একটুখানি_প্রেম ❤️ #পর্বসংখ্যা_০৮

0
320

#একটুখানি_প্রেম ❤️
#পর্বসংখ্যা_০৮

আলতো খোলা দরজায় উঁকি দিলো হিয়া। ঘর ফাঁকা, কাহন নেই। হিয়ার মন খারাপ হবার কথা, কিন্তু হলো না। বরং খুশি হলো। দরজায় হাত রাখলো। এক পা এগোলো। কোনো এক বিচিত্র আকর্ষণ শক্তির বলে সে ঢুকে গেল ঘরটায়! কাহন নেই তো কি হয়েছে, ওর সবকিছু তো আছে? সেসব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে ক্ষতি কি?

ছোট্ট একটা ঘর। একপাশে একটা চৌকি পাতা। পাশেই পড়ার টেবিল, চেয়ার। চেয়ারখানার অবস্থা দেখবার মতোই! পায়ার সাথে আলাদা কাঠ লাগিয়ে জোড়া দেয়া। টুপ করে সেটাতে বসে পড়লো হিয়া। নড়বড়ে চেয়ার দুলতে দুলতে ‘ক্যাচ-ক্যাচ’ শব্দ করে উঠলো। টেবিলে চোখ বুলালো। হরেক রকমের বই। ভারী ভারী, মোটা মোটা। টেবিলের সামনের দেয়ালে নানা রঙের কাগজ সেঁটে রাখা। কোনটা পুরোনো পরীক্ষার রুটিন, ডেইলি-রুটিন, কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির উক্তিও চোখে পড়লো। সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো হিয়া। আত্মস্থ করলো কাহনের প্রতিটি বিষয়!

আসবাব বলতে ঘরে একটিমাত্র আলনা, আর ছোট্ট একটা ট্রাংকই চোখে পড়লো। ট্রাংক তালাবদ্ধ। আলনায় কিছু অগোছালো কাপড়-জামার ভীড়! হিয়ার কি হলো কে জানে! চেয়ার ছেড়ে উঠে আলনার সামনে দাড়ালো। উপরের এলোমেলো একটা শার্ট তুলে নিলো হাতে। পুরোনো রংচটা শার্ট, তবুও হিয়ার কাছে মনে হলো পৃথিবীর সবচে’ দামী কাপড় এটা। ছুঁয়ে দেখলো, ঘ্রাণ শুঁকলো, বুকের সাথে চেপে দাড়িয়ে রইলো। আহা, কাহনকে পাওয়ার তৃষ্ণা যেন অনেকখানিই মিটে গেল। আলগোছে শার্টে একটা চুমুও খেল হিয়া। তারপরেই হঠাৎ লজ্জা পেল। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে?

— “তুমি?”

হঠাৎ কারো কণ্ঠ শুনে ধ্যান ভঙ্গ হলো হিয়ার। চট করে দৃষ্টি ফেরাতেই দেখলো কাহন দাড়িয়ে! ওকে দেখেই বললো,

— “তুমি এখানে কি করছো? আমার শার্ট–”

হতবাক, হতবিহ্বল হয়ে পড়লো হিয়া। কাহনের শার্টটা তখনও বুকের সঙ্গে লেপ্টে ধরা। কি বলবে সে? কি জবাব দেবে? হিয়াকে নিশ্চুপ দেখে ঠোঁট টিপে কি যেন ভাবলো কাহন। ক’ পা এগিয়ে এসে নিজের শার্টটা দখলে নিলো। সেটার দিকে চেয়ে রইলো তীক্ষ্ণ নজরে। হিয়া মাথা নিচু করে অপরাধী সুরে বললো,

— “এমনই এসেছিলাম। বাড়িটা দেখছিলাম একটু–”
— “বাড়ি দেখছিলে ভালো কথা। কিন্তু আমার ঘরে কি? আর আমার জিনিসপত্র নাড়ছিলে কেন?”

তীব্র হলো কণ্ঠ। উষ্ণতা টের পাচ্ছিল হিয়া। কাহন রেগে গেছে! কিন্তু উপযুক্ত জবাব হিয়ার শব্দভাণ্ডারে নেই। ভাষাহীন হয়েছে সে। ঠিক সেই সময় কাহনের রাশভারী, গম্ভীর ধ্বনিতে গমগম করে উঠলো পুরো ঘর,

— “না বলে অন্যের ঘরে ঢুকে তার জিনিসপত্র ঘাঁটা কোনো ভদ্র মেয়ের কাজ নয়। দয়া করে বেরিয়ে যাও!”

নিঃশব্দে, চোরের মতো চুপিচুপি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল হিয়া। আনমনে কপোল বেয়ে গড়ালো একফোঁটা নোনা জল!
___

সন্ধ্যায় পড়তে বসেছে দুই জমজ ভাই। নিজেদের ঘরে। আগে অবশ্য কান্তার কাছে তাদের পড়ার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে উঠবার পর থেকে আপা আর তাদের পড়ায় না। তার নিজের পড়া আছে ঢের। ছোট ভাইদের দেখবার সময় নেই!

এই সুযোগে দুরন্ত পবন পড়তে বসে হাজারটা দুষ্টুমি করতে পারে। পড়ালেখা তার কোনোকালেই ভালো লাগে নি; আপার যন্ত্রণায় তবুও মুখ বুঁজে সহ্য করতো। কিন্তু এখন সে স্বাধীন। ডানা মেলা পাখির ন্যায় উড়ে বেড়ায় আকাশে! ইচ্ছে হলে হোমওয়ার্কের জায়গায় হিজিবিজি লেখে, আঁকি-বুঁকি করে। পরাগ তাতে ভারী বিরক্ত,

— “তুই পড়ছিস না কেন, বল তো?”
— “এমনই। শখ করে!”

উদাস গলায় জবাব দিলো পবন। পরাগ বেজায় চটে গেল,

— “কাল ক্লাসে সিটি আছে! পাশ করতে না পারলে মাকে কল করে জানাবে মিস! তুই পাশ–”

— “সে আমি করবো কোনমতে। তুই তোর চিন্তা কর।”

পবনের কোনো হেলদোল নেই। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে অন্য দিকে সরে গেল পরাগ। ঠিক করলো পবনের সাথে আর কথাই বলবে না। এতো উদাসী, বেপরোয়া হয় কেউ? পবন তার জমজ ভাই না হলে ওকে নিয়ে একটুও মাথা ঘামাত না পরাগ। নেহাতই দুজনের চেহারা এক, ক্লাসের স্যার-মিসদের গোলমাল হয়ে যায়। পবনের দোষের শাস্তি প্রায়ই তাকে পেতে হয়; মাও দুজনকে একসঙ্গে শাস্তি দেন; তাই নিজে বাঁচবার জন্যই পবনকে পড়তে বলা। নয় তো ওর কি ঠ্যাকা!

পবন নিজের মত বই দাগাচ্ছিল। হঠাৎ কি মনে করে লাফিয়ে উঠলো,

— “একটা খবর শুনবি, পরাগ?”
— “কি?”

গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো সে। কথা বলবো না, বলবো না করেও। একলাফে ওর কাছে সরে এলো পবন। গায়ে গায়ে বসে, ফিসফিস করে বললো,

— “হিয়া আপার সাথে কাহন ভাইয়ের কি যেন চলছে!”
— “কি?”

বোকা বনে গেল পরাগ। ওর দিকে চেপে এসে পবন জানালো,

— “লাভ চলছে। আজকে বিকেলে দেখছি। জানিস?”
— “কি দেখেছিস? বুঝলি কি করে?”

বড় বড় চোখ করে তাকালো। বিজ্ঞের মতো হাসলো পবন,

— “আজকে হিয়া আপা বাড়ি এসেছিল, মনে নেই? বিকেলের দিকে? তখন দেখেছি। কাহন ভাইয়ের ঘরে ঢুকেছে। ভাইয়ার শার্ট হাতে নিয়ে চুমু খাচ্ছিল!”

বলেই মুখ চেপে হি হি করে হাসতে লাগলো পবন। বোকা পরাগ বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে গেল! বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,

— “বলছিস কি!”

— “হ্যাঁ রে, হ্যাঁ। যদি কিছু না থাকে অমন করলো কেন? কান্তা আপা তো ভাইয়ের ঘরে যায় না। হিয়া আপা গিয়ে– সিনেমায় দেখিস না? নায়কের কাপড় নিয়ে নায়িকা কেমন আহ্লাদ করে?”

পবন আবারও হাসতে লাগলো। পরাগ পুরোপুরি আহাম্মক হয়ে গেল। বাড়িতে এতকিছু হয়ে যাচ্ছে সে জানতেও পারছে না?
___

রাতের খাবার টেবিলে বসে কথাটা তুললেন মনজুর আলম। মেয়ে হিয়াকে প্রথমে লেখাপড়ার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন,

— “পড়ালেখা কেমন চলছে তোমার, মামণি? সামনে তো এইচএসসি। প্রস্তুতি কেমন?”
— “জ্বি, বাবা। ভালো।”

কোনমতে মাথা নাড়লো হিয়া। বাপের সাথে সব বিষয়ে তার আহ্লাদ খাটে, কিন্তু এই একটি বিষয়ে নয়। সেটি হচ্ছে পড়ালেখা! মনজুর আলম মেয়ের সব আবদার, বায়না হাসিমুখে মিটিয়ে দেন কিন্তু পড়ালেখায় কোনো গাফিলতি মানতে পারেন না। বললেন,

— “গোল্ডেন থাকবে তো?”

এবার বিপদে পড়লো হিয়া। সে কি করে বলতে পারে গোল্ডেন থাকবে কি-না? সে তো আর ভবিষ্যৎ বলনেওয়ালা নয়! মিনমিন করে প্রত্যুত্তর করলো,

— “চেষ্টা তো করবো। এখন বাকিটা আল্লাহ্ ভরসা।”
— “হুম। চেষ্টাটা হলো জরুরি। ভালো করে পড়ো। ভালো কিছুই হবে।”
— “আচ্ছা।”

আর কোনো কথা হলো না। হিয়া চুপচাপ খেয়ে পালিয়ে গেল। এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। বাবার মাথায় পড়ালেখার ভুত চেপেছে। সেটা না নামা পর্যন্ত এখানে বসে থাকা নিরাপদ নয়। যেকোনো সময় রেগে যেতে পারেন তিনি। আর রাগলে তার মাথা ঠিক থাকে না। একমাত্র মেয়ে কিংবা অন্য কেউ সাজা পেতেই হবে!

হিয়া চলে গেলেও রয়ে গেলেন মৌসুমি। স্ত্রীর দিকে চেয়ে মনজুর আলম প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

— “মেয়ের লেখাপড়ার বিষয়ে কিছু জানো?”
— “ও তো বললো–”
— “ওর বলা দিয়ে কাজ নয়। তুমি নিজে কিছু জানো?”

কণ্ঠস্বরের দাপট শুনেই আত্মা কেঁপে উঠলো মৌসুমীর। জড়তা এলো মুখ বিবরে,

— “ন-না। আ-আমি কি করে জানবো?”
— “আমি কি করে জানবো? মেয়েকে নিয়ে এখানে থাকো তুমি। আর কিছু জানবে না? শেষ পরীক্ষায় মেয়ে তোমার দু’টো সাবজেক্টে ফেল সেটা কি আমি জেনে বসে থাকবো?”

ক্ষেপে উঠলেন তিনি। মৌসুমীর ভয় বাড়লো। আতঙ্ক নিয়েও মেয়ের পক্ষে গেলেন,

— “সে তো অনেকদিন আগের কথা। নির্বাচনী পরীক্ষায় একটু খারাপ হয়েছিল। সামনে তো মডেল টেস্ট আছে। সেখানে–”

— “সেখানে কি? শোনো, মৌসুমী। মেয়েটা তোমার একার নয়, আমারও। ওকে বেশি প্রশ্রয় দিবে না। আজ বাজারেই হিয়ার মাস্টারের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। উনি আমাকে সব বলেছেন। মেয়ের পড়ালেখায় একটুও অগ্রগতি নেই। এমন চলতে থাকলে উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো করবার আশা ছাড়তে হবে।”

মৌসুমি চুপ করে আছেন। এখন কিছু বলবার উপায় নেই। যাই বলবেন, মনজুর আলম আরও তেঁতে উঠবেন। তাই নিরব থাকাই শ্রেয়। এমন সময় থমথমে আওয়াজে মনজুর আলম বললেন,

— “শোনো, আমি ঠিক করেছি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেব। হিয়া এমনিতেও লেখাপড়ায় আগ্রহী নয়। তাই সে বোঝা ওর মাথায় চাপাতেও চাইছি না। এইচএসসি দিক। বিয়ে দেব, সংসার করবে। ব্যস!”

— “কি বলছো তুমি! মেয়ে আমার কতো ছোট—”

— “তোমার মেয়ে মোটেও ছোট নয়, মৌসুমী। ওর আঠারো হয়ে গেছে। আর আমি তো এখনই বিয়ে দিতে চাই নি।”

— “ওকে বিয়ে করবে কে? শুনি!”

অভিমানে কান্না এসে যাচ্ছিল তার। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেয়ার কথা তিনি কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। এমন নিষ্ঠুর কথা কি করে বলতে পারেন মনজুর?

— “পাত্র অনেক আছে। সবচে’ ভালো পাত্র আছে হাতের কাছে। তোমার দুলাভাই-ই ফুয়াদের জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। ছেলেটা তো খারাপ না। বিয়ে দিলে সুখে থাকবে হিয়া!”

— “সে যতোই সুখে থাকুক। আমি আমার মেয়েকে এখনই বিয়ে দিতে চাই না। কিছুতেই না!”

আঁচলে মুখ চেপে কেঁদে ফেললেন মৌসুমী। মনজুর আলম বিরক্ত চোখে তাকালেন। তার মেয়ে তার ছিচকাঁদুনে স্বভাবটা নিজের মায়ের কাছ থেকেই রপ্ত করেছে। মা-মেয়ে দু’ জনেই একরকম!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

[আমার প্রথম ই-বই ‘বাতাসে বহিছে প্রেম’ পাওয়া যাচ্ছে বইটই অ্যাপে। পড়তে চাইলে ঝটপট কিনে ফেলুন মাত্র ত্রিশ টাকা দিয়ে! লিংক কমেন্টে… ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here