#ধারাবাহিকগল্প
#একটি ভুল
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী
রিমার মা ওর বাবাকে ধরে নিয়ে তাড়াতাড়ি সোফায় বসিয়ে দেয়। রিমারা যেহেতু সরকারি কোয়ার্টারে থাকে তাই চিৎকার চেঁচামেঁচি শুনে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে রিমাদের বাসার দিকে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলো। জুনায়েদ দরজায় দাঁড়িয়ে রিমাকে বললো,
——রিমা তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি আমার বিয়ে করা বউ। দেখি তোমাকে কে আটকায়?আমি সাথে পুলিশ নিয়ে এসেছি। অন্যের বউকে জোর করে আটকে রাখা এক ধরনের অপরাদ।
রিমাকে নির্লিপ্তভাবে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে রিমার বাবা চিৎকার করে ওর মাকে বললো,
——ওরা আমার কলিজাটাকে আমার শরীর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। আমার নির্বোধ মেয়েটা আগুনে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে। তুমি ওকে আটকাও।
রিমার মা বললো,
—–শান্ত হও রিমার বাবা যে যেতে চায় তাকে তুমি আটকে রাখবে কিভাবে?দেখি আল্লাহপাক আমাদের ভাগ্যে কি লিখে রেখেছে?
ততক্ষণে রিমা দরজার কাছে পৌঁছে জুনায়েদকে বললো,
—–তুমি মনে হয় আমার চিঠিটা পাওনি?
——কিসের চিঠি ডার্লিং
—– তোমাকে ডিভোর্সের চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি। আজ না পেলেও কাল পেয়ে যাবে।
——আমি জানি, রিমা তুমি তোমার বাবা মাকে ভয় পেয়ে এ কথা বলছো। ভয় পাওয়ার কো কারণ নেই। আইনত তুমি আমার স্ত্রী। আগাম সতর্কতার জন্য আমি সাথে পুলিশ নিয়ে এসেছি। তুমি নির্ভয়ে আমার সাথে চলো।
—–আমি সজ্ঞানে নির্ভয়ে তোমাকে ডিভোর্স দিয়েছি। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো না। আমি তো হিব্রু ভাষায় বলছি না। খাঁটি বাংলা ভাষায় তোমার সাথে কথা বলছি। আর এই যে পুলিশ ভাই আপনারা নিজ কানে তো শুনলেন আমার সাথে ওর এখন কোনো সম্পর্ক নেই। ওকে বিয়ে করে আমি সারাজীবনের ওন্য একটা বড় ভুল করেছি। হয়ত কোনদিন আমার এই ভুলের সংশোধন করা যাবে না। আমার দুভার্গ্য আমি ভুল মানুষকে ভালবেসেছিলাম। আপনারা এখন আসতে পারেন।
এই কথা বলে রিমা চলে গেল। রিমার বাবা এসে জুনায়েদকে বললো,
——ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো নইলে আমাকে ব্লাকমেইল করার জন্য তোমাকে এই মূহুর্তে পুলিশে দিবো। রিমার বাবার কথা শুনে পুলিশ জুনায়েদকে বললো,
—–শোনেন আমাদের সময়ের অনেক দাম। ফাজলামি করার জায়গা পান না। মেয়েতো আপনারে ডিভোর্স দিছে। শুধু শুধু আমাদের এখানে নিয়ে আসলেন।
—–স্যার ওর সাথে আমার কাল রাতেও কথা হয়েছে। ও ওর বাবা মার ভয়ে এসব কথা বলছে।
—–কার ভয়ে বলছে সেটা আমাদের জানার দরকার নেই। মেয়ে এখন সাবালিকা। ও সজ্ঞানে বললো,আপনাকে ডিভোর্স দিয়েছে। আমাদের আর কিছু জানার বাকি নাই। আমরা চললাম।
জুনায়েদ রিমার মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো। ওর সব প্লান ভেস্তে গেল। অগত্যা বিমর্ষ বদনে ওর সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় হলো।
ওরা চলে যাবার পর পাশের ফ্লাটের প্রতিবেশী রিমার বাবার কলিগ জামান সাহেব কি বিষয় জানার জন্য রিমাদের ফ্লাটের ডোরবেল বাজালো। রিমার মা দরজা খুলে দেখে জামান সাহেব আর উনার সহধর্মীনি দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও রিমার মা মনে মনে অনেক বিরক্ত হলো তবুও মুখে কাষ্ঠ হাসি মেখে বললো,
—–আসসালামুআলাইকুম। আসেন ভাই ঘরে আসেন।
—-আমরা আপনাদের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী। আপনাদের বিপদে না এসে থাকতে পারি। ছেলেটার সাথে কি রিমার সত্যি বিয়ে হয়েছিলো নাকি আপনাদের ব্লাকমেইল করছিলো।
রিমার মা কিছু একটা বলতে যাবে তখনি মিসেস জামান বললেন,
—–ওমা তুমি শোননি ছেলে তো সাথে করে কাবিননামা নিয়ে এসেছে। বিয়ে না হলে কাবিননামা পেলো কোথায়? মেয়েটা আপনাদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে তবে ছাড়লো। সন্তান অল রাউন্ডার হলে বাবা মার গর্ব হয়। কিন্তু লেখাপড়ার সাথে সাথে সন্তানের চরিত্রটা সুন্দরভাবে গড়া উচিত। অহংবোধের কারণে অনেক বাবা মা সেটা ভুলে যায়।
অবশ্য ভাবি আপনাদের অনেক ধৈর্য। শুনেছি রিমার বাবা মেয়েটাকে অনেক ভালবাসত। অথচ দেখেন মেয়ে কি ভালবাসার মুল্য দিল? ও যদি আমার মেয়ে হতো এতোক্ষণে কেটে গাঙ্গের জলে ভাসিয়ে দিতাম।
রিমার মা বললো,
——ভাবি আপনি কি আর কিছু বলবেন। আপনার ভাইয়ের প্রেসারটা মনে হয় বেড়ে গেছে।
জামান সাহেব বললেন,
—–প্রেসারের কি দোষ? মেয়ে যে কাহিনী করেছে তাতে যে কারো প্রেসার বেড়ে যাবে। দেখেন ভাবি আমার মেয়েটা পড়াশোনায় অত ভালো না। কোথাও চান্স পায়নি। কিন্তু আমার মেয়ের চরিত্র একশত ভাগ খাঁটি। কোনো ছেলে ওর মুখের দিকে তাকাতে পারেনি। আপনার ভাবি ওকে আনা নেওয়া করে। ও সরি ভাবি অনেক কথা বলে ফেললাম। ভাইকে ডাকার দরকার নেই। আমরা আজ উঠি। আপনি বরং ভাইয়ের শরীরের দিকে খেয়াল রাখেন।
অপমানে রিমার বাবা মা আজ জর্জরিত। রিমার মা ওর ঘরে এসে বললো,
—–তোর আমরা কি ক্ষতি করেছিলাম যে এভাবে আমাদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিলি?
রিমার বাবা রিমার মাকে ডেকে বললো,
—–ওকে আর বকে কি হবে?এ আমাদের অহংবোধের শাস্তি। আমরা সবসময় ভেবেছি আমাদের ছেলেমেয়েদের রেজাল্ট ভালো হয় ওদের নিজের যোগ্যতায়। এই জন্য আমাদের ভিতরে অহংবোধের জন্ম হয়। কিন্তু এটা ঠিক নয়। আল্লাহপাকের রহমত থাকে বলেই ওরা ভালো রেজাল্ট করে। আমি বহুবার জামান ভাইয়ের সাথে রিমার রেজাল্ট নিয়ে গর্ব করতাম। উনার মেয়েটা ছাত্রী হিসাবে অতটা মেধাবী ছিলো না। জামান ভাই একা আয় করতো যার কারণে সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য আমাদের চেয়ে কম ছিলো। জামান ভাই কমপ্লেক্সে ভুগতো। অহংকার পতনের মূল জীবনের কাছে আবারও শিখলাম। রিমাকে আর কিছু বলো না। ওকে একটু একা থাকতে দেওয়া উচিত। তারপরও আজ মনে হলো মেয়েটা আমার এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ও যে সঠিক পথে ফিরে এসেছে আমি এতেই খুশী।
রিমার মা বাবা আর ওর দুই ভাইসহ টেবিলে ডিনার করতে বসলো। রিমার মা রিমাকে ডিনার করতে ডেকেছিলো। ও বললো,”ও রাতে কিছু খাবে না”। রিমার মা ও জোর করেনি।
ওরা তাড়তাড়ি ডিনার শেষ করলো। রিমার বাবা ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। রিমার মা জেগে আছে। রিমা টেনশনে ঘুমাতে পারছে না। রিমার মায়ের একটু তন্দ্রাভাব এসেছে। রিমা ওর রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো। আকাশে আজ অনেক মেঘ করেছে। থেমে থেমে দমকা বাতাস বইছে। রিমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে আছে। পাশের ফ্লাটের আঙ্কেল আন্টির কথাগুলো ওর কানে এখনও বাজছে। আর বুকের গহীন কুয়াটায় বাবা মার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। দমকা বাতাসের ঝাপটায় শীতলবাতাস রিমাকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ওর বুকের ভিতরের কষ্ট আর যন্ত্রণাগুলো এই বাতাসে উড়িয়ে দিতে পারত ক্ষণিকের জন্য হলেও বুকের ভিতরটা হালকা হতো।
রিমা অপেক্ষা করছে একটা বৃষ্টির। অনেক দিন ধরে একটা অপরাধবোধের দহনে পুড়তে পুড়তে অঙ্গার হয়ে আছে। বৃষ্টির জল এসে যদি আগুনটা নিভিয়ে দিতে পারতো রিমার জ্বালাটা দূর হতো। রিমা ওর ভুলে ভরা অতীতটা ভুলে যেতে চায়। ও আর পিছন দিকে তাকাতে চায় না।
মাঝরাতে বারান্দায় ধপাশ করে শব্দ হলো। রিমার মা বারান্দায় এসে দেখে রিমা মেঝেতে পড়ে আছে। রিমার মা টেবিল থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে এসে মুখে ছিটা দিতেই চোখের পাতাটা নড়ে উঠলো। ঠোঁটটা কেঁপে উঠছে। ও যেন কিছু বলতে চায়। ওর মা মেয়েকে তুলে কোলের কাছে বসালো। তারপর মেয়ের মুখের কাছে মাথাটা নামিয়ে শোনার চেষ্টা করছে। মাফ করে দাও শুধু এই কথাটা শুনতে পেলেন। মেয়েটা আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। রিমার মা চিন্তিত হয়ে ওর বাবাকে অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে বললো।
চলবে