আড়ালে_অন্তরালে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ২

0
850

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ২

কলেজে যাওয়ার পথে মায়াকে দেখে হাঁটার গতি থামায় ফাহিম। একেবারে মায়ার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় সে। হঠাৎ গতি রোধ হওয়ায় ভয় পেয়ে যায় মায়া। আড়ষ্ট কন্ঠে বলে – পথ ছাড়ুন।
কোন ভণিতা না করে ফাহিম বলল – আপনাকে কি আপনার স্টে প মাদার এভাবেই ট র্চা র করে?
অচেনা, অপরিচিত লোকটার কথার পিঠে কোন কথাটা বলবে তা ভাবতে কিছুটা ভড়কে গেল মায়া। জিহ্বা বের করে শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বলল – আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে আমি অপরিচিত কোন ব্যক্তির সাথে কথা বলতে অনিচ্ছুক।

ফাহিম যেন এই উত্তরের অপেক্ষায় ছিলো। মুখে হাসিভাবটা টেনে বলল – একদম ঠিক। কিন্তু আপনাদের উপরের ফ্লোরে মিলন থাকে তো, তার বাসায় যাওয়ার সময় আমি ব্যাপারটা দেখে কিছুটা আপসেট হয়েছি। আপনাকে দেখে এখন একান্ত কৌতূহলবশত প্রশ্নটা করেছি।
মায়া ফিরতি জবাব না দিয়ে পাশ কা টি য়ে চলে গেলো। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়েও আবার থামলো মায়া। কিছুটা ঝুঁকে নিচে তাকিয়ে দেখলো কোনমতে আটকে থাকা জুতার ফিতেটা ছিঁ ড়েই গেলো। বাকিটা রাস্তা খালি পায়ে হাঁটতে হবে ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিচু হয়ে জুতাটা হাতে নিতেই আবারও কন্ঠটা শুনলো – আপনার হাতে ব্যান্ডেজ কেন?
জুতাগুলো হাতে নিয়ে মায়া উত্তর দিলো – কে টে গেছে।
কৌতূহলী চাহনি নিয়ে ফাহিম পাল্টা প্রশ্ন করলো কিভাবে কা ট লো।
কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে মায়া বললো সৎমায়ের সংসারে থাকলে এরকম কিছু হওয়া স্বাভাবিক নয়?
মায়ার কথার ধরনে ফাহিম বলল এখন কি খালি পায়ে হাঁটবেন?
কথা না বাড়িয়ে হাঁটা ধরলো মায়া। মনটা খারাপ হয়ে গেল, সেই ছাপ পড়েছে মুখের উপর। সে পিছু ফিরে একবার তাকালে দেখতে পেত অপরিচিত মানুষটা তখনো দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখছে।

____

– মিলন! প্রথম দেখায় প্রেম বলে কি কিছু আছে?
ফাহিমের করা এমন প্রশ্নে মিলন হতবাক হয়ে আগাগোড়া ফাহিমকে দেখে বলল – তুই কি কোনভাবে প্রেমে পড়েছিস?
– মনে হয় অ ঘ ট ন ঘটেই গেল। ঐ যে তোদের থার্ড ফ্লোরের ঐ মেয়েটা।
ফাহিমের কথা শুনে মিলন কিছু বলতে গিয়েও বলল না কারণ ফাহিম হাত দিয়ে ইশারা করে থামতে বলেছে।

মুঠোফোনটাকে হাতে নিয়ে কিছু একটার হিসাব মিলাতে ব্যস্ত সে। কোনমতে তার হিসেব মিলছে না। নিজের মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে হিসেবটা আন্দোলিত হচ্ছে। মিলনের কন্ঠ নিঃসৃত বাক্যটা তার কাছে নিছক শব্দ দূষণ মনে হয়েছে।
নিজেকে যথাসম্ভব চুপ রেখে আবার কাজে মনোযোগ দিলো ফাহিম কারণ অফিসের কাজ ঠিকঠাক করে করতে না পারলে বসের ধমক শোনার মত এই ব্যাপারটা তাকে খুব পী ড়া দেয়।
তখন মিলন আবারও বলল – দোস্ত রায়হান সাহেব কিন্তু বড্ড কড়া। আজকের প্রজেক্ট রেডি করতে তিন মিনিট লেট হওয়ায় কি করলো?
ফাহিম এবার ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে মিলনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলল – আমার কাজের সময় তোর এত কথা মনে হয় কেন?
কথাটা শেষ করতে না করতেই মুঠোফোনে কম্পন অনুভব করলো ফাহিম। স্ক্রিনটা আনলক করে মেসেজটা পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার। হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে শান্ত করে মিলনকে বললো – আমি আসছি মিলন।
মিলনকে কোন কথা বলতে না দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো ফাহিম, সিঁড়িতে আবারও মায়ার সঙ্গে দেখা। মেয়েটা গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠছে। তার পায়ের দিকে তাকাতেই ফাহিম বললো – জুতো ছাড়াই ছিলেন এতক্ষণ?
মায়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল – কে আপনি? এত কৌতূহল কেন আপনার?
ফাহিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল – আমি ফাহিম মির্জা।
কন্ঠটা শুনে কিছুটা দমে গেল মায়া। লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত। শান্ত, টলমলে দীঘির স্বচ্ছ জলের মতো চোখজোড়া খুব আকর্ষণীয়, দুবাহুর পেশীগুলো যেন জামা ভেদ করে বাহিরে আসতে চায়, শার্টের টপ বাটন দুটো খোলা, সেই উন্মুক্ত জায়গায় উঁকি দিচ্ছে প্রশস্ত বুক, গলার উঁচু হাড়টা প্রতিটি ঢোকের সাথে তাল মিলিয়ে উঁঠা নামা করছে, ঠোঁটজোড়া যেন সদ্য সিগারেটের ধোঁ য়া বিসর্জন দিয়েছে, ক্লিন শেভ আদলখানা, কপালের কোণে আছড়ে পড়া এক ঝাঁক চুল সব মিলিয়ে যে-কোন মেয়ের হার্টবিট থামিয়ে দেওয়ার মত ক্ষমতা রাখে লোকটার সৌন্দর্য। অস্ফুটস্বরে মায়া বলল – মাশাল্লাহ!

বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনী দিয়ে নিজের ঠোঁটের দুপাশ থেকে হাতটা নিচে নামিয়ে ফাহিম বলল – এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার লজ্জা করছে না বুঝি?
সম্বিত পেয়ে ভিষণ লজ্জায় পড়ে যায় মায়া, নিজের এই বেহাল দশা ফাহিমকে বুঝতে না দিয়ে দৌড়ে উপরে উঠে গেল সে। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আনমনে হাসলো ফাহিম, পরক্ষণে কিছু একটা মনে পড়তেই দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে গেল।

_____

– আসসালামু আলাইকুম, স্যার। একটা সংবাদ পেয়েছি। আমাদের ইনফর্মার সেলিম হায়দারকে মুরাদ রেহমান খু*ন করেছে, তার মৃ ত দে হ টাকে ওখানেই পুঁ/ তে ফেলেছে এমন তথ্যা পেয়েছি।
সামনে থাকা মেয়েটার কথা শুনে নির্বাক বসে রইলেন সাদমান আশরাফ। তিনি প্রস্তুত থাকেন এসব তথ্য শোনার জন্যই। দীর্ঘশ্বাসটা নীরবে বুকের ভেতর চা|পা দিয়ে বললেন – আর কত লা শ পড়লে মুরাদ ধরা পড়বে। ধরা পড়বে তার বিশাল রাজ্যের আগাছাগুলো।
কথাগুলো শুনে নড়েচড়ে বসে মেয়েটা বলল – স্যার, অল্প কিছুদিন সময় চাইছি। আর সেলিমের লা শ টা সেখান থেকে আনানোর ব্যবস্হা করেছি স্যার।

চুপচাপ কিছুক্ষণ ভেবে সাদমান বললেন – রি স্ক হয়ে যাচ্ছে না?
নিশ্বাসটাকে খানিকটা গভীর করে সামনে থাকা নারী কন্ঠটা বলল – ব্রত নিয়েছি স্যার। নিজের জীবন দিয়ে হলেও দেশকে রক্ষা করব। আমাদের সেলিমের পবিত্র দেহ ঐ অপবিত্র জায়গায় থাকা মানে তাদের কাছে হেরে যাওয়া। তাদের প ত ন আমি দেখব স্যার।

প্রত্যোত্তরে কিছুই বললেন না সাদমান। ঈষৎ হাসলেন শুধু যার অর্থ তোমার উপর ভরসা আছে।
সাদমান আশরাফের রুমটা পেরিয়ে ডানেবায়ে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে ফোনটা কানে লাগালো। মুহূর্তেই হাসি মুখটা মলিন হয়ে গেল। ওপাশ থেকে তাকে বলছে – ম্যাম আপনার কথামতো রাস্তার দক্ষিণ পাশটা খুঁড়ে মুল এরিয়া থেকে তিনফুট দূরত্বে আসার সাথে সাথেই রাস্তা ধ্বসে পড়ে। খবরটা মুরাদের কানে যেতেই তার লোকেরা ছুটে আসে আর মাটির ভিতর থেকে গর্তে থাকা অসীম আর প্রীতমকে বের করে আনে আর ভিতরে নিয়ে যায়। গত রাত থেকে যতটুকু কাজ এগিয়েছে আজ সম্পূর্ণটা আবার ভেস্তে গেছে, তারা জায়গাটা ভরাট করে দিয়েছে। জানিনা অসীম আর প্রীতম কেমন আছে।

কথাগুলো শুনে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিলো
র হ স্য ময়ীর। নিজের নেয়া সব সিদ্ধান্তকে ভন্ডুল করে দিচ্ছে মুরাদ। সে যেন এক কাঠি বেশি এগিয়ে থাকে সবসময়, স্যারকে কি জবাব দিবে, নিজের জেদের কারণে আরো দুজন চৌকস সদস্য হারিয়ে ফেলল সে। তাদের শুন্যস্হান পূরণ হবার নয়। পুনরায় সাদমান আশরাফের কক্ষের বাহিরে দাঁড়িয়ে নারীকণ্ঠটা বলল – আসব স্যার!
ভেতর থেকে উত্তর এলো – দুঃসংবাদ দেয়ার দরকার নেই, কাজের ক্ষেত্রে আরো সাবধান হতে হবে।
লজ্জায় মাথানিচু করে ফিরে এলো সে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে – মুরাদের মত লোককে সে ধরবেই।
আদতে সে জানেও না মুরাদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে। তাকে শুধু বলা হয়েছে মুরাদকে থামাতে। ব্যস এই ইন্সট্রাকশনটাকে সে ব্রত বলে মেনে নিয়েছে।

____

– কার আদেশে আর কি কারণে আমার এখতিয়ারাধিন জায়গায় তোমরা গর্ত খুঁড়েছ?
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কোন উত্তর না পেয়ে আবারও প্রশ্নটা করলো মুরাদ। তিনবার একই প্রশ্ন করে যথারীতি জবাব না পেয়ে হো হো করে হেঁসে উঠলো সে। তার হাসি শুনে সামনে থাকা অসীম আর প্রীতম ঘাবড়ে গেলেও মুখে প্রকাশ করছে না তারা। তাদের সামনে বসা লোকটার মুখে মাস্ক, চোখের রোদচশমাটা হয়ত চোখগুলো আড়াল করার জন্য ব্যবহার করছে, এক কথায় বলতে গেলে পা থেকে মাথা অব্দি কোন অংশই খোলা রাখেনি লোকটা। তাদের দৃষ্টির তাল বুঝে মুরাদ বলল – আমাকে স্ক্যান করা শেষ হলে আমি কাজ শুরু করব। বলবে কেমন!
মুরাদের বলা কথাগুলো অসীম আর প্রীতমের হিম শীতল করে দিয়েছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল – আমাদের নিরুপমা ম্যাম পাঠিয়েছেন, সেলিম হায়দারের লাশটা নিতে। আমরা সেজন্য মাটি খুঁড়ে গর্ত করে সেলিমের লা শ অব্দি সুড়ঙ্গ করে সেই পথ দিয়ে তাকে নিয়ে বের হতে চেয়েছিলাম।

মুরাদ হাসলো কি না দেখা গেলো না। কিন্তু কন্ঠস্বরে ছিল ভয়ানক গাম্ভীর্য। গমগমে কন্ঠে সে শুধালো – নিরুপমা কে?
প্রীতম বলল – লেডি গোয়েন্দা, শখের বশে করে এই কাজ।
তাদের দিক হতে দৃষ্টি সরিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে মুরাদ বলল – বাহ্, তাহলে তো তার জন্য উপহারস্বরূপ কিছু পাঠাতে হয়।

চেয়ারে বাঁ ধা অসীম আর প্রীতমের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো মুরাদ। তাদের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বলল – তোমাদের ছেড়ে দেবো। তাকে গিয়ে আমার পরিচয়টা দিও।

খানিক বাদে কান ফাটানো চিৎকারের শব্দ। চেয়ারে বাঁধা অসীম আর প্রীতমের পায়ের কাছে পড়ে আছে তাদের কাঁ টা আঙ্গুলগুলো আর দুটো মাংশল পিচ্ছিল পিন্ড,অনায়াসে যে কেউ বুঝবে ঐ পিন্ডদুটো কারো জিহ্বার কাঁ / টা অংশ। লাল বর্ণের তরলটা আস্তে আস্তে চেয়ার বেয়ে নিচে গড়িয়ে আসছে। নিজের হাতে লাগা লাল তরলটা মুছে মুরাদ বলল – কেউ ওদের ট্রিটমেন্ট করে নিরুপমার কাছে পৌঁছে দিস, সাথে তাদের আঙ্গুল আর জিহ্বাগুলো তার জন্য স্মৃতিচারণ করতে পাঠিয়ে দিস।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here