অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-২১||

0
1304

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২১||

৩৮.
শেক্সপিয়র বলেছিলেন, “একজন ছেলে কখনো একজন মেয়ের বন্ধু হতে পারে না, কারণ এখানে আবেগ আছে, দৈহিক আকাঙ্খা আছে।”
এই কথাটিকে সত্য প্রমাণ করে দিয়েছে মাওশিয়াত আর সায়ন্তনী। সায়ন্তনী তার ভালো লাগার কথা ইমনকে জানানোর সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু মাওশিয়াত মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা হওয়ার হোক, সে তার ভালো লাগার কথা ইভানকে জানাবেই।

আজ কলেজের ক্লাস শেষ করে মাওশিয়াত ইভানের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাবলো, আজই সব জানিয়ে দেবে। তখনই ইভান মুচকি হেসে তাকে বললো,
“চলো, আজ তোমাকে বাসায় নিয়ে যাই।”

মাওশিয়াত খুশি হয়ে বলল,
“আজ তুমি তোমার বাসায় নিমন্ত্রণ করছো?”

“হ্যাঁ, ইমন তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।”

“শুধু এই জন্য? আর ও তো দেখা করতে চেয়েছে, কিন্তু একবারো যোগাযোগ করে নি।”

“আরেহ, ও উলটো তোমার উপর অভিমান করে বসে আছে।”

“কেন? আমি কি করেছি?”

“ওই যে তুমি ওর সাথে যোগাযোগ করো নি।”

মাওশিয়াত হেসে বললো,
“অভিমানী খেলোয়াড়। আমি তো কারো সাথেই রাখি নি।”

তারপর মাওশিয়াত লাজুক হেসে বলল,
“শুধু তোমার সাথেই আমার সব যোগাযোগ।”

ইভান কথাটি শুনে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এদিকে বাসায় ঢুকেই ইমন মাওশিয়াতকে অরুণিকার সাথে খেলতে দেখে অবাক হলো।

মাওশিয়াত ইমনকে দেখে বলল, “কেমন আছো, ইমন?”

ইমন মাওশিয়াতের সামনে এসে বসলো। আর মাওশিয়াত গালে হাত রেখে বলল,
“তুমি নাকি আমার সাথে অভিমান করেছো?”

ইমন আড়চোখে ইভানের দিকে তাকালো, তারপর বলল,
“তুমি তো একবারো আসো নি এইদিকে। আমি কি তোমার বাসায় যেতে পারবো, বলো? তখন আংকেল-আন্টি কি না কি ভেবে বসে থাকবে!”

মাওশিয়াত হেসে বলল,
“আমার মা অনেক মিশুক মানুষ। আর বাসায় কে আসে না আসে, এসব দেখার মতো সময় বাবার নেই। ভাবছি তোমাদের সবাইকে একদিন বাসায় দাওয়াত করবো। মা, ইভানকেও দেখতে চায়।”

কথাটি বলেই মাওশিয়াত ইভানের দিকে তাকালো। ইমন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“বাকিদের দেখতে চায় না?”

মাওশিয়াত মাথা নেড়ে বলল,
“আরেহ, না। আমি তো ইভানের কথায় মাকে বলেছি। ও তো এখন আমার সাথে একই কলেজেও পড়ছে।”

তখনই তাহমিদ খাবার সাজিয়ে বলল,
“ইমন তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। সবাই খেতে বসো, মাওশিয়াত তুমিও আসো। ব্যাচেলর সংসারের রাঁধুনির রান্না খেয়ে দেখো।”

তূর্য শতাব্দীকেও ডেকে নিয়ে এসেছিলো। শতাব্দী মাওশিয়াতকে বলল,
“মিষ্টিমশাই, মিষ্টি ছাড়া খাবারে ভীষণ ঝালও দেয়। একেবারে মুখ জ্বালিয়ে দেবে।”

অরুণিকা বলল,
“শতু আপু, তাহমিদ তো ইচ্ছে করেই মরিচ বেশি দিয়েছিল..”

তাহমিদ অরুণিকার মুখ চেপে ধরে বলল,
“অরুণিকা, বেশি কথা বলছো তুমি।”

মাওশিয়াত অরুণিকাকে তার কাছে টেনে এনে বলল,
“আমাকে কানে কানে বলো!”

অরুণিকা উঠে জোরে জোরেই বলল,
“শতু আপু ওইদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় তার বন্ধুর সাথে হাসছিলো তাই।”

শতাব্দী অবাক হয়ে তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদ আমতা-আমতা করে বলল, “মোটেও না।”

ইমন বলল, “আমি বলছি।”

তাহমিদ চোখ গরম করে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বলল,
“শতাব্দী, তুমি তোমার ছেলে বন্ধুর সাথে হাসছিলে, এই জন্য সেই মরিচের শাস্তি পাও নি৷ শাস্তি পেয়েছো, তাহমিদকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে এসেছিলে তাই।”

শতাব্দী গোমড়া মুখে তাহমিদকে বললো,
“আমি মায়ের দিব্যি করে বলছি। আমি তোমাকে দেখি নি। হয়তো তোমার মনে হয়েছিল।”

তাহমিদ খাবারের বাটি নিয়ে উঠে একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শতাব্দী মনে মনে বলল,
“মিষ্টি মশাই, তুমি বিনা অপরাধে আমাকে শাস্তি দিয়েছ। দাঁড়াও, আমিও তোমাকে ঝাল খাইয়ে ছাড়বো।”

এরপর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে শতাব্দী আর মাওশিয়াত বসে অনেক গল্প করলো। আর তাদের গল্প শুনতে লাগলো অরুণিকা। বিকেলে মাওশিয়াত নিজেই সবার জন্য চা বানালো। চায়ের কাপ সবার হাতে দেওয়ার পর মাওশিয়াত ইভানের পাশে বসে ফিসফিস করে বলল,
“তোমার জন্য আলাদাভাবে বানিয়েছি।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“চা আবার আলাদা হয় কিভাবে?”

“তুমি বুঝবে না।”

মাওশিয়াত মনে মনে হাসলো আর বলল,
“প্রেম দিয়েছি, প্রেম! বোকা ছেলে”

এদিকে ইমন ইভান আর মাওশিয়াতের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমনের চোখ অনুসরণ করলো আরাফ আর তাহমিদ। এরপর মাওশিয়াত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ইভানের হাত ধরে বলল,
“চলো, আমাকে বাসায় নামিয়ে দেবে!”

ইমন বলে উঠলো,
“আমি নামিয়ে দিয়ে আসি, চলো। সেই সুযোগে তোমার বাসাটাও চিনে নিতে পারবো।”

মাওশিয়াত ইভানের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে চাইছে ইভান বলুক, সে নিজেই যাবে। কিন্তু ইভান বলল,
“ইমন নামিয়ে দিয়ে আসুক।”

মাওশিয়াত বলল,
“না, না। ও তো মাত্র বাসায় এসেছে। এখন একটু বিশ্রাম নিক।”

ইমন মাওশিয়াতের হাত ধরে তাকে টেনে বাইরে নিয়ে বলল,
“আমি একদম প্রস্তুত।”

মাওশিয়াত ইভানের দিকে এক নজর তাকিয়ে ইমনের সাথে বেরিয়ে পড়লো। পুরো রাস্তা ইমন মাওশিয়াতের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করে গেছে। কিন্তু মাওশিয়াত তেমন কোনো জবাব দেয় নি। ইমন বারবারই দমে যাচ্ছিলো। কিন্তু পরক্ষণেই অন্য বিষয়ে কথা বলে মাওশিয়াতের হাসি দেখার অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু মাওশিয়াতের দৃষ্টি রাস্তার চলন্ত গাড়িগুলোর দিকেই আটকে আছে। ইমন তাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার হাসিটা অসম্ভব সুন্দর। আজ আমি সেই হাসি দেখার কতো চেষ্টা করেছি, কিন্তু পুরো রাস্তায় তুমি অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিলে। কেন মাওশিয়াত?”

মাওশিয়াত ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কোথায়? আমি তো তোমার সব কথা শুনেছি।”

“তাহলে উত্তর দাও। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”

মাওশিয়াত কপাল ভাঁজ করে বলল, “প্রশ্ন!”

“কিছুক্ষণ আগেই করলাম, তুমি কি রাজি আছো?”

মাওশিয়াত কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ রাজি আছি।”

যদিও সে কিছুই শুনে নি। কিন্তু সে ইমনকে তা বুঝতে না দেওয়ার জন্যই মিথ্যে বলল। ইমন মাওশিয়াতের উত্তর শুনে হাসলো আর বলল,
“তাহলে আগামী শুক্রবার দেখা হবে।”

মাওশিয়াত মাথা নেড়ে বাসায় ঢুকে পড়লো। আর ইমন মাওশিয়াতের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পরও এখনো সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সে মাওশিয়াতের ঘরের বারান্দার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, এখন কি মাওশিয়াত বের হয়ে দেখবে সে দাঁড়িয়ে আছে কি না? প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেলো। মাওশিয়াত আর বারান্দায় আসে নি। ইমনও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটতে লাগলো।

একপাক্ষিক ভালোবাসাগুলো অনেক যন্ত্রণাদায়ক। এই ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খা একটা মানুষকে তার নিজস্ব স্বকীয়তা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। সেদিনের পর থেকেই ইমন কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায়। রাত-দিন তার চোখে মাওশিয়াত আর ইভানের একে-অপরের দিকে তাকিয়ে থাকাটা ভাসতে থাকে। সে কোনোভাবেই সেই মুহূর্তটা ভুলতে পারছে না।

এক সপ্তাহ পর শুক্রবার বিকেলে ইমন মাওশিয়াতকে তার ভালো লাগার কথা বলে দেয়। তবে মাওশিয়াত কোনো উত্তর না দিয়েই বাসায় চলে আসে। পরের দিন সকালে কলেজের জন্য বের হওয়ার সময় মাওশিয়াত ইমনের মুখোমুখি হলো। মাওশিয়াত তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে আসতে যাবে, তখনই ইমন তার হাত ধরে বলল,
“তুমি বলেছিলে, রাজী আছো। তাহলে গতকাল চুপচাপ চলে এসেছো কেন?”

মাওশিয়াত বলল,
“আমি ওইদিন তোমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনি নি।”

“তাহলে মিথ্যে কেন বলেছো? সেদিনই এই কথা বলতে পার‍তে। এখন তুমি আমার মনে তো একটা আশা জাগিয়ে দিয়েছ!”

মাওশিয়াত বলল,
“তুমি যাও, ইমন। এই মুহূর্তে আমার বাসার সামনে কেন এসেছো? কেউ দেখলে কি মনে করবে?”

“তুমি বলেছ, তোমার মা অনেক মিশুক মানুষ। তুমি সত্যটাই বলবে। বলবে আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি সেই শুরু থেকেই।”

“কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি না।”

“তাহলে ইভান ভাইকে ভালোবাসো, তাই না?”

মাওশিয়াত কোনো উত্তর না দিয়ে একটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে চলে গেলো। আর ইমন সেখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে বলল,
“সেদিন আমি তোমাকে কোনো প্রশ্ন করি নি। ইচ্ছে করে ওই কথা বলেছি। মাওশিয়াত, এখন তুমি আমাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হবে। তুমি আমার মনে মিথ্যে আশা জাগিয়ে, কখনোই নিজেকে ভালো রাখতে পারবে না। তোমার এই ভাবনায় এবার আমাদের এক করবে। কিন্তু আমি আর তোমার কাছে আসবো না। তুমি নিজেই আমার কাছে আসবে।”

এদিকে ইমন কয়েকদিন ধরেই ইভানের কাছ থেকে দূরত্ব রাখার চেষ্টা করছে। কথাবার্তাও কম বলছে না। ইভান ইমনের এমন ভাব দেখে অনেক কষ্ট পাচ্ছে।

আজ ইভান ইমনের কাঁধে হাত রেখে বলল, “কেন এমন করছিস?”

ইমন হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি এখন ব্যস্ত আছি।”

ইভান ইমনের হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে বলল,
“আমার প্রশ্নের উত্তর দে, ইমন।”

ইমন চেঁচিয়ে বললো,
“তুই আগে আমার মাওশিয়াত ফিরিয়ে দে।”

ইভান অবাক হয়ে বলল,
“পাগল হয়ে গেছিস? কি বলছিস এসব!”

“তুই জানিস, আমি মাওশিয়াতকে ভালোবাসি। তবুও ওকে নিয়েই তোর ব্যস্ততা। তুই ফোনে ওর সাথেই চ্যাট করিস। তোরা সারারাত কথা বলিস। আর আমি এসব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।”

ইভান ইমনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমাদের চ্যাট পড়ে দেখ, আমরা পড়া নিয়েই কথা বলি। ফোনেও পড়ার বিষয়ে কথা বলি।”

“হয়েছে। আমার এতোসব শুনার কোনো ইচ্ছে নেই। তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই। তুই মনে করিস, বাবা-মার মতো সেদিন আমিও মারা গিয়েছিলাম। আমরা এখন থেকে রুমমেটের মতো থাকবো।”

কথাটি বলেই ইমন ইভানকে ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

ইভান ইমনের ব্যবহারে অনেক কষ্ট পেয়েছে। বাবা-মাকে হারানোর পর আজ সে প্রথম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করেছে। ইভানকে কাঁদতে দেখে বাকি চারজন মুষড়ে পড়লো। তূর্য বিড়িবিড় করে বলল,
“আমি জানতাম, ওই মেয়ের জন্য একদিন তোদের মধ্যে কোনো না কোনো ঝামেলা হবে।”

ইভান কাঁপা কন্ঠে বললো, “ওর জন্য কেন ঝামেলা হবে?”

“কারণ ইমন শুরু থেকেই মাওশিয়াতকে পছন্দ করতো। কিন্তু মাওশিয়াত তোর ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখাতো। আগে কি ছিল জানি না। কিন্তু কিছুদিন আগে ও যখন বাসায় এসেছিল, তখন ওর হাবভাব দেখেই বুঝেছি, ও তোকে সত্যিই পছন্দ করে।”

ইভান শার্টের হাতায় চোখ মুছে বলল,
“কিন্তু আমি মাওশিয়াতকে ওই দৃষ্টিতে পছন্দ করি না। আমার জন্য ইমনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউই নেই। আমি মাওশিয়াতের কাছ থেকে দূরত্ব রাখবো। যেই বন্ধুত্ব আত্মার সম্পর্ক নষ্ট করে, সেই বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়ায় ভালো। কারণ বন্ধু ছাড়া আমি বেঁচে থাকবো, আত্মার সম্পর্ক ভেঙে গেলে আমি হেরে যাবো।”

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here