একদিন নববর্ষা -৪২

0
190

একদিন নববর্ষা -৪২
অদ্রিজা আশআরী
____________

সব ভুলে একসময় সত্যিই নাব্য পা বাড়ায় বর্ষার দিকে। কাছে এসে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে শেষ অবলম্বনের মতো। অথচ বর্ষা নির্বিকার নিশ্চুপ।
নাব্যর বিধস্ত ভাঙা স্বরে ওঠে কথার ঝংকার।
–‘ বর্ষা আজ আমার হারানোর আর কিছু নেই। তুমিও তো আমার নও। তোমাকে পাওয়ার যোগ্যতা কোনোদিন আমার ছিল না। তাই তোমাকে হারানোর ভয়ও করি না।
তোমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে একজন শোচনীয় ব্যার্থ মানুষ। আজ আমার শেষ স্বপ্ন টুকুও ক্ষয়ে গেছে। আব্বার গড়ে তোলা ব্যাবসাটা সবচেয়ে বড় লসের মুখোমুখি হয়েছে। আমাকে চল্লিশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নয়তো ফ্যাক্টরি ওদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এতো টাকা যে আমার কাছে নেই! কি হবে বর্ষা?
আমি আর নিতে পারছি না। তুমি কি পারো এসব যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্তি দিতে? অন্তত ক্ষণকালের জন্য হলেও আমি সব ভুলে থাকতে চাই। তুমি ম্যাজিক করে সব দুঃসহ স্মৃতি আমার মানসপট থেকে মুছে দাও না..’
নাব্যর স্বরে আজ উত্তাপের লেশমাত্র নেই। শুধু কাতর অনুরোধ। যেন সে প্রয়োজনে বর্ষার কাছে স্ব প্রাণ টুকু তুলে দিতেও রাজি। জীবনে আর কখনো এতটা ভেঙে পড়েনি নাব্য। প্রথম প্রেমে ব্যার্থতার পরও নয়। আজ যেন সত্যি সে সম্বিত হারা মাতালে পরিণত হয়েছে।

অথচ নাব্যর এই অপ্রকৃতস্থ মুর্তি আর জরাগ্রস্ত মস্তিষ্ক আজ এক বিন্দু টলাতে পারে না বর্ষাকে। সে স্থির দাঁড়িয়ে থেকে নাব্যর এলোমেলো কথা নিঃশব্দে শোনে। নাব্যকে সরিয়ে দেয় না। আবার সামান্যতম সহমর্মিতাও দেখায় না।
অনেকক্ষণ অসংলগ্ন কথাবার্তার পর নাব্য একটু শান্ত হয়।
–‘বর্ষা…. বর্ষা তুমি কথা বলছো না কেন?’

বিজনেসে লস, ফ্যাক্টরি হারানো.. এসব যেন কোনো বড় ব্যাপারই নয়। বর্ষা এমন ভাবলেশহীন শীতল স্বরে বলে,
–‘ কি বলব? ব্যাবসায় উত্থান পতন তো থাকবেই! আপনি জোয়ান মানুষ। ব্যাবসা একটা গেলে আরও দশটা ধরতে পারবেন। জীবন সবসময় এক গতিতে চলে না। সেখানে ঝড়-ঝঞ্ঝা, হার-জিত হতে থাকবে। এসব অতিক্রম করে ঘুরে দাড়ানোটাই প্রকৃত সফলতা। ‘বাবার ফ্যাক্টরি’ এই আবেগ টাকে পুঁজি করে সত্যিই কি কিছু হবে?
রিযক তো আসমান থেকে সয়ং আল্লাহ দেবেন। আমাদের কাজ শুধু পৃথিবীতে সেই রিযকের অনুসন্ধান করে যাওয়া। ‘

নাহ! বর্ষার এসব খটখটে জটিল যুক্তি আজ সত্যি বোধগম্য হয়না নাব্যের। বাবার ফ্যাক্টরি হারানোর আগাম শোকটাকে স্রেফ আবেগ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে বর্ষা। বর্ষার এই অতি বাস্তববাদী রূপ মেতে নিতে কষ্ট হয় ওর। এর চেয়ে বর্ষার মেয়েলি প্রতিক্রিয়াই যেন বেশি কাম্য ছিল। নাব্যর দুঃখে দুঃখী হয়ে সেও খুব খানিকটা কাঁদত, বেদনার রঙে একইভাবে রঙিন হতো ওর অন্তঃকরণ। একসময় স্নেহের সুকোমল পেলবতায় জড়িয়ে নিত নাব্যকে..

অথচ নাব্য ভুলে যায়! বর্ষার সমস্ত আবেগ, কোমলতাকে রোজ একটু একটু করে অবহেলা করতে করতে একসময় সে নিজেই চিরতরে খু’ন করেছিল। ওর অবজ্ঞা সইতে সইতেই বর্ষার মন এমন অকরুণ, পাষাণ ভার হয়ে গেছে আজ!

বর্ষার কথায় সামান্য ধা-ক্কা মতো খেয়েছিল নাব্য। তবে সেখানেই বর্ষার সমস্ত কথা ফুরিয়ে যায় নি। বরং সেটুকু ছিল মূল বক্তব্যের আগে পূর্বপ্রস্তুতি।

দীর্ঘ কিছু মুহুর্ত পেরিয়ে যাবার পরও নাব্য ওকে আকড়ে ধরে রইল। নাব্যর বুকে মাথা রেখেই বর্ষা একসময় অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা টেনে আনল।
নিরুত্তাপ গলায় বলল,
–‘সন্ধ্যায় পপুলারে গেছিলেন আপনি? ‘
নাব্যর ঘোরলাগা মস্তিষ্কে বিদ্যুতের মতো সাড়া ফেলল প্রশ্নটা।
সে শুধু জানতে চাইল,
–‘একথা কেন জিজ্ঞেস করছো?’

–‘ বিকেলে আম্মা আর আমি পপুলারে গেছিলাম। সন্ধ্যায় ফেরার সময় ওখানে দেখলাম আপনাকে। তাই জিজ্ঞেস করলাম!’

সঙ্গে সঙ্গে ওকে বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত করলো নাব্য। বর্ষার মুখপানে তাকাল সজাগ দৃষ্টি মেলে।
বর্ষার মুখের রঙ বদলে যেতে আরম্ভ করেছিল।
–‘ ঘাবড়ে যাবেন না! আম্মা আপনাকে দেখেনি। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
কি হয়েছিল বলুন তো এবার? বর্ষার জন্য বড় বেশি উদ্ধিগ্ন দেখাচ্ছিল আপনাকে!’

নাব্য থমকানো গলায় বলল,
–‘তুমি ভুল ভাবছো। বর্ষার জন্য সেখানে যাইনি আমি। অন্য একটা কাজে ওদিকে এসেছিলাম। তখন বর্ষা ফোন করে জানালো বর্ষন এক্সি’ডেন্ট করে গুরুতর ভাবে আ’হত হয়েছে। অনুরোধ করলো আসতে।

–‘বর্ষন কে? আপনাদের ভালোবাসার সার্টিফিকেট? আপনার সন্তান?’

–‘বর্ষা…’
প্রায় ধমকে উঠল নাব্য।

–‘রেগে যাচ্ছেন কেন? এমন একটা কিছুর সম্ভাবনা কি থাকতে পারে না? ‘

–‘ সবটা না জেনে অকারণ বাজে বকছো তুমি। বর্ষন ওর ভাই। ঢাকা শহরে বর্ষার পরিচিত কেউ নেই। আর এক্সি’ডেন্টের পর বর্ষনের বাজে রকম ব্লি’ডিং হচ্ছিল। তাই উপায় না দেখে বর্ষা বারবার আমাকে অনুরোধ করছিল সাহায্যের জন্য। শুধু অনুরোধ রাখতেই… ‘

–‘ আমি আপনার কাছে কৈফিয়ত চাইনি।’

–‘ কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছো।’

বর্ষা মৃদু হাসলো।
–‘ এতো কিছু ঘটে যাবার পর এই সামান্য ব্যাপারে যদি ভুল বোঝার মতো আনাড়িপনা দেখাই তাহলে সত্যিই কিছু বলার থাকে না। ‘

–‘পুরনো কোনো কথাই দেখছি তুমি ভুলতে পারো নি..’

–‘ভুলতে আর দিচ্ছেন কোথায়? রোজ রোজ নতুন করে প্রলেপ মাখাচ্ছেন। উনুনে লাকড়ি ফেলার মতো জাগরুক রাখছেন পুরনো দিনের স্মৃতিকে। ‘

নাব্যর কথা হারিয়ে যায়। অনেকটা সময় নিরব থেকে একসময় বলে,
–‘ভুল আসলে আমারই ছিল। চরম ভুল। নিজের দুর্বোধ্য জীবনের সঙ্গে জেনে-বুঝে জড়িয়েছিলাম তোমাকে। তুমি জানো না। প্রতি পলে পলে আমি নিজেও কতটা যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। একটা নির্বিবাদ, ছাপোষা জীবন চাওয়া কি অপরাধ? তবে কেন এতো দুরূহ এর পথ?
না চাইতেও আমি বারবার শুধু অন্যের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াই।
তোমার জীবনেও সুখের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক আমি নিজে। আমাকে তুমি ঘৃণা করো তাই না বর্ষা?’
বলে আবারও অক্ষম হাত জোড়া বর্ষার দিকে বাড়ায় সে। বর্ষার সঙ্গে সঙ্গে দূরে সরে যায়। কম্পমান স্বরে বলে,
–‘ছোবেন না আমায়! ‘

–‘আমাকে ভীষণ ঘৃণা করো?’

–‘ জানি না। তবে বোধহয় আগের মতো আর ভালোবাসি না।’

–‘তোমার জীবনে সুখ বিকশিত হবার একমাত্র ঝরোকা রুদ্ধ করেছিলাম বলে?’

অন্ধ ক্রোধে কাঁপতে থাকে বর্ষার স্বর। তবুও ওর চোখের কোলাজে জমে অভিমানের জল।
–‘ শুধু সেটুকু হলেও চলতো। আপনি তার চেয়েও অনেক জঘন্য কিছু করেছেন। আপনার অপরা’ধের ফিরিস্তি দিতে হলে একটা আস্ত রচনা লিখতে হয়।

সেই প্রথমের দিনে, মনের ভেতর বর্ষার জন্য সীমাহীন ভালোবাসা পুষে রেখে শুধুমাত্র পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করেছিলেন আপনি। তারপর সব জেনে যাবার পর আমাকে ভোলাতে মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করেছেন।
পুরনো প্রেমিকা তার স্বামীকে ছেড়ে আপনার কাছে এলো। আপনি তাকে ফিরিয়ে দেননি। বরং আমাকে ভুলে আবারও ওতে মত্ত হলেন। দিনের পর দিন এড়িয়ে গেছেন আমাকে। যখন সবার চেয়ে আপনার সান্নিধ্য আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। তখন আপনি বর্ষায় আকণ্ঠ ডুবে ছিলেন।

কত রাত আমি একা জেগে কাটিয়েছি। হাহাকারে গুমরে কেঁদেছি। সেসব দিনে আমার পাশে থাকেননি আপনি। আমার কথা নায়হ বাদই দিলাম। কারোর জীবনে বিশেষ হবার যোগ্যতা কোনোকালেই আমার ছিলনা। কিন্তু নিজের সন্তানের কথাও কি কখনো আপনার মনে হয়নি? এই দীর্ঘ নয় মাসে কতবার ডাক্তারের কাছে একা গেছি আমি। সবাই করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়েছে আমার দিকে। জিজ্ঞেস করেছে এমন মুহুর্তেও কেন স্বামী পাশে নেই।
তবুও আপনাকে যেতে বলার সাহস টুকু সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি কখনো। বুঝে নিয়েছি অফিসের কাজ আমার চেয়ে হাজার গুণ বেশি জরুরি। সেই আপনিই আজ একটা পরনারীর জন্য হাসপাতালে ছুটলেন!
আপনার যুক্তি যত অকাট্যই হোক। আজ আমি জেনে গেছি কোন বর্ষার স্থান আপনার জীবনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

নাব্যর নিষ্প্রভ স্বরে মৃদু প্রতিবাদ ঝড়লো,
–‘ বিশ্বাস করো, আমি ওকে ভালোবাসি না আর…’

–‘বাসেন! তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণও আছে আমার কাছে। সন্ধ্যায় হাসপাতালে আপনি যখন বর্ষনকে নিয়ে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ঢুকলেন। ওয়েটিং রুমে বর্ষা এসে বসেছিল পাশের বেঞ্চিতে। ও অবশ্য আমাকে চিনতে পারেনি। আম্মা মেডিসিন কর্ণারে ছিলেন। ফাঁকা ঘরে বর্ষার দিকে একটা প্রশ্ন ছুড়েছিলাম আমি। জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি ওর কি হন। ও স্পষ্ট গলায় জানালো স্বামী!

বিশ্বাস করুন। আপনার স্ত্রী আর অনাগত সন্তানের মা হয়েও এতটা জোর দিয়ে কখনো আপনাকে এভাবে নিজের বলে দাবি করতে পারতাম না আমি। বর্ষার বলায় আশ্চর্যরকম দৃঢ়তা ছিল। আমি হার মেনেছি!

স্বীকার করতে বাঁধা নেই আপনার পাশে ওকেই সত্যিকারের অর্ধাঙ্গী হিসেবে মানায়। আমার আর কি যোগ্যতা বলুন? মন ভোলানো রূপ বা বশীকরণ বিদ্যা.. কিছুই তো জানা নেই। ও আপনার যোগ্য স্ত্রী হতে পারবে। এখন তো বর্ষা ডিভোর্সি। আর কোনো বাঁধা নেই। আপনি ওকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করুন। এই এতো বড় বাড়িতে কোনো এককোণে আমার ঠিক জায়গা হয়ে যাবে। নাহয় পুরো পৃথিবীটাই তো পড়ে রইল বাইরে..। আপনাকে নিয়ে আমার আর কোনো আকাঙ্ক্ষা অক্ষ’ত নেই।’

এতো কথার বিপরীতে বলার মতো সামান্য শব্দও নাব্যর মুখে জুটল না আজ। অপার বিস্ময় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল সে বর্ষার দিকে। একসময় হাল ছেড়ে দেবার গলায় বলল,
-‘তুমি আর আমাকে ভালোবাসো না?’

-‘এরপরও চান আমি ভালোবাসি?’

হঠাৎ যেন নাব্য নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।
-‘ওহ তাইতো! ভুলেই গেছিলাম তুমিও আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ! ভালোবাসার প্রতিদানে ভালোবাসা না পেলে কতদিন বা একপাক্ষিক ভালোবেসে যাওয়া যায়! আমার ভ্রম হয়েছিল। ভেবেছিলাম তোমার ভেতর টা হয়তো আমাদের মতো র’ক্ত মাংসের গড়া নয়। সেখানে ঐশ্বরিক কোনো ব্যাপার আছে। যার দরুন সবকিছু পেরিয়েও চিরকাল তুমি আমাকে ভালোবাসবে… ‘

-‘আমার ভালোবাসা অতি নিম্ন আর সস্তা ধরনের। আপনার পোষাবে না। বর্ষার কাছে যান। ও আপনাকে সেভাবে ভালোবাসতে পারবে যেভাবে আপনি চান।’

-‘তুমি ঘুরেফিরে কেন বারবার বর্ষায় এসে থামো?’

-‘কারণ আমি চাই আপনি বর্ষার কাছে ফিরুন। আপনার প্রতি যেটুকু শ্রদ্ধা এখনো অটুট আছে সেটুকু ধরে রাখতে চাই আমি। এভাবে নীতিহীন পথে আর ওর পাশে ভিরবেন না। স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে নিয়ে আসুন।’

-‘আমাকে সম্মন্ধে এতো জঘন্য ধারণা তোমার? আমি কাম তৃপ্তির জন্য ওর কাছে বারবার ভিরি বলে তোমার মনে হয়?’

বর্ষা প্রতুত্তর করল না। ওর নিরবতা আরও বেশি মরিয়া করে তুললো নাব্যকে।
-‘ বর্ষা… এসো সব ভুলে আমরা আবার নতুন করে সবটা শুরু করি। আমাদের সেই নতুন অধ্যায়ে কোথাও ওর স্থান থাকবে না।’

-‘ সেটা আর সম্ভব নয়।’

-‘কেন সম্ভব নয়? বর্ষাকে দূরে সরিয়ে দিলেই তো হল। ‘

-‘ আপনি সেটা পারবেন না। আমি দেখেছি বর্ষাকে। নিতান্তই কিশোরী। ওর তরলমতি মন আপনাতে ভয়ংকর ভাবে আচ্ছন্ন। ওর চোখের দৃষ্টি আপনার প্রাঁজলে ঝলকাচ্ছে। বর্ষা এখনো ঘোরে নিমগ্ন। যার জন্য আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কটাও ওর কাছে নিতান্ত তুচ্ছ ঠেকছে। অচেনা লোকের সামনে তাই এতো সহজে আপনাকে স্বামী বলে পরিচয় দিতে পেরেছিল তখন। আগেপিছে ভাবেনি। আমাকে নিয়ে ও বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়। ও জানে, আমার উপস্থিতি ওর প্রণয়ে কোনো বাঁধার সঞ্চার করতে পারবে না কখনো।

এমন অবস্থায় আপনি ওকে ছুড়ে ফেললে, বিবশতার জগৎ ছেড়ে বাস্তবে এসে ও হয়তো আর বাঁচতেই পারবে না। যখন ওকে দূরে সরানো যেত তখন আপনি কাছে টেনেছেন। বর্ষা আপনার ছায়াতলে আশ্রয় পেয়েছে। ক্রমে ক্রমে আজ ও আমাদের জীবনেরই একটা অংশে পরিণত হয়েছে। আমাদের কিছুদিনের সুখের জন্য তাই আমরা ওকে আর ছুড়ে ফেলতে পারি না।’

-‘বর্ষা। এতো দুর্বোধ্য তুমি কবে হলে? এতসব জটিল ব্যাখ্যার দ্বারা তুমি কি বোঝাতে চাও, আমার বর্ষার কাছেই ফেরা উচিত?
আমি ওর কাছে ফিরলে তুমি কষ্ট পাবে না একটুও?’

বর্ষা কখনো স্থির প্রজ্ঞ মেয়ে ছিল না। একটা দীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতির পর আজ নিজেকে এতোটা সংযত রাখা সম্ভব হয়েছে ওর দ্বারা। কিন্তু সেটুকুও ক্ষয়ে যেতে শুরু করল একসময়। একটা অবর্ণিত শারীরিক যন্ত্রণা ধীরে ধীরে ওকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। যন্ত্রণায় কুকঁড়ে গিয়ে এতক্ষণে ক্ষানিক এলোমেলো হয়ে গেল বর্ষার চিন্তাচেতনা। অসহিষ্ণু হয়ে পড়ল মস্তিষ্ক। উন্মত্ত জ্বলজ্বলে দৃষ্টি নাব্যর ওপর নিক্ষেপ করে, প্রবল আক্রোশে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে বলল,
-‘ না। কষ্ট পাবো না। মনে আঘাত পাবার জন্য যতটুকু ভালোবাসা থাকা প্রয়োজন, সেটুকু অনেক আগেই হারিয়েছে। আজ যা আছে তা শুধু করুণা।
আপনাকে আমি আর ভালোবাসি না। আপনার দিকে তাকালেও আজ আমার অশুচি মনে হয় নিজেকে। আমার সামনে থেকে চলে যান আপনি। ‘

নাব্য পাথরের মুর্তির মতো নির্বাক তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। মনে হলো বেঁচে থাকার শেষ আসঞ্জনটুকুও হারিয়েছে সে। নাব্য অনুভব করে ওর নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ছে মস্তিষ্কের ভাবনা গুলো।
-‘তারমানে সত্যিই তুমি আমাকে ঘৃণা করো?’

-‘হ্যাঁ সত্যি ঘৃণা করি। আমার ঘৃণায় কি-ই বা আসে যায়? আপনার প্রেমিকা তো রইল। ওর ভালোবাসাই জয়ী হোক! ‘

আর কিছু বলার বা শোনার মতো শক্তি নাব্যর ছিল না। সে হঠাৎ দু পা পিছিয়ে যায়। তারপর অকস্মাৎ ঘুরে হাটতে শুরু করে। দরজায় শব্দ তুলে নয়, পলকা বাতাসের মতো নিঃশব্দে নাব্য বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। বাইরে তখন বৈশাখের একটি ঝোড়ো দূর্যোগপূর্ণ রাত্রির আভাস। প্রলয়নৃত্যে মত্ত হয়েছে আকাশ। ভূতল বিভেদকারী প্রকট শব্দে মুহুর্মুহু হচ্ছে বজ্রপাত।

নাব্য আজ রাজপথে নামে বর্ষারই দেখানো পথ ধরে। ঠিক সে রাতের মতো, যে রাতে প্রগাঢ় অভিমানে আচ্ছন্ন হয়ে বর্ষা ঘর ছেড়েছিল। হারাতে চেয়েছিল সামুদ্রি বিপর্যয়ে।
কিন্তু অভিমান নিয়ে ঘরছেড়েও রাত্রিশেষে বর্ষা ঠিক ফিরেছিল। কারণ অভিমানের বিচ্ছেদ ততটা প্রবল নয়, যতটা ঘৃণার হয়। কিন্তু আজ নাব্য ঘর ছাড়ল একবুক ঘৃণার প্রকাশ্য স্তুতি নিয়ে। সেও কি ফিরবে সেই রাত্রির মতো? যে রাতে অভিমানের বদলে ভালোবাসা নিয়ে বর্ষা ফিরেছিল? নাকি নাব্য হারিয়ে যাবে? আজই চিরতরে শেষ হবে ভালোবাসা নিয়ে ওদের দ্বন্দের উপাখ্যান?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here