#এক_শহর_প্রেম?,৩০,৩১,৩২
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩০
আহনাফের পরিবার আদিরাকে সাদরে আপ্যায়ন করল। মারসাদ তো তাদের কাছে আহনাফের মতোই।তাছাড়া আহনাফের কাছ থেকে পুরো ঘটনা সংক্ষেপে শুনেছে তারা। আহনাফের মা আদিরার মেসের সুপারের কাছে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। মেসের সুপারকে বুঝাতে একটু কসরত তো করতেই হয়েছে। মারসাদ ও আহনাফরা রাত বারোটার পর আরও কিছু বন্দোবস্ত করে হোস্টেলে ফিরে গেছে। আহনাফের পরিবারের সকলের সাথে কুশল বিনিময় ও রাতের খাবারের পর্ব শেষ হওয়ার পর আদিরা আহনাফের ছোটো বোনের সাথে ঘুমোতে চলে যায়। আহনাফের ছোটোবোন অনেকটাই ছোটো। সবে দশম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। আহনাফের ছোটোবোনকে দেখে আদিরার মনে হয়েছিল মেয়েটা অনেক পড়াকু হয়তো। চোখে মোটা গ্লাসের চশমা সাথে খুব কম কথা বলা। এখন আদিরা অর্নি মানে আহনাফের বোনের রুমে বসে আছে। রুমের ভেতরে বড়ো একটা বুকশেলফ আর তাতে পাঠ্যবই, বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য ও জ্ঞানমূলক বইয়ে পরিপূর্ণ। আদিরা পুরো ঘরে চোখ বুলাচ্ছে। অর্নি বিষয়টা খেয়াল করল অতঃপর আদিরাকে বলল,
–আপনি মারসাদ ভাইয়ার ওয়াইফ তাই না?
আদিরা অর্নির প্রশ্ন শুনে অর্নির দিকে তাকায়। মেয়েটা কথা বলার সময়ও কেমন যেনো গম্ভীর্যতা নিয়ে কথা বলে। আদিরা অর্নিকে মৌন সম্মতি দিলে অর্নি খানিকটা হাসে। তারপর বলে,
–আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন আমি মারসাদ ভাইয়াকে প্রপোজ করেছিলাম।
আদিরার অক্ষিগোলক খনিকেই কিয়ৎপরিমাণ বড়ো হয়ে যায়। অর্নির থেকে এরকম কিছু শুনবে এটা সে ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি। আদিরাকে চমকে যেতে দেখে অর্নি আবারও হেসে বলে,
–বিনিময়ে মারসাদ ভাইয়া বলেছিলেন, “এখন সময় নিজের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করা, নাকি আবেগে অতল সাগরে ভেসে যাওয়া! একসময় নিজেই বুঝতে পারবে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। তোমাকে আমি মাহির মতোই ভাবি। আশাকরি তুমি আমার কথার তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম।” উনার সেদিনের বলা প্রতিটা শব্দ আমার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। উনার বলার মধ্যেই আমার মন সংকেত দিচ্ছিল, উনি কখনোই আমায় প্রিয়তমার আসনে বসাবেন না। তাকে এতটুকু চিনতাম যে সে সম্পর্কের মূল্যবোধ জানে। আজ আমায় বোন বলবে আর কাল বউ! এমন স্বভাব উনার না। আমার ছোটোভাইয়াও তেমনি। তাই তার আশা আমি তখনই ত্যাগ করেছি। আমার মনে হয়, যা আমার না তার পেছোনে সময় নষ্ট করা অর্থহীন। জানি নিয়তি অনেক কিছু বদলায় কিন্তু আমার মনে হয়নি নিয়তি সেটা বদলাতো। এই দেখো, আজ আমার নিয়তি পরীক্ষাও হয়ে গেলো। কনগ্রাচুলেশন ফর ইউর নেক্সট জার্নি।
আদিরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অর্নির কথাগুলো শুনলো। অর্নির জায়গায় অন্যকেউ হলে এতো সহজে বিষয়টা মেনে নিতো না। অনেক জল ঘোলা করতো। অর্নির বয়স কম হলেও ম্যাচুরিটি মাশাআল্লাহ্। আদিরা অর্নির হাত ধরে বলল,
–দোয়া করি তুমি জীবনে এমন এক সঙ্গী পাও যে কীনা তোমাকে ছাড়া অন্যকাউকে প্রিয়তমার নজরে না দেখে।
অর্নি চমৎকার হাসলো। এরপর অর্নি আদিরাকে ঘুমোতে বলে নিজে টেবিল লাইট জ্বালিয়ে পড়তে বসলো। সামনে তার টেস্ট পরীক্ষা।
_________
সকালে ভার্সিটির ক্যাম্পাসে দেলোয়ার সহ তার কয়েকজন সঙ্গী এলো। প্রথমেই সাগরদের সাথে দেখা করল। দেলোয়ার সাগরকে সরাসরি প্রশ্ন করে,
–আদিরা কই? ওরে এখানে আনো। আইজকে আর আমার হাত থেকে পালাইতে পারতোনা। ওরে লইয়াই যামু আইজকা।
সাগর শ*য়তা*নী হাসি দিয়ে বলে,
–ধৈর্য ধরেন। মাত্র আসলেন একটু বসেন তারপর পরশ আপনাদের আদিরার মেসের কাছে নিয়ে যাবে।
খানাপিনা শেষে পরশ দেলোয়ারদের আদিরার মেসে নিয়ে গেছে। নিলয় পুরো ঘটনা নিরবে দেখে গেছে। সে আশা রাখছে, মারসাদ ঠিক কিছু না কিছু করেছে।
অপরদিকে রবিন আড়াল থেকে দেলোয়ারদের দেখে মারসাদকে গিয়ে জানায়। মারসাদ বাঁকা হেসে বলল,
–আজ মিষ্টি বিতরণ হবে। সাগররা তো ক্যান্টিনেই আছে। চল। সেলিমকে বলেছিলি পাঁচ কেজি মিষ্টি আনতে?
রাহিন খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে,
–হ্যাঁ। সেলিম পথেই আছে। এই শোন, এক কেজি আমাদের জন্য চমচম আনতে বলছি। আর চার কেজি মিষ্টি সবাইকে বিলি করবি।
মৃদুল রাহিনের মাথায় ঠু*য়া মে*রে বলে,
–পেটুকরে পেটুক! আগে ঝামেলা মিটুক। তারপর তুই মিষ্টি খাস। এখন সাগরদের বেশি করে মিষ্টি খাওয়াবো যাতে ডায়েবেটিস হয়।
রাহিন মাথা ঘষতে ঘষতে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ওদের সাথে চলতে থাকে। ক্যান্টিনে গিয়ে আহনাফ সকলের উদ্দেশ্যে জোড়ালো শব্দে বলে,
–নেও সবাই মিষ্টি মুখ করো। তোমাদের ভিপি কাল বিয়ে করেছে।
আহনাফের মুখ নিঃসৃত বাক্য শুনে ক্যান্টিনে উপস্থিত সকলে হতবাক হয়ে গেল। সাগর তখন সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছিল। আহনাফের বক্তব্যে ও মারসাদের হাসিমাখা মুখশ্রী দর্শনে গরম চা নাকে-মুখে উঠে গেছে। নিলয় মুখ বিকৃত করে হাসি কন্ট্রোল করে সাগরকে পানি দেয়। এদিকে সেলিম সবাইকে মিষ্টি দিচ্ছে। এখন মৃদুল উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে উঠে,
–বিয়ের কনে কে জানতে চাইবে না? না চাইলেও বলে দিচ্ছি। ফার্স্ট ইয়ারের জুলোজি ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী আদিরা আদওয়া।
সাগর এবার পানির গ্লাসটাই ফ্লোরে ফেলে দিয়েছে। কাচের গ্লাসটার কিছু অংশ ভেঙে গিয়ে সেটা এখন ব্যবহারের অনুপুযোগী। মারসাদ সাগরের হতভম্ব মুখাবয়ব দেখে বড়োই তৃপ্তি পেলো। ওরা পাঁচজন গিয়ে সাগরদের পাশের টেবিলে বসল। মারসাদ হেসে বলল,
–আমাকে অভিনন্দন জানাবি না? কালরাতে মনে হলো বিয়েটা করেই ফেলি। আর কতো হা*রাম সম্পর্কে থাকব!
সাগর রাগে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে। মারসাদ আবারও বলল,
–কাল দাদী ও ফুপির সাথে কথা বলার পর আমার মনে হলো, আমার জীবনে খুব আপন কাউকে আনা উচিত। আর তারাও চাচ্ছিলেন আমি বিয়ে করি। তাই করে ফেললাম। এই সেলিম! সাগরকে এক পিস মিষ্টি বেশি দিস।
মারসাদরা ক্যান্টিন থেকে মিনারের কাছে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। মারসাদের বিয়ের খবর তুফানের গতিতে ক্যান্টিন থেকে পুরো ভার্সিটিতে ছড়িয়ে পরে। সামিরার কানে কথাটা যাওয়া মাত্র সামিরা হতবাক হয়ে যায়। তার এখন নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। গতকাল রাতে তার কাকিমনির কাছ থেকে মারসাদের রিজেক্ট করা শুনে নিজের রুমে ভা*ঙচুর করেছে আর আজ সকালে এসে মারসাদের বিয়ের খবর শুনে তার নিজেকে ভীনগ্রহের প্রাণী মনে হচ্ছে। সামিরার কাছে হুট করে মনে হলো খবরটা গুজবও হতে পারে। সাগরকে ফোন করলে সাগর তাকে বলে,
–একটু আগে আদিরার মেসে গিয়ে দেলোয়াররা ফিরে এসেছে। মেসে গিয়ে আদিরার আত্মীয় পরিচয় দেওয়ার পর দেলোয়ার জানতে পারে কাল রাতে আদিরা তার এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে গিয়েছে। আর মারসাদ বলছে সে নাকি আদিরাকে বিয়ে করেছে। সবটা কেমন উল্টে গেলো। দেলোয়ার এখন রাগে ক্ষোভে ভার্সিটির গেটে আসছে। দেলোয়ার এখনও জানেনা আদিরার যে বিয়ে হয়েছে।
সামিরা হতবাক হয়ে স্বস্থানে বসে পরেছে। দেলোয়ারের সাথে সাগরদের ভার্সিটির গেটে দেখা হলে দেলোয়ার চিৎকার করে কয়েকটা অশ্রাব্য উক্তি নিঃসৃত করে বলল,
–কই আদিরা? ওর মেসের হেড কয় ওয় নাকি কাইল রাতে কই গেছে। তুই কইছিলি আদিরারে আমি ওইখানে পামু। এখন কই আদিরা? তোরা আমার সাথে বাটপারি করছোস?
নিলয় জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
–কাল রাতে আদিরা বিয়ে করেছে। একসাথে দুই প্ল্যান করা হয়েছিল যার একটার কারণে আরেকটা ভেস্তে গেছে।
দেলোয়ার নিলয়ের শার্টের কলার ধরে চোখ-মুখ শক্ত করে বলে,
–কী কইলি তুই? আবার ক।
পরশ জলদি এসে নিলয়কে দেলোয়ারের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। নিলয় আবার বলে,
–বিশ্বাস না হলে ভার্সিটিতে যাকেই জিজ্ঞেস করবেন সেই বলবে। আদিরার হাজবেন্ড এই ভার্সিটির ভিপি। আপনি আরেকটু আগে আসলে আদিরাকে পেতেন হয়তো।
দেলোয়ার রাগে দেয়ালে লা*থি দেয়। সাগররা দেলোয়ারকে মারসাদদের কাছে নিয়ে যায়। দেলোয়ার সেখানে গিয়ে চিৎকার করে অশ্রাব্য গালি দেয় তারপর বলে,
–কার লগে আদিরার বিয়া হইছে? সামনে আয়। দেখি তোর কতো বড়ো বুকের পাটা।
মারসাদ শিস বাজিয়ে পকেটে দুহাত পু’রে দেলোয়ারের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর বলে,
–আমি আদিরার হাজবেন্ড।
দেলোয়ার হুংকার ছেড়ে জিজ্ঞাসা করে,
–তোর সাহস হয় কেমনে আদিরাকে বিয়ে করার? কোন সাহসে তুই ওরে বিয়া করছোস?
মারসাদ দেলোয়ারের শার্টের কলার ঝেড়ে দিয়ে হাসিমুখে বলে,
–যেই অধিকারেই করি সেটা একান্ত আমার ও আদিরার ব্যাক্তিগত। তাছাড়া শ্বশুর-শাশুড়ির থেকে আগে থেকেই অনুমতি একবার নিয়েছিলাম। এখন সে আমার বউ আর ওরা আমার পরিবার। তাই তুই আমার পরিবারের দিকে চোখ তুলেও তাকাবি তো তোর ব্যাবসা ও তোর বাপের ব্যাবসা সব সব লাটে উঠবে। কাল রাতেই সাতক্ষীরাতে আমি আমার পরিচিত পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছি। আর বর্ডারেও তোর চোরাকারবার ধরার জন্য পুলিশ বসে আছে। খবর নিয়ে দেখ তোর ট্রাক বর্ডারে ধরা পরেছে। আর সাতক্ষীরা থেকে আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে পুলিশ ফোর্স সসম্মানে ঢাকাতে নিয়ে আসবে। আর দোকানবাজার সব তোর বাপের কাছেই পরে বিক্রি করবে আর সেটা করাবে পুলিশ ফোর্স নিজ দায়িত্বে। আর অতি শিগ্রই তোর বাপ তার গদি হারাবে কারণ তোদের কিনে রাখা পুলিশ অফিসারকে বান্দরবান ট্রান্সফার করা হবে। তখন কী করবি?
দেলোয়ার সহ সবাই হতভম্ব হয়ে মারসাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।
#এক_শহর_প্রেম?
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩১(ধামাকা)
দেলোয়ার তড়িঘড়ি করে ট্রাকের চালককে ফোন করলে ফোন বন্ধ পায়। তারপর ট্রাকের হেল্পারকে ফোন করে। সেটাও বন্ধ। অস্থির হয়ে দেলোয়ার কী করবে দিশা পাচ্ছে না। মারসাদসহ আহনাফরা ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি এঁকে দেলোয়ার চিন্তায় অস্থির মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করছে। এদিকে সাগর খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে কাউকে ফোন লাগায়। প্রতি বৃহঃপতিবার দুপুর বারোটার আগে চো*রাই কারবার বর্ডার ক্রস করে ভারতে প্রবেশ করে। বুধবার রাতে বর্ডার ক্রস করে। (কাল্পনিক। কখন বর্ডার ক্রস করে তা আমার জানা নেই।)
অপরপাশ থেকে রুহুল আমিন ফোন রিসিভ করলে সাগর তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করে,
–এমপি সাহেব! বর্ডারে কী কাল আপনার কোনো ট্রাক গিয়েছে?
রুহুল আমিন সবে নাস্তা শেষ করে তার বাগানে চা নিয়ে পত্রিকা হাতে বসেছিলেন। ঘড়ির কাটায় বেলা ৯টা। রুহুল আমিন কড়া লিকারের চায়ের কাপে আয়েশ করে চুমুক দিয়ে বলেন,
–হ্যাঁ। এইতো রাত তিনটায় বের হয়েছে। এতক্ষণে বর্ডারে থাকার কথা।
সাগর হকচকিয়ে বলে উঠে,
–খোঁজ নেন এমপি সাহেব! প্রতি বৃহঃপতিবার বর্ডারে গার্ড কম থাকলেও আজকে কড়া নজরদারী চলতেছে।
রুহুল আমি চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেসা করেন,
–মানে? আজকে কড়া নজরদারী থাকবে কেনো?
–কারণ মারসাদ বর্ডারে পুলিশ ফোর্স পাঠিয়েছে। আপনার পরিচিত যে আছে বর্ডারে সেও আজ কিছু করতে পারবে না।
রুহুল আমিন সাগরের প্রতিউত্তরে চিন্তিত স্বরে বলেন,
–খোঁজ নিয়ে দেখি।
এই বলে তিনি ফোন কে*টে তার এসিসট্যান্টকে ফোন করে,
–হ্যালো খোরশেদ, বর্ডারে খোঁজ নে।
খোরশেদ নামক ব্যাক্তি অশুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দিয়ে বলে,
–জি স্যার। এখনই নিতাছি।
……
কিছুক্ষণ পর দেলোয়ারের বাবা গ্রাম থেকে ফোন করে দেলোয়ারকে হুংকার ছেড়ে কয়েকটা অশ্রাব্য শব্দ নিঃসৃত করে বলেন,
–তোর ট্রাক যে বর্ডারে ধরা পরছে তুই জানোস? এখন কী হইবো? তোর জন্যে আমার চেয়ারম্যান পদ নড়বড়ে অবস্থা। গ্রামে আহাদ ব্যাপারির বাড়িতে পুলিশ আইছে ওগোরে ঢাকা নিয়া যাইতো। ওই পুলিশরাই এখন আমার বাড়ির উঠানে বইসা রইছে। তোর চো*রাকা*রবারে জন্য এখন হেরা আমার হিসাব খাতাও দেখব। তুই এখনই সাতক্ষীরা আসবি।
দেলোয়ার তার বাবার কথা শুনে মারসাদের দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকায়। মারসাদের বাঁকা হাসি দেলোয়ারের হৃদয়ে কাঁ*টার মতো বিঁধছে। দেলোয়ার সেখানে আর এক মূহুর্তও দাঁড়ায় না। দেলোয়ারের সাথে সাথে সাগররাও চলে যায়। নিলয় যাওয়ার আগে মারসাদের দিকে তাকিয়ে একটা নীরব হাসি বিনিময় করে চলে যায়।
_________
রুহুল আমিনের মৌসুমি ফলের সাথে ড্রা*গ বোঝাই ট্রাক বর্ডারে আটক হয়েছে। সেটা আবার মিডিয়াতেও ছড়িয়ে পরেছে। রুহুল আমিনের এসিসট্যান্ট এই খবর রুহুল আমিনকে দিলে রুহুল আমিন টিভি খুলে নিউজ চ্যানেলের হেডলাইন দেখছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সাংবাদিকরা যে তার বাড়িতে হাজির হবে সেটা রুহুল আমিনের জানা। নিউজ চ্যানেলের হেড লাইন,
“এ*মপি রুহুল আমিনের ফল বোঝাই ট্রাকে ১২০ প্যাকেট হে*রো*ইন পাওয়া গেছে।”
ইতোমধ্যে বাড়ির দারোয়ান এসে খবর দিলো, গেইটের বাহিরে সাংবাদিকরা এসেছে। রুহুল আমিন এবার নিজেকে বাঁচাতে একটা চাল চালবেন। দারোয়ানকে বলেন সাংবাদিকদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসতে। সাংবাদিকরা এসে রুহুল আমিনকে একের পর এত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলছে। রুহুল আমিন যথাসম্ভব নিজেকে সামলে রেখেছেন। অতঃপর আফসোসের সুরে চেহারায় দুঃখী ভাব এনে সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,
–জানিনা কে বা কারা আমাকে ফাঁসাতে চাইছে। কে বা কারা আমার ট্রাকে ড্রা*গ রেখেছে! এতোদিন ধরে ট্রাক পারাপার হচ্ছে, কখনও এমন শুনেছেন? এটা আমার বিরুদ্ধো ষড়যন্ত্র! কেউ আমার ক্ষতি চায়। আমি এর জোর তদন্ত করব।
এরপর সাংবাদিকরা আরও অনেক প্রশ্ন করেন। কীভাবে সে শহরের উন্নতি করবেন? তার লক্ষ্য কী? বস্তি এলাকায় কী কোনো তহবিল যাবে কীনা? আরও কিছু। রুহুল আমিন মনে মনে বিরক্ত হলেও তাকে তার এই খবরটা ঢাকতে এসব কিছু করতে হবে।
মারসাদরা ইউটিউবে নিউজটা লাইভ দেখছিল। রাহিন অট্টহাসি দিয়ে বলে,
–এক ঢিলে দুই পাখি কুপোকাত বন্ধু। ভালোই ফাঁসছে রুহুল আমিন।
মৃদুল তাচ্ছিল্য করে বলে,
–কয়েকটা দিন রুহুল আমিন একটু সমাজসে*বক সাঁজবে। তার পা*পের উপর একটু নামের পূণ্যের প্রলেপ দিবে।
মারসাদ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–করতে থাকুক সমাজসে*বা। এতো এতো জনগনের টাকা মে*রে যে খাচ্ছে সেগুলো এবার বের করুক। এরপর যখন ওর ফ্যাক্টরি রে*ট হবে তখন তার এই শুকনো কথায় চিঁড়ে ভিজবে না।
রাহিন রম্যস্বরে বলে,
–এরে তো গিরগিটি বলা যায়। বিপদে পরলে কী অভিনব পন্থায় রঙ বদলায়।
আহনাফ হাই তুলতে তুলতে বলে,
–গিরগিটিও এর থেকে ভালো। তবে রুহুল আমিনের ট্রাক ধরা পরাটা আকস্মিক চমক ছিল।
রবিন মাঝ দিয়ে বলে,
–এখন আরও শতর্ক হয়ে যাবে না সে?
মারসাদের শান্ত জবাব,
–একটা ধা*ক্কার দরকার ছিল যা মেঘ না চাইতে জলের মতো হয়ে গেছে। এখন সে কয়েকদিন জনসেবা করুক আর আমরাও এখন একটু জিরোই। যখন তার মন থেকে সন্দেহ কমবে তখন বাকিটা। তবে বর্ডারে তাকে আরেকবার যেদিন ধরা হবে সেদিন তার কুকর্ম সব জনসম্মুখে আসবে। তখন তার জারিজুরি ক্ষান্ত হবে।
হঠাৎ মারসাদের ফোন বেজে উঠে। মারসাদ ফোন নিয়ে দেখে পু’লিশের যে টিম সাতক্ষীরাতে আছে সেখান থেকে কল এসেছে। মারসাদ রিসিভ করে সালাম দিলে অপরপাশ থেকে তার জবাব আসে। অপরপাশ থেকে জানায়,
“আদিরার বাবা তার বাড়িটা বিক্রি করতে চায় না। সেখানে ১কাঠা জায়গা আছে আর দোকানঘরে আধ শতাংশ জায়গা আছে। আধ শতাংশ জায়গা সে বিক্রি করতে রাজি হয়েছে।”
মারসাদ সবটা শুনে বলে,
–তাহলে তাই করুন। গ্রামের মানুষ তার ভিটেমাটি ছাড়তে চাইবেই না। তাদের ঢাকা নিয়ে আসুন।
মারসাদ ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভালো সব সুন্দর চলছিল। একদিনের ভেতর সবটা জলদি জলদি মোর ঘুরে গেলো। তবে যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। যে কাজ আরও বছর দুয়েক পরে করতো সেটা এখনি হয়ে গেছে।
আহনাফ ও মৃদুলরা মারসাদের কাঁধে হাত রাখে। মৃদুল বলে,
–আমরা সবসময় তোর সাথে আছি। যেখানেই যাবো আমরা পাঁচজন একসাথে যাবো।
পাঁচ বন্ধুর একটা গ্রুপ হাগ হয়ে যায়। বন্ধুত্ব শব্দটার মূল্য অনেক। নাম মাত্র বন্ধুও হয় আবার আত্মার বন্ধুও হয়।
_________
আদিরা নাস্তা খাওয়ার পর থেকে একা একা অর্ণির রুমে বসে আছে। অর্ণি স্কুলে গেছে আর আহনাফের বড়োভাবি তার মেয়েকে স্কুলে নিয়ে গেছে। আদিরা উুঁকি দিয়ে বুঝেছে আহনাফের মা তার নিজের ঘরে আছেন। কাজের মহিলা ঘর পরিষ্কারের কাজ করছেন সাথে আহনাফের ভাবির নির্দেশনায় পেঁয়াজ, মরিচ, সবজি এসব কে*টে রাখছেন। একটু আগেই এসে এই রুমটা ঝা*ড়ু দিয়ে গেছেন। ঘড়ির কাঁটা ১১টার ঘরে। বড়োভাবির তার মেয়েকে নিয়ে ফেরার সময় হয়ে আসছে।
আদিরা একা একা একা বোর হচ্ছে বলে অর্ণির বুকশেলফ থেকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “দেবী চৌধুরানী” উপন্যাসের বইটা নিলো। বুকশেলফে আরও অনেক সাঁজানো আছে। একই সারিতে কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, দূর্গেশনন্দিনী, আনন্দমঠ, বিষবৃক্ষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখেরবালি, নৌকাডুবি, শেষের কবিতা, যোগাযোগ সাথে হুমায়ুন আহমদের বই পরের সারিতে আছে।
আদিরা দেবী চৌধুরানী বইটা পড়া শুরু করেছে। প্রায় চল্লিশ মিনিট একটানা পড়ে এবার বিরতির জন্য রুম থেকে বেরোলো তারপর রান্নাঘর থেকে কথা বলার শব্দে সেদিকে গিয়ে দেখে আহনাফের মা ও ভাবি একত্রে রান্না করছেন। আদিরা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছে বউ-শাশুড়ির সুন্দর জুটি। একজন পাতিলে মাং*স কষাচ্ছেন আরেকজন পোলাও রান্না করছেন। আদিরা তৃপ্তি নিয়ে দেখছে। আহনাফের ভাবি কাঁচামরিচের বাটিটা নিতে পেছোনে ঘুরে আদিরাকে দেখে সহাস্যে বলেন,
–আরে আদিরা। ভেতরে আসো।
আদিরা ভেতরে গিয়ে দেখতে থাকে। আহনাফের ভাবি আদিরাকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখে হেসে বলেন,
–মায়ের হাতের বিফ রান্নাটা আমারও অনেক প্রিয়। আমি নিজে রান্না করলেও এতো মজা হয়না। তাই আহনাফ যেদিন বাড়িতে আসে সেদিন বিফ রান্না হলে মা করেন। আর রোস্টটার জন্য মুরগির পিস গুলো ভেজে রেখেছি সেটাও মা আজ রান্না করতে চাচ্ছেন। আজ মারসাদরা সবাই দুপুরে এখানে খাবে। মারসাদ এলে মা নিজে রান্না করেন। জানোই তো ছেলেটা সেই ছোটোবেলাতে মা হারিয়েছে তারপর সৎমা আদর করেনি। মা মারসাদকে আহনাফের মতোই মনে করেন। ওদের পাঁচজনকেই মা অনেক স্নেহ করেন। আচ্ছা সেসব বাদ দেও। আমি শুধু পোলাও আর চাইনিজ সবজি রান্না করব। তোমার পছন্দ তো?
আদিরা মুগ্ধ হলো। ঘার নাড়িয়ে সায় দিলো। মারসাদের কথাটা শুনে আদিরার মনের ভিতর এক তীব্র হাহাকার জেগে উঠল। মায়ের পর বড়োবোনের মৃ*ত্যুতে সে এখন তার বাবার সাথেও কথা বলেনা। আদিরা চায় বাবা-ছেলের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাক।
আহনাফের মা কড়াইয়ের ঢাকনা দিয়ে আদিরার দিকে ফিরে বললেন,
–তোমার সাথে ঠিক করে গল্পই করা হলোনা। আজ বিকেলে চায়ের আড্ডায় গল্প হবে। তোমার কী কী খাবার পছন্দ?
আদিরা হেসে জবাব দেয়,
–আমার খাবারে বাছবিচার নেই। আমাকে দিন আমিও কিছু একটা করি। জানি আপনারাই সব সামলে নিতে পারবেন কিন্তু কিছু একটা করতে দিলে ভালো লাগবে।
আহনাফের ভাবি বলেন,
–তোমার কিছু করতে হবে না মেয়ে। তুমি না বই পড়ছিলে? গল্পের ভেতর ডুবেছিলে। আগে সেটা শেষ করো। আমরা সামলে নিবো।
আদিরা মুখ ভাড় করল সামান্য। তা দেখে আহনাফের মা বলেন,
–তুমি নাহয় কিছুক্ষণ পর শশা, টমেটো কে*টে দিও। আর কোনো কাজ নেই তোমার ভাগে। যাও বই পড়ো গিয়ে। অর্ণির কালেকশনে অনেক বই আছে। মাঝে মাঝে আমিও এনে পড়ি।
আদিরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবারও বই পড়তে চলে গেল।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,
#এক_শহর_প্রেম?
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩২
খাবার টেবিলে খাবার খাওয়ার সাথে যুক্ত হয়েছে আড্ডা। আহনাফের মা, ভাবি ও আদিরা খাবার পরিবেশন করছে। হাসি আড্ডাতে ছেলেদের খাবারের পর্ব শেষ হলে ওরা আহনাফের রুমে যায় তারপর আদিরা, আহনাফের মা, ভাবি ও বোন ওরা একসাথে খেয়ে নেয়।
বিকেলের একটু আগে, সূর্যের তেজ আজ অন্যদিনের তুলনায় কম। আহনাফদের ছাদে অনেক গাছ-গাছালি টবে লাগানো আছে। বাড়িটা তিনতলা বিশিষ্ট হলেও উপর ও নিচ তলা ভাড়াতে দেওয়া। বাড়ির পাশে দুয়েকটা বড়ো বড়ো আম ও কাঁঠাল গাছ আছে। ছাদে একটা দোলনাও লাগানো। আদিরা দেখেছিল, আহনাফের ভাবি তার মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন তাছাড়া সে অনেকটাই ক্লান্ত। আহনাফের মাও ঘুমোচ্ছেন। আসরের আজান হতে আরও ঘণ্টাখানেক বাকি। আদিরা টুক করে ছাদে উঠে গেল। অর্ণিকে আসতে বলেছিল কিন্তু অর্ণি ম্যাথ মিলাচ্ছিল বলে আসতে পারেনি। ছাদে গিয়ে গাছে ঝুলে থাকা লেবু, করমচা, আমরুজ এসব ধরে ধরে দেখছিল। বিমোহিত চিত্তে উপভোগ করছিল সব। অন্যদিন রোদের তেজে এসময় ছাদে আসাই যায় না। আদিরা একটা পাঁকা করমচা ছিঁড়ে নিল। গাছগুলো আহনাফদের এটা সে জানে।
হুট করে নিজের চোখের উপর কারও হাতের স্পর্শ বুঝতে পেরে মুচকি হাসল আদিরা। পেছোনে চোখ ধরে রাখা মারসাদ অপেক্ষা করছে আদিরার ভীত কন্ঠস্বর শোনার জন্য। কিন্তু মারসাদকে হতাশ করে আদিরা বলে,
–আপনার স্পর্শ আমায় ভীত করে ঠিক কিন্তু সাথে লাজুকতা ভর করে।
মারসাদ আদিরার চোখ ছেড়ে দিয়ে ওকে নিজের দিকে ঘুরায়। দুজনের চোখে অন্যরকম হাসি। যেন দুজনেই দুজনকে নিজেদের ঊর্ধ্বে অনুভব করতে পারে। মারসাদ আদিরার অবাধ্য চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলে,
–আমার এলোমেলো জীবন গুঁছিয়ে নিও। বড্ড এলোমেলো এই আমি। তোমার পদচারণায় আমার মনের শহরে আরও তোলপাড় হয়েছে। এখন সবকিছু তোমায় ঠিক করতে হবে মনোহারিণী!
আদিরা বিনিময়ে চমৎকার হাসে। তার মনে যা একটু সংশয় কাজ করছিল সেগুলোও খাবার টেবিলে কে*টে গেছে। মারসাদরা সেখানে পুরো ঘটনার বিশদ আলোচোনা করেছিল। মারসাদ বলে,
–একটা দুই রুমের ফ্লাট নিয়েছি। ফ্লাটটা এক মাস ধরে ফাঁকা ছিল। দেয়ালের রঙ করিয়েছিল বলে ভাড়াটে ছিল না এক মাস আর এই মাসেও কেউ উঠেনি। মাসের প্রায় মাঝামাঝি চলে এসেছে তাও প্রয়োজনে যে পেয়েছি ওটাই অনেক। আঙ্কেল-আন্টি, আহাদকে নিয়ে সেখানে ওঠো। বড়ো ফ্লাট পাইনি। বিকেলে মাহি আসবে। মাহি আমাকে ভার্সিটিতেই কতক্ষণ কি*ল, ঘু*ষি দিয়েছে তাকে না জানিয়ে বিয়ে করার জন্য।
এটা বলে মারসাদ হাসতে থাকে। আদিরা বলে,
–আমাকেও এসে কতোগুলা দিবে নয়তো মুখ ফুলিয়ে থাকবে। আচ্ছা, আহনাফ ভাইয়ের সাথে মাহি তো সেইদিনের পরে আর কথাই বলল না। আমি কী মাহিকে কিছু জিজ্ঞেসা করব? আমার মনে হয় মাহি আহনাফ ভাইয়াকে পছন্দ করে।
মারসাদ হতাশ স্বরে বলে,
–তোমার আমার ভাবনা মিথ্যেও হতে পারে। আমি আমার বন্ধুর লুকানো হতাশা অনুভব করতে পারি। তবে সবচেয়ে বড়ো সত্য আমি একজনের ভাই। ভাইয়ের সম্পর্কের সাথে বন্ধুর মতো ভাইয়ের সম্পর্কটা একই ধাঁচের কিছুটা। একটা রক্তের আরেকটা আত্মার। আমি তাই ওদের বিষয়ে কিছুই বলব না। সময় নিক। টাইম কেন হিলস এভরিথিং।
আদিরা কিছু বলল না। মারসাদ এবার কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে বলে উঠে,
–ও আচ্ছা শোনো, তোষক আপাততো একটা অর্ডার দিয়েছি যেটা আজ রাতেই দিবে। উনারা তো ম্যাট্রেসে ঘুমাতে পারবে না। তাই কিনি নি। তবে ম্যাট্রেসটা ভালো হতো। তোমার জন্যও কী তোষক আনব? ম্যাট্রেস আনি? আমার ওটাই ভালো লাগে।
আদিরা বুঝলো মারসাদের ম্যাট্রেস বেশি পছন্দের। তাছাড়া ওরা বিবাহিত তাই এখন মারসাদ চাইলেই আদিরা সাথে এসে থাকতে পারে। আদিরার ম্যাট্রেসে ঘুমানোর অভ্যাস নেই কিন্তু মানুষকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভ্যাস গড়তে হয়। আদিরা মারসাদকে হ্যাঁ বলে দিল। মারসাদ বলল,
–তাহলে নিচে চলো। তোমার ননোদিনী একটু পরেই চলে আসবে। আমিও বিকেলে বেরিয়ে যাব। তুমি আজকে রাতটা এখানেই থাকো। আমরা পাঁচ বন্ধুও রাতে এখানে থাকব। তোমার বাবা-মা মনে হয় আসতে আসতে অনেক রাত হবে কারণ ওরা এখনও রওনাই করেনি। ঝামেলা মিটিয়ে রওনা করবে। আর কী কী নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস লাগবে বলে দিও।
আদিরা কিয়ৎ ভাবে। তারপর বলে,
–নিত্য প্রয়োজনীয় কিছুই লাগবে না এখন। আপনি তো আমার মাকে চিনেন না। সে আমাকে যদি মেসে উঠার জন্য হাড়ি-পাতিল, কড়াই, প্লেট সব একটা একটা করে দিয়ে দেয় তাহলে নিজেরা আসার সময় নিশ্চয়ই নিয়ে আসবে। আপনাকে অযথা খরচ করতে হবে না। এমনিতেও ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া অনেক। আমি ভাবছি ভাড়া আমি দিব। কারণ ওরা আমার বাবা-মা। আমার দায়িত্ব বেশি।
মারসাদ আদিরাকে বাধা দিয়ে বলে,
–ওয়েট ওয়েট। কী বললে তুমি এসব! তুমি আমার বউ। তোমার সবকিছুর দায়িত্ব আমার। আর তোমার বাবা-মায়ের জন্য এটুকু আমি করতে পারব না?
আদিরা মুচকি হেসে মারসাদের হাত ধরল। মারসাদ ভ্রুঁ কুঁচকে আদিরার দিকে তাকিয়ে আছে। আদিরা বলে,
–আমি আপনার বউ তাই একমাত্র আমি আপনার দায়িত্ব হতে পারি কিন্তু আমার বাবা-মায়ের দায়িত্ব আমি নিতে চাই। আর আপনি তো আমার বাবাকে আমার দেনমোহর দিয়েই দিয়েছেন। আমার খুব ইচ্ছে আমার বাবা-মাকে আমি নিজের উপার্জনে রাখব। আপনি রাগ না করে আমার দায়িত্ব নেন আর আমি আমার পরিবারের। দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিলে কোনো কিছুই বোঝা মনে হবে না।
মারসাদ তো আদিরার বলা, “আপনি তো আমার বাবাকে আমার দেনমোহর দিয়েই দিয়েছেন।” ওখানেই আটকে আছে। আদিরাকে তো সে বলেনি। মারসাদের হতভম্ব মুখশ্রী দেখে আদিরা হেসে বলে,
–এটাই ভাবছেন তো আমি দেনমোহরের ব্যাপারে কিভাবে জানলাম? সকালে পুলিশ ওখানে যাওয়ার পর মা আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল তারা ঠিক আছে আর জিজ্ঞেসা করেছিল, দেলোয়ার আমাকে কিছু করেছে কীনা? তখন আমি বিয়ের কথাটা বলে দিয়েছি। মা তখন আমাকে দেনমোহর দিয়ে কর্জ চুকানোর কথা বলেছে। দুপুরে তো আপনি বললেনই কীভাবে সব ঠিক করেছেন। এরপর আমি বুঝতে পারলাম, আপনি কীভাবে বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়েছেন।
মারসাদ এবার আদিরার গাল দুটো টেনে দেয় তারপর বলে,
–দেখেছ, কতো বুদ্ধিমান আমি! শ্বশুর-শাশুড়ির মন জয় করে নিয়েছি আগেই।
মারসাদ আদিরাকে নিজের প্রশস্ত বুকের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গন করল। হঠাৎ হাসি রোলে আদিরা ও মারসাদ একে অপরের থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল। ছাদের দরজার কাছে মারসাদের চার বন্ধু, আহনাফের ভাবি, মাহি, অর্ণি, রিন্তি ও সাবিহা দাঁড়িয়ে হাসছে। মাহি তীক্ষ্ম নজর দিয়ে মারসাদদের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
–একে তো না জানিয়ে বিয়ে করেছিস! আবার এখন লুকিয়ে লুকিয়ে দিনের আলোয় খোলা ছাদে বাসরও করছিস! দাভাই তুই দিন দিন লজ্জাহীন হয়ে যাচ্ছিস সাথে আমার ভোলাভালা বান্ধুবীটাকেও বানাচ্ছিস।
মারসাদ মাহির মাথায় ঠোকা দিয়ে বলে,
–এই বা*চাল! তুই কখন এলি? এলি যখন ছাদে কেন এলি! ভাই-ভাবি নতুন বিয়ে করেছে একটু রোমান্স করবে না! নিজে লজ্জাহীন হচ্ছিস আর দোষ দিচ্ছিস আমাদের।
মাহি হা করে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে মারসাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফের ভাবি এসে হাসতে হাসতে বলে,
–ভাই তোমার রোমান্স করার ইচ্ছে হলে বলতে। আমি নিজে তোমাদের একটা রুম খালি করে দিতাম। তাও ছাদে তো যেকেউ চলে আসতে পারে।
আদিরা এমন লজ্জাজনক অবস্থায় পরবে আশা করেনি। চোখ মুখ খিঁচে মাথা নিচু করে রেখেছে। আদিরাকে এমনভাবে থাকতে দেখে মাহি ওর হাত ধরে বলে,
–ভাবিবান্ধুবী! তোকে আমি এখন কোনটা বলব বুঝতেছি না। নাম ধরে বললে যদি তোর বর রাগ করে!
মারসাদ মাহিকে বলে উঠে,
–তোকে এতো ফর্মালিটি করতে হবে না। ওকে আগে যেভাবে ডাকতি তেমন করেই ডাকিস।
মাহি মুখ বাঁকা করে বলে,
–ইশ! তোর কাছ থেকে ট্রিট নেওয়ার এখন আদিরারাই উৎস। তাই আমি ওকে ভাবি বলেও ডাকব যখন তোর থেকে কিছু নেওয়ার হবে।
মারসাদ মাহিকে দৌঁড়ানি দিলে মাহিও ছুটতে থাকে। ওদিকে একজন মলিন দৃষ্টিতে মারসাদ ও মাহির খুঁনশুটি দেখছে। সেই একজনটা আহনাফ। মাহি এখনও তার সাথে কথা বলেনি বলে সে মলিন দৃষ্টিতে তার প্রেয়সীকে দেখছে। মাহি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আহনাফের ভাবির পেছনে এসে থামে আর ভাবিকে বাঁচাতে বলে। মাহি পেছোন দিকে ব্যালেন্স হারাতে নিলে আহনাফ ধরে ফেলে। দুজন দুজনকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পরে। মারসাদ আহনাফ ও মাহিকে একত্রে দেখে থেমে যায়। ওদের দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হোক মারসাদ চায়।
অপ্রস্তুত হয়ে মাহি সরে আসে তারপর বলে,
–আদু চল। আমরা আড্ডা দিব। ভাবি ও আন্টিও আমাদের জয়েন করবে। চল চল।
এটা বলে সে খুব ব্যাস্ততার সাথে আদিরাকে টেনে নিচে নিয়ে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,