সাথে এমনটা হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গায় অনাচ্ছাদিত তাদের সাথে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনা ভুলে যেতে চায় অভ্র। আজকের রাত তার কাছে কাল রাত্রির মতো বিষাদ লাগছে। গ্রামের মধ্যে ছোট একটা মাটির ঘরে জানালা গেষে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। জানালা দিয়ে বাহিরে দূর আকাশের গোলাকার বৃত্তর মতো গোল চাঁদটার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভ্র। ঘরটার মধ্যে জ্যোৎস্না রাতের আলো পস্ফুটিত হচ্ছে। অন্ধকার ঘরটা জ্যোৎস্নার আলোয় জ্বলজ্বল করছে। মাটিতে একটা পাটি বিছানো পাটির উপরে একটা চাদর মুড়ানো। চাঁদরের উপর নেশাগ্রস্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে বর্ষা।

জানালার সামনে একটা কুকুর অভ্রকে দেখে ঘেউঘেউ করা শুরু করেছে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল অভ্র। কুকুরের ডাকে ঘোর কেটে যায় তার। দৃষ্টি নিচে নামিয়ে কুকুরটার দিকে একনজর তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে মাটিতে শুয়ে থাকা মেয়েটা অর্থাৎ বর্ষার দিকে তাকালো। জানালার পাশ থেকে সরে আসল।

বর্ষার মাথার কাছে বসে চুলগুলো তে আলতো ভাবে বিলি কেটে দিতে লাগল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বর্ষার ঘুমন্ত মুখটার দিকে, আনমনে বলে উঠল,

‘ তোকে আমি চেয়েছি খুব করে চেয়েছি। নিজের থেকেও বেশি আমি তোকে চেয়েছি। কিন্তু এভাবে নয়। আজকের রাতের কথা হয়তো তোর মনেও থাকবে না। ভোরের আলো পস্ফরিত হওয়ার আগেই তুই সব ভুলে যাবি৷ আমিও চাই না তোর কিছু মনে থাকুক কেননা, আমি চাই না এমন একটা ভয়ংকর রাতে গা হিমহিম করা দূর্ঘটনার কথা তোর মনে থাকুক। খুব করে চাই যাতে তুই ভুলে যাস৷ যদি মনে রাখিস তাহলে হয়তো কখনো আমাকে ক্ষমা করতে পারবি না৷ কিন্তু বিশ্বাস করিস আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্য করেছি। নিজের কথা ভেবে একদম করিনি। আমি যদি এই পদক্ষেপ না নিতাম তাহলে তোর যে বড় ক্ষতি হয়ে যেতো। না জানি গ্রামবাসীরা কি করতো? তবে কথা দিচ্ছি তোকে আজ আমি, আজ থেকে তুই সম্পূর্ণ আমার রেসপনসেবলিটি। তোর অগোচরে তোকে আগলে রাখার দায়িত্ব আজ থেকে আমার। তুই হয়তো ভুলে যাবি নেশা কেটে গেলে কিন্তু আমি? আমি কিভাবে ভুলবো? বলতে পারিস? উঁহু, বলতে পারবি না। কারণ আমি নিজেই ভুলেও ভুলতে চাই না। আজকের রাতটাকে স্মৃতির পাতায় খুব আদর ভালোবাসা ও যত্ন সহকারে তুলে রাখবো। লিখে রাখবো ইতিহাসের পাতায়। যখনই ইচ্ছে হবে পাতা উল্টিয়ে পড়ে নেবো। তবুও ভুলতে দেবো না নিজেকে। তোকে আবদ্ধ করে রাখবো আমার স্মৃতি চারণে।

*

অফিসের কাজে হিমশিম খাচ্ছে অভ্র৷ লাইফে প্রথম আজ বাবা ও চাচাদের সাথে অফিসে এসেছে। সব সময়ই সে খোঁটা দিয়ে বলতো,’ তোমরা সারাদিন তো বসে বসে কাজ করো। তাতে আবার এত কিসের কষ্ট হুহহ? ‘

অভ্রর এমন কথায় বিরক্ত হয়ে তাকে আজ অফিসের কঠিন কঠিন কাজ দেওয়া হয়েছে। সে সব দিক সামলাতে সামলাতে আজ বেহাল অবস্থা অভ্রর। এদিকে সে খেয়াল করেছিল বর্ষার ফোনের লোকেশন কোণ্থেকে কোণ্থায় গিয়েছিল। ভেবেছিল বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছে। তাই সে ওতো গুরুত্ব দেয়নি। অফিসের কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে নেয়।

রাত বাজে ৯টা অথচ বর্ষা এখনো বাড়ি ফিরেনি। বাড়িতে সকলে টেনশনে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। বর্ষার মা অফিসে তার স্বামী বর্ষার বাবা-র কাছে কল দেন। তাকে বিস্তারিত জানালে তারাহুরো করে অফিস থেকে বাড়িতে ছুটে আসে তারা সকলে সাথে অভ্র ও আসে।

বাড়িতে এসে অভ্র রিয়ার সাথে কথা বলে। রিয়া কান্নার জন্য সঠিক ভাবে কথাও বলতে পারছিল না। অভ্র জোরেসোরে ধমক দিলে অভ্রকে সব কিছু বলে দেয় রিয়া। অভ্র ছুটে বাড়ি থেকে বের হয়। বের হওয়ার পূর্বে সকলকে বলে যায়। তারা জেনো কেউ টেনশন না করে যেখান থেকেই হোক বর্ষাকে খুঁজে নিয়ে আসবেই৷
বাইক নিয়ে বের হয়। বর্ষার ফোনের লাস্ট লোকেশন চেক করে সেদিকেই যাচ্ছে।
_______
কানের কাছে ভো ভো করছে মশা ও মাছি। আশ পাশ থেকে কুকুর ও শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। মশার ভোভো ও শিয়ালের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় বর্ষার। হাত দিয়ে চোখ ঢলতে ঢলতে উঠে বসে। চারপাশে তাকিয়ে দেখল শুধু অন্ধকার। তবে আকাশের চাঁদের আলোয় কিছুটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে।

বর্ষা চোখ বুলিয়ে সামনে তাকাতে দেখল কয়েকটা শেয়াল ডাকতে ডাকতে এদিকেই আসছে। বর্ষা ভয়ে ধান ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে পরে। হাত পা লাগাতার কাঁপছে। একবার শেয়ালের নজরে পরলে সকলে মিলে আজ ওকে দিয়েই ডিনার সারবে। কোন আক্কেলে যে ঘুমিয়েছিল? সব কিছু ওই চিঠিবাজের জন্য ইচ্ছে করছে নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিড়ে ফেলতে। শেয়ালের ডাক বন্ধ হয়ে গেলে বর্ষা ধান ক্ষেতের মধ্য থেকে বের হয়। সেই সকালে খেয়েছিল আর সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি। খিদে পেটের মধ্যে ইঁদুর ছুঁইছুঁই করছে।
রাস্তায় তাকিয়ে আছে। কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। কোন দিক দিয়ে এসেছিল সেটাও ভুলে গেছে। এদিকে প্রচুর পানি পিপাসা লেগেছে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। বর্ষা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুদূর সামনে যেতেই দেখল একটা লোক বসে আছে সাথে একটা পানির বোতল।
বর্ষা কোনো কিছু না ভেবেই ছুটে গেলো মধ্য বয়স্ক লোকটার কাছে। অচেনা লোকটার সামনে দাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,’ আমার অনেক পানি তৃষ্ণা পেয়েছে। আঙ্কেল পানির বোতল টা আমাকে একটু দিবেন। ‘

লোকটা মাথা তুলে নেশালো দৃষ্টিতে বর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’ পানি খাবে? ‘

বর্ষা মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে মুখ দিয়ে বলল,’ হুম ‘

লোকটা ঠোঁট বাঁকা করে হাসল, বোতলটা বর্ষার দিকে বাড়িয়ে দিলো। বর্ষা হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিয়ে খেতে শুরু করল। লোকটা হাত উপরে তুলে হাসতে হাসতে চলে গেলো। বর্ষা একঢোক খেতেই তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। সে সাথে সাথে মাটিতে বসে পরল।
তবুও বর্ষা একঢোক একঢোক করে পুরোটা বোতলের পানি পেটে চালান দিয়ে দিলো। মিনিটের মধ্যেই বর্ষার নেশা হয়ে যায়। রাস্তায় বসে বসে মুরগির বাচ্চার মতো ঝিমাচ্ছে তখনই বাইক এসে থামলো বর্ষার সামনে৷ বাইক থেকে নেমে ছুটে আসছে অভ্র, বর্ষাকে ধরে দাঁড় করিয়ে পাগলের মতো গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করছে, ‘ কি হয়েছে? এখানে কিভাবে এলো? বাংলা মদ কোণ্থেকে পেয়েছিস? ‘

বর্ষা অভ্রর মুখের দিকে নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘ এই অভ্র তুমি আমাকে সব সময় বিরক্ত কেন কোরো? তুমি জানো আমার খুব খারাপ লাগে। ইচ্ছে করে তোমার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে দেই। ‘

বলেই বর্ষা অভ্রর চুল টেনে ধরল। অভ্র বর্ষার দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরে অস্ফুটস্বরে বলল,’ বর্ষা লাগছে। তোর নেশা হয়ে গেছে চল বাড়িতে চল। ‘

‘ উঁহু আমি যাবো না। ‘ মাতাল কন্ঠে বলল।

‘ কেন যাবি না শুনি। জানিস বাড়ির সকলে কত টেনশন করছে? ‘

‘ আমি যামু না। আমি এখানেই থাকমু বাতাসে বাতাসে উড়ে বেড়াবো আকাশে। ‘

বলে বর্ষা অন্য দিকে চলে যাচ্ছিল। অভ্র ফট করে হাত ধরে নেয়। বাড়িতে মেসেজ দিয়ে সকলকে জানিয়ে দেয়, ‘ ও বর্ষাকে পেয়ে গেছে সকলে জেনো টেনশন না করে। ওরা এখনই আসছে। ‘

ফোন থেকে মাথা তুলে সামনে তাকাতে দেখে বর্ষা অন্য দিকে দৌঁড় লাগিয়েছে। অভ্র ও পেছন পেছন ছুটে গেলো। বেশ অনেকটা দূরে চলে গেলো। গ্রামের কিছু মুরব্বিরা দেখতে পায়। একটা মেয়ের পেছনে একটা ছেলে ছুটে যাচ্ছে। তার পরই তারা এসে দুজনের পথ আটকে দাঁড়ায়। দু’জনকে সাথে নিয়ে চলে যায় গ্রামের মাতব্বরের কাছে। গ্রামের মাতব্বর ফজল মিয়া তার মতামত পেশ করে। অভ্র বর্ষাকে এক হাতে বুকের সাথে ধরে রেখেছে। গ্রামের কিছু মানুষ ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

মাতব্বরের কথার বিরুদ্ধে কথা বলে অভ্র। এদিকে বর্ষা মাতলামি করছে। অভ্রর কথায় গ্রামবাসিরা নারাজ হয়ে যায়। বর্ষাকে টান দিয়ে অভ্রর কাছ থেকে আলাদা করতে চাইলো। বর্ষাকে শক্ত হাতে ধরে অভ্র অনেক ভেবে মাতব্বরের প্রস্তাবে রাজি হয়।

কিছুক্ষণের মধ্যে বর্ষা সেন্সলেস হয়ে যায়। বর্ষাকে দুইহাতে আগলে নেয় অভ্র দুই হাতে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। তাদের দু’জনকে একটা ঘরে রেখে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সকলে চলে যায়৷ বর্ষাকে পাটিতে শুইয়ে দিয়ে সেই থেকে জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

*

সকালের এক চিলতে রোদ জানালা দিয়ে এসে বর্ষার মুখের উপর উপচে পরে। ঘুমে নড়েচড়ে উঠে বর্ষা৷ পিটপিট করে চোখ খুলে তাকিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করল একটা মাটির ঘরে। উঠে বসে ঘরটায় চোখ বুলাতেই দেখল একটু দূরে অভ্র মাটির দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে ঘুমিয়ে আছে। বর্ষা উঠে অভ্রর পাশে গিয়ে বসে শীতলাকন্ঠে অভ্রকে ডাকতে লাগল।

অভ্র চোখ খুলে বর্ষাকে দেখে কর্কশকন্ঠে চেচিয়ে বলে উঠে,’ তুই আমার এত কাছে কি করছিস দূরে সর। ‘

বলে অভ্র উঠে দাঁড়ালো। আঁড়চোখে তাকিয়ে আছে বর্ষার দিকে। একহাত দিয়ে মাথা শক্ত করে চেপে ধরেছে। মাথাটা এখনো ঝিম মেরে আসছে মাথাটা ঘুরাচ্ছে। মাথায় হাত দিয়ে ঘুরে পরে যাচ্ছে বর্ষা। অভ্র ‘বর্ষাহহ’ বলে চিৎকার দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। বর্ষা আবারও সেন্সলেস হয়েগেছে। তাকে মাটিতে শুয়ে দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে কাউকে দরজা খোলার জন্য ডাকতে থাকে।

তৎপর কয়েক জন এসে দরজা খুলে দেয়। অভ্র সকলকে বর্ষার অবস্থা জানালে সকলে তাদেরকে যেতে বলে। অভ্র বর্ষাকে নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করে।

বর্ষা বাইকের পেছন থেকে অভ্রর গলা চেপে ধরে বলল, ‘ কেমন দিলাম। ‘

অভ্র হাসতে হাসতে বলল,’ তোকে তো এক্টিং এর এওয়ার্ড দেওয়া উচিত রে ‘

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here