আড়ালে_অন্তরালে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ১৩

0
401

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ১৩

হুইসেলটা বাজিয়ে ট্রেন যখন ছুটতে আরম্ভ করলো ফাহিম মৃদুস্বরে মায়াকে বলল – ভয় হচ্ছে?
ফাহিমের স্বরটা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই গম্ভীর লাগছিল। তার দিকে এক নজর তাকিয়ে মায়া বলল – আপনার চোখজোড়া বেশ লাল হয়ে আছে।
মায়া অনুভব করতে চাইলো ফাহিমের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা। হঠাৎ তার স্বর বদলে যাওয়ার উপলক্ষ্য কি! উদ্বেগী দৃষ্টি নিয়ে মায়া অপেক্ষা করছে কখন সে জবাব পাবে।
হাতের পিঠ দিয়ে চোখজোড়া মুছে নিল ফাহিম। নিজের কথা বলার ধরন বদলে স্বাভাবিক স্বরে বলল – একটা ভুল করে ফেলেছি মায়া। বাহিরে বের হলে চোখে চশমা পড়তে হয় আমার নয়ত একটা ধূলা পড়লেও আমার চোখের অবস্থা নাজেহাল হয়।
উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করা মায়া যখন জবাবটা পেল তখন তার খুব অপরাধবোধ হলো। যেই লোকটা তার এত কেয়ার করে, সেই লোকটার সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে সে বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল নয়। নিজের প্রতি এই দায়িত্বহীন আচরণে মুহূর্তেই মনের আকাশে মেঘ জমে তার। তবুও কিছুটা আশা নিয়ে বলল – চোখে পানির ঝাপটা দিবেন? আমি দিয়ে দেই! আপনার চোখে ফুঁ দিয়ে দেই!

পরিণত মায়ার মাঝে গত কয়দিনে এই বাচ্চাসুলভ আচরণটা দেখেনি ফাহিম। একেবারে বাচ্চাদের মত করে সে হন্যে হয়ে উঠেছে ফাহিমের কষ্টে। ফাহিমের মনে পড়লো ছোটবেলার দূরন্তপনার কথা।
খেলতে খেলতে যখনই তার চোখে জ্বা:লা:পো:ড়া করত এভাবে, তার বন্ধু রিহানও এমন করে বলত – আয় ফুঁ দিয়ে দেই।
আনমনে হেসে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল – উহু লাগবে না। ওয়েট করো, কিছুক্ষণ পর আই ড্রপটা দিলে ঠিক হয়ে যাবে।
কথাটা মনপুত হলো না মায়ার। উশখুশ করছে বেশ। এই অস্হিরতা টের পেয়ে নিজের এক হাত মায়ার পিঠের দিক হতে ঘুরিয়ে আলতো করে বাম হাতের বাহু করে। মায়া অনুভব করতে পারল ফাহিম তাকে এভাবেই আশ্বস্ত করছে। মায়া মুচকি হাসলো।

হেডফোন কানে গুঁজে গান শুনছিলো ফাহিম। চোখ জ্বা-লা কমেছে কিছুটা। ফোনে রিংটোনের শব্দ পেয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো বাবা লেখা।
একনজর মায়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা মেঘ দেখছে, গাছপালা দেখছে।
কলটা রিসিভ করে বাবাকে সালাম দিয়ে ফাহিম বলল – আমরা পথে আছি বাবা।
এক বাক্যের কথোপকথনে মায়া অবাক হলেও বুঝতে দিলোনা ফাহিমকে। তার কখনো মনে হয় লোকটা গম্ভীর, কখনো মনে হয় লোকটা চঞ্চল।

______

পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে মুরাদের বাড়ির পিছনের অংশে থাকা তার গোপন আ’স্তা’না’টা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। বিন্দুমাত্র চিহ্ন কিংবা কোন প্রমাণ রাখা হয়নি যে সেই ঘরগুলোতে কি হতো।
আত্মঘা’তী আক্রমণে হৃৎক্রিয়া বন্ধ হওয়া যাদের সেই এরিয়ায় মা|টি|চা|পা দেয়া হয়েছিল তাদেরও কৌশলে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

মাটি উপর থেকে তোলা হয়নি। মাটির ভিতর থেকে সুড়ঙ্গ বানিয়ে তাদের সরানো হয়েছিল। কাজটা করতে তিনদিন সময় লেগেছিল তাদের। সবকিছু আগের অবস্থানে নিতে অনেক কাঠ-খড় পোহাতে হয়েছিলো তাদের।
মুরাদের বিশ্বস্ত সহকারী রিহান তাকে মুহূর্তে মুহূর্তে খবর এনে দিয়েছে। সাদমানকে নিজেদের জি-ম্মা-য় নেয়ার পর মূলহোতাকে ধরতে নিজের মস্তিষ্কের সবগুলো কোষকে প্রতিটি মুহূর্তে ব্যস্ত রেখে পরিকল্পনা করে মুরাদ। ইমতিয়াজও সশরীরে সর্বোচ্চ সহায়তা করে তাকে।

মুরাদের সামনে চেয়ার টেনে বসে ইমতিয়াজ। কিছুটা আবদারের স্বরে বলে – আপনার ঘটনা বলবেন না? আপনি যাদের এখানে এনেছিলেন তাদের সাথে কি আপনার জীবন জড়িত আছে নাকি শুধুই নির্যাতিত মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছেন?

মুরাদ সেদিন হুট করেই মুখোশের আড়ালে থাকা নিজের মুখটা উন্মুক্ত করলো ইমতিয়াজের সামনে।
ইমতিয়াজ চমকে উঠল। অনেকটা জোরেই বলল – আমি তোমাকে প্রতিনিয়ত দেখেছি, তোমার সাথে প্রতিনিয়ত আমার চা দোকানটায় দেখা হয়।
মুরাদ হাসলো। ইমতিয়াজ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে মুরাদের হাসি। কি সুন্দর সেই হাসি!
মুরাদ এবার উত্তর দিল – ডাক্তার সাহেব, আপনি কি জানেন বাবা কিংবা মায়ের আদরে বড় হতে পারিনি। অথচ বাবা মা দুজনই বেঁ/চে আছে।
দশ বছর বয়সে একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা নেই ঘরে, ছোট্ট ফুটফুটে বোনটার মুখ বাঁধা, নীলচে হওয়া যাওয়া নিথর দেহ। আরেকটা বোন যে আমার তিন বছরের ছোট তাকে পাচ্ছিনা। চিৎকার করে করে মাকে ডেকেছিলাম। তখন আমার বোনটা খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে এলো। চোখে মুখে সে কি আতংক!
ভীত চোখে সে বলে – মা চলে গেছে ভাইয়া। আমাদের ছোট্ট বোনটাকে নিজের গর্ভধারিণী নিজ হাতেই গলা টি/পে শেষ করে ডাক্তার সাহেব।
কথাটুকু বলে থামল মুরাদ। চোখের কোল বেয়ে অশ্রু ফোঁটা গাল পর্যন্ত এসেছে। বাঁধা দিল না সে।
চোখ বন্ধ করে বলল – আমার নাম মুরাদ নয় আমার নাম তানভীর। বোনের নাম আয়েশা আর ছোট্ট ঐ ফুলের মত বোনটার নাম ছিল মারিয়াম।
চমকালো ইমতিয়াজ। সামনে বসে থাকা লোকটার নিজের সমস্ত পরিচয় ছিল কৃত্রিম। কোনটাই আসল নয়। কিন্তু অশ্রু ফোঁটাগুলো সত্যি ছিল।
হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছে মুরাদ বলল – আমার বাবা তখন ছিল রাঙামাটিতে। বিপর্যস্ত আমাদের পাশে তখন কেউ নেই। আমার সেঝ চাচী মাকে দেখে ফেলে যখন আমার মারিয়ামকে মা গলা টিপে শেষ করে। ভয়ার্ত চাচী চিৎকার করে উঠে। তার চিৎকার শুনে তাকেও আ ট কে ধ/র্ষ/ণ করে সিলিংফ্যানে ঝুলিয়ে দেয় সাদমান। আমার সেঝ চাচী অনেকটা তোমার স্ত্রীর মত দেখতে ছিল ডাক্তার সাহেব।
কিন্তু তারা ভুলে গেছে আমার বোন আয়েশা স্বয়ং দেখেছে সব।
জানো ডাক্তার, আমার একটুও কান্না আসেনি সেদিন। চাচা সেদিন ডুকরে কেঁদেছিল। মুহূর্তে শ্মশানে পরিণত হয়েছিল আমাদের ভালবাসার নীড়টা। বাবা কিছুই জানতে পারেনি। কিন্তু তিনদিন বাদে বাবা ফিরে আসে চাকরি ছেড়ে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় বাবাকে। আমার মেজর বাবাকে, সৎ নিষ্ঠাবান বাবাকে ঘুষের মিথ্যা অপবাদে, নারী কেলেংকারী জড়িয়ে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করে ঐ জামশেদ রহমান আর একজন কে, আমি এখনো জানতে পারিনি।
ডাক্তার সাহেব আমার বাবা, বোন আর আমাকে তখন আগলে রেখেছিলো আমার সেঝ চাচা। গ্রামের সব সম্পত্তি বিক্রি করে আমরা চট্টগ্রামের পটিয়ায় এসে উঠি। এখানকার হাসপাতাল, ব্যবসা, কোম্পানি সব কিছুর দেখভাল আমিই করি ডাক্তার। আমাদের এই স্বপ্নের নীড়ে পরকীয়া নামক বিষাক্ত ছোবলে আমরা আক্রান্ত হয়েছি। ডাক্তার আজ সবকিছু আছে, আমিও পড়াশোনা করে বড় হয়েছি। কিছুই ভুলিনি ডাক্তার। ঐ তামান্না রহমানকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই আমার মারিয়ামের কি দোষ ছিল?
পুরো ঘটনাটা ইমতিয়াজের কাছে যেন দুঃস্বপ্ন। সামনে বসে থাকা সুপুরুষটা ভয়ংকর রূপে আসার কারণ জানতে পেরে ইমতিয়াজ বলল – কষ্ট পেওনা।
মুরাদ স্বর বদলে বলল – কষ্ট পাইনা একদম। দাম চুকোবো শুধু।

______

বিশাল ফটকটা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেই চোখ ছানাবড়া মায়ার। ফাহিম বলেছিল সে ছোটখাটো চাকরি করে কিন্তু বাড়ির অবয়ব বলছে ভেতরের মানুষগুলো খুব অভিজাত। গলা উঁচিয়ে ফাহিম বলল – বাবা!
মিনিট দুয়েক পরে মায়া দেখল তার সামনে দাঁড়ানো অর্ধবয়স্ক লোকটা মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। তার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা দৌড়ে এসে মায়াকে জড়িয়ে বলল – ভাবীইই, কি সুন্দর তুমি!
ফাহিম মেয়েটার কান টেনে বলল – ঢং বাদ দিয়ে ওকে ভেতরে নিয়ে যা। বহুদূর থেকে এসেছি। টায়ার্ড লাগছে।
মায়াকে বলল – উনি আমার বাবা। আমি না থাকলেও বাবা তোমাকে মেয়ের মতন রাখবে।
এতক্ষণ সব শুনে অর্ধবয়স্ক লোকটা বলল – ভেতরে গিয়ে সব আলোচনা হবে, আগে ভেতরে এসো।

চলবে……

টাইপোগ্রাফি : মাকসুদা রত্না❤️❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here