#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৬||
#নতুন_মোড়
৫৯.
সায়ন্তনীর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরাফ। সায়ন্তনীর ভাই সায়ান দোকান থেকে সকালের নাস্তা কিনে বাসায় ফিরে আরাফকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরল৷ আরাফ ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো। সায়ান চেঁচিয়ে মাকে ডেকে বলল,
“আম্মা, দেখো না কে এসেছে।”
তারপর আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আসো না ভাইজান। ভেতরে আসো।”
সায়ন্তনীর মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আরাফকে দেখে তার চোখের পানি উপচে পড়লো। তিনি ভেতর থেকে একটা চাটাই এনে মাটিতে বিছিয়ে একটা ময়লা উড়না দিয়ে তা মুছে দিতে লাগলেন। আরাফ তাকে থামিয়ে বলল,
“আন্টি, আমি সায়ন্তনীর সাথে দেখা করতে এসেছি।”
সায়ন্তনীর নাম শুনে তার মায়ের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ তিনি আরাফের হাত ধরে বললেন,
“আমি কতো খুঁজেছি তোমাদের, জানো, বাবা? ছোট বাবু কোথায়? ও আসে নি?”
কথাটি বলেই সায়ন্তনীর মা এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ছোট বাবু!”
সায়ান বলল,
“ইমন ভাইজান! উনি আসবে না? আপা বলল, ভাইজান দেশের বাড়ি গেছে। এখনো কি আসে নি?”
আরাফ কোনো উত্তর দিতে পারলো না। সায়ন্তনীর মা বললেন,
“বাবুর কথা মেয়েটা সারাদিন বলে। হায়রে আমার মেয়েটা! আল্লাহ আমাদের এতো কষ্ট দেখাচ্ছেন কেন?”
কথাটি বলতে বলতেই তিনি কেঁদে দিলেন। সায়ান বলল,
“ভাইজান, আপা অনেক অসুস্থ। ডাক্তার বাবু বলেছেন, আপা আর ভালো হবে না। তুমি তো ডাক্তারি পড়ছো, তাই তোমার কলেজের ওখানে গিয়ে তোমাকে অনেক খুঁজেছি। আপার দোকানেও আসো না এখন। গেল এক সপ্তাহ ধরে আপা দোকানেও যায় নি। আমিই বসেছিলাম। কিন্তু তোমাদের কাউকে দেখি নি। ইমন ভাইজান দেশের বাড়ি থেকে কবে আসবে? আপা ভাইজানকে দেখলে অনেক খুশি হতো।”
আরাফের গলায় কথা আটকে গেছে। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে সায়ন্তনীর?”
“ডাক্তার বাবু বলল ক্যান্সার হয়েছে। এই রোগ নাকি ঠিক হয় না। অনেক টাকা লাগে।”
আরাফ আর শব্দ করতে পারলো না। এবার সায়ন্তনীর মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“বাবা, একটা টাকাও কেউ দেয় না। যাদের বাসায় ঝি’র কাজ করি, তাদের অনেক টাকা আছে। তবুও দেয় না। আমার মেয়েটা কি বাঁচবে না, বাবা?”
আরাফ বলল, “ও কোথায়?”
সায়ান বলল, “আপা ঘরে আছে।”
সায়ান তার হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলো। আরাফ সায়ন্তনীকে দেখে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সায়ন্তনী পাশ ফিরে আরাফকে দেখে মলিন হাসলো। আরাফ সায়ন্তনীর পাশে এসে বসলো। সায়ন্তনী ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“কেমন আছো, আরাফ?”
আরাফ কোনো উত্তর দিলো না। সে এখনো সায়ন্তনীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার সবকিছু খারাপ স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সায়ন্তনী মাথা তুলে বলল,
“আমি তো ভেবেছি কেউই আসবে না৷ আর তোমরা ছাড়া আমার কোনো ভালো বন্ধু হয় নি। এখন তোমাদেরও হারিয়ে ফেলেছি।”
আরাফ সায়ন্তনীর হাত ধরতে গিয়েও ধরলো না। সায়ন্তনী বলল,
“আল্লাহ, আমাকে পাপের শাস্তি দিচ্ছে। ইমনকে ভালোবেসে পাপ করে ফেলেছি হয়তো। আরাফ, নিজেকে খুব কলুষিত মনে হচ্ছে। নিজের উপরই নিজের বিরক্ত এসে গেছে। সারাদিন জ্বর, মাথা ব্যথা, কাঁশি। এতো রোগ কি ভালো লাগে, বলো? এখন মরে গেলেই এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো।”
আরাফ কোনো কথায় বলছে না। সায়ন্তনী আবার বলল,
“এই রোগ আল্লাহর নেয়ামত হয়ে এসেছে। আমি এতোদিন মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি চেয়েছি। আল্লাহ আমাকে শারীরিক কষ্ট দিয়ে মানসিক যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে।”
কথাগুলো বলতে বলতেই সায়ন্তনীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আরাফ পাশে পড়ে থাকা রিপোর্টগুলো দেখে বুঝলো, সায়ন্তনীর এখন লাস্ট স্টেজ। আরাফ বলল,
“এতোদিন ধরে তুমি অসুস্থ ছিলে, অথচ কাউকে জানাও নি!”
“আমি বুঝতে পারি নি, আরাফ। এতো বড় রোগ হবে ওটা কল্পনাও করি নি। আমি তো ভেবেছিলাম, অনেকদিন বাঁচবো। মা-ভাইয়ের জন্য আমার বাঁচা উচিত। এখন আমি মরে গেলে ওদের কে দেখবে?”
সায়ন্তনীর কথায় আরাফের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সায়ন্তনীর মা চাটাইয়ের উপর পান্তা ভাত মেখে ছেলেকে খেতে দিলেন৷ আরাফ বেরুতেই তিনি বললেন,
“বাবা, আজ ইদ। তুমি এসেছো অথচ তোমাকে কিছু খাওয়াতে পারছি না। ভাত ছাড়া বাড়িতে কিছু নেই। মেয়েটা অসুস্থ। ওকে দেখতে হচ্ছে, তাই বাজার-সদাই করতে পারি নি।”
এবার তিনি আঁচলের বাঁধন থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে দিয়ে বললেন,
“কিছু খেয়ে নিও। ইদে এসেছো, কিছু খেতে দিতে পারলাম না।”
আরাফ সায়ন্তনীর মায়ের মলিন হাসিটা দেখে টাকাটা নিয়ে বলল,
“ইদ মোবারক, আন্টি। এখন চলি।”
আরাফ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টাকাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। আর তার চোখ দুটি ছলছল করছে। অর্ধেক পথ যেতেই সে রাস্তায় বসে পড়লো। তার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। এদিকে ফোনে রিং বাজলো। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো আহনাফের কল। আরাফ কল ধরতেই আহনাফ বলল,
“কোথায় তুই? আসবি না?”
আরাফ ফুঁপিয়ে উঠলো। আহনাফের আশেপাশে মাওশিয়াত ও তার কাজিনরা বসে আছে। সে একপাশে এসে বলল,
“কি হয়েছে আরাফ?”
আরাফ ভেজা কণ্ঠে বলল,
“আমি অলক্ষুণে, আহু। অলক্ষুণে আমি।”
আরাফ কথাটি বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো। আহনাফ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তুই এখন কোথায়?”
আরাফ রোডের নাম বলতেই আহনাফ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লো। তূর্য ইভানকে বলল,
“আহনাফকে দেখে মনে হলো কিছু একটা হয়েছে। ও এভাবে হুট করে কোথায় গেলো?”
ইভান সাথে সাথেই আহনাফকে ফোন করলো। আহনাফ ফোন ধরতেই ইভান বলল,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
আহনাফ বলল,
“আমি তোদের পরে বলবো। আমি এখন রাখছি।”
আহনাফ রিক্সায় উঠে আরাফের বলা জায়গায় চলে গেলো। কাছাকাছি আসতেই রাস্তায় আরাফকে বসা দেখে আহনাফ ভয় পেয়ে গেলো। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দৌঁড়ে আরাফের কাছে গেলো। আরাফ আহনাফকে দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। আহনাফ তার পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল,
“কি হয়েছে বল? এভাবে কাঁদছিস কেন? আরাফ, কি হয়েছে, ভাই। বল না।”
আরাফ আহনাফের হাত ধরে বলল,
“মামা ঠিকই বলেছিল, আমি অলক্ষুণে।”
“হঠাৎ তোর মামার কথা কেন বলছিস?”
“জন্মের তিন বছর পর মাকে হারিয়ে ফেললাম। এরপর রুহানি, এরপর বাবা, আর আমার সম্পূর্ণ পরিবার, এখন সায়ন্তনীও। এভাবে কেউ সব হারায়? একটা মানুষই কেন সবকিছু হারাবে? তার জন্য কি কিছুই বাকি থাকা উচিত না?”
“সায়ন্তনীর কি হয়েছে?”
“ক্যান্সার।”
আহনাফ মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর আরাফকে উঠিয়ে বাসায় নিয়ে গেলো। তূর্য ফোন দিতেই আহনাফ বলল,
“আরাফের শরীর ভালো না। আমি ওর সাথে আছি।”
তূর্য বলল,
“কিছু একটা তো হয়েছে। বল কি হয়েছে।”
“আরাফ সায়ন্তনীর বাড়িতে গিয়েছিল। ওখানে গিয়ে জানলো, ও অসুস্থ। ওর ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ।”
তূর্য অবাক হয়ে বলল,
“কি বলছিস এসব? একমাস আগেও তো ও ঠিক ছিল।”
“ঠিক ছিল না। ঠিক থাকার চেষ্টা করতো। টাকার জন্য ডাক্তার দেখায় নি।”
“মেয়েটা কি পাগল! এটা কোনো কথা?”
“কি বলবো আর ভাই! এখন ওর চিকিৎসার জন্য টাকা লাগবে। আরাফ ওর সিনিয়রকে ফোন দিলো একটু আগে। বিকেলে সায়ন্তনীকে নিয়ে যেতে বলেছে। তারপর ট্রিটমেন্ট শুরু করবে।”
ইভান তূর্যকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? কার কথা বলছিস?”
তূর্য কল কেটে রাগী কন্ঠে বললো,
“তুই তো আর কথায় বলিস না।”
মাওশিয়াত বলল, “কি হয়েছে, তূর্য?”
“সায়ন্তনীর ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ চলছে। অথচ আমরা কেউই জানি না।”
ইমন কথাটি শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মাওশিয়াত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহমিদ বলল,
“আমাদের এখন ওখানে যাওয়া উচিত।”
সবাই চলে যাওয়ার পর মাওশিয়াতের মা এসে বললেন,
“কি হয়েছে মৌ। ওরা সবাই চলে গেল কেন?”
মাওশিয়াত তার মাকে সবটা খুলে বলতেই তিনি মাওশিয়াতকে সায়ন্তনীর বাসায় যেতে বললেন।
মির্জা বাড়িতে বড় বড় ইনভেস্টার আর ব্যবসায়ীদের ভীড়। মির্জা গ্রুপের এমডি সাহিল মির্জা ব্যবসায়ীদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করছে। সাহিল মির্জার বাবা, শাহেদ মির্জা গ্রুপের চেয়ারম্যান, তিনি সোফায় বসে ব্যবসায়ীক আলাপ-আলোচনা করছেন। তখনই সিঁড়ি দিয়ে হনহনিয়ে নেমে পড়লো তার কনিষ্ঠ কন্যা সানায়া মির্জা। মেয়েকে বের হতে দেখে তিনি বললেন,
“এই অসময়ে কোথায় যাচ্ছো?”
সানায়া বুকে হাত গুঁজে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো,
“আমি বাসায় কখন আসছি, কখন যাচ্ছি, এই বিষয়ে আপনি কবে থেকে প্রশ্ন করা শুরু করেছেন?”
শাহেদ মির্জা তার পাশে থাকা অতিথিদের দিকে এক নজর তাকিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বাবাকে উঠতে দেখে সাহিল অতিথিদের একপাশে বসতে বলে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। সানায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যেতে নেবে, তখন সাহিল তাকে বলল,
“তুই বাবাকে কি বলেছিস?”
সানায়া বলল,
“তা তুমি তোমার বাবার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করো।”
কথাটি বলেই ভাইয়ের হাত ছাড়িয়ে সানায়া ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। সাহিল সানায়াকে থামাতে যাবে তখনই একজন ইনভেস্টর তাদের সামনে এসে বলল,
“কি অবস্থা শাহেদ সাহেব?”
শাহেদ মির্জা বললেন,
“জ্বি, ভালো।”
“মিস্টার সাহিল তো এবার আপনার কোম্পানিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এবারের সেরা কোম্পানিগুলোর তালিকায় মির্জা গ্রুপের নাম প্রথমে।”
সাহিল কথাটি শুনে হাসলো। তখনই লোকটি আবার বলল,
“কিন্তু একটা সময় ছিল মৈত্রী গ্রুপের উপরে কোনো গ্রুপই ছিল না।”
শাহেদ মির্জা কথাটি শুনে অন্য প্রসঙ্গ তুলে বললেন,
“ওহ, আপনি ফাইভ নাইন প্রজেক্টের কাজটা দেখবেন না?”
তারপর তিনি সাহিলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“সাহিল, তুমি উনাকে আমাদের প্রজেক্টের কাজটা দেখিয়ে আনো।”
সাহিল লোকটাকে নিয়ে সামনে এগুতে লাগলো। লোকটা হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“সবাই জানে মৈত্রী গ্রুপের আসল শত্রু কে? কিন্তু যেদিন সেই ঘটনা প্রমাণিত হবে, মির্জা গ্রুপের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।”
সাহিল বলল,
“দেখুন মিস্টার। শত্রু আর খুনীর মধ্যে অনেক পার্থক্য। সব শত্রু খুনী হয় না, তবে সব খুনীরাই শত্রু হয়। এখন মির্জা গ্রুপকেই আলাদাভাবে টার্গেট করাটা ভালো দেখাচ্ছে না। আর যখন প্রমাণিত হওয়ার প্রশ্ন আসবে, তখন দ্বিতীয় প্রশ্নটা বরং আমিই করি।”
“কি প্রশ্ন!”
“মৈত্রী গ্রুপের আর কোন উত্তরাধিকারী জীবিত আছে যে সেই রাতটা আবার পুনরুদ্ধার করবে? সেই রাত এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। আর ইতিহাসে সাসপেন্স থাকা ভালো।”
এদিকে সানায়া গাড়ি নিয়ে তার বান্ধবী রাহির বাসায় চলে এলো। রাহি সানায়াকে দেখে বলল,
“এভাবে চলে এলি যে! ইদের জামাটাও পরে এলি না।”
সানায়া চেঁচিয়ে বললো,
“ইদ? আমার জন্য কোনো ইদ আসে নি। প্রতিবছর ইদের আগে টাকা দিয়ে বলবে যাও ইদের কেনাকাটা করে আসো। নিজে তো কখনো আমাকে শপিংয়ে নিয়ে যায় নি। আবার ইদের দিন কোনো ডাকাডাকি নেই। ঘর ভর্তি ওদের ফার্মের মোরগ-মুরগিদের ভীড় থাকবে। ভাইয়া আর মিস্টার মির্জা সেই ফার্মের মোরগদের নিয়েই এখন ব্যস্ত।”
রাহি সান্ত্বনার সুরে বলল,
“সানায়া, ঠান্ডা হয়ে বস। চল, আমার সাথেই ঘুরতে যাবি।”
“প্রতিবছর তোর সাথেই তো যাই।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। আগে কিছু খেয়ে নে। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।”
“না, খাবো না আমি। মিস্টার মির্জা কি একবারো আমি খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করেছে? তার তো ছেলে খেলেই চলবে। আমি তো তার কেউই না।”
সানায়া এসব বলতে বলতেই পা ধাপিয়ে কাঁদতে লাগলো। রাহি তাকে শান্ত করার জন্য তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আংকেল তোকে অনেক ভালোবাসে। আর মাঝে মাঝে বাবারা ভালোবাসা প্রকাশ করে না। কিন্তু সন্তানদের তা বুঝে নিতে হয়। সাহিল বলেছিল…”
সানায়া রাহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“সাহিল ভাইয়ার কথা আমাকে বলিস না।”
“এভাবে বলিস না। সাহিল তোকে অনেক ভালোবাসে।”
“প্লিজ, রাহি। তোর প্রেমিক তাই তুই ওর পক্ষ নিচ্ছিস। তুই বায়াস হতে পারিস। আমি না। আই হেইট দেম।”
রাহি চুপ করে বসে রইলো। সানায়া আবার বলল,
“তোর চোখে সমস্যা ছিল, নয়তো তোর পছন্দ তো এতোটাও খারাপ ছিল না।”
বেল বেজে উঠায় রাহি বসা থেকে উঠে বলল,
“তুই বসে থাক। আমি আসছি।”
রাহি দরজা খুলতেই সাহিলকে দেখে চমকে উঠলো। সাহিল দরজায় হেলান দিয়ে রাহির পা থেকে মাথা অব্ধি দেখে বলল,
“গর্জিয়াস। বিনা সাজেই যাকে এতো সুন্দর লাগে, মির্জা গ্রুপের এমডির ওয়াইফ হলে তাকে তো রাণির মতো লাগবে।”
রাহি কোনো উত্তর না দিয়ে সাহিলকে বাসায় ঢোকার জন্য দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। সাহিল ঘরে ঢুকেই বলল,
“সানায়া এখানেই এসেছে, তাই না?”
“হুম।”
“আংকেল-আন্টি কোথায়?”
“বাবা বাইরে গেছে চাচাদের সাথে। মা রান্নাঘরে আছেন, নাস্তা বানাচ্ছে।”
“দাদী কোথায়?”
“তোমার অপেক্ষায় বসে আছে।”
সাহিল দাদীর ঘরে চলে গেলো। দাদীর পাশে বসে গল্প জুড়িয়ে দিলো। সানায়া ভাইয়ের কন্ঠ শুনে বিড়বিড় করে বলল,
“উফ! মিস্টার মির্জার ফ্রি বডিগার্ড এখানেও চলে এসেছে।”
রাহি রুমে ঢোকার আগেই সানায়া দরজা আটকে রাহির বিছানায় শুয়ে পড়লো।
রাহি আর সানায়া ছোট বেলার বান্ধবী। আর সাহিল সানায়ার বড় ভাই। সাহিল, সাবা আর সানায়া শাহেদ মির্জার তিন সন্তান। তাদের মা মিসেস মির্জার স্বামীর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তিনি একই বাসায় থাকেন৷ পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে তারা তালাক নেন নি। মূলত সমস্যাটা মিস্টার শাহেদেরই ছিল। তিনি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তবে এখন আর সেই সম্পর্ক নেই। এরপর থেকেই সাবা আর সানায়া বাবাকে খুব অপছন্দ করে। তবে সাহিল খুবই বাবা-মা ভক্ত। তার বাবা তার মানসিক শক্তি, আর মা তার দুর্বলতা। সাহিল রাহিকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো। তবে রাহি যখন নবম শ্রেণিতে উঠেছিল, তখন এই সম্পর্কটা পুরোপুরি শুরু হয়৷ রাহির সাথে সম্পর্কে যাওয়ার পরই সাহিল মির্জা গ্রুপের এমডি নিযুক্ত হয়। সাহিল আর রাহির বয়সে পনেরো বছরের পার্থক্য৷ বর্তমানে রাহি আর সানায়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে৷
অন্যদিকে সাহিল সোজাসুজি কথাবার্তা বলতে পছন্দ করে, তাই রাহি যখন কলেজ পাশ করে ফেলল, তখনই সে রাহির পরিবারকে তাদের প্রেমের ব্যাপারে জানিয়ে দিলো। তবে মিডিয়ার কাছে রাহি সানায়ার বান্ধবী মাত্র। দুই পরিবারের সম্মতি থাকলেও তারা বিষয়টা এখনো কারো সামনেই প্রকাশ করে নি।
৬০.
জীবনটা যুদ্ধ ক্ষেত্র৷ এখানে টাকার জন্য যুদ্ধ করতে হয়। যার যতো টাকা, সে-ই জয়ী হয়।
তূর্য সেদিন তার জমানো টাকা দিয়ে সায়ন্তনীর মা, ভাই আর সায়ন্তনীকে জামা কিনে দিয়েছিল। আহনাফ আর ইভান নিজেরাই গিয়ে বাজার-সদাই করে সায়ন্তনীর বাড়িতে দিয়ে গিয়েছিল। শতাব্দী আর তাহমিদ তাদের বাসায় খাবার-দাবার রান্না করে পাঠিয়েছিল। আরাফ আর ইমন সায়ন্তনীকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ছুটাছুটি করেছে। মাওশিয়াত তার ক্লাসমেটদের নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে সায়ন্তনীর চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করেছে।
তিন মাস কেটে গেছে। চিকিৎসা চলছে, তাই হয়তো সায়ন্তনী এখনো বেঁচে আছে। আজ ডাক্তার বলে দিয়েছে, চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেই সে মারা যাবে। আর চালালে আল্লাহ যতোদিন তাকে বাঁচায়, তবে তার হাতে বেশিদিন সময় নেই।
সায়ন্তনী কেমোথেরাপি দেওয়ার পর হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। মাওশিয়াত তার পাশে এসে বসলো। সায়ন্তনী মাওশিয়াতের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“পৃথিবীতে সবাই সব পায় না। আমিও হয়তো এই জীবনে যা চেয়েছি, পাই নি। কিন্তু এখন আর আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কেন জানো?”
মাওশিয়াত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সায়ন্তনী বলল,
“অনেক ভালো বন্ধু পেয়েছি। যারা জীবনের শেষ মুহূর্তে আমার বন্ধু হয়েছে, তারাই প্রকৃত বন্ধু। আমার তোমাদের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।”
মাওশিয়াত ভেজা কণ্ঠে বলল,
“আই এম সরি। আমি তোমাকে অনেক অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছি।”
“ওসব আগের কথা। আমি সব ভুলে গেছি। এখন এতোটুকু জানি, আমার ভাই একটা বোনের পরিবর্তে তিনটা বোন পেয়েছে। আমার মা এক মেয়ের পরিবর্তে তিন তিনটা মেয়ে, আর ছ’টা ছেলে পেয়েছে। আমার মা আর ভাইকে তোমরা দেখবে তো?”
মাওশিয়াত মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”
এদিকে আরাফ শুকনো মুখে হাসপাতালে বসে আছে। অনেকদিন সে নিজের দিকেই তাকায় নি। তূর্য তার পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে সে আরাফকে এতোটা বিধ্বস্ত কখনোই দেখে নি। তূর্য আরাফের কাঁধে হাত রাখতেই আরাফের বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এখন শুধু নিশ্চুপ অপেক্ষায় দিন কাটছে। প্রতিটি সেকেন্ডই ভীতি নিয়ে আসছে, যদি এখনই কোনো খারাপ খবর আসে?
অন্যদিকে তাহমিদ এখন ক্রাচের উপর ভার দিয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারে না। ক্রাচের সাহায্যে হুইলচেয়ারে বসতে পারে। তাই এখন আর কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। থেরাপি দেওয়াতে অনেক লাভ হয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছে আরো দুই-একমাস পর পুরোপুরি হাঁটতে পারবে। শুধু নিয়মিত ওষুধটা খেতে হবে।
রাত দুইটা। ইমন জায়নামাজে বসে কাঁদছে। ইভান মেঝেতে বসে আছে। আর তাহমিদ তাদের পাশেই বসে রইলো। ইমন মোনাজাত শেষে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাই, ওর কিছু হবে না তো?”
ইভান কোনো উত্তর দিলো না। ইমন জায়নামাজে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে। কিন্তু আজ তার ইচ্ছেটা যেন পূর্ণ হওয়ার নয়। হঠাৎ সায়ন্তনীর শরীর বেশি খারাপ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। আরাফ, তূর্য আর আহনাফ সেখানেই গিয়েছে। রাত আড়াইটায় আহনাফ বাসায় ফোন দিলো। ইমন ফোনের শব্দ শুনেই সব বুঝে গেলো। সে জায়নামাজে বসেই কেঁদে দিল। ইভান কাঁপা হাতে ফোনটা হাতে নিয়ে তাহমিদের দিকে এগিয়ে দিলো। তাহমিদ রিসিভ করতেই আহনাফ বলল,
“সায়ন্তনী আর নেই। তাহমিদ, আমরা আরাফকে সামলাতে পারছি না। ও এভাবে কাঁদছে কেন ভাই? কি করবো এখন?”
তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আর বলল,
“ওকে হাসপাতাল থেকে কখন আনবি?”
“একটু পর। এখানেই দাফন করাবে ফজরের নামাজের পর।”
“আমরা আসছি।”
ফোন রেখেই তাহমিদ বলল,
“সায়ন্তনীকে ফজরের নামাজের পর দাফন করাবে।”
তাহমিদ শতাব্দীকে মেসেজ দিয়েই অরুণিকাকে ঘুম থেকে উঠালো। তারপর সবাই সায়ন্তনীদের বাড়িতে গেল। আশেপাশে অনেক মহিলা এসে ভীড় জমিয়েছে। মাওশিয়াত জানার পর সায়ন্তনীদের বাসায় আসার জন্য অনেক কান্নাকাটি করছিল। শেষমেশ মাওশিয়াতের মা তার সাথেই এলেন৷ সায়ন্তনীকে বাড়িতে ঢুকানো হলো। আরাফ একপাশে বসে কাঁদছে। আহনাফ তার পাশে বসতেই সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি ওকে বলতেই পারলাম না, যে আমার ওকে ভালো লাগে। আমি ওকে আমার অনুভূতির কথাটাই জানাতে পারি নি। এখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আহু।”
আহনাফ আরাফকে জড়িয়ে ধরলো। তূর্যও আরাফের মাথায় হাত রাখলো। তার মনে পড়ে গেলো রুহানির মৃত্যুর কথা।
সেদিন রুহানি আরাফের সাথে প্রতিদিনের মতো মাঠে ফুটবল খেলছিল। রুহানির ফুটবল খেলতে খুব ভালো লাগতো। তারা খেলা শেষে মাঠের একপাশে এসে দাঁড়ালো। তখনই দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক যুবক, তাদের দেখে মাঠে এলো। এরপর তারা রুহানিকে আরাফের সামনেই টেনে নিয়ে গেল। আরাফ তাদের আটকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় আরাফ তাদের সাথে পেরে উঠতে পারে নি। তারা এক ধাক্কায় আরাফকে দূরে সরিয়ে দিলো। এরপর পাশের একটা নির্মাণরত বাড়ির তিনতলায় নিয়ে গিয়ে রুহানিকে ধর্ষণ করলো। আরাফ তাদের আটকানোর জন্য আশেপাশের অনেকজনকে ডাকলো। কিন্তু কেউই এগিয়ে এলো না। আরাফ তখন নিজেই গেলো। কিন্তু রুহানির অবস্থা দেখে সে নিজেও আর তাদের আটকানোর সাহস পেলো না৷ সে অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এরপর সেই অবস্থায় সে একটা গাড়ি নিয়ে বাসায় এসে বাবা-চাচাদের জানালো। তারা পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে শুধু রুহানিকেই পেলো। সেই ছেলে দুইটাকে আর পেলো না। এরপর রুহানিকে হাসপাতালে ভর্তি করার চারদিন পর সে মারা গেল। পরে অবশ্য সেই ছেলে দুইটাকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে আরাফ নিজেকে রুহানির অপরাধী ভেবে এসেছে। আরাফ এতোটা বছর রুহানিকে মনপ্রাণ দিয়েই ভালোবেসেছিল। আর এখন দ্বিতীয় বারও কাউকে ভালোবেসে হারিয়েছে।
জীবনে সবাই সবকিছু পায় না। আর এই না পাওয়ার মাঝেই জীবনের সমাপ্তি ঘটে যায়। জীবনে আক্ষেপ রেখে লাভ নেই, কারণ সৃষ্টিকর্তা হয়তো সেই আক্ষেপের মাঝেই কোনো মুক্তি রেখেছেন। দিনশেষে মুক্তিটাই আক্ষেপের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অভাগী সায়ন্তনী তার দুর্ভাগ্য নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। আর এই জীবনসংগ্রাম থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়েছে। তার গুরুত্বটাও মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেছে।
চলবে–
(💜কালকে পরশু দুইদিন বোনাস পর্ব আসবে। )