অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||বোনাস পর্ব||

0
1069

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৮২.
দুই মাস পর, উপমা আর তূর্যের বিয়ে উপলক্ষে ছ’জনই অরুণিকাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। তাদের সাথে মাওশিয়াত আর তার বাবা-মাও এসেছে। আদিল আগে থেকেই তাদের থাকার জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। তার এক বন্ধুর মামার ফ্ল্যাট খালি ছিল। এখন সবাই সেখানেই উঠেছে।

আগামীকাল সন্ধ্যায় এনগেজমেন্ট। উপমা তার বান্ধবীদের ফোন করে জানাচ্ছে, তার রিকির সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে। কিন্তু তার বান্ধবীরা কোনোভাবেই তার কথা বিশ্বাস করছে না। উপমা সবাইকে একটা কথায় বলছে,
“আগে দেখা করিস, তারপর আমার স্টার তোদের সব কনফিউশান দূর করে দেবে।”

পরের দিন থেকেই আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। আর উপমা জানালার গ্রিল ধরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আদিল বোনের কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কি রে, মন খারাপ কেন? তোর প্রিয় স্টারের সাথেই তো তোর বিয়ে হচ্ছে।”

উপমা মলিন মুখে বললো,
“ভাইয়া, এই বর্ষায় বিয়েটা না রাখলে হতো না? মানুষ শীতের সময় বিয়ে করে। আর তোমরা বর্ষায় বিয়ের অনুষ্ঠান রেখেছো। দেখো, আজ নিশ্চিত বৃষ্টি নামবে। আর এই বৃষ্টি এক সপ্তাহ ধরে থাকবে।”

“থাক, সবাই শীতে বিয়ে করে, আর আমার বোন বর্ষায় করবে। চিন্তা করিস না, তোর বিয়েটা অনেক স্পেশাল হবে। আমি তোর জন্য এই দিনগুলো স্পেশাল বানিয়ে দেবো। দেখবি, তখন বর্ষা আসলেই আমার কথা মনে পড়বে।”

উপমা ভেজা কণ্ঠে বলল,
“বর্ষা কেন, আমার তো প্রতি ঋতুতেই তোমার কথা মনে পড়বে।”

আদিল বোনকে জড়িয়ে ধরলো। আদিলের খুব কান্না পাচ্ছে। একটা মাত্র বোন তার! বিয়ে দিয়ে দিলে ঘরটা খালি হয়ে যাবে।

এদিকে সন্ধ্যায় সব অতিথিরা চলে এসেছে। ছেলেপক্ষের সবাই উপস্থিত হওয়ার পর তূর্যকে ঘিরে উপমার বান্ধবীদের ভীড় জমলো। সেই হাত, সেই চুল, তাহলে কি উপমা সত্যি কথায় বলেছিল? এটাই ‘রিকি দা স্টার?’ কিন্তু এভাবে বিশ্বাস করা তো সম্ভব না। তাই সবাই তূর্যকে গান গাওয়ার অনুরোধ করতে লাগলো। কিন্তু এতো সহজে তূর্য আজ গান গাইবে না। সে বলল, অন্যদিন শুনাবে। আদিল তূর্যকে উপমার বান্ধবীদের ভীড় থেকে বের করে সোফায় বসালো। কিছুক্ষণ পর মিসেস জুলেখা উপমাকে একটা সোনালি রঙের শাড়ি পরিয়ে নিয়ে এলেন। তারপর তিনি উপমাকে তূর্যের পাশে বসিয়ে দিলেন৷ উপমা লজ্জায় তূর্যের দিকে তাকাতে পারছে না। তূর্যের মাখা সেই পরিচিত সুগন্ধির ঘ্রাণটা তার নাকে এলো। উপমার কেমন যেন মাতাল মাতাল লাগছে। তার মনের মধ্যে উত্তাল ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, রিকির সাথেই তার বিয়ে হতে যাচ্ছে। রিং পরানোর পর অরুণিকা উপমার হাত ধরে বলল,
“আজ থেকে তুমি আমার সুইট স্টার। ঠিক আছে?”

উপমা মুচকি হেসে অরুণিকার থুতনি ধরে বলল,
“আর তুমি আমার মুনলিট।”

অরুণিকা গালে হাত দিয়ে বলল,
“ওয়াও, আমার নামটা খুব পছন্দ হয়েছে।”

করিম সিদ্দিক মাওশিয়াতের বাবাকে বললেন,
“বেয়াই সাহেব, ভাবছি আমরা দুইদিন পর আক্দ অনুষ্ঠানটা করবো। তারপর এক সপ্তাহ পর মেয়েকে উঠিয়ে দেবো।”

মিরাজ হাসান বললেন,
“জ্বি, যেটাতে আপনাদের সুবিধা।”

রাতে বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগলো। অরুণিকা জানালার বাইরে হাত বের করে দিয়ে বৃষ্টির স্পর্শ অনুভব করছে। তখনই আহনাফ তার পাশে এসে দাঁড়ালো। সে বুকে হাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা আহনাফকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি এভাবে ভ্যাবলা কান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

আহনাফ ধীর কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে একটুও সম্মান করো না।”

“আমি আবার কখন অসম্মান করলাম?”

“এই যে এখন ভ্যাবলা কান্ত বললে! এটা অসম্মান না?”

“ওটা তো এমনিতেই বলেছি।”

“সবাইকে তুমি কতো সুন্দর করে সম্বোধন করো। আমার সাথে তোমার কি সমস্যা? অরু, বলো না, আমার সাথে কেন এমন করো?”

অরুণিকা কিছু না বলে চলে যেতে নিবে তখনই আহনাফ তার হাত ধরে বলল,
“দাঁড়াও আমার পাশে।”

“না, দাঁড়াবো না।”

কথাটি বলেই অরুণিকা আহনাফের হাত ছাড়িয়ে চলে গেলো। অরুণিকা যাওয়ার পর আহনাফ জানালার বাইরে বৃষ্টিস্নাত শহরকে দেখতে লাগলো। তার মনটা আজ অশান্ত। এই মুহূর্তে তার কিছুই ভালো লাগছে না। অরুণিকাকে সে কিভাবে নিজের করে পাবে, সেটাই ভাবছে। জোর করে কি ভালোবাসা পাওয়া যায়? সে তো তার পিচ্ছি অরুকে ভালোবেসে ফেলেছে। এখন অরুণিকা বড় হয়ে যদি তাকে ভালোবাসতে না পারে? এখনই এমন খিটখিটে ভাব দেখায়, বড় হলে হয়তো সহ্যই করতে পারবে না। আহনাফ শক্ত করে জানালার গ্রিল আঁকড়ে ধরলো। তার গলা ভারী হয়ে আসছে। ভেজা কন্ঠে সে দু’টো শব্দ বের করল শুধু,
“ভালোবাসি অরু।”

সকালে ইভান রাস্তায় বের হয়ে দেখলো পানি জমে পুরো রাস্তা ভরে গেছে। প্যান্ট ভাঁজ করে সে পানিতে নেমে পড়লো। একটু বৃষ্টিতেই শহরের এই রূপ তার চির পরিচিত। ছোট ছোট বাচ্চারা পানিতে ধাপাধাপি করছে। কাল রাতে আহনাফের জ্বর উঠেছিল। তাই এই মুহূর্তে তার জন্য ওষুধ কিনতেই সে ফার্মেসিতে যাচ্ছে। মেইন রোডে আসতেই একটা গাড়ি জোরে তার সামনে দিয়ে চলে গেলো। আর রাস্তার সব পানি তাকে সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। ইভান সেখানেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমত ড্রেনের পানি রাস্তার পানির সাথে মিশে গেছে, দ্বিতীয়ত সেই পানিগুলোই তার মুখে এসে পড়েছে।

এদিকে গাড়িটা কিছুদূর গিয়ে থামলো। তারপর আবার পেছনে এসে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। তারপর গাড়ির গ্লাস নামিয়ে একটা মেয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“সরি সরি সরি, আমি আপনাকে দেখি নি। আচ্ছা, এই নিন টিস্যু। সব ময়লা পানি আপনার মুখে এসে পড়েছে। আসলে কিছু বদমাশ লোক আমার পিছু করছিলো, তাই হুড়োহুড়িতে খেয়াল করি নি।”

ইভান পরিচিত কন্ঠ শুনে চোখ খুলে দেখলো, এটা তো সেই মেয়েটাই। ইভান এক ঝটকায় টিস্যুটা টেনে নিয়ে মুখটা মুছে গাড়ির জানালায় ভর দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বদমাশ লোকগুলো এখনো আপনার পিছু ছাড়ে নি? নাকি জন্মের পর থেকেই আপনার পিছু নিচ্ছিলো?”

সানায়া হাঁ করে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি? আপনি, সেই লোকটা?”

“জ্বি, আমিই সেই ব্যাক্তি যার গায়ে আপনি কখনো পানি ঢেলে দেন, কখনো রিকশা থেকে ফেলে দেন, আবার এখন একেবারে গোসল করিয়ে দিয়েছেন।”

সানায়া গাড়ির দরজা খুলে নামতে গিয়ে রাস্তায় পানি দেখে আর নামলো না। ইভান হনহনিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো। ইভানের এমন অবস্থা দেখে সানায়ার খুব খারাপ লাগলো। সে গাড়িটা একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে গাড়ির অন্য দরজা খুলে উঁচু রাস্তায় উঠে দাঁড়ালো। তারপর ইভানের পিছু এসে বলল,
“সরি, আপনি আমার উপর রাগ করেছেন?”

ইভান রাগী দৃষ্টিতে সানায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্লিজ এখান থেকে যান। নয়তো আপনাকে সেই বদমাশ লোকগুলো উঠিয়ে নিয়ে যাবে।”

“আচ্ছা, আগে আমার কথাটা তো শুনুন। দেখুন একবার আমার কথা শুনলে আপনার নিশ্চিত আমার উপর মায়া হবে।”

“আমি কারো মায়ায় পড়ি না।”

কথাটা বলেই ইভান হাঁটা শুরু করলে সানায়া তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কেন? আপনি কি মানুষ না?”

“মানে?”

“মানুষ মানেই মায়ায় পড়বে। মানুষের মন আছে, মানুষ মহৎ হয়। সবগুলো শব্দই ম দিয়ে, তাই তাদের অন্যের সমস্যার কথা শুনলে মায়া লাগবে, স্বাভাবিক!”

“আমার এতো সময় নেই যে যার-তার সমস্যার কথা শুনে মায়া বাড়াবো!”

ইভান কথাটি বলেই চলে যাবে তখনই সানায়া চেঁচিয়ে বললো,
“আমাকে এ্যাটিটিউড দেখাচ্ছে! হুহ।”

ইভান পেছন ফিরে একনজর সানায়ার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। সানায়াও সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িতে গিয়ে বসলো। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“সব পুরুষ মানুষের একটাই সমস্যা, নিজেদের মহামানব মনে করে।”

৮৩.

তিন কবুল বলেই তূর্য আর উপমার আক্দ সম্পন্ন হলো। আক্দ হওয়ার পর তাদের পাশাপাশি বসানো হলো। আর তূর্যকে ঘিরে বসে রইলো উপমার বান্ধবীরা। তাদের মধ্যে একজন বলল,
“ভাইয়া, আপনি তো অনেক ভালো গান করেন, একটা গান শুনাবেন?”

আরেকজন বলল,
“হ্যাঁ, আপনার ভালোবাসার মানুষটার জন্য না হয় গান করেন। সে হয়তো আপনার গান শুনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে।”

তূর্যকে পাশের বাসার ভাড়াটিয়ার ছেলের গিটার এনে দেওয়া হলো। সে গিটারটিতে সুর তুলে কন্ঠে গান ধরলো,

“কারণে-অকারণে, নিষেধে বা বারণে,
তোমার নামেই যত জোছনা নিলাম,
নিয়মে-অনিয়মে, দহনে বা ধারণে,
আমায় নিখোঁজ ভাবো বাঁ পাশেই ছিলাম।
.
চোখে জল নোনা কি? নিয়ে গেল জোনাকি
কেন আমি পথে একা দাঁড়িয়ে?
আলোদের পিয়নে, সোডিয়াম নিয়নে যেন
সবই কোথায় হারিয়ে…
.
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি, তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে.. তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
আমি তোমার স্বপ্নে বাঁচি, তোমার স্বপ্নে পুড়ে যাই
এমন সাধের পৃথিবীতে..তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
পুরোটাই…”

উপমা অবাক হয়ে তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বুকের মাঝে হঠাৎ একটা পাথর চেপে বসেছে। সে শুনেছিল, ভালোবাসার মানুষ চোখের দিকে তাকিয়ে গান করে। কিন্তু তূর্য একটিবারের জন্যও তার দিকে তাকালো না। তূর্যের চোখ কখনো অরুণিকার দিকে, কখনো বা উপমার বান্ধবীদের দিকে, কখনো বা নিচের দিকে যাচ্ছে। গান শেষ হওয়ার পর উপমার এক বান্ধবী তার কাছে এসে বলল,
“তুই অনেক ভাগ্যবতী রে, তোর ক্রাশের সাথেই তোর বিয়ে হয়েছে। তাও আবার যেমন তেমন ক্রাশ নয়, একেবারে সেলেব্রিটি ক্রাশ! ভাইয়াকে চোখে চোখে রাখিস কিন্তু। যেমন হ্যান্ডসাম, তেমনি চমৎকার তার কন্ঠ, তার উপর আবার সে সেলেব্রিটি মানুষ। এসব সেলেব্রিটিদের সংসার বেশিদিন টিকে না।”

উপমা ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“ও আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না।”

এদিকে অরুণিকা তূর্যের পাশে বসে ছবি উঠাচ্ছে। তূর্য একবারও ক্যামেরা ম্যানকে বলছে না, উপমার সাথে তার ছবি উঠিয়ে দিতে। উপমা তাই মন খারাপ করে বসে আছে। এদিকে রাতে তূর্যও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। এক সপ্তাহ পর সে উপমাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। তবে এর মধ্যে তূর্য একবারো উপমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে দেখায় নি। উপমাও তূর্যকে বিরক্ত করে নি।

পাঁচদিন পর আকাশে রোদ উঠেছে। আরাফ অরুণিকাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা মেয়ে দৌঁড়ে তার কাছে এসে বলল,
“ভাইয়া একটা সাহায্য করবেন?”

আরাফ মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটির চোখেমুখে ভীতি।
পরিবেশ ঠান্ডা। কয়েকদিন বৃষ্টি পড়েছিল, তাই মিষ্টি রোদ উঠলেও ঠান্ডা বাতাস বইছে। তবে এর মধ্যেও মেয়েটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অরুণিকা বলল,
“কি হয়েছে তোমার?”

মেয়েটা কাঁপা কন্ঠে আরাফকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“কিছু লোক আমার পিছু নিচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরেই আমাকে ফলো করছে। আমি একটা কল করতে পারবো? আসলে আমার ফোনটা বাসায় রেখে এসেছি।”

আরাফ তার ফোন এগিয়ে দিতেই মেয়েটা একটা নম্বরে কল দিয়ে বলল,
“সাহিল, কোথায় তুমি?”

ওপাশ থেকে সাহিল বলল,
“রাহি! তুমি এটা কার নম্বর থেকে ফোন করেছো?”

“রাস্তায় একজনকে পেয়েছি, সেখান থেকেই কল করেছি।”

“তুমি জানো আমি কে? আমি সাহিল মির্জা। তুমি যে কারো কাছ থেকে ফোন নিয়ে আমাকে ফোন করতে পারবে না। তোমার ফোন কোথায়?”

রাহি রাগী কন্ঠে বললো,
“সরি সাহিল মির্জা, ভুল হয়ে গেছে আমার। তবে একটা কথা জানিয়ে দেই, আপনার কর্মকান্ডের ফলস্বরূপ আমাকে এখন রাস্তায় নিজেকে বাঁচানোর জন্য অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে। থাক, আপনার এখানে আসতে হবে না। আপনার তো সময় নষ্ট হবে। আমি না হয় অন্য কারো সাহায্য নেবো।”

কথাটা বলেই রাহি কল কেটে দিয়ে নম্বরটি ডিলিট করে দিলো। আর সাথে সাথেই সাহিলের কল এলো। রাহি কল রিসিভ করেই বলল,
“কেন ফোন দিয়েছ?”

“কোথায় তুমি?”

“জাহান্নামে।”

সাহিল চেঁচিয়ে বলল, “কোথায় তাড়াতাড়ি বলো?”

রাহি ঠিকানা বলতেই সাহিল দশ মিনিটের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে হাজির হলো, সাথে আরো দুইটা গাড়ি এসেছে। আরাফ এতোক্ষণ রাহির সাথেই দাঁড়িয়ে ছিল। সাহিলকে দেখে রাহি দৌঁড়ে যেতেই আরাফ হাঁটা শুরু করলো। সে অরুণিকাকে নিজের সামনে এনে পেছন ফিরে সাহিলের দিকে তাকালো। অরুণিকা ব্যথায় বলে উঠলো,
“আহ! আরাফ, তুমি এতো শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরেছো কেন?”

আরাফ সাথে সাথেই হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ওহ সরি। খেয়াল করি নি।”

তারপর আরেকবার সে পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো সাহিল মির্জা তার বডিগার্ড নিয়ে গাড়িতে উঠে গেছে। আরাফ গাড়িগুলোর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“শাহেদ মির্জা আমাদের পরিচয় কেঁড়ে নিয়ে, নিজের ছেলেকে উপরে উঠিয়ে দিয়েছে। এই অন্যায়ের প্রতিশোধ তো একদিন নিবোই, মির্জা সাহেব। আজ মির্জা গ্রুপের এমডির সাথে দেখা হয়ে গেলো, কাল আপনার সাথে দেখা হবে।”

দুই সপ্তাহ পর তূর্য আর উপমার বিয়ের দিনটি চলে এলো। উপমা বউ সেজে স্টেজে বসে আছে। বর পক্ষ আসার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু বর এখনো আসছে না। বিয়ে বাড়িতে সবার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। উপমার বান্ধবীরা বলাবলি করছে,
“স্টার হয়তো বউ রেখে পালিয়েছে।”

আদিল বার-বার ফোন দিচ্ছে তূর্যকে, কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। বাকিদের ফোনেও কল যাচ্ছে না। আদিল বোনের দিকে একনজর তাকিয়ে ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেলো। গাড়ি নিয়ে সে সোজা তূর্যরা যেই বাসায় উঠেছিল, সেখানে গেল। গিয়ে দেখলো দরজা খোলা, আর পুরো ঘর এলোমেলো। আদিল ঘর থেকে বের হতেই পেছন থেকে কেউ একজন তার পিঠে ছুরি ঠেকালো। আদিল পিছু ফিরতেই মুখোশধারী লোকটা তার একপাশে ছুরিকাঘাত করলো। আদিল সাথে সাথেই ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেলো।

এদিকে তূর্য আর আরাফ ক্লাবে এসেছে। বাকিরা কেউ আসে নি। তূর্য ক্লাবে আসতেই সবাই তাকে বরণ করে নিলো। কিন্তু তূর্য আর আরাফের চোখে-মুখে আতংক। তারা ক্লাবে ঢুকেই সোজা করিম সিদ্দিকের কাছে চলে গেলো। আর তূর্য বলল,
“আংকেল, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। আমাদের এখনই কলকাতায় ফিরে যেতে হবে। আপনি উপমাকে বিদায় করে দিন।”

“কি বলছো এসব? এভাবে হুট করে বিদায়?”

“প্লিজ আংকেল, আমরা এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না।”

তূর্য স্টেজে উঠে উপমার হাত ধরে তাকে স্টেজ থেকে নামালো। এদিকে করিম সিদ্দিক আদিলকে ফোন করছেন। অনেকবার কল হওয়ার পর ওপাশ থেকে আদিল কল রিসিভ করে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“বাবা, আমি তূর্যদের ফ্ল্যাটে এসেছিলাম। কেউ একজন আমার কাঁধে ছুরি চালিয়েছে। অনেক রক্ত যাচ্ছে। আমাকে এখান থেকে নিতে আসো৷ সাথে পুলিশও নিয়ে আসো।”

করিম সিদ্দিক ছেলের এমন কথা শুনে হিতাহিতজ্ঞান হারালেন। তূর্য আর আরাফ আদিলের উপর আক্রমণ হয়েছে শুনে আরো চিন্তায় পড়ে গেলো। তারা সবাই তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাটে গেলো। এরপর আদিলকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করালো। সেখান থেকেই তূর্য উপমাকে বাসায় নিয়ে গেলো। উপমা শাড়ি পরিবর্তন করে তার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। তূর্য এরপর তাকে নিয়ে স্টেশনে চলে এলো। উপমা যদিও ভাইকে এই অবস্থায় ফেলে যেতে চাচ্ছিল না। কিন্তু বাবা-মার চুপচাপ হয়ে থাকা, আর তূর্যের জোরাজুরিতে সে কলকাতায় যেতে বাধ্য হলো। আর এদিকে ডাক্তারও বলেছে, আদিল এখন ঠিক আছে। ক্ষত এতো বেশি গভীর ছিল না। তাই উপমাকে হাসপাতাল থেকে বের করানো গেলো। নয়তো তূর্য টেনে নিয়ে আসতে চাইলেও সে আসতো না।

বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে উপমা। তার হাতে মেহেদি, মুখে এখনো বিয়ের সাজ। শুধু বিয়ের শাড়িটাই পরিবর্তন করে একটা সাধারণ জামা পরেছে। তার পাশে তূর্য স্থির হয়ে বসে আছে। তূর্য ও তার বন্ধুদের থমথমে চেহারা দেখে সে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। তার জীবন এমন জায়গায় মোড় ঘুরিয়েছে, সে এর কোনো শেষ খুঁজে পাচ্ছে না। তার মাথায় হাজারো প্রশ্ন। একদিকে আজ তার বিয়ে, আর তার বর বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তাকে স্টেজ থেকে নামিয়ে তার সাথে অজানা পরিবেশে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে তার ভাইয়ের উপর হামলা হয়েছে, অথচ সে তার পাশে থাকতে পারছে না। এভাবে তো কারো বিয়ে হয় না। জীবনে সে এমন বিয়ে হতেও দেখে নি। তার এই চমৎকার দিনটা আজ নষ্ট হয়ে গেলো।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here