#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৭||
৯৪.
রাত দশটায় অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হলে আরাফ স্টেজে উঠে উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আজ আমাদের বন্ধু তার ভালোবাসার মানুষের সাথে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। আজকের এই দিনটি আরো বেশি মনে রাখার জন্য আমরা আরেকটা সুসংবাদ আপনাদের দিতে যাচ্ছি। আর হবে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান।”
সবাই আরাফের দিকে আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আরাফের ইশারায় আহনাফ স্টেজে উঠে তার পাশে দাঁড়ালো। আর তাহমিদ অরুণিকার হাত ধরে তাকে স্টেজে উঠলো। অরুণিকা ফিসফিসিয়ে তাহমিদকে বলল,
“তাহমিদ, আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দেবে নাকি? আমি তো এখনো কোনো প্ল্যানই করি নি৷ এভাবে আমি বিয়ে করবো না।”
অরুণিকা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহমিদ হাতের ইশারায় অরুণিকাকে চুপ করে থাকতে বললো। এবার আরাফ দুইটা রিং পকেট থেকে বের করে একটা আহনাফের হাতে দিলো, আরেকটা অরুণিকার হাতে দিলো। তারপর বলল,
“আগামী মাসে মাওশিয়াতকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ে আসার পর আমাদের অরু আর আহনাফের বিয়ের আয়োজন হবে। তবে আজই তাদের এনগেজমেন্টটা রেখেছি। এটাই ছিল আজকের সারপ্রাইজ।”
অরুণিকা আর আহনাফ মুখোমুখি দাঁড়ালো৷ অরুণিকা হাত এগিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“আমি আমার বিয়ে নিয়ে কতো প্ল্যান করেছিলাম। ভেবেছি, আমার এনগেজমেন্ট ঝর্ণার পাশে হবে, আর তোমরা ভূতের বাড়িতেই আমার এনগেজমেন্ট রেখেছো।”
আহনাফ আড়চোখে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ মুচকি হেসে তাড়াতাড়ি রিং পরিয়ে দেওয়ার জন্য ইশারা করলো। আহনাফ রিং পরিয়ে দেওয়ার পর অরুণিকা আহনাফের আঙ্গুল ধরে বলল,
“এক শর্তে আমি তোমাকে রিং পরাবো।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোমার সব ব্যাপারে এতো শর্ত কেন থাকে?”
আরাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“অরু, সবাই দেখে আছে। তাড়াতাড়ি রিং পরিয়ে দাও।”
অরুণিকা বলল,
“আগে ওকে বলো, আমার শর্ত মেনে নিতে।”
আহনাফ দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা, তোমার সব শর্ত পূরণ করবো।”
অরুণিকা হেসে বলল,
“আমাকে বাইকে করে পুরো চট্টগ্রাম শহরে ঘুরাতে হবে, আর আমি সেদিন যা ইচ্ছে করবো, তুমি আমাকে একটুও বকা দিতে পারবে না।”
আহনাফ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে, এটা কোনো শর্ত হলো? আমি এই সপ্তাহেই তোমাকে নিয়ে ঘুরার প্ল্যান করবো। এখন আল্লাহর ওয়াস্তে রিং-টা তো পরিয়ে দাও।”
অরুণিকা রিং পরাতে পরাতে বলল,
“রিং পরার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছে।”
আহনাফ চোখ ছোট করে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। পরেরদিন সকালে কলিং বেল বাজতেই উপমা এসে দরজা খুলে দিলো। দেখলো বাড়ির দারোয়ান এসেছে। উপমা বলল,
“রহিম, তুমি এতো সকাল সকাল? কিছু লাগবে?”
“আপামণি, কে একজন এসেছে। স্যারদের খুঁজছে। ছোট মেডামকেও দেখতে চাচ্ছে।”
“কি নাম?”
“নাম বললো, রহমতুল্লাহ।”
“আরেহ উনি? আমি তোমার স্যারকে ডাকছি। উনি অনুমতি দিলে ঢুকতে দিও।”
উপমা তূর্যকে বলতেই তূর্য ইমনকে ডেকে ঘুম থেকে উঠালো। ইমন শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে বলল,
“আমি উনার সাথে কথা বলছি। তুই বাকিদের আসতে বল।”
এবার নিচে নেমে ইমন রহমতুল্লাহকে বাসায় আনলো। আর সোফায় বসতে বলল। রহমতুল্লাহ বললেন,
“বড় হয়ে আমাকে একেবারে ভুলে গেছো।”
ইমন মুচকি হেসে বলল,
“ভুলে যাই নি। আপনাকে তো ভুলে যাওয়া সম্ভব না৷ শুধু ব্যস্ততার চাপে সময় পাচ্ছি না।”
“চার বছর হয়ে গেছে বাংলাদেশে এসেছো। এখানে আসার পর কোনো যোগাযোগ রাখো নি৷ তোমাদের নম্বরও ছিল না, বাসার ঠিকানাও জানতাম না। তাই মাঝে মাঝে তোমাদের অফিসে চলে যেতাম। ওখানেও দেখা পাই নি। এরপর আরাফের চেম্বারে গিয়েছিলাম। ও ব্যস্ততা দেখিয়ে সরে গেলো। তোমরা এভাবে মুখ ফিরিয়ে না নিলেও তো পারতে। আমি গরিব মানুষ বলে কি তোমাদের কাছে টাকা খুঁজতে আসতাম?”
ইমন বলল,
“এখন ঠিকানা কিভাবে পেয়েছেন?”
“তোমাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে জানতে পেরেছি তোমরা এই এলাকায় থাকো। তারপর সব বাড়ি ঘুরে টুইংকেল হাউজ দেখেই বুঝে ফেলেছি, এটাই তোমাদের বাড়ি।”
এদিকে বাকিরাও নিচে নামলো। তূর্য বলল,
“তা আপনার কি অবস্থা?”
রহমতুল্লাহ বললেন,
“ভালোই আছি। তোমরা শুধু এই গরিবের কোনো খবর নাও না।”
তাহমিদ হেসে বলল,
“আপনি আবার গরিব হলেন কখন? ভালোই তো আমাদের পড়াশুনার খরচ চালিয়েছেন। সামর্থ্য নেই, তবুও মাস শেষে আমাদের অনেক টাকা পাঠিয়েছিলেন। আপনার ঋণ তো শোধ করা সম্ভব না।”
রহমতুল্লাহ হালকা হাসলেন। আরাফ বলল,
“তা আপনার কার কার সাথে উঠাবসা হয়?”
রহমতুল্লাহ আরাফের প্রশ্নে চমকে উঠলেন। তখনই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে পড়লো অরুণিকা। অরুণিকার শব্দ পেয়ে রহমতুল্লাহ বললেন,
“আমাদের ছোট্ট সোনামণি!”
অরুণিকা বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে রহমতুল্লাহকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। তিনি হাতের ইশারায় অরুণিকাকে ডাকলেন। অরুণিকা তার সামনে এসে দাঁড়ালো৷ রহমতুল্লাহ মুগ্ধ হয়ে অরুণিকাকে দেখে বললেন,
“মাশাল্লাহ অনেক বড় হয়ে গেছো। তোমাকে যখন দেখেছিলাম, চার বছরের ছিলে।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তাহলে আমাকে কিভাবে চিনলেন?”
অরুণিকার প্রশ্নে ছ’জনও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রহমতুল্লাহর দিকে তাকালো। রহমতুল্লাহ জোরপূর্বক হেসে বললেন,
“আরেহ, আন্দাজ করেছি।”
“বাসায় তো ভাবীও আছে। ভাবীকে দেখে আন্দাজ করেন নি?”
“তোমার চেহারা তো তোমার বাবার মতো হয়েছে। তাই চিনতে পেরেছি।”
“আপনি আমার বাবাকেও চিনেন?”
“হ্যাঁ। চিনতাম তো। তুমি তো তোমার বাবার রাজকন্যা ছিলে।”
আরাফ অরুণিকার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অরুণিকার চোখাচোখি হতেই সে ইশারায় অরুণিকা ভেতরে যেতে বললো। অরুণিকা আর কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলো। রহমতুল্লাহ টুকটাক অনেক কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে অরুণিকা সেই মুহূর্তে কলেজের জন্য বের হলো। রহমতুল্লাহকে দেখে সে বলল, “আল্লাহ হাফেজ, আংকেল।”
“কোথায় যাচ্ছো, মা?”
“কলেজে যাচ্ছি।”
“ওহ, আচ্ছা।”
রহমতুল্লাহ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, “একা যাচ্ছো?”
“না, আহনাফ নিয়ে যাবে।”
“আহনাফ কোথায়? দেখছি না যে!”
“আসছে।”
রহমতুল্লাহ কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে বললেন,
“শুনলাম তোমার সাথে আহনাফের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
অরুণিকা মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ।”
“তুমি রাজি হয়ে গেছো?”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”
“এটা কেমন কথা, মা? তুমি আহনাফকেই বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছো? আহনাফ তোমার চেয়ে এগারো-বারো বছরের বড়। আজকাল কি এতো বয়সের ব্যবধানে বিয়ে হয়?”
অরুণিকা রহমতুল্লাহর কথায় ভাবনায় পড়ে গেলো। হ্যাঁ, সে তো এটা আগে ভেবে দেখে নি। রহমতুল্লাহ অরুণিকাকে ভাবতে দেখে বললেন,
“কিছু মনে করো না মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হুম, করুন।”
“তোমার কি আহনাফকে পছন্দ? মানে তুমি কি ওকে ভালোবাসো?”
“না, তো।”
“তাহলে বিয়েতে কেন রাজি হয়েছো?”
“আরাফ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ও চায়, আমার আর আহনাফের বিয়ে হোক।”
“ব্যস, এতেই রাজি হয়ে গেছো?”
“হ্যাঁ।”
রহমতুল্লাহ এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“সম্পত্তির লোভ মানুষকে কি থেকে কি বানিয়ে দেয়! একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে এতো বড়ো ছেলের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে? কিছু মনে করো না, তোমার তো মাত্র আঠারো হয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি কেউ বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় না। তোমার কি পড়াশুনা করার ইচ্ছে নেই? ক্লাসে সবাই তোমাকে বিবাহিতা মনে করবে। তোমার স্বপ্নগুলো কখনো পূরণ হবে না। বিয়ে তো একটা দায়িত্ব। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়েও একপ্রকার ব্যবসা হয়ে গেছে। আজকাল টাকার জন্য মানুষ সব করতে পারে।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমি আপনার কথাটা বুঝতে পারলাম না। ব্যবসা মানে?”
“আরেহ, তোমার বাবাদের ব্যবসায়িক গ্রুপটা আবার চালু হয়েছে শুনো নি?”
“হ্যাঁ, শুনেছি। তার সাথে আমার বিয়ের কি সম্পর্ক?”
“শুনো, মৈত্রী গ্রুপের দুইটা ইউনিট। বি ইউনিটের ৫০ ভাগ অংশ ইমনের নামে। আর বাকিগুলো তূর্য আর ইভানের। আর এ ইউনিটের ৫০ ভাগ অংশ তোমার নামে। বাকিগুলো আরাফ, আহনাফ আর তাহমিদের। এই ৫০ ভাগ নিজেদের কাছে রাখার জন্য আহনাফ তোমাকে বিয়ে করছে। তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে সেই ৫০ ভাগ অন্য কারো হয়ে যাবে। এখনো বুঝো নি?”
অরুণিকা চুপ হয়ে গেলো। সে চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“আহনাফ আমাকে সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার জন্য বিয়ে করছে?”
“হ্যাঁ। আর নয়তো কেন বিয়ে করবে?”
“আরাফ এসব জানে?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই জানবে।”
“তাহলে আহনাফই কেন বিয়ে করছে?”
“আরেহ, ইমন আর তূর্য তো বিয়ে করে ফেলেছে। আর তাহমিদ তো অন্য কাউকে ভালোবাসতো। আরাফ এমনিতেই ব্যবসা করতে ইচ্ছুক নয়। ও তো ডাক্তার মানুষ। ও ব্যবসা কেন করতে যাবে? ও শুধু ব্যবসার লাভের অংশটাই পাবে। আর আহনাফ তো চমৎকার ব্যবসায়ী। ইটা গ্রুপের এতো উন্নতি তো আহনাফ আর ইমনের সূক্ষ্ম চিন্তাভাবনার কারণে হয়েছে। এদের মস্তিষ্ক খুবই তীক্ষ্ণ৷ কখন কি সিদ্ধান্ত নিতে হয় এরা ভালো করেই জানে।”
কথাটা বলেই রহমতুল্লাহ চলে গেলেন। অরুণিকা আবার ঘরে ঢুকে গেলো। আহনাফ সিঁড়ি বেয়ে নেমে অরুণিকার সামনে এসে দাঁড়ালো আর বলল,
“আমার বাইকের চাবিটা কোথাও পাচ্ছি না!”
অরুণিকা শীতল কণ্ঠে বলল,
“আলমারির ভেতরে।”
“ওখানে কে রেখেছে?”
“আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমাকে বিরক্ত করার প্ল্যান ছিল, তাই না?”
অরুণিকা কিছু না বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহনাফ চাবি এনে অরুণিকাকে নিয়ে বাইকে উঠলো। অরুণিকা চুপ করে আছে দেখে আহনাফ বলল,
“আজকে মিস অরুর ইঞ্জিন বন্ধ কেন? তেল শেষ হয়ে গেছে নাকি?”
অরুণিকা আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে কলেজে দিয়ে আসো।”
আহনাফ লুকিং গ্লাসে অরুণিকাকে একনজর দেখে বাইক চালাতে লাগলো। কলেজের সামনে নেমে অরুণিকা ভেতরে চলে গেলো। একবারও আহনাফের দিকে তাকালো না। আহনাফ অরুণিকার ব্যবহারে অবাক হলো। অন্যদিন সে পুরো রাস্তা বকবক করে আসে, আর বাইক থেকে নামার পর আহনাফকে চিমটে দিয়ে আসে বা কখনো মানিব্যাগ থেকে জোর করে টাকা নিয়ে ফেলে। আর আজ এসব তো করলোই না, উলটো ফিরেও তাকালো না। আহনাফ কিছুক্ষণ অরুণিকার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাইক নিয়ে সোজা অফিসে চলে গেলো।
৯৫.
একটি রেস্টুরেন্টে তাহমিদের মুখোমুখি বসে আছেন মুরশিদ জুবাইয়ের। তাহমিদের দৃষ্টি এদিক-ওদিক ছুটছে। সে একবারো মুরশিদ জুবাইয়েরের চোখাচোখি হয় নি। সে টেবিলের উপর একটা হাত উঠিয়ে রেখেছে, এখন তার দৃষ্টি ঘড়ির দিকে। মুরশিদ জুবাইয়ের ঝুঁকে তাহমিদের হাতের উপর হাত রেখে বললেন,
“একবারো আমার দিকে তাকাও নি। তাহমিদ আমি তোমার মামা।”
তাহমিদ হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “কেন ডেকেছেন?”
“হুম। শুনলাম এবং দেখলাম, তোমরা আবার মৈত্রী গ্রুপ চালু করেছো।”
“হ্যাঁ করেছি। তো?”
“তো! এটা তোমরা ভালো করো নি।”
তাহমিদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“শত্রুর ভয়ে লুকিয়ে থাকার মতো মন-মানসিকতা আমাদের নেই। আমাদের বাবারাও তেমন ছিলেন না। কিন্তু আমাদের শত্রুরা তো কাপুরুষ। তাই পেছন থেকে আঘাত করেছে। এমনিতেই কাপুরুষদের সামনা-সামনি এসে দাঁড়ানোর মতো সাহস নেই।”
“দেখো, তুমি আমার মরিয়মের শেষ চিহ্ন। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তাহমিদ এসব ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে বাইরের দেশে পাঠিয়ে দেবো। ওখানে গিয়ে বিয়ে করো, সংসার করো, একটা ভালো চাকরি করো। কিন্তু বাংলাদেশের টপ বিজনেস গ্রুপগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে যেও না। এরা মানুষ না। ক্ষমতার জন্য এরা মানুষ খুন করে ফেলে।”
“আপনি এই কথা বলছেন? আপনার হঠাৎ আমার প্রতি এতো মায়া কেন জেগে উঠেছে?”
“আমি তোমার মামা। আমার তোমার প্রতি মায়া থাকবে না? কি বলছো এসব তাহমিদ?”
“আমাদের শত্রুদের সাথে তো আপনার ভালোই আঁতাত আছে।”
মুরশিদ জুবাইয়ের কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
“কি বলতে চাইছো তুমি?”
“মির্জা গ্রুপ আর বাস্কার গ্রুপের একটা প্রজেক্টে ভালোই ইনভেস্ট করেছিলেন।”
মুরশিদ জুবাইয়ের হেসে বললেন,
“আমার সম্পর্কে সব তথ্য নিয়ে ফেলেছো দেখছি। জেনে যেহেতু গেছো তাহলে শুরু থেকে সবটা বলছি। তোমার মায়ের সাথে আমার মনোমালিন্য হওয়ার কারণ তোমাদের অরূপা ফুফি। অরূপা যেই ছেলেকে ভালোবাসতো, সে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছিল। আর অরূপাকে ভালোবাসতো রিয়াজ। রিয়াজকে তো চেনোই, বাস্কার গ্রুপের এম.ডি রিয়াজুর রহমান। চৌধুরীদের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সে কলেজ জীবনে আমার ভালো বন্ধুও ছিল। অরূপা আত্মহত্যা করার আগে আমি তোমার বাবাকে বলেছিলাম, রিয়াজের সাথে বিয়ে না দিয়ে যাতে ওই ছেলেকেই মেনে নেয়। অরূপার সাথে আমার অনেক বার দেখা হয়েছিল। ও আমাকে সেই ছেলের কথা বলেছিল। আমিই ওকে বলেছি, একটু ধৈর্য ধরলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ও আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়। আর সবাই মনে করতো, আমিই ওকে ইনফ্লুয়েন্স করেছি। আমার খুব রাগ হয়েছিল তখন, তাই আর কারো সাথে যোগাযোগ করি নি। পরে অবশ্য তোমার বাবা, আর চৌধুরীদের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। কথাও হয়েছিল। আর অরূপাকে হারানোর পর রিয়াজ এখনো বিয়ে করে নি। আমি ওকে ভালো জানি। তাই ওর গ্রুপে ইনভেস্ট করা আমার অসুবিধের মনে হয় নি। আর মির্জা গ্রুপে ইনভেস্ট করেছি, রিয়াজের কথায়। কারণ ও চেয়েছিল মির্জাদের পেছনে ফেলার জন্য ওদের একটা প্রজেক্ট হাতে নেওয়া উচিত। সেই সূত্রে এই ইনভেস্টমেন্ট। এগুলো বিজনেস পলিসি। তুমি এসব দেখে নিজের মামাকে সন্দেহ করছো?”
“তাহলে কেন বার-বার আমাদের সরে যেতে বলছেন? আপনার বিজনেস পলিসি ঠিক রাখার জন্য?”
“না, তাহমিদ। আমি জানি না সেদিন মৈত্রী ম্যানশনে হত্যাযজ্ঞ কে চালিয়েছিল। কিন্তু এতোটুকু জানি যেই করেছে সে এখন বিজনেসের টপ পজিশনে আছে। আর তারা তোমাদের হটিয়ে দিতে আবার খুন করবে। তাই আমি চাই নি তোমরা কলকাতা থেকে আসো।”
মুরশিদ জুবাইয়ের এবার কলকাতায় তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করা, তাদের পড়াশুনার খরচ দেওয়া, তাদের সাথে ঘটা প্রতিটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তার লোক রাখা এবং বিক্রমকে বলে তাদের সাহায্য করার সব ঘটনা খুলে বললেন। তাহমিদ সব শুনে বলল,
“আমার তো রহমতুল্লাহকে সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু আপনি বললেন, রহমত চাচা আপনার কথায় আমাদের সাহায্য করেছেন।”
“রহমতকে তো আমারও সন্দেহ হচ্ছে। ও আজকাল অনেক রহস্যময় কথাবার্তা বলছে। কিন্তু সেদিন রহমতই আমাকে সাহায্য করেছিল।”
এবার মুরশিদ জুবাইয়ের অতীতের সেই দিনটিতে ফিরে গেলেন। জুবাইয়ের করিম ফোন করে সেদিন রাতে তাকে বলেছিলেন,
“হ্যালো, মুরশিদ আমরা শেষ হয়ে গেছি। তুমি এক্ষুনি আমবাগান যাও। আরাফরা স্কুলের পিকনিকে গিয়েছে। তাহমিদও আছে তাদের সাথে। ওরা বাসায় ফেরার আগেই তুমি ওদের আটকাতে পারলে বেশি ভালো হবে। নয়তো আমিই ওদের আমবাগান পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।”
মুরশিদ জুবাইয়ের ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“কি হয়েছে জুবাইয়ের ভাই?”
জুবাইয়ের করিম চৌধুরী কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“বাসায় খুন হয়েছে। জিহানের মাকে নিয়ে বের হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও হয়তো আর বেঁচে নেই। বাকিরা কোথায় আছে জানি না। ঘরে সবার লাশ পড়ে আছে। এখন হাকিমের ঘরে ঢুকেছে। ওরা ইমতিয়াজের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। একটু পর হয়তো এই বাড়িতেও লাগিয়ে দেবে। আমি এখান থেকে বের হতে পারবো কিনা জানি না৷ বের হতে পারলে আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ, আমার অরুকে নিয়েই বের হবো। আর তার দায়িত্ব আরাফ আর আহনাফের উপর ছেড়ে যাবো।”
মুরশিদ জুবাইয়েরের কপালে ঘাম জমেছে। তিনি কাতর কন্ঠে বললেন,
“ভাই সাহেব, খুব ভয় লাগছে। কি বলছেন আপনি?”
“আমাদের কেউ একজন খুন করতে এসেছিল। আমি তাকে চিনি। কিন্তু বুঝতে পারছি না সে কে! মুরশিদ, এখন বাসায় আর কেউ বেঁচে নেই হয়তো। কিন্তু আনিস মুখোশধারী লোকটার চেহারা দেখেছিল। ও কথা বলতে পারছিলো না। ইশারায় একটা কোড নম্বর দিয়েছে, আমি একটা কাগজের সাথে সেই নম্বরটি পাঠিয়ে দেবো। কাগজের লেখা নামগুলোর মধ্যেই খুনীর পরিচয় থাকবে।”
মুরশিদ জুবাইয়ের এবার বাস্তবে ফিরে এলেন, আর তাহমিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“জুবাইয়ের সাহেব ঘরে আগুন লাগার সাথে সাথেই ফোন কেটে দেন। এরপর আমি তড়িঘড়ি করে তোমাদের স্কুলে চলে যাই, আর রহমতুল্লাহকে আমবাগান পাঠিয়ে দেই। তোমাদের সাথে অরুণিকা থাকবে এটা আমি জানতাম। কিন্তু রহমতুল্লাহকে বলি নি। এরপর তোমাদের সিলেট নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলি। রহমতুল্লাহ আমাকে আশ্বস্ত করেন, বাকি সব কিছু উনি সামলে নেবেন। উনি যা বলেছিলেন, তাই করেছেন। কিন্তু ইদানিং আমার মনে হচ্ছে, এসবের পেছনে উনার কোনো স্বার্থ ছিল। আমি চাই নি তোমরা দেশে ফিরো। কিন্তু উনি চাইতেন তোমরা বাংলাদেশে আসো। কেন চান এটাই আমি বুঝতে পারছি না।”
তাহমিদ স্থির হয়ে বসে রইলো। মুরশিদ জুবাইয়েরের হঠাৎ জরুরী কাজে ফোন আসায় উনি চলে গেলেন। যাওয়ার আগে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। তাহমিদ অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে। মামার শরীর থেকে সে মায়ের ঘ্রাণটাও পাচ্ছিলো, তাই হয়তো এতো খারাপ লাগছে। বাসায় এসে সে বাকিদের পুরো ঘটনা জানানোর পর ইভান বলল,
“তাহলে সেদিন আমবাগানে মুরশিদ মামার যাওয়ার কথা ছিল!”
ইমন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“ওয়েট, একটা জিনিস খেয়াল করেছিস? আনিস আংকেল খুনিকে চেনার জন্য কোড দিয়েছেন। কিন্তু জুবাইয়ের আংকেল খুনিকে চেনেন না, অথচ জানেন এটা আমাদের পরিচিত কেউ, তার মানে!”
“তার মানে?”
“কোডযুক্ত সেই ব্ল্যাককোট, যেটা মৈত্রী গ্রুপের একটা অনুষ্ঠানে সবাইকে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের জন্যও তো ছোট সাইজে বানানো হয়েছিল। ওখানে নম্বরও ছিল। আমাদের জন্মসাল।”
আহনাফ বলল,
“হ্যাঁ, জন্মসাল দিয়েই তো কোটটা তৈরী করা হয়েছিল। আর সেদিন ঝোপের আড়াল থেকে আমরা সবাইকে কোট পরাই দেখেছি।”
“তাহলে কে খুনী?”
“শাহেদ মির্জাও সেই অনুষ্ঠানে ছিল। রিয়াজুর রহমান, শাহবাজ খান এরাও ছিল। আর সেই রাহেলার সিমটাও কিন্তু শাহবাজ খানের নামে।”
তাহমিদ বলল,
“শাহবাজ খানই এই কাজ করেছে। আর রহমতুল্লাহ তাকে সাহায্য করছে। মির্জা গ্রুপও তাকে সাহায্য করেছে।”
চলবে—