অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৭২: ১ম ভাগ||

0
1288

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৭২: ১ম ভাগ||

১১৯.
মৈত্রী বাড়িতে আজ অনেক বছর পর লোকের সমাগম হয়েছে। ছ’জন মিলে এলাকায় যতো পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল, সেগুলো নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার করিয়ে মালিকদের আবার ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করছে। আর মালিকের অবর্তমানে তাদের সন্তানদের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে, নিজেদের পৈতৃক বাড়িগুলো আবার পুনঃনির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছে। যদিও তাদের সেখানে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই। তারা শুধু মৈত্রী ম্যানশনকে তাদের কোম্পানির কাজে ব্যবহার করবে। সেখানেই তাদের প্রধান অফিসটা থাকবে। কিন্তু তাদের ঠিকানা তো এখন টুইংকেল হাউজ। যদিও তারা বন্ধু, তবুও ছ’জনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মৃত্যু পর্যন্ত তারা একসাথে এই বাড়িতেই থাকবে। সেই সিদ্ধান্ত থেকেই টুইংকেল হাউজ উপরে আরো দু’তলা বাড়ানোর জন্য কথাবার্তা চলছে। কারণ ইমনের পরিবার বড় হচ্ছে। কিছুদিন পর উপমা আর তূর্যের পরিবার বড় হবে। ইভান বিয়ে করতে পারে। তাই তারা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করছে। উপমার বাবা-মাকেও টুইংকেল হাউজে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের যেহেতু বয়স হয়েছে, এদিকে আদিল আর উপমা ছাড়া তাদের কেউই ছিল না। আর এখন তো আদিলও নেই। তাই তূর্য তাদের নিয়ে এসেছে।

এদিকে সুলতান মুন্সী আর রহমতুল্লাহর একই মাসে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ফাঁসি হয়ে গেলো। সালেহ আলী আর সুরাইয়া সেই সূত্রেই দেশে এসেছেন। সুরাইয়া নিজের ভাসুরের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। সালেহ আলীও ছ’জনের কারো সাথেই চোখ মেলাতে পারছেন না। কিন্তু অরুণিকা সব মান ভেঙে সুরাইয়াকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। সুরাইয়া অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
“বাবুন সোনা, আমি তোমার জন্য কতো দোয়া করেছি, জানো? আল্লাহ, আমার বাবুনটার যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। দেখেছো, আল্লাহ ন্যায় বিচার করেছে।”

তারপর তিনি অরুণিকার থুতনি ধরে বললেন,
“বাবুনের তো দেখছি রাজপুত্রের সাথে বিয়ে হয়েছে।”

আহনাফ কথাটি শুনে হালকা হাসলো। কেন যেন তারা ছ’জনের কেউই সালেহ আলী আর সুরাইয়ার দিকে এগিয়ে আসার সাহস পেলো না। সালেহ আলী আর সুরাইয়াই তো কলকাতার মতো অচেনা শহরে তাদের ছ’জনকে পথ দেখিয়েছিল, তাদের অবর্তমানে অরুণিকার দেখাশুনা করেছিল। তবুও যতো যাই হোক, এরা রহমতুল্লাহর আত্মীয়।

এদিকে কয়েক সপ্তাহ পর আহনাফ আর অরুণিকার বিয়ের আনুষ্ঠানিক আয়োজন শুরু হয়ে গেলো। টুইংকেল হাউজ এক সপ্তাহ আগেই সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে। মরিচ বাতি, ঝাড়বাতি, দামি দামি সব বাতি লাগিয়ে পুরো এলাকা সাজিয়ে ফেলেছে আরাফ, তূর্য আর ইভান। শুধু ফুলের সাজসজ্জাগুলো বিয়ের আগের দিন করবে।

এদিকে আহনাফ সকালে অরুণিকার রুমের সামনে এসে দরজায় ঠোঁকা দেওয়ার আগেই অরুণিকা দরজা খুলে দিলো। যার ফলে আহনাফের হাতটা অরুণিকার নাকের সাথে ধাক্কা খেলো। অরুণিকা নাকে হাত দিয়ে আহনাফকে জোরে ধাক্কা দিয়ে অভিমানী সুরে বলল,
“তুমি সবসময় আমাকে মারো!”

আহনাফ দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“এই তুমি আমাকে এভাবে ধাক্কা দিলে কেন? তুমি কি ভুলে যাচ্ছো, আমি তোমার বর। রেস্পেক্ট করো আমাকে।”

অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে রুমে ঢুকে বলল,
“রেস্পেক্ট করতে আমার বয়েই গেছে। আগে বলো, কেন এসেছো?”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোমার লাল শাড়ি আছে?”

অরুণিকা কোণা চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি শাড়ি পরবে?”

কথাটি বলেই আহনাফের উত্তরের অপেক্ষা না করে অরুণিকা হাসতে লাগলো৷ আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে থাকায় সে আলমারী খুলে বলল,
“হ্যাঁ, আক্দের শাড়িটাই আছে। আর কোনো লাল শাড়ি নেই।”

আহনাফ কিছু না বলে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। বিকেলে একটা প্যাকেট নিয়ে আহনাফ অরুণিকার ঘরে এসে বলল,
“কাল সকালেই এই শাড়ি পরে তৈরি হয়ে থাকবে।”

অরুণিকা প্যাকেট খুলে দেখলো, লাল রঙের শাড়ি। সে মুচকি হেসে ধন্যবাদ দেওয়ার আগেই আহনাফ বেরিয়ে গেলো। আর আহনাফকে আবার হনহনিয়ে চলে যেতে দেখে সে আহনাফের যাওয়ার পানে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো।
পরেরদিন ঠিক আটটায় অরুণিকা শাড়ি পরে তৈরী হয়ে নিচে নামলো। তাকে দেখেই আহনাফ ভুবন ভোলানো হাসি দিলো। অরুণিকা নিজেও জানে না, সেই হাসির মাঝে কি ছিল। সে শুধু অবাক হয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ বাইক স্টার্ট দিতেই অরুণিকা আহনাফকে ধরে বসলো। আর বলল,
“আজকে কি কোনো প্রোগ্রাম আছে?”

আহনাফ কোনো উত্তর দিলো না। সে চুপচাপ বাইক চালাচ্ছে। অনেকক্ষণ তারা চুপ করেই আছে। অরুণিকা আহনাফের পিঠে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। আজকাল আহনাফের সবকিছুই তার ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে সে নিজেও জানে না। এই মুহূর্তে আহনাফের গায়ে আতরের গন্ধটাই তাকে মোহিত করে তুলছে। সে চোখ বন্ধ করে সেটাই অনুভব করছে। অনেকক্ষণ পর আহনাফ বাইক থামালো। অরুণিকা চোখ খুলে আশেপাশে তাকালো। রাস্তাঘাট সে তেমন একটা চেনে না। তাই আহনাফের হাত ধরে সে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে, অরুণিকা সেদিকেই যাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর আহনাফ বলল,
“চোখ বন্ধ করো। একটা সারপ্রাইজ আছে।”

অরুণিকা চোখ বড় বড় করে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “সত্যিই!”

“চোখগুলো ফুলিয়ে ফেলতে বলি নি। বন্ধ করতে বলেছি।”

অরুণিকা ঠোঁট ফুলিয়ে মিনমিনিয়ে বলল, “এটিটিউড!”

আহনাফ এবার তার রুমাল দিয়েই অরুণিকার চোখ বেঁধে দিতে দিতে বলল,
“চোরামি করলে সারাজীবন আফসোস করতে হবে। তাই ফাঁক দিয়েও দেখার চেষ্টা করবে না কিন্তু। চোখটা বন্ধই রাখবে।”

অরুণিকা এক গাল হেসে চোখ বন্ধ করলো। সে আহনাফের হাত ধরে এক পা এক পা হাঁটছে, আর সিঁড়ি বেয়ে নামছে। কিছু পথ আহনাফের কোলে চড়েই সে পার করেছে। অরুণিকা এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
“মাটির ভেতরে চলে যাচ্ছো নাকি? এতো সিঁড়ি কেন সামনে?”

আহনাফ তাকে নামিয়ে দিয়ে তার ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, “কিছু শুনতে পাচ্ছো?”

অরুণিকা মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল,
“পাখির আওয়াজ, আর পানির আওয়াজ।”

আহনাফ পেছন থেকে অরুণিকার চোখটা খুলে দিয়ে বলল,
“এবার চোখ খুলে দেখো।”

অরুণিকা চোখ খুলে সামনে ঝর্ণা দেখে এক সিঁড়ি নামতে গিয়েই পিছলে পড়ার আগেই আহনাফ তার হাত ধরে ফেললো, আর বলল,
“বানরের মতো লাফাচ্ছো কেন? জায়গাটা পিচ্ছিল, দেখছো না?”

অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে ঝর্ণার কাছে এলো। অরুণিকা কিছুক্ষণ ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ তার হাত ধরে এক পা এক পা সামনে এগুতে লাগলো। এরপর একদম ঝর্ণার পাশে থাকা পাথরের উপর অরুণিকাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আহনাফ বলল,
“আমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করতে চাই, অরু।”

আহনাফ একটা রিং এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি কি এবার অতীত ভুলে নিজ ইচ্ছায় আমার সাথে একটা নতুন জীবন শুরু করতে চাও?”

অরুণিকা হাত এগিয়ে দিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। আহনাফ তার হাতে রিংটা পরিয়ে দিয়ে পাথরের উপর উঠে দাঁড়ালো। ঝর্ণার পানি পাথরের সাথে আঘাত পেয়ে তাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর সেই পানির ফোঁটা আহনাফের মুখের একপাশে বিন্দু বিন্দু কণার মতো জমে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। অরুণিকা হুট করে তার গালে হাত রেখে সেই পানির কণাগুলো স্পর্শ করে বলল,
“তুমি আমার ওই কথাটা মনে রেখেছো?”

আহনাফ মুচকি হেসে বলল,
“তোমার সবকিছুই আমার মনে থাকে।”

অরুণিকা মাথা নিচু করে মলিন মুখে বলল,
“ওদিন যা বলেছি, তাও?”

আহনাফ অরুণিকার মলিন মুখটা দেখে হালকা হেসে বলল,
“শুধু ঝাঁঝালো কথাগুলো ভুলে যাই।”

অরুণিকা মুচকি হেসে আহনাফকে বলল,
“আমি কি এখন তোমাকে জড়িয়ে ধরবো?”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি তো তোমারই মানুষ। অনুমতি কেন নিচ্ছো?”

অরুণিকা আহনাফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এবারও সে খুব শান্তি পাচ্ছে। আহনাফের বুকে এতো শান্তি কেন সে বুঝে উঠতে পারে না। তাহলে কি সে আহনাফকে ভালোবেসে ফেলেছে? কারণ সে শুনেছে, একমাত্র প্রিয়জনের বুকেই খুব শান্তি পাওয়া যায়। আহনাফ হয়তো ধীরে ধীরে তার খুব প্রিয়জন হয়ে উঠেছে। আর এই প্রিয়জন সব প্রিয়জন থেকে আলাদা।

১২০.

আজ আহনাফ আর অরুণিকার বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে মাস্টারমশাই, মিতুবালা আর শ্রীজাও কলকাতা থেকে এসেছেন। তারা এখনো শতাব্দীকে দেখেন নি। তারা বার-বার এদিকে ওদিক তাকিয়ে তাদের মেয়েকে খুঁজছেন। এদিকে উপমা শতাব্দীকে লেহেঙ্গা পরিয়ে দিয়ে তাহমিদকে রুমে আসতে বলল। তাহমিদ অরুণিকার ঘরে এসে শতাব্দীর হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফিরালো। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আমি এই লেহেঙ্গাটা তোমার জন্য পছন্দ করেছি। কলকাতায় কোনো অনুষ্ঠান হলেই তুমি লেহেঙ্গা পরতে। তারপর আমার সামনে এসে এই পোজ ওই পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। সেই শতাব্দী মেয়েটা কতো চঞ্চল ছিল, তাই না?”

শতাব্দী মলিন হাসলো। তার ইচ্ছে করছে হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে আগের মতোই তাহমিদের সামনে এসে দাঁড়াতে। কিন্তু সে পারছে না। অনেক চেষ্টা করেও সে পারছে না। শতাব্দীর চোখে পানি দেখে তাহমিদ তার চোখের পানি মুছে দিলো, তারপর তার চুলে খোঁপা করে সেই খোঁপায় কাঠ গোলাপের মালা বেঁধে দিলো। এরপর তাহমিদ নিজ হাতে শতাব্দীকে সাজিয়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আজ তোমার ছোট সখী, এই ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে চলে যাবে। তাই আমি তোমার জন্য আলাদা মেয়ে রেখেছি। এখন থেকে সে সবসময় তোমার পাশে থাকবে। আর আমি আমার রুমটা এই পাশে নিয়ে এসেছি। এখন তোমার পাশের ঘরে আমি আছি। মাঝখানে শুধু একটা দেয়াল মাত্র।”

শতাব্দী হাসলো। এরপর তাহমিদ তাকে নিয়ে নিচে নামলো। শতাব্দীর বাবা-মা আর বোন তাকে দেখে এগিয়ে এলেন। মেয়েকে দেখে আনন্দে তাদের চোখে জল চলে এলো। মাস্টারমশাই তাহমিদের সামনে হাতজোড় করে বললেন,
“তোমরা আমার মেয়েটাকে এতো ভালো রেখেছো যে গত চার বছরেও আমরা ওকে এতো ভালো রাখতে পারি নি।”

তাহমিদ মাস্টারমশাইয়ের হাত ধরে বলল,
“আমি আমার দায়িত্ব থেকে পিছপা হই না। শতাব্দী আমার দায়িত্ব। আমি আমৃত্যু এই দায়িত্ব পালন করে যাবো।”

এদিকে মাস্টারমশাই মেয়ের কাছে যেতেই মুরশিদ জুবাইয়ের ভাগ্নের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“এবার তুমিও নিজের বিয়েটা সেড়ে নাও। তুমি যদি বলো, আমি আর তোমার মামী মিলে তোমার জন্য মেয়ে দেখবো।”

তাহমিদ মুচকি হেসে বললো,
“আমি তো এখনো বিয়ে করার চিন্তা ভাবনা করি নি। আমি এভাবেই ভালো আছি।”

“কিভাবে ভালো আছো?”

“আমি শতাব্দীর সাথে ভালো আছি। আমার পাঁচটা বন্ধু, একটা মাত্র অরুণিকা, আর শতাব্দী, এটাই আমার সংসার।”

মুরশিদ জুবাইয়ের ভ্রূ কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“এটা কি বলছো তুমি, তাহমিদ? তুমি ভালোভাবেই জানো, শতাব্দী কখনো সুস্থ হবে না। ওর রোগটা ভালো হওয়ার মতো নয়।”

“আমি ওর সাথে এভাবেই ভালো আছি, মামা। ও সুস্থ হবে, কি হবে না, আমি সেই আশায় নেই। ও আমার সাথে আছে, এটাই অনেক।”

“শতাব্দীর যদি কিছু হয়ে যায়?”

“আমি এতোদূর ভাবি নি, মামা। আমি এখন আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে চাই না। অনেক বেশি ভেবে ফেলেছিলাম। তাই আজ শতাব্দীর এই পরিণতি। ওর এই অবস্থার জন্য আমিও কোনো না কোনো অংশে দায়ী।”

“তাই বলে বিয়ে না করে তুমি একা কিভাবে থাকবে? তোমার বংশ!”

তাহমিদ হেসে বলল,
“মামা, অরুণিকাই আমার বংশ। আমার সবকিছু ওর নামে।”

“যাই বলো, আহনাফ তোমার আপন ভাই নয়। এতো বিশ্বাস করে কি তুমি ঠিক করছো?”

তাহমিদ মুচকি হেসে বলল,
“আমাদের ছ’জনের সম্পর্ক আত্মার। আর এই সম্পর্কে আমি অন্ধবিশ্বাস রাখতে পারি। কারণ এই সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু অরুণিকাতেই সমাপ্ত।”

অনেক দিন পর আবার পথ চলতে গিয়েই সানায়া আর ইভানের দেখা হয়ে গেলো। সানায়া ইভানকে দেখেই হালকা হেসে কুশল বিনিময় করলো। ইভানও ঠোঁটে হাসি রেখেই সানায়ার সাথে কথা বললো। কথার মাঝখানে ইভান বলল,
“চলো, আমরা কোথাও বসি।”

সানায়া কথাটা শুনে ইভানকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল,
“অন্যদিন। আজ আমার কাজ আছে।”

“আচ্ছা। ঠিক আছে।”

সানায়া হালকা হেসে সামনে এগুতেই ইভান সানায়াকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার ভাইয়ার বাচ্চার কি অবস্থা?”

সানায়া হেসে বলল,
“রাহির একটা ছেলে হয়েছে। ওরা এখন আমাদের বাসায়ই আছে।”

“আর তুমি!”

সানায়া ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আমি কি?”

ইভান ইতস্তত ফেলে বলেই ফেললো,
“আগের কথাগুলো কি ভুলে যাওয়া সম্ভব না?”

সানায়া মলিন হেসে বলল,
“আমি তো অনেক আগেই সব ভুলে গেছি।”

ইভান এবার হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তাহলে আমরা কি আবার বন্ধু হতে পারি?”

সানায়া ইভানের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইভান সানায়ার ইতস্তত ভাব দেখে বলল,
“এবার আর কোনো মিথ্যেমিথ্যি চলবে না।”

সানায়া মুচকি হাসলো। সে আর অপেক্ষা করালো না। ইভানের হাত ধরে বলল,
“আমি তো এই বন্ধুত্বটা ফেলতে পারি না।”

ইভানও মুচকি হাসলো। ইভানের কাছে এই মেয়েটা সব মেয়েদের চেয়ে আলাদা। তাই তো মেয়েটার কাছেই সে ফিরে আসতে বাধ্য হলো। সে জানে না, সে সানায়াকে ভালোবাসে কিনা। কিন্তু যখন তার কাছে থাকতো, তখন সে ভালোই থাকতো। তখন একবারও তার মনে হয় নি, এই সব প্রতিশোধের কারণেই করছে। তাই হয়তো এই কয়েক মাসে সে অনেক অনুতপ্ত ছিল। সাহিলের মৃত্যুতে এই অনুতাপ যেন আরো বেড়ে গেছে।

এদিকে শাহেদ মির্জা সাহিলের একমাত্র শেষ চিহ্ন সায়িম মির্জার নামে তার পুরো সম্পত্তির অর্ধেক অংশ লিখে দিয়েছেন। বাকী অর্ধেক অংশ সানায়ার নামে করেছেন। সানায়া এখন মির্জা গ্রুপের নতুন এম.ডি। ব্যবসা নিয়ে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তাই তাকে সবকিছু শেখানো হচ্ছে। সাহিল নিজেও চাইতো, তার অবর্তমানে সানায়ায় যাতে সব দায়িত্ব নেয়। এদিকে সাবার সাথে শাহেদ মির্জার পছন্দ করার ছেলের বিয়ে হয়ে যায়। তারা আগের মতোই নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে। শুধু সাহিলের স্থানটিই এখন শূণ্য রয়ে গেছে।

এদিকে বিয়ের পর দিন থেকে প্রতিদিনই রাতে অরুণিকাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় আহনাফ, আর তাদের সঙ্গ দেয় আহনাফের শখের বাইক। তাদের বিয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। এই দুই সপ্তাহ অরুণিকার চরম প্রশান্তির সাথে কেটেছে। বিয়ে নামক সম্পর্কটা যে এতো সুন্দর হয়, তা আহনাফকে বিয়ে না করলে সে কখনোই বুঝতো না। আজও প্রতিদিনের মতোই সে আহনাফের সাথে বের হয়েছে। কিন্তু আজ বাইক থামলো একটা নদীর পাড়ে। অরুণিকা বাইক থেকে নেমে আহনাফের হাত ধরে বলল, “এখানে এতো অন্ধকার?”

আহনাফ বলল, “কেন তুমি ভয় পাচ্ছো?”

অরুণিকা মুচকি হাসলো। সে কিছু বললো না। শুধু আহনাফের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে রেখে বুঝিয়ে দিলো, এই মানুষটা পাশে থাকলে তার কোনো ভয় নেই। অনেকক্ষণ তারা নদীর পাড়ে চুপচাপ বসে ছিল। আহনাফ হঠাৎ তার কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“তুমি আমার পাশে থাকলে সারাদিনের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়? আমি কতো বছর এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম জানো?”

অরুণিকা দম আটকে রেখেছে। ইদানিং আহনাফ তাকে স্পর্শ করলেই তার অদ্ভুত অনুভূতি হয়। তখন অনিচ্ছায় সে তার শ্বাস আটকে রাখে। মনে হয় শ্বাস ছাড়লেই আহনাফ তার অস্থিরতা বুঝে ফেলবে। আহনাফ অরুণিকার কোনো শব্দ না পেয়ে তার কাঁধ থেকে মাথা তুলে বলল,
“চুপ করে আছো কেন?”

অরুণিকা শ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তুমি কি আমাকে কথা বলতে দিচ্ছো?”

আহনাফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
“আমি কি তোমার মুখে সেলাই করে দিয়েছি?”

অরুণিকা হুট করে বলে ফেললো,
“আহনাফ, তুমি আমাকে স্পর্শ করলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”

অরুণিকা কথাটি বলে খেয়াল করলো আহনাফ অনেকক্ষণ ধরেই চুপ করে আছে। অন্ধকারে তার মুখ বোঝা যাচ্ছে না, তাই সে আহনাফের প্রতিক্রিয়া দেখতে পারছে না। শুধু আহনাফের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলো। এই দীর্ঘশ্বাসটাই অরুণিকার মনে প্রশ্ন সৃষ্টি করলো। আহনাফ কি তার কথায় কষ্ট পেয়েছে? এভাবে বলাটা কি সুন্দর হয়েছে? হয়তো ও সুন্দর ভাবে গুছিয়ে কথাটা বলতে পারে নি। অরুণিকা তো সেই স্পর্শকে বিরক্তি বোঝাতে চায় নি, ভালো লাগা থেকেই দম বন্ধ হয়ে আসা বুঝিয়েছে। আহনাফ কি তাহলে উল্টোটা বুঝেছে?

আহনাফ অরুণিকার কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখে বসলো, আর বলল,
“সরি, আমি একটু বেশিই আগাচ্ছি। আচ্ছা, চলো। বাসায় ফেরা যাক।”

আহনাফ হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। অরুণিকা আহনাফকে উঠতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। আহনাফ তার বাইকের দিকে পা বাড়াতেই অরুণিকা চোখ বন্ধ করে জোর গলায় বলে উঠল,
“আমি হয়তো তোমাকে ভালোবাসি, আহনাফ।”

আহনাফ থমকে দাঁড়ালো। অরুণিকা আবছায়ার মধ্যে আহনাফকে কয়েক হাত দূরে দেখে দৌঁড়ে তার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“আমাকে ওখানে ফেলে এসেছো কেন?”

আহনাফ বলল,
“একটু আগে কি বলেছিলে?”

“ওখানে ফেলে এসেছো কেন, সেটাই জিজ্ঞেস করেছি। কানে শুনতে পাও নি নাকি?”

আহনাফ হালকা হাসলো। সে বাইকে উঠতেই অরুণিকা বাইকে উঠে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি এর আগে কি বলেছি তুমি শুনে ফেলেছো, তাই না?”

আহনাফ অরুণিকার কথায় শব্দ করে হাসলো। অরুণিকা নিজের বোকা বোকা কথায় নিজেই লজ্জা পেলো। আহনাফ এবার বাইক স্টার্ট দিলো। অরুণিকা বুঝতে পারছে না, আহনাফ কিছু বলছে না কেন। সে বারবার চাইছে আহনাফ নিজ থেকে বলুক, সে অরুণিকাকে ভালোবাসে। তারপর অরুণিকাও বলবে। আগে আগে বলে তার ছ্যাকা খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। হঠাৎ আহনাফ তার বাইক থামালো। অরুণিকা চমকে উঠে বলল,
“রাস্তার মাঝখানে কেন থেমেছো? তোমার শখের বাইক কি অক্কা পেয়েছে?”

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে টেনে নিজের সামনে দাঁড় করালো। তারপর হেলমেট খুলে, অরুণিকার হেলমেটটি খুলে নিলো। এরপর অরুণিকাকে তার সামনে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“বাইক না, আমার কষ্টগুলো অক্কা পেয়েছে।”

তারপর অরুণিকার হাত ধরে তাকে নিজের আরো কাছে টেনে এনে বলল,
“আমি যখন প্রথম তোমাকে বাইকে করে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় ঘুরতাম, তুমি তখন ঠিক এই জায়গায় বসে আমার বুকের সাথে লেপ্টে থাকতে। আমি এরও অনেক আগে থেকে তোমাকে আমার এই খালি বুকটাই জায়গা দিয়ে ফেলেছিলাম। আমি সেই সদ্য জন্ম নেওয়া ছোট্ট অরুণিকার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম, আর আমার চোখ সেদিনই তোমাকে মনে বসিয়ে ফেলেছিল। সেই ছয় মাসের ছোট্ট অরুণিকার ছোট ছোট আঙ্গুল ধরে ভেবেছিলাম, এই মেয়েটা বড় হয়ে আমার বউ হবে? কি অদ্ভুত, তাই না? আমি সেই আট বছরের অরুণিকার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, যখন সে দূর্গা বিসর্জনের দিন হারিয়ে যাওয়ার পর আমার কাছে ছুটে এসে, আমার গলা জড়িয়ে ধরে, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে, আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, আমি সেই মেয়েটাকেই সেইদিন আমার অনেক প্রিয় জায়গাটা দিয়ে ফেলেছিলাম। তোমাকে আমি ঠিক কখন থেকে ভালোবাসতে শুরু করেছি, আমি জানি না। কিন্তু তুমি আমার খুব শখের মানুষ ছিলে, অরু, যাকে আমি এই হাতে কোলে নিয়েছি, এই হাতেই খাইয়ে দিয়েছি, এই হাতেই বড় করেছি, আর এখন এই হাতটাই তার জন্য এগিয়ে দিয়েছি। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, অরু। ভালোবাসা কি সেটা জানার পর থেকেই তোমাকে ভালোবাসি।”

অরুণিকা শক্ত করে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমিও তোমাকে ভালোবাসি, আহনাফ। হয়তো আমার ভালোবাসতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমি ভালো তো এখন বেসেই ফেলেছি।”

আহনাফ অরুণিকার কপালে তার ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে বলল,
“আজকের এই নিস্তব্ধ পথ আর এই অন্ধকার রাত, আমার নতুন জীবনের সাক্ষী। আজ থেকে আমি আমার অরুকে আমার মতো করে পাবো।”

চলবে—

(লাইট থেকে কেউ পড়তে পারে না। তাই শেষ পর্বটা দুই ভাগে দিলাম। দ্বিতীয় অংশটা বিকেলে দেওয়া হবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here