অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৭১||

0
1253

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৭১||

১১৭.
ইশমামের লোকেরা তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করতেই সুলতান মুন্সীর ক্ষোভ আরো বেড়ে গেলো৷ আহনাফ দু’জন লোকের সাথে এসে ইশমামকে মেরে ফেলেছে। সুলতান মুন্সী এই কথা জানার পর তার রাগ আর ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি তার লোককে ফোন দিয়ে বললেন,
“এরা ধৈর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ওই মেয়েকে মেরে ফেলো। আর কাজটা তাড়াতাড়ি হওয়া চাই।”

সুলতান মুন্সী ফোন রাখতেই তার ফোনে ইমানের কল এলো। ইমানের নম্বর দেখতেই সুলতান মুন্সী কঠিন সুরে বললেন,
“এখন কেন ফোন করেছো? আহনাফ তোমার বড় ভাইকে মেরে ফেলেছে। আর তুমি….”

ইমান তার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমিই আহনাফ ভাইকে বড় ভাইয়ার ঠিকানা দিয়েছিলাম।”

সুলতান মুন্সী অবাক হয়ে বললেন,
“মাথা ঠিক আছে তোমার?”

“এতোদিন মাথা ঠিক ছিল না। যখন থেকে তোমার কুকর্ম সম্পর্কে জেনেছি, আমার মাথাটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে। যাদের আমি নিজের আইডল ভাবতাম, তারাই যদি এতো খারাপ হয়, তাহলে আমি তো কোনো মানুষের পর্যায়ে পড়ছি না। তাই এখন মাথা ঠিক করে, নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে নেমেছি।”

“নেমেছি মানে? কোথায় তুমি এখন? তুমি তো রাঙামাটি গিয়েছিলে।”

“মুরাদপুরের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি।”

সুলতান মুন্সী ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“পাগল হয়ে গেছো তুমি?”

“হ্যাঁ, পাগল তো হয়েই গেছি। যার বাবা খুনী, সেই মানুষ কিভাবে সুস্থ থাকবে? আমি অরুণিকাকে ভালোবাসতাম৷ তুমি আমার কাছ থেকে আমার ভালোবাসাই কেঁড়ে নিয়েছো।”

“ওই মেয়ে তোমাকে ভালোই বাসে না।”

“ভালোবাসতো। কিন্তু আমি খুব দেরী করে ফেলেছি। আর তুমিই বলো, আমার বাবা আমার ভালোবাসার মানুষটার পুরো পরিবারকে মেরে ফেলেছে। আমি সেই মেয়েকে কিভাবে নিজের করে নেওয়ার সাহস পাবো? অরুণিকা যদি কখনো জানতে পারে, আমি তার বাবা-মার খুনীর সন্তান, ও আমাকে ঘৃণা করবে। তাই অন্তত আজ নিজেকে আমি ইমান মুন্সীর পরিবর্তে ইমান হিসেবে পরিচয় দিতে চাই। তুমি প্রতিশোধের কারণে এতো অন্ধ হয়ে গেছো যে সব হারিয়ে ফেলেছো। আর আজ আমাকেও হারাবে। আমি অরুণিকা আর সাহিল মির্জাকে বাঁচাবো। তুমি আমাকে বাঁচাতে চাইলে এই হামলাটা আটকাবে। এখন সিদ্ধান্ত তোমার হাতে।”

ইমান কল কেটে দিল। সুলতান মুন্সী ছেলের কথা শুনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার লোকের নম্বরে কল দিতে যাবেন, তখনই শাহবাজ খান আর তার সাথে সাত-আটজন পুলিশ অফিসার এসে তাকে গ্রেফতার করল। সকালে উঠেই তিনি তার ছেলে ইশমামের সাথে রিয়াজুর রহমানের বাড়ি থেকে পালিয়ে যান৷ তার বাড়ির বাকি সদস্যদের পুলিশ কাস্টাডিতে রাখা হয়েছে।
এদিকে সুলতান মুন্সী জরুরি কল করবেন বলে চেঁচাতে লাগলেন। কিন্তু কেউ তার কথা কানেই তুললো না। তার ফোনটাও ছিনিয়ে নেওয়া হলো। সুলতান মুন্সী পাগলের মতো নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন। বয়স বেশি হওয়ায় পুত্রের চিন্তায় তার মস্তিষ্ক বিকার ঘটেছে। তিনি ঠিকভাবে একটা বাক্যও উচ্চারণ করতে পারছেন না। ‘ইমান, ইমান, ফোন দাও, আমার ছেলে, বাঁচাও ওকে।’ এসব শব্দই ভাঙা ভাঙা ভাবে উচ্চারণ করছেন।

এদিকে অরুণিকার জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে অন্ধকার পরিবেশে আবিষ্কার করলো। সে হাতে ভর দিয়ে উঠতেই মাথায় আঘাত পেলো। মাথায় হাত দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ছোট একটা জায়গায় সে আটকে আছে। ভালোভাবে তাকিয়ে বুঝলো, সে কোনো গাড়ির ডিকিতে আটকে আছে। মনে হচ্ছে গাড়িটা ধীর গতিতেই চলছে। মাঝে মাঝে থামছে, আবার হর্ণও দিচ্ছে। অরুণিকা ডিকিতে জোরে জোরে আঘাত করতে লাগলো। সে কোনোভাবেই তার পা’টা নাড়াতে পারছে না। এদিকে গরমে তার মাথাটাও ঝিনঝিন করছে। এই মুহূর্তে তার প্রচন্ড বমি পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কয়েক সেকেন্ড এখানে থাকলে সে মারা যাবে৷ অরুণিকা নিজের সব শক্তি দিয়ে গাড়িতে জোরে আঘাত করলো। গাড়িটাও কিছুক্ষণ পর থেমে গেলো। অরুণিকা বুঝতে পেরে ডিকির দরজায় বার-বার ধাক্কা দিতে লাগলো। হঠাৎ ডিকিটা খুলে গেলো। অরুণিকার চোখে আলো পড়তেই সে নিজেকে বের করার জন্য একটা হাত বের করে দিলো।
তার সামনে একটা অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা অবাক হয়ে বলল,
“তুমি কে? গাড়ির ডিকিতে কি করছো?”

অরুণিকা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“আমাকে কিছু লোক বাসা থেকে তুলে এনেছে। আমি আমার বাসায় যাবো।”

লোকটা অরুণিকার শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে বুঝলো, মেয়েটা আসলেই বিপদে পড়েছে। কিন্তু তার গাড়ির ডিকিতে এই মেয়ে কিভাবে এলো? লোকটা অরুণিকাকে ধরে গাড়ির ডিকি থেকে নামালো। অরুণিকা ঝাপসা চোখে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে কোনো এক রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে অনেকগুলো গাড়ি। অরুণিকা বলল,
“আমি এখন কোথায়?”

“এটা মুরাদপুর।”

অরুণিকা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো রাস্তায় প্রচুর জ্যাম পড়েছে। লোকটা বলল,
“তুমি বাসায় ফোন করবে?”

অরুণিকা গাড়ি ধরে হালকা এগিয়ে গেলো। গাড়ি, রিক্সা, সিন.এন.জিতে পুরো রাস্তা ব্লক হয়ে গেছে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকার এসব দেখে আরো মাথা ঘুরাচ্ছে। সে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আরাফকে ফোন দেবো।”

অরুণিকা ফোন নিয়ে কোনোভাবে আরাফের নম্বরে ডায়াল করলো। কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। আর কারো নম্বর তার মুখস্থ নেই। তবে নিজের আর বাড়ির টেলিফোন নম্বরটা তার মুখস্থ ছিল। সে প্রথমে টেলিফোন নম্বরে কল দিলো। কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না। তারপর নিজের নম্বরেই কল দিলো। সেটাও কেউ ধরছে না। হতাশ হয়ে অরুণিকা বলল,
“আমি বাসায় যাবো। আমার বাসা হালিশহর।”

লোকটা ভালো মানুষ। তিনি অরুণিকাকে রাস্তার অন্য পাশে নিয়ে এলেন। তিনি ভাবছেন, এই অবস্থায় মেয়েটাকে তার বাসায় নামিয়ে দেওয়ায় উচিত হবে। কিন্তু এই জ্যামের মধ্যে তিনি গাড়িটাও ঘুরাতে পারছেন না। আবার অরুণিকাকে একলাও ছাড়তে চাচ্ছেন না। তাই তিনি ভাবলেন তাকে থানায় নিয়ে যাবেন। পাশেই থানা আছে। আবার ভাবছেন, গাড়িটা মধ্য রাস্তায় রেখে থানায় গেলে, আবার তার গাড়ির জন্যই জ্যাম বাঁধবে।

এদিকে ইভান আর তাহমিদ হাঁটতে হাঁটতে আবার মুরাদপুরে ঢুকলো। রাস্তার একপাশে তাহমিদ, অন্যপাশে ইভান হাঁটছে। তাহমিদ আর হাঁটতে পারছে না। তার রাগে পা’দুটি কেটে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। তবুও সে থামছে না। অরুণিকাকে না পেলে সে শান্তি পাবে না। ইভানেরও ধৈর্য সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। সে এবার কেঁদেই দিলো। হঠাৎ অরুণিকা রাস্তার ওপাশে তাহমিদকে হাঁটতে দেখে প্রাণ ফিরে পেলো। সে লোকটাকে বলল,
“ওই তো তাহমিদ, ওই তো, দেখো।”

লোকটা তাহমিদকে দেখার আগেই অরুণিকা চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো,
“তাহমিদ, তাহমিদ, আমি এখানে।”

তাহমিদের নাম শুনে ইভান চমকে উঠলো। মনে মনে বলল, “এটা তো অরুণিকার কন্ঠ।”

সে এলোমেলো ভাবে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সামনে পেছনে হাঁটতে লাগলো। কয়েক পা বাড়াতেই দেখলো অরুণিকা তার সামনেই। অরুণিকা ফুটপাত থেকে নেমে রাস্তার ওপাড়ে হাঁটতে থাকা তাহমিদের দিকে ছুটার জন্য পা বাড়াতেই ফুটপাতের উপর দিকে নিচে পড়ে গেলো। আর এদিকে ইভান অরুণিকাকে দেখে দৌঁড়ে তার দিকে ছুটে এলো। অরুণিকাকে নিচে পড়ে যেতে দেখে তার পাশে থাকা লোকটা, আর একজন রিক্সা চালক এগিয়ে এলেন। ইভানও ততোক্ষণে অরুণিকার কাছে চলে এসেছে। ইভানকে দেখে অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সে শক্ত করে ইভানের গলা জড়িয়ে ধরলো। ইভানও অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। তারপর অরুণিকাকে দাঁড় করালো। লোকটা বলল,
“আপনি ওর আত্মীয় হোন?”

ইভান কাঁপা কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, ও আমার বোন। আমার প্রাণ।”

“ওহ আচ্ছা, ও আমার গাড়ির ডিকিতেই আটকে ছিল। বুঝলাম না, ও আমার গাড়িতে কিভাবে এলো।”

ইভান লোকটার কথা কিছুই শুনছে না। মাথা হেলিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে অরুণিকাকে কোলে নিয়ে ফুটপাতের উপর উঠে গেলো। তারপর অরুণিকাকে শক্ত করে ধরে রেখে তাহমিদকে ফোন করে খবরটা জানালো। তাহমিদ তাড়াতাড়ি রাস্তা পার করে অরুণিকাকে দেখে প্রশান্তির হাসি হাসলো। ইভান আর তাহমিদ যেন তাদের প্রাণ ফিরে পেয়েছে। দু’জনই একে অপরকে ঝাপটে ধরলো। অরুণিকা দুর্বল শরীর নিয়ে ইভানের শার্ট খামচে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইভান পাশ ফিরে দেখলো অরুণিকার পায়ে রক্তের দাগ। সে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“পায়ে ব্যথা পেয়েছো?”

অরুণিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“ওরা আমায় অনেক মেরেছে। বেল্ট দিয়ে মেরেছে। বড় একটা লোহা দিয়েও মেরেছে।”

ইভান অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে কোলে উঠালো। তারপর তাহমিদের এক হাত নিজের কাঁধে উঠিয়ে বলল,
“আমার উপর ভার দিয়েই চল। সামনে জ্যাম নেই। ওখান থেকে একটা গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে চলে যাবো।”

তাহমিদ ততোক্ষণে অরুণিকাকে পাওয়ার খবর ইমনকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে। আরাফ অরুণিকাকে খোঁজার জন্য বের হতে যাবে, তখনই ইমন আরাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“অরুণিকাকে পাওয়া গেছে। ওকে এখানেই আনছে।”

আরাফ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“ও ঠিক আছে তো?”

“জ্ঞান আছে বললো। আর বেশিকিছু তো বলে নি। এখানে আনছে মানে আঘাত তো পেয়েছেই। আচ্ছা, আমি আহনাফকে ফোন দিয়ে জানাচ্ছি।”

এদিকে ইমান মুরাদপুরের রাস্তার সামনে পেছনে চারটা গাড়ি বাঁকাভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝলো, তার বাবা ইচ্ছে করে এই গাড়িগুলো চারদিকে থেকে দাঁড় করিয়ে রাস্তা আটকে দিয়েছে। এই ভীড়ের মধ্যেই হয়তো কোনো গাড়িতে বোম রাখা আছে। তাই সে সামনে থেকেই প্রতিটা গাড়ির সামনে এসে বলতে লাগলো,
“গাড়ি থেকে নামতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোম বার্স্ট হবে।”

অনেকেই ইমানের কথা শুনে ভয়ে গাড়ি ফেলেই নামে যাচ্ছে। রাস্তায় মানুষজনকে গাড়ি ফেলে দূরে যেতে দেখে বাকিরাও না বুঝে গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক ছুটতে লাগলো। এরইমধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে গেছে। এদিকে ইমান কোনোভাবেই সাহিলের গাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। সে মনে মনে ভাবলো,
“গাড়ি যদি ফ্লাইওভারে থাকে?”

এই মুহূর্তে ফ্লাইওভারের গাড়িগুলো থামানোর মতো সুযোগ নেই। কারণ যেখানে সবাই এই খবরকে গুজব ভেবে আবার রাস্তায় নেমে পড়েছে, সেখানে ব্যস্ত গাড়িগুলো থামাতে গেলে আরো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। হঠাৎ ইমান খেয়াল করলো একটা গাড়িকে ঘিরে সাত-আটজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ইমান দৌঁড়ে সেদিকে গিয়েই দেখলো গাড়িতে সাহিল মির্জা বসে আছে। ইমানকে দেখে সে ইশারায় বলল, রাস্তায় এতো হট্টগোল কেন?

ইমান বলল,
“আপনাকে মারার জন্য সুলতান মুন্সী এখানে আশেপাশে কোথাও বোম রেখেছেন।”

এই কথা শুনেই সাহিল মির্জা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এলো। ইমান বলল,
“আপনি তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালান।”

ইমানের কথায় বেশ জোর ছিল। তাই সাহিল মির্জা এই আগন্তুক ছেলের কথায় বিশ্বাস করে দৌঁড়াতে লাগলো। ইমান আশেপাশের গাড়িতে বসে থাকা সবাইকে বের হওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। হঠাৎ ইমান দাঁড়িয়ে গেলো। মুরাদপুরের আশেপাশে অনেকগুলো দোকান আছে, সেখানেও মানুষ আছে। তাদের কিভাবে বাঁচাবে সে? তার কেন যেন মনে হচ্ছে সময়টা শেষ হয়ে যাচ্ছে। অরুণিকাকে কি পাওয়া গেছে? ও এখন কোথায়? এসব প্রশ্নই ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার শরীরটাও বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে। সে একটা গাড়িতে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
“আই লাভ ইউ, অরুণিকা। তুমি ভালো থাকলেই, আমি ভালো থাকবো। আমি হয়তো তোমাকে নিজের করে পাবো না। কিন্তু আমার মনে তুমি সবসময় থাকবে।”

বিকট শব্দ তুলে মুরাদপুরে একটা বিস্ফোরণ হলো। এই বিস্ফোরণে আশেপাশের এলাকা কেঁপে উঠলো। ফ্লাইওভারে বড় একটা ফাঁটল ধরলো। মুহূর্তেই আরেকটা বিস্ফোরণ হলো। ইভান আর তাহমিদ গাড়িতে উঠেই থমকে গেলো। ইভান তাড়াতাড়ি সি.এন.জি থেকে নেমে দেখলো পেছনের পুরো শহর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সে উপরের দিকে তাকিয়ে বুঝলো, ফ্লাইওভারটা হয়তো এবার ভেঙে পড়বে। ইভান অরুণিকাকে সি.এন.জি থেকে নামিয়ে তাহমিদকে টেনে নামালো। সি.এন.জি ড্রাইভারও গাড়িতে থেকে নেমে ফ্লাইওভার থেকে দূরে সরে দাঁড়ালেন। কাউকে সতর্ক করার মতো সময় তাদের হাতে ছিল না। মুহূর্তের মধ্যেই ফ্লাইওভারটি নিচে ধসে পড়লো। যারা সময়ের আগে সরে এসেছে তারা বেঁচে গেছে। আর যারা পারে নি, তারা ফ্লাইওভারের নিচেই চাপা পড়েছে।
শহর জুড়ে মানুষের মধ্যে আতংক ভীড় করতে লাগলো। গুজবটা যে মিথ্যে ছিল না, তা সবাই বুঝে গেছে। ইভান কিছুদূর গিয়ে আরেকটা সি.এন.জি ভাড়া করে অরুণিকা আর তাহমিদকে উঠালো। সি.এন.জিতে উঠেই সে আহনাফকে ফোন করলো। আহনাফ কল ধরতেই সে দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। আহনাফ বলল,
“তোরা কোথায় এখন? তাহমিদের মেসেজ দেখেছি। অরু কোথায়? ভালো আছো ও?”

“আসছি আমরা। তূর্যের কি অবস্থা?”

“ডাক্তাররা কিছুই জানাচ্ছে না। আমি একটু আগেই এখানে এসেছি। ডাক্তাররা শুধু বললো রক্ত লাগবে। আমরা এখন রক্ত জোগাড় করার চেষ্টা করছি।”

“বোমটা বার্স্ট হয়েছে। মনে হচ্ছে অনেক মানুষ মারা যাবে।”

আহনাফ স্থির হয়ে গেলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“ইমানকে ফোন করেছিস? ও তো ওদিকেই ছিলো।”

ইমানের কথা পড়তেই ইভান তাড়াতাড়ি ফোন কেটে ইমানকে কল করলো। কিন্তু কল দিতেই শুনছে, কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাহমিদ বলল, “কি হয়েছে?”

“ইমানের ফোন বন্ধ।”

অরুণিকা স্থির দৃষ্টিতে ইভানের ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠা ইমানের নম্বরটির দিকেই তাকিয়ে রইলো।

১১৮.

দগ্ধ শরীর নিয়ে রাস্তায় পড়ে আছে সাহিল মির্জা। কোনোভাবে পাশ ফিরে দেখলো, রাস্তায় থাকা গাড়িগুলোতে আগুন ধরেছে। ধোঁয়া ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে মানুষের লাশ পড়ে আছে। সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগুতেই আবার মাটিতে পড়ে গেলো। তখনই সে কিছু মানুষের কন্ঠের স্বর শুনতে পেলো। সাহিল মির্জা চোখ খুলতে পারছে না। কিছু লোক যে তাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে। তার মুখটা ঝলসে গেছে, তাই বোঝার উপায় নেই, সে সাহিল মির্জা নাকি অন্য কেউ। খুব জোর নিয়েই সে কাঁপা কন্ঠে তার পাশে থাকা মানুষটিকে একটা নম্বর বলতে লাগলো। লোকটা বুঝলো কিনা সে জানে না। অনেকক্ষণ পরই তার জ্ঞান ফিরলো। সে শরীর নাড়াতে পারছে না। মনে হচ্ছে ভেতরের সব কিছুই ঝলসে গেছে। পাশ ফিরে একজন নার্সকে দেখে সে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমার সাথে দেখা করতে কি কেউ এসেছে?”

নার্স তার পাশে এসে বলল,
“মিস্টার সাহিল মির্জা, আপনার পুরো পরিবার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”

সাহিল এটা শুনে হালকা হাসলো। ধীর কন্ঠে বললো,
“রাহিকে একটু দেখবো।”

নার্স সাহিলের কথা শুনে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে রাহিকে ডেকে আনলো। রাহি ভেতরে এসে সাহিলকে দেখেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সাহিল রাহির বেড়ে উঠা গর্ভের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাচ্চাটা হয়তো আর আমার দেখা হবে না।”

রাহি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তোমার কিচ্ছু হবে না।”

“তুমি ঠিক বলেছিলে, রাহি। আমার কাজটা একদিন আমাকে ডুবিয়ে দেবে। আমি এতো তাড়াতাড়ি মরতে চাই নি। তোমার সাথে, আমাদের বাবুর সাথে বাঁচতে চেয়েছিলাম। আচ্ছা, আমার বাচ্চাটা কি আমাকে বাবা ডাকবে না, রাহি?”

“ডাকবে। তুমি সুস্থ হও। তারপর আমরা ওকে বাবা ডাকা শেখাবো।”

“মনে হচ্ছে না আমি সুস্থ হবো। ভেতরে অনেক জ্বালা করছে। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি তোমাকে সুখ দিতে পারি নি। রাহি, মনে কোনো কষ্ট রেখো না। হয়তো আমার জোরাজুরিতেই তুমি আমাকে বিয়ে করেছো, কিন্তু আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম। এখনো ভালোবাসি।”

রাহি সাহিলের ঝলসের যাওয়া হাতটা ধরে বলল,
“আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম৷ এখনো ভালোবাসি। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। অনেক অবহেলা করেছি। কিন্তু সাহিল, আমি তোমাকেই ভালোবাসি, বিশ্বাস করো।”

“বিশ্বাস করতে চাই। তুমি তো আমারই। কিন্তু তোমার মনটাও যদি আমারই হতো।”

রাহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সে আর কথা বলতে পারছে না। সে সাহিলকে ভালোবাসলেও ক্ষণিকের জন্য আরাফের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সে সাহিলকে ছাড়তে চায় নি। সে চেয়েছিল, সাহিল আরাফের মতো হয়ে যাক। কিন্তু কারো ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করা তো সম্ভব না। রাহির এই মুহূর্তে নিজেকে কীট মনে হচ্ছে। সে সাহিলের হাতে চুমু খেয়ে বলল,
“আমাদের বাচ্চাটা সাহিল মির্জার পরিচয়েই বড় হবে। ডাক্তার তো বলেছে ছেলে হতে পারে। আমাদের বাবুর নাম সায়িম মির্জা রাখবো, ঠিক আছে? সে বাবার মতোই অনেক বড় বিজনেসম্যান হবে। তোমাকেও আমার পাশে থাকতে হবে, সাহিল। আমি তো ব্যবসার কিছুই বুঝি না। তুমি তোমার ছেলেকে বুঝিয়ে দেবে।”

রাহি কথা বলেই যাচ্ছে। নার্স এসে ডাক্তারকে ডেকে আনলো। ডাক্তার ভালোভাবে চেক করে রাহিকে বলল,
“উনি আর বেঁচে নেই। দুঃখিত।”

রাহি কথাটি শুনে থমকে গেলো। সে নির্বাক হয়ে সাহিলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর শাহেদ মির্জা, তার প্রাক্তন স্ত্রী রুমি, সানায়া, সাবা সবাই ভেতরে ঢুকলো। শাহেদ মির্জা ছেলেকে দেখে পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন। রুমি ছেলের পাশে বসে কাঁদছেন। সাবা আর সানায়া একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। রাহি সাহিলের হাতের উপর মাথা রেখে বলল,
“আমি আসলেই তোমার যোগ্য ছিলাম না, সাহিল। তোমাকে তোমার মতো করে ভালোবাসতে পারি নি। আল্লাহ, আমার উপর ক্ষিপ্ত। আমাকে তো একটা সুযোগও দেন নি। আমার সাহিলকেই নিয়ে গেছেন। এখন আমি ছেলেটাকে একা কিভাবে বড় করবো?”

শাহেদ মির্জা রাহির মাথায় হাত রেখে বললেন,
“আমরা সবাই আছি। তোমার শাশুড়ী তো তোমার সাথেই আছে। আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। যদি একটাও ভালো কাজ করে থাকি, আল্লাহ সেই ফলস্বরূপ আমার ছেলেটাকে জান্নাত নসিব করুক। সে যেমনই হোক, তার বাবা-মাকে কখনো কষ্ট দেই নি। আমি রুমির সাথে এতো অন্যায় করেছি, তবুও আমার ছেলে তার বাবা-মা দু’জনকেই সম্মান করেছে। কাউকে একটুও কষ্ট দেই নি। মানুষ হিসেবেও আমার ছেলেটা খারাপ ছিল না। তবুও যা ভুল হয়েছিল, আল্লাহ ওকে মাফ করুক।”

সানায়া কেবিন থেকে বের হয়ে একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে রইলো। ইভান সানায়াকে দেখে তার পাশে বসে বলল, “তুমি এখানে?”

সানায়া ইভানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ইভান চিন্তিত কন্ঠে বলল, “সব ঠিক আছে তো?”

সানায়া এবার কেঁদে উঠলো। ইভান সানায়ার হাতটা আলতো হাতে স্পর্শ করলো। সানায়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ভাইয়া আর নেই।”

এমন কথা শুনে ইভানের খুব খারাপ লাগলো। সানায়া ইভানের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার তো এখন ভালো লাগছে, তাই না?”

ইভান বলল,
“আমরা ভুলের মধ্যেই এতো বছর পার করেছি, সানায়া। এতো বছর তোমার বাবা আর ভাইকে খুনি মনে করে এসেছি। আসল খুনি তো সুলতান মুন্সী।”

সানায়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আর সাবা আপু সেই ঘরে বিয়ে করার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছিল।”

শাহেদ মির্জা বের হয়ে ইভানকে সানায়ার সাথে দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। ইভানও তাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো৷ কিছুক্ষণ পর তিনি ইভানকে পাশ কেটে চলে গেলেন।

এদিকে অরুণিকা আর তাহমিদকেও হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তূর্যের জন্য রক্তের ব্যবস্থা করে আহনাফ অরুণিকার সাথে দেখা করতে কেবিনে ঢুকলো। অরুণিকার পাশে আরাফ আর ইমন বসে ছিল। আহনাফকে দেখে তারা উঠে দাঁড়ালো। আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসলো। আরাফ ইমনকে ইশারায় বাইরে যেতে বললো। ইমন আর আরাফ বেরিয়ে গেলো। তারা বেরুতেই আহনাফ অরুণিকাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অরুণিকার পুরো শরীরে ব্যথা৷ তবুও সে কোনো শব্দ করলো না। কেন যেন আহনাফের জড়িয়ে ধরাতেই তার মনের অস্থিরতা কেটে গেলো। আহনাফ অরুণিকার গালে আর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তার হাতটা শক্ত করে ধরে হাতে ভালোবাসার স্পর্শ দিলো। হঠাৎ আহনাফের চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে অরুণিকার হাতে পড়লো। অরুণিকা আহনাফের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমার কিছু হয়ে গেলে, তুমি কি কাঁদতে।”

আহনাফ অরুণিকার এক হাত ধরে অন্য হাতে অরুণিকার সামনে আসা চুলগুলোতে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল,
“জানি না কি করতাম, কিন্তু এই কয়েক ঘন্টা আমার উপর দিয়ে কি ঝড় গেছে, তা আমি প্রকাশ করতে পারবো না। আমি এটা বুঝে গেছি, তুমি আমার খুব শখের মানুষ। যেই শখ হারিয়ে গেলে, মানুষ পাগল হয়ে যায়।”

অরুণিকা আহনাফের হাত নিজের দিকে টেনে এনে বলল,
“আবার একটু জড়িয়ে ধরবে?”

আহনাফ মুচকি হেসে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলো। অরুণিকা বলল,
“একটু আস্তে ধরো। আমার পিঠে অনেক ব্যথা।”

আহনাফ আলতো হাতেই অরুণিকার পিঠে হাত রাখলো। অরুণিকা চোখ বন্ধ করলো। কয়েক ঘন্টা পর সে আহনাফের বুকেই শান্তি খুঁজে পেয়েছে।

এদিকে শাহবাজ খান অরুণিকাকে দেখতে এসে আহনাফের বুকে অরুণিকাকে দেখে মুচকি হাসলেন। তিনি আবার রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আরাফকে বললেন,
“তুমি ঠিক বলেছো। অরুর জন্য আহনাফের চেয়ে ভালো ছেলে হবে না। তবে আমার ওকে তেমন ভদ্র মনে হয় নি, তাই আমি এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না।”

আরাফ বলল,
“আংকেল, আমরা ভাবতাম, আপনিই খুনি ছিলেন। সব প্রমাণ আপনার বিরুদ্ধে ছিল। পরে জানলাম সুলতান মুন্সী আপনার নাম ব্যবহার করেই এতো কিছু করেছে। আহনাফের রাগটা তো স্বাভাবিক, এমনই হওয়ার ছিল। তবে ও আসলেই একটু রাগী মেজাজের, কিন্তু ওর মনটা অনেক ভালো।”

শাহবাজ খান তার সামনে শাহেদ মির্জাকে দেখে চুপ হয়ে গেলেন। সাহিলের মৃত্যুতে তিনি স্ত্রী-কন্যাদের সামনে না কাঁদলেও আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। শাহবাজ খান তার কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“সুলতান মুন্সীই এই কাজ করেছে। ওকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মৈত্রীদেরও সে-ই হত্যা করিয়েছিল। তার সাথে আরবান তালুকদার ও রহমতুল্লাহ জড়িত ছিল।”

শাহেদ মির্জা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“রহমত এই কাজ করেছে? মৈত্রীরা তো তাকে আশ্রয় দিয়েছিল!”

“বেইমান লোকেদের আশ্রয় দেওয়ায় তাদের ভুল হয়েছিল। এসব মানুষের জন্য বিশ্বাস শব্দটাও আজকাল খুব হালকা হয়ে গেছে।”

“আমার ছেলেকে মেরে মুন্সী আর রহমত প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে। ওদের শাস্তি পেতে হবে। খুব কড়া শাস্তি।”

আহত-নিহত কোনো মানুষের ভীড়েই ইমানকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। উদ্ধার কর্মীরা তাদের উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে সুলতান মুন্সী পাগলের প্রলাপ বকছেন। বারবার বলছেন তার ইমানকে একটু দেখলেই হবে। কিন্তু ইমানের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। এদিকে মুরশিদ জুবাইয়ের এসে তাহমিদকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। নিজের মামার পরিবারের সবার সাথে দেখা করে তাহমিদের অনেক ভালোই লাগলো। মামী তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন। তাহমিদ মামীর হাত ধরে বলল,
“এতোদিন পর মনে হচ্ছে শান্তিতে কিছু খাচ্ছি।”

মামী মুচকি হাসলেন। তাহমিদ মাওশিয়াতকে ফোন করলো। ভিডিও কলে শতাব্দীকে দেখলো। এতোক্ষণ শতাব্দীর মনটা ছটফট করছিল। সে তাহমিদকে দেখে প্রশান্তির হাসি হাসলো। এরপর মাওশিয়াত বলল,
“ইমন আমাদের নিতে আসবে না?”

তাহমিদ বলল,
“হ্যাঁ, আহনাফ অরুণিকাকে বাসায় নিয়ে গেছে। ইমনও ওদিক থেকে এসে তোমাদের নিয়ে যাবে।”

“তূর্যের এখন কি অবস্থা?”

“ভালো। ডাক্তার বলেছে আশংকামুক্ত। রিলিজ দিতে সময় লাগবে। ইভান আর আরাফ ওখানেই আছে।”

তূর্যের জ্ঞান ফিরতেই উপমাকে পাশে দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে উঠলো। উপমা তূর্যের হাত ধরে বলল,
“আমি তোমার পাশে আছি, তূর্য।”

তূর্য কথা বলার মতো শক্তি পাচ্ছে না। সে শুধু “হুম” শব্দ করলো। উপমা আবার বলল,
“আমি তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবো না। এখন থেকে সবসময় তোমার পাশে থাকবো।”

তূর্য মুচকি হাসলো। উপমার বাবা-মা কেবিনে এসে তূর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মিসেস জুলেখা বললেন,
“আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। তিনি আমাদের ছেলেকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে কিন্তু বাসায় ফিরতে হবে, বাবা। আমরা তোমার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় আছি।”

এদিকে এক সপ্তাহের মধ্যেই উদ্ধার কাজ শেষ হলো। ইমানকে আর পাওয়া গেলো না। অনেকের বিচ্ছিন্ন হাত-পা পাওয়া গেছে। কিন্তু ইমান বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে এটা শুধু প্রশ্নই থেকে গেলো। সুলতান মুন্সী তার পাপ স্বীকার করেছেন। সুলতান মুন্সী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একে একে সব বলতে লাগলেন,
“আমিই খুনী। আমি মৈত্রীদের হত্যা করিয়েছিলাম। আমাকে সাহায্য করেছিল, আরবান তালুকদার আর রহমতুল্লাহ। আমার ছোট ভাই সেজান, মৈত্রীদের মেয়েকে ভালোবাসতো। মেয়েটার নাম আরূপা ছিল। আমরা গরিব ছিলাম, তাই তারা তাদের মেয়েকে আমার ভাইয়ের সাথে বিয়ে না দিয়ে বাস্কার গ্রুপের এম.ডি রিয়াজুর রহমানের সাথে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আরূপা সেজানকে খুব ভালোবাসতো, তাই সে আত্মহত্যা করে ফেলে। আর ওর মৃত্যুর জন্য মৈত্রীরা আমার ভাইকে দায়ী করে। তাকে গ্রেফতার করিয়ে মারধর করে। তারপর একদিন তাকে মৈত্রী ম্যানশনে নিয়ে যায়। সেখানেও অনেক অপমান করে। আমার ভাইটা অনেক আবেগী ছিল। এসব সহ্য করতে না পেরে সেও আত্মহত্যা করে ফেলে। মৈত্রীদের এতো ক্ষমতা ছিল যে আমার ভাইয়ের লাশটাও আমাকে ধর‍তে দেয় নি। তাই আমি মৈত্রীদের নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তারপর আরবানের সাথে মিলে এই কাজ করেছি।”

রহমতুল্লাহও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন,
“অনেক বছর আগে আমি মির্জাদের সাথে কাজ করতাম। কিন্তু তারা আমার উপর মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে, আমাকে বের করে দেয়। আমি অনেক সম্মান নিয়ে চলতাম। মির্জা সাহেবের এমন অভিযোগের জন্য আমি অনেক অপমানিত হয়েছিলাম। আমার ছেলে অসুস্থ ছিল। আমার মা অসুস্থ ছিল। তারা আমার একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। শাহেদ মির্জা আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিল। তখনই মৈত্রী কোম্পানির আলিম হোসেন আমাকে সাহায্য করেছিলেন। ওদের কোম্পানিতে কাজ দিয়েছেন। ওদের কোম্পানির কাজ একটু ব্যতিক্রম ছিল। আমি বুঝতে পারতাম না। এরপর আমার কারণে ওদের লস হয়ে যায়। তাই ওরা আমাকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেয়। কিন্তু মাসে মাসে টাকা দিতো। এদিকে আরবান তালুকদারের সাথে আরহাম চৌধুরীর ঝামেলা ছিল। উনি চৌধুরীদের ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজছিলেন, আর তিনিই আমাকে একটা অফার দেন। আমি প্রথমে খুনের ব্যাপারে জানতাম না। শুরুতে চৌধুরীদের উপর নজর রাখার কাজ পেয়েছিলাম। আরবান তালুকদার অনেক টাকা অফার করেছিলেন। তাই আমি লোভ সামলাতে না পেরে রাজি হয়ে যায়। আমি জানতাম জুবাইয়ের করিম চৌধুরীর সাথে মুরশিদ সাহেবের অনেক ওঠাবসা হয়। তাই আমি মুরশিদ সাহেবেরও প্রিয় হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। তারপর সেই রাতের পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন হলো।”

সুলতান আবার মুন্সী বললেন,
“আমি সবাইকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। পরে জানলাম, ওদের ছয় জন ছেলে আর একটা মেয়ে এখনো বেঁচে আছে। মুরশিদ জুবাইয়ের সেদিন রহমতুল্লাহর মাধ্যমে তাদের সিলেট পাঠিয়ে দেন। আমি যখন জানলাম, ওখানে গিয়ে ওদের মারতে চেয়েছিলাম। কারণ ওরা সবাই মরলেই আমার ভাইয়ের আত্মা শান্তি পেতো। কিন্তু আরবান ওদের মারতে দেয় নি। রহমতুল্লাহও চেয়েছিল, ওদের বাঁচিয়ে রাখতে। এদের দিয়েই মির্জাদের হত্যা করাতে৷ কারণ মিডিয়া মির্জাদের নিয়েই গুজব ছড়িয়েছিল। আরবান যখন জানলো, অরুণিকার নামে অর্ধেক সম্পত্তি লেখা আছে, সে চাইছিল মেয়েটা বড় হলেই ওকে নিজের ছেলের বউ বানিয়ে সব সম্পত্তি লিখিয়ে নেবে।”

এবার রহমতুল্লাহ বললেন,
“এরপর মুরশিদ সাহেবের কথায় আমি তাদের কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করি। কিন্তু ইচ্ছা করে আমার ভাইয়ের পাশেই তাদের বাসা ঠিক করে দেই, যাতে সালেহ ওদের উপর নজর রাখতে পারে। সালেহ জানতো না আমি খুনের সাথে জড়িত ছিলাম। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ভালো ছিল না, এটা ও জানতো। এরা ছ’জনই আমার ভাইকে অনেক সম্মান করতো। আমার ভাইয়ের স্ত্রী সুরাইয়া নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতো ওদের। অরুণিকা তো তার খুব প্রিয় ছিল। সুরাইয়া যখন সব জানলো, সালেহ আমাকে আর সাহায্য করতে চাইছিল না। তখন রাহেলাকে মাওশিয়াতের বাসায় কাজের লোক হিসেবে পাঠিয়ে ওদের সব তথ্য নিয়েছিলাম।”

এবার সুলতান মুন্সী বললেন,
“আমার বড় ছেলে ইশমাম সাবাকে ভালোবাসতো। শাহেদ মির্জার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পর সে আমাদের উল্টোপাল্টা শুনিয়ে দিলো। এই দেশে ক্ষমতার খুব দাম। তাই এই ক্ষমতা দিয়েই ওদের শেষ করে দিতে চেয়েছি। তাই সাহিল মির্জাকে মারার জন্য, মির্জা গ্রুপকে ধ্বংস করার জন্য এই পরিকল্পনা করেছিলাম। ভেবেছি এই হামলার জন্য মৈত্রী সন্তানকদের ফাঁসিয়ে দেবো। কারণ ওরাই মির্জাদের আসল শত্রু। কিন্তু এর আগেই আমার ছেলে ইমান আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।”

ইমানের কথা উঠতেই সুলতান মুন্সী ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পনেরো বছর আগের গণহত্যা, আর পনেরো বছর পর আবার এতোগুলো মানুষকে হত্যার জন্য সুলতান মুন্সী আর রহমতুল্লাহর ফাঁসির রায় হলো। রায় হওয়ার পর ছ’জনই কোর্ট থেকে বের হয়ে এলো। শাহেদ মির্জা তাদের দেখে পুরোনো রেষারেষির জন্য ক্ষমা চাইলেন। শাহবাজ খান মির্জা সাহেবকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
“আপনার এখন ছ’জন ছেলে আছে। নিজেকে একা ভাববেন না। সাহিল যেখানেই আছে, ভালো থাকবে ইনশাআল্লাহ।”

চলবে–

(আগামীকাল শেষ পর্ব আসবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here