‘অবেলায় কেন বসন্ত নিয়ে এলে?’
কলেজ থেকে ফিরেই হালকা কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিল মাধবীলতা। গোসল না করলে রাতে ঘুমুতে পারে না। দীর্ঘদিনের অভ্যাস। শরীরটা অনেক দিন থেকে ভালো নেই। তারপরও গোসল বাদ রাখেনি। ঠাণ্ডা বেশ পাকাপোক্তভাবে ধরেছে। রোজ রোজ মধুর সাথে আদা,তুলসির রস গিলতে অসহ্য লাগে। তুলসি পাতার গন্ধটা বিদঘুটে। রমিজা খালা নাছোড়বান্দা। আমাকে খাওয়েই ছাড়বে। নাক বন্ধ রেখে কোনো রকম গিলে নেই। মাধবীলতা খাটে বসে ফ্যানের বাতাসে লম্বা চুল শুকাচ্ছে, আর একা একাই বিড়বিড় করছে।
রমিজা বানু হাতে নামাজের বিছানা নিয়ে মাধবীলতার সামনে দাঁড়ালেন।
‘তোকে খাবার দিয়ে আমি নামাজ পড়বো। আয় তাড়াতাড়ি!’
‘খালা তুমি আগে নামাজ শেষ করো তারপর একসাথে খেতে বসবো।’
‘তুই নামাজ পড়বি না?’
‘নামাজ নেই।’
মাধবীলতা চুল শুকাতে শুকাতে এফবিতে চোখ রাখলো। হঠাৎ ম্যাসেনঞ্জারে বয়েস কল আসে।
পরিচিত আর প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে তেমন কথা হয় না। নামটা ভালো করে না দেখেই কল রিসিভ করে। অপরিচিত একজন বলল,
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়াআলাইকুমুস সালাম।’
‘কে বলছিলেন প্লিজ?’
‘আমি সবুজ খন্দকার।’
‘জ্বি,বলুন।’
‘ম্যাম, আপনার শরীর ভালো আছে?’
‘আছি মোটামুটি। একটু ঠাণ্ডা লেগেছে।’
‘কথা শুনে বুঝতে পারছি। বাই দ্যা ওয়ে,ম্যাম ‘আপনি মেলায় যাবেন কবে? আপনার অটোগ্রাফসহ তিনটি বই নিতে চাই। কাইন্ডলি যদি সময়টা জানাতেন খুব ভালো হতো।’
মাধবীলতা কিছু না বলে স্কিন থেকে নামটা দেখে নিল। ‘সবুজ খন্দকার’ চিনতে পারছি না তো। আগে কখনও কথা বলেছি মনে পড়ছে না।
ম্যাম,বিরক্ত করছি?
একদম না। আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখেন সামনে শুক্রবার বিকেল তিনটায় ‘কথামালা’ প্রকাশনীর ৫২৫ নং স্টলে থাকবো।
‘জ্বি,ম্যাম। ধন্যবাদ আপনাকে। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। দোয়া রইলো।’
মাধবীলতা ফোন রাখলো।
মাধবীলতা বাংলায় অনার্স মাস্টার্স শেষ করে বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন। সাহিত্যেকে ভালোবেসে লেখালেখি শুরু করেন।
বাবা ছিলেন কৃষি কর্মকর্তা। যখন এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয় তখন বাবা মারা যান। মা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। একবছর হলো মা মারা গেছেন।
তিন বোনের বড় বোন মাধবীলতা। মেঝো বোন চারুলতা সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করে। ছোট বোন বনলতা ডেন্টিস্ট। দুই বোন পেশা, স্বামী,সংসার, নিয়ে ব্যস্ত। মা’কেই নিয়েই মাধবীলতার ছোট্ট সুখের জগত ছিল। মা মারা যাবার পর নিকট আত্মীয় রমিজা বানুকে নানাবাড়ি থেকে নিজের কাছে এনে রাখেন। রমিজা বানুর কোনো সন্তান নেই। স্বামী মারা গেছেন অনেক বছর আগে।
খাবার টেবিল থেকে রমিজা বানুর ডাক শুনে মাধবীলতা টেবিলে গিয়ে বসলো। দু’জনে টুকটাক কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ করেন।
শুক্রবার ছুটির দিন। ঘরের টুকটাক কাজ শেষ করে এগারোটার দিকে গোসল করে নিল মাধবীলতা। আজ অনেকের সাথে মেলায় দেখা হবে,কথা হবে। লেখক আড্ডায় সময়টুকু ভালো কাটবে। নিজের লেখা বইয়ে অটোগ্রাফ দিবে অনুভূতিটা অন্যরকম। নিজের লেখা একেকটা বই তার কাছে সন্তানতুল্য। রেডি হয়ে বিকেল তিনটের একটু আগেই বের হলো মাধবীলতা। ছুটির দিন সিগন্যাল ছাড়া রাস্তায় জ্যাম নেই। সিএনজি নিয়ে সব পথ পেরিয়ে খানিকটা হেঁটে মেলা চত্বরে প্রবেশ করে। ‘কথামালা’ স্টলে বসে অন্য লেখকদের সাথে কথা বলছে মাধবীলতা।
এর মধ্যে বেশ কয়েকজন ছাত্রী এল। ছাত্রীরা অটোগ্রাফসহ গল্পগ্রন্থ ‘এখনও অনেকটা পথ বাকি’ উপন্যাস ‘তাকে দেখিনি’ কিনল।
ছাত্রীদের সাথে ফটোসেশনে অংশ নিল মাধবীলতা। হঠাৎ খেয়াল করলো, একজন ভদ্রলোক শ্যাম বর্ণের,উচ্চতায় পাঁচ ফিট সাত মুখে ছোট ছোট দাড়ি। গায়ে আকাশী রংয়ের শার্ট,জিন্স প্যান্ট পিঠে কালো রঙের একটা ব্যাগ ঝুলছে। মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে আছে।
ছাত্রীরা ম্যাডামকে সালাম জানিয়ে এক ঠোঙা বাদাম দিয়ে চলে গেল। ভদ্রলোক কাছে এলেন।
‘আপনি সবুজ খন্দকার?’
‘জ্বি। আপনার ব্যস্ততা বেশি। তাই দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।’
মাধবীলতা তাঁর লেখা তিনটি বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে সবুজের দিকে এগিয়ে দিল। সবুজ হাসিমুখে বইয়ের প্যাকেট নিয়ে ধন্যবাদ দিল। সবুজ আস্তে করে বলল,
‘ আপনার জন্য ছোট্ট একটা গিফটের প্যাকেট ছিল। নিঃসংকোচে যদি গ্রহণ করেন আমার ভালো লাগবে।’ বলেই সবুজ প্যাকেটটি এগিয়ে দিল।
মাধবীলতা কোনো কথা বলে নি। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে শুধু বলল,
‘ অনেক অনেক ধন্যবাদ।’
সবুজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাধবীলতাকে দেখছে।
মাধবী তার দিকে দৃষ্টি দিতেই অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। মাধবীলতা বলল,
‘কিছু বলবেন?’
‘একটা কথা বলবো? কিছু মনে করবেন না।’
‘বলুন’।
‘আপনি ছবির চেয়ে বাস্তবে দেখতে অনেক সুন্দর।’
মাধবী খানিকটা বিব্রতবোধ করছে। মুখোমুখি এমন প্রশংসা শুনে কি বলবে মাথায় আসছে না।
মৃদু হেসে বলল,
মহান রবের সৃষ্টির সবকিছু সুন্দর। তার মধ্যে মানুষ হলো সৌন্দর্যে,চিন্তাশক্তি,জ্ঞানবুদ্ধিতে সেরা।
‘জ্বি। সুন্দর,যৌক্তিক ব্যাখ্যা। আজ তাহলে আসছি।’
‘দোয়া করবেন।’
‘ইনশাআল্লাহ।’
সবুজ বিদায় নিয়ে চলে গেল। মাধবী সন্ধ্যার পর পরই রিকশা নিল। বাসায় আসতে আসতে প্যাকেটে কি আছে বের করে দেখলো। গৌর কিশোর ঘোষ ‘প্রেম নেই’ দ্বিজেন্দ্র কুমার মিত্রের ‘পৌষ ফাগুনের পালা’ দুটো উপন্যাস দেখে মাধবীলতার ভালো লাগে। মনে মনে খুশি হয়। ভেতরে আরও ছোট্ট প্যাকেট দেখতে পায়। দেখলো,লাল রঙের ছোট্ট প্যাকেটে টকটকে লাল একটি গোলাপ,তিনটি ছোট পারফিউম।
কোন ব্রান্ডের দেখার চেষ্টা করলো। ছোট লেখা, ল্যাম্পপোস্টের দূর্বল আলোতে অনেক কষ্ট করে পড়ে নিল। EAU DE PERFUME,MADE IN FRANCE। মাধবীলতা অবাক হলো। উপন্যাস দুটো ঠিক ছিল। গোলাপ আর পারফিউম দিয়েছে কেন? গিফটের জিনিস ফেরত দিলে ছোট লোক ভাববে। আর ফেরত পাঠাবো কীভাবে? ফেরত দেব? সবুজকে পাবো কোথায়?
মাধবী বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে রমিজা বানুকে বলল,
খালা চট করে কড়া এক মগ কফি বানিয়ে দাও।
উপন্যাস পড়তে বসবো। দেখো,শরবত বানিও না কিন্তু! তোমার বানানো চা বরাবরই খুব মিষ্টি হয়। তোমার চা’য়ের মগে যত ইচ্ছে চিনি দাও। আমারটায় এক চামচ দুই চিমটি চিনি দিবা। রমিজা বানু মাধবীলতার কথা শুনে হাসলেন।
রাতে আর নেটে আসে নি মাধবীলতা। ‘প্রেম নেই’ উপন্যাসের প্রেমে ডুবে আছে। কোনো রকম অল্প খেয়ে আবার ডুবে রইলো রাত একটা পর্যন্ত।
সাধারণত রাত জাগতে পারে না মাধবীলতা।
বইয়ের নেশায় থাকলে কখন রাত কখন দিন ভুলে যায়। রমিজা বানু রাতে প্রকৃতির ডাকে ঘুম থেকে উঠে দেখে মাধবীলতা বই পড়ছে।
‘কালকে তোর কলেজ বন্ধ? শরীর খারাপ নিয়ে রাত জাগছিস কেন?’
‘না। কলেজে যেতে হবে। এই এখনি বাতি নেভাবো।’
মাধবীলতা সাথে সাথেই লাইট নিভিয়ে রমিজা বানুর পাশে শুয়ে চোখ বন্ধ করে।
কলেজ করে বাসায় ফেরার পথে বাজার করে
রমিজা বানুর জন্য প্রেসারের,গ্যাসের ঔষধ কিনল। সারাদিন নেটে আসতেই পারেনি। বিকেলে অনলাইন হয়ে এফবিতে চোখ বুলায়।
একটার পর একটা মেসেজ আসতেই থাকে। এফবি রেখে ম্যাসেনঞ্জারে আসে। কোনো সময় মেসেজ সিন করে ইচ্ছে হলে রিপ্লাই দেয়।আবার ব্যস্ততার কারণে এড়িয়ে যায়। সবুজের মেসেজ সিন করলো।
বইমেলা থেকে ফেরার পর পরই টেক্সট করেছে,
‘আবারও বলছি, আপনি অনেক সুন্দর! পাঁচ বছর পর দেখা হলে একটা কথাই বলব মাধবীলতা অনেক সুন্দর……………..’
পর্ব-১
—-চলবে
#মাকসুদা খাতুন দোলন