#এক_কাপ_চায়ে : ০৭
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ
বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে। হাড় কাঁপুনি দিয়ে শীত শীত ভাব হচ্ছে। ছাদের শুকনো পাতাগুলো উড়ে চোখেমুখে লাগছে। পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে ভ্রুক্ষেপহীন। এলোমেলো উড়ন্ত চুলে ওকে উদাসীন দেখাচ্ছে। আধখোলা ঘোমটা, গায়ে গোল ফ্রকে বয়সের চেয়েও ছোট দেখাচ্ছে। নিজেকে জাহিরের প্রবণতা থাকলে হয়ত এই দৃশ্য ক্যামেরার স্ক্রিনে বন্দি করা যেত। আকাশে গুড়ুম গুড়ুম ডাক। ও নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে একা একা, শূন্য সঙ্গী নিয়ে।
পুষ্প আকাশের বিজলী চমকানোর দিকে তাকিয়ে রইল। কালোমেঘের মাঝে আলোর ঝলকানি, ঠিক যেন জীবন! শুধু সবার জীবনে আলোকচ্ছটা আসে না, এই যা।
আফরোজা বাসায় নেই। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি দেখে নবীন কাপড় আনতে ছাদে এসেছিল। বর্জ্রপাত হবার দশা বাইরে। তবুও এর মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে আছে। মানসিক বিকারগস্ত নাকি! ঠিক যে মুহুর্তে শব্দ হলো, সে মুহুর্তে মেয়েটাকে টেনে চিলেকোঠায় দাঁড় করালো। নবীন পুষ্পকে কখনো দেখেনি। সবসময়ই মাস্ক পড়ে থাকত। ও অবাক হয়ে গেল। বাচ্চা একটা মেয়ে, মুখটা এতটুকুন। অথচ ব্যবহার-বাচনভঙ্গি দেখে মনে হয় ওর দাদী।
ধমক দিয়ে বলল,
— “মাথায় কী একটু সমস্যা? তার ছিড়া? এই ওয়েদারে কেউ বাইরে যায়?”
পুষ্প জবাব দিলো না প্রশ্নের। বলল,
— “ছাদ যে মেয়েদের জন্য, সেটা জানেন না? ছেলেদের ছাদে ওঠা বারণ।”
নবীন থতমত খেয়ে গেল।
— “আমি তো জানতাম না, স্যরি। কিন্তু আপনি ওমন করছিলেন কেন? আত্মহত্যা কিন্তু ভয়ংকর পাপ। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় না।”
পুষ্প আর একটি কথাও বলল না। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেল। নবীনের মনে হলো ওকে তৃতীয়বারের মতো অপমান করলো মেয়েটা। নিজেও নিচে নামতে নামতে বলতে লাগল,
— “কী পাপ করেছি আমি? আমার সঙ্গেই বা কেন বারবার এমন করছে মেয়েটা?”
নবীন ভাবতে ভাবতেই অবাক হলো। ওই বা কেন পুষ্পকে নিয়ে এত ভাবছে?
.
.
শুভ জেদ ধরে বসে আছে। পুষ্পর বিয়ে না হওয়া অব্দি সে বিয়ে করবে না। চাঁটগাইয়াদের মধ্যে অবশ্য এই রেওয়াজ চালু আছে। কিন্তু শুভর চিন্তা অন্য প্রকারের। তার ধারণা পুষ্প সবে এস.এস.সি দেবে। ওর বিয়ে হতে ঢের সময় বাকি। এ সময়ের মধ্যে সে কিছুটা একা থাকতে চায়।
বৃষ্টিকে একটু একটু পছন্দের ব্যাপারটা অস্বীকার করা যায় না। তবুও তার মন টানছে না। বিয়ে পরবর্তী জীবন যদি দূর্বিষহ হয়, তাহলে শুভ নিজেকে কীভাবে সামলাবে? এমনিতেই ধাক্কা খেয়ে খেয়ে মনের বেহাল দশা হয়ে আছে।
মাহবুব ওর যুক্তি শুনলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল,
— “ঠিক আছে। পুষ্পকে তাহলে বিয়ে দিয়ে দিই।”
শুভ আঁতকে উঠলো।
— “ভাইয়া! কী বলছো তুমি? ও বাচ্চা একটা মেয়ে।”
— “সতেরো বছরের একটা মেয়ে কীভাবে বাচ্চা হলো? বিয়ে মানে কী বলিদান?”
— “ভাইয়া প্লিজ! ও মন খারাপ করবে। এত কঠোর হয়োনা, আমাদের একটাই তো বোন।”
মাহবুব সিদ্ধান্ত বদলালো না।
— “ঠিক, ও আমার একটা মাত্র বোন। ওর মনের খেয়াল আমি রাখি।”
মাহবুব ভেতরে গেল৷ শুভ নিজের চুল নিজেই টানছে। কী দরকার ছিলো মাতুব্বরি করার?
মাহবুব পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে তনুর দিকে তাকালো। ও কাপড়ে সুতা দিয়ে নকশা তুলছে। মাহবুব ক্লান্ত গলায় বলল,
— “মৃত্তি, তুমি কেমন আছ?”
তনু হেসে বলল, “ভালো। আপনি?”
— “ক্লান্ত, ক্লান্ত! আচ্ছা শুনো, তুমি কী বিয়ের আগে সুখী ছিলে না বিয়ের পর?”
— “কেন বলুন তো!”
— “এমনি, জানতে চাচ্ছি।”
— “দুই সুখ দুরকম। তবে বিয়ের আগে ডিপ্রেশনে একা একা পড়ে থাকতাম, এখন নিজের সব হতাশা পাশেরজনের ঘাড়ে তুলে দেই। সেও তার হতাশা আমাকে গিফ্ট করে। ব্যাপারটা মজার। আমি বিয়ের পক্ষে।”
তনু হাত তুলে জোর প্রকাশ করল। মাহবুবের চোখ নিভু নিভু। ঘুমিয়ে পড়ছে। তনু ওর হাতঘড়ি খুলে দিয়ে ফ্যানের ভলিউম বাড়ালো। মাহবুব অনুভব করছে। ভালো লাগছে। তার সিদ্ধান্ত তাহলে ভুল হওয়ার কথা নয়।
.
.
নবীন মাহবুবের কথামতো রাহিলা ম্যাডামদের বাড়িতে খোঁজ লাগিয়েছে। পাড়ার মহিলারা কিছু অতিরিক্ত বলে যদিও, সারাংশ এই ; রাহিলা ম্যাডাম কে এহসান সাহেব নবম শ্রেণিতে থাকাকালীন পড়াতেন। এহসান স্যার তাকে খুব পছন্দ করতেন, কিন্তু ম্যাডামের বাবা রাজি হননি। কারণ স্যার তখন বেকার ছিলেন। পরে স্যার রাগ করে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেন। রাহিলা ম্যাডাম যেহেতু তখন কিশোরী ছিলেন, তিনি খুব কষ্ট পান। কেউ কেউ বলে, ম্যাডামকে নাকি বিয়ের দিন কাঁদতে দেখেছে।
পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যায়। ম্যাডাম পড়াশোনা চালিয়ে যান। তিনি কখনো স্যারের সংসারে বাঁধা হয়ে দাঁড়াননি। উপরন্তু ম্যাডামকে সবসময় দূরত্ব বজায় রেখে চলতেই দেখা যেত। রাহিলা ম্যাম অত্যন্ত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী। নবীনের অবিশ্বাসের কোনো কারণ নেই। কিন্তু আসল সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন রাহিলা ম্যাম সেই একই ভার্সিটিতে চাকরি পান যে ভার্সিটিতে এহসান সাহেব চাকরি করতেন। মূলত এক কষ্টকর অধ্যায় রচিত হয় তার ফলেই।
রাহিলা ম্যাম স্বামীর প্রতি বরাবরই বিশ্বস্ত। তার ছেলেমেয়েদের সবাই খুব ভদ্র বলেই চেনে। তিনি কখনো এহসান সাহেবকে পাত্তা দেয়ার মানুষ নন। এহসান সাহেব ধীরে ধীরে ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন মূলক আচরণ শুরু করেন। তাদের সাথে নিজের বাল্যপ্রেমের রসগ্রাহী গল্প করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। নবীনেরই এক ক্লাসমেট মেয়ে তার স্বীকার। মেয়েটা বেশ ঠোঁটকাটা, গড়গড় করে বলে ফেলল দ্বিধাহীন। নবীন নিজেই লজ্জা পাচ্ছিলো খানিক। শত হোক নিজের বস তিনি।
সবচেয়ে আপত্তিকর তথ্যটাও মেয়েটা দিয়ে দেয়। তিনি অনলাইনে কোনো এক মহিলার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার সামনেই এহসান সাহেব ইশারায় কথা বলছিলেন। ভুলবশত দেখে ফেলে তার ছাত্রী। এরপর থেকেই পারিবারিক কলহের সুর শোনা যেত। স্যারের স্ত্রীর সঙ্গে সবসময় তার কথা কাটাকাটি হত। নিজেদের এই ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো ভার্সিটির আনাচে কানাচে মেয়েদের মহলে অবাধ চর্চা হয়। শুধু নবীনই বোধ হয় জানত না। নবীনের মাথা ভনভন করছে। তাহলে স্যারের স্ত্রীকে কী স্যারই মেরে ফেলেছিলেন? এও সম্ভব?
চলবে ~