চৈত্রের_বিকেল #পর্ব_৭ #মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

0
433

#চৈত্রের_বিকেল
#পর্ব_৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
চৈত্রী তড়িৎবেগে কাব্যর হাত চেপে ধরে। ক্ষতস্থান চেপে ধরাতে জ্ব’ল’ছি’ল ভীষণ। অন্ধকারে কাব্যর ব্যথিত মুখটি চৈত্রী দেখতে পায়নি। উলটো তার চোখে-মুখে, মনে রয়েছে ত্রাসের প্রতিচ্ছবি। কাব্য কিছু বলার পূর্বেই চৈত্রী হড়বড়িয়ে বলা শুরু করল,

‘প্লিজ, প্লিজ এই কথাটা মাকে বলিয়েন না। মা জানলে ভীষণ বকবে আমায়।’

কাব্য আহম্মক বনে যায়। খামচি দিয়ে ক্ষত তৈরি করে ফেলেছে সেদিকে এই মেয়ের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই! সে পড়ে আছে বিচার দেওয়া নিয়ে। কাব্য মনে মনে আওড়ায়,

‘আসলে ভুলটা আমারই। আমি অযথাই একটু বেশি ভেবে ফেলেছি। সংবেদনশীলতা এই মেয়ের স্বভাবে নেই। নিরামিষ!’

কাব্য হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,’তোমার নাচানাচি বন্ধ করো আগে।’

‘আমি নাচলাম কখন?’

‘হাত ধরে লাফালাফি কেন করছ?’

চৈত্রী গলা নামিয়ে বলল,’স্যরি।’

‘ভয় নেই। কাউকে কিছু বলব না আমি। নিচে চলো।’

কাব্যর সঙ্গে নিচে নামল চৈত্রী। রাতের খাওয়া-দাওয়া সবাই আজ এই বাড়ি থেকেই করে গেছে। দুই পরিবারের ভাবসাব দেখে মনে হলো বিয়ের কথাবার্তা আশি পার্সেন্টই পাকা। চৈত্রী সবার সাথে থেকেও চুপ করে রইল। রাতে আজ দিশাও ওদের সাথে ঘুমাবে। ওরা তিনজন একসাথে ঘুমালে চৈত্রী সবসময় ওদের দু’বোনের মাঝখানে শোয়। দিশা যখন আজ সাইডে শুতে যাচ্ছিল চৈত্রী বাধা দিয়ে বলল,

‘তুই মাঝখানে শো। আমি কিনারে ঘুমাব।’

দিশা বেশ অবাকই হলো চৈত্রীর এমন পরিবর্তনে। রুহানিয়া তখন রুমের দরজা লাগাচ্ছিল। সে নিজেও অবাক। দরজা লাগিয়ে খাটের ওপর বসে বলল,

‘চৈত্রী কী হয়েছে তোর?’

বালিশ ঠিক করে শুয়ে চৈত্রী বলল,’কী হবে? কিছুই না।’

‘কিছু তো একটা অবশ্যই হয়েছে। বিকেল থেকে দেখছি তুই গাল ফুলিয়ে রেখেছিস। কেন বল তো?’

‘গাল ফুলিয়ে রাখতে যাব কেন? আমার গাল তো এমনিতেই ফুলোফুলো। চাপা ভাঙা নাকি?’

দিশা এই কথায় শব্দ করে হেসে ওঠে। চৈত্রী একবার ওর দিকে ফিরে চোখ পাকাল। দিশা দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে বলল,

‘স্যরি।’

রুহানিয়া চৈত্রীর হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বসাল। চৈত্রী নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

‘কী হয়েছে? এমন করছ কেন? ঘুমাব আমি। সকালে ক্লাস আছে।’

‘তোর কী হয়েছে সেটা বল।’

‘আমার কিছুই হয়নি।’

‘তাহলে তুই আমাকে এড়িয়ে চলছিস কেন?’

‘কারণ আমি তোমার কেউ না তাই।’

বিস্মায়ভূত হয়ে তাকিয়ে থাকে রুহানিয়া। দিশাও কিছুই বুঝতে পারছে না। রুহানিয়া এবার পা উঠিয়ে বসল। জোর করেই চৈত্রীর দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

‘তুই কি কোনো কারণে আমার ওপর রেগে আছিস?’

বিকেল থেকে আটকে রাখা কান্নাগুলো এবার আর বারণ শুনল না। ঝরঝর করে চোখের পানি পড়ছে চৈত্রীর। রুহানিয়া এবং দিশা দুজনই হতবিহ্বল হয়ে যায় এই কাণ্ডে। চৈত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘হাত ছাড়ো আমার। তুমি আমার সাথে আর কখনো কথা বলবে না। আমি তো কেউ না তোমার।’

রুহানিয়া অসহায়ের মতো বলল,’আমার অপরাধ কী? প্লিজ লক্ষী বোন আমার! কাঁদিস না তুই। বল আমি কী করেছি?’

চৈত্রী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,’তুমি যে জিহাদ ভাইয়াকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ কেন জানাওনি আমায়? তারা আসবে, কাকিরা আসবে এসব কিছুই তো তুমি আমাকে জানাওনি। আসলে তুমি প্রয়োজনই মনে করোনি। কারণ আমি তো আর দিশা নই। দিশা তোমার আপন বোন। কিন্তু আমি তো কাজিন। বলতে গেলে পর-ই।’

কথাগুলো বলতে বলতেই ঠোঁট ভেঙে আবার কান্না শুরু করে চৈত্রী। দিশা আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখও ছলছল করছে। সে কারও কান্না সহ্য করতে পারে না। আর সামনে থাকা সেই মানুষটা যদি হয় প্রিয় মানুষ; তাহলে তো কথাই নেই। দিশার নিজেরও বোনের ওপর খুব রাগ হলো। সে নাক ফুলিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় রুহানিয়াকে বলল,

‘এমনিতে তো চৈত্রীর ওপর খুব ভালোবাসা দেখাস। কত আদর! তাহলে ও-কে কেন জানাসনি?’

রুহানিয়া পড়েছে মাঝ সাগরে। এদিকে চৈত্রী হাউমাউ করে কাঁদছে। ওদিকে দিশার অভিযোগের বাণ। সে চৈত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘আমাকে তুই ভুল বুঝছিস বোন। তোকে জানানোর সুযোগটাই তো আমি পাইনি। তুই প্রতিদিন রাত ১২টার মধ্যে পড়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়িস। গতকাল রাতেও তুই সাড়ে ১১টায় ঘুমিয়ে পড়েছিস। রাত ১টায় জিহাদের সাথে কথাবার্তা বলে সিদ্ধান্তে এসেছি যে আমি এই বিয়েতে রাজি হব। ঐ সময়ে তোকে ঘুম থেকে তুলতে ইচ্ছে হয়নি। কাকি জেগেই ছিল। তাই কাকিকে জানিয়েছি। কাকি তখনই বাড়িতে ফোন করে মাকে সব জানিয়েছে। মা সকালে বাবাকে বলেছে। বাবা তখন সকলকিছু বিস্তারিত জানার জন্য কাকিকে ফোন করেছিল। কাকি জরুরী তলব বলে যে করেই হোক আজকেই আসতে বলেছে। জিহাদও চায়নি দেরি করতে। ও নিজেও ওর বাবা-মাকে আজ ঢাকায় চলে আসতে বলেছে। বাসায় আর কাকিকে এসব জানানোর কথা জিহাদকে জানাব বলে রুমে এসে ফোন করেছিলাম। ঐ সময় কথা বলতে বলতে ভোর হয়ে গেছে। লেট করে ঘুমিয়েছি বলে সকালে উঠতেও আমার দেরি হয়েছিল। আমি উঠে দেখি তুই কলেজে চলে গেছিস। কলেজে তোর ফোন নেওয়া নিষেধ তাই ফোন করেও জানাতে পারিনি। দুপুরে তো আর তুই বাসায়ও আসিস না সব মিলিয়ে তোকে জানানোর মতো সময়-সুযোগ কোনোটাই আমার হয়ে ওঠেনি।’

রুহানিয়াকে চৈত্রী যতটা ভালোবাসে ততটা বিশ্বাসও করে। তাই সে যা বলছে তার সবটাই যে সত্য এতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে সত্যিটা জানার পূর্বে চৈত্রী নিজেও নিজ স্থানে সঠিক ছিল। এক কথায় বলতে গেলে, একটা ছোট্ট ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গেছে। চৈত্রীর কান্নার গতি এবার কমে আসে। রুহানিয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘এবার আর রাগ করে থাকিস না প্লিজ!’

চৈত্রী চোখ মুছে বলল,’স্যরি আপাই। ভুলটা আসলে আমারই।’

দিশা তখন চৈত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল,’তোর কোনো ভুল হয়নি। আপুরও না। শুধু একটু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে এই যা!’

রুহানিয়া দিশার গাল টেনে বলল,’একটু আগে তো তুইও আমায় ভুল বুঝেছিলি।’

‘ভুল বুঝবোই তো! তোর কারণে চৈত্রী কেঁদেছে। আমার কষ্ট হয় না?’

‘সব কষ্ট শুধু তোদের একারই হয় তাই না? আমার তো কষ্ট হয় না কোনো।’

দিশা আর চৈত্রী একসাথে রুহানিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,’স্যরি। আর ভুল বুঝব না আমরা।’
.
.
বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে কাব্য। রুমে নীল রঙের ডিম লাইটের আবছা আলোতে নিজের ক্ষ’ত’স্থা’ন’টি দেখছে। যতবার ব্যথা অনুভব হচ্ছে ততবারই চৈত্রীর মায়া মায়া ভীত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। পরক্ষণে আবার হাসিও পাচ্ছে। সে আকাশমুখী হয়ে শুলো। মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটি বিরতিহীনভাবে ঘুরছে। পাশের সিঙ্গেল খাটে শুয়ে শুয়ে ইউটিউবে গান শুনছে তিতাস। জিহাদ আজ ওদের সাথে নেই। ওর বাবা-মাকে নিয়ে খালার বাসায় গেছে।

তিতাস নড়েচড়ে বলে,’কিরে ঘুমাবি না আজ?’

কাব্য ওর দিকে তাকিয়ে বলল,’তুই ঘুমাস না কেন?’

‘এতক্ষণ তো ঘুমের যন্ত্রণায় টিকতে পারছিলাম না রে ভাই! আর এখন ঘুমই নাই।’

‘আমারও একই অবস্থা।’

তিতাস হাসতে হাসতে বলল,’শুভ্রর বিয়েতে গিয়ে মাঝখান থেকে জিহাদ ছক্কা মেরে দিলো। তোর আর চৈত্রীর ঝগড়া-ঝাটি দেখে আমি তো ভেবেছিলাম হলে তোদেরই কিছু হবে। আর যাদের নিয়ে কিছু ভাবিনি তারাই বিয়ে করতে চলেছে।’

কাব্য মাথার নিচে দু’হাত রেখে বলল,’চৈত্রী আর আমি? এ যেন আকাশ আর পাতাল।’

‘কেন? মেয়েটা তো ভালো।’

‘খারাপ বলিনি। এক নাম্বারের একটা ঝগড়াটে আর নিরামিষ টাইপের মেয়ে।’

‘কী হয়েছে বল তো?’

‘আরে আমি ও-কে ফোন করতাম, ম্যাসেজ করতাম এসবকিছু রুহানিয়া আপুর কাছে বলেছে। আবার বলছে আমি নাকি বিরক্ত করি। রুহি আপু আবার জিহাদ ভাইয়াকে বলছে আমি যেন ও-কে আর ফোন বা ম্যাসেজ না করি। ও খুব সেনসিটিভ টাইপের মেয়ে।’

‘বাপরে বাপ! তলে তলে এতদূর?’

‘এতদূর আর কোথায় দেখলি? মনে তো জায়গাই করতে পারলাম না। তার আগেই বিচার দিয়ে বসে আছে।’

‘তুই আর ফোন করিসনি?’

‘না। আবার কাকে বিচার দেয় ঠিক আছে নাকি? শুভ্র জানলে বিষয়টা খারাপভাবে নেবে।’

‘তুই কি সত্যিই চৈত্রীকে ভালোবাসিস?’

‘চৈত্রীর মতো তোরও কি মনে হয় আমি মজা করছি?’

‘না মানে, কত ওয়েল ওয়েল মেয়ে, স্টাবলিশড্ মেয়ে তোকে পছন্দ করে। বিয়ে করতে চায়। ওদের রেখে….’

‘হ্যাঁ, ওদের রেখে আমার চৈত্রীকেই ভালো লাগে। একটা কথা আছে জানিস তো, আমাদের যারা ভালোবাসে তাদেরকে আমাদের ভালো লাগে না। আবার আমরা যাদের পছন্দ করি, তারা আমাদের পছন্দ করে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এত এত অপশন হাতে থাকা সত্ত্বেও ঐটুকুন পিচ্চিবাচ্চা মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। রীতিমতো নাকানি-চুবানি খাওয়ানোর পরও ঐ মেয়ে বুঝে না যে, আমি তাকে ভালোবাসি।’

তিতাস আফসোস করে বলল,’আহারে! কেন যে বয়সে এত ছোটো মেয়ের প্রেমে পড়তে গেলি।’

চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে কাব্যর। তিতাস যে ও-কে নিয়ে মজা উড়াচ্ছে এটা বেশ ভালোই টের পাচ্ছে সে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

‘ঢং করিস না। তুই যে কেমন করে দিশার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলি সেটা কিন্তু আমি দেখেছি। আর হ্যাঁ, দিশাও আহামরী বড়ো মেয়ে নয় ঠিক আছে?’

তিতাস থতমত খেয়ে বলে,’কী যা তা বলিস! আমি আবার কখন দিশার দিকে তাকালাম?’

‘তোর এই বাজে অভিনয় অন্য কারও সামনে করিস। এখন চুপ করে থাক। কথা বলতে ভালো লাগছে না।’

‘চৈত্রীকে মিস করছিস?’

কাব্য কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বলল,’হুম।’

‘তোকে একটা বুদ্ধি দেই।’

‘তোর আজাইরা বুদ্ধি আমার লাগবে না।’

‘আরে ব্যাটা ভালো বুদ্ধি। একদম কার্যকরী।’

‘মজা করবি না তো?’

‘একদম না।’

কাব্য শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,’বল, শুনি।’

‘চৈত্রী বিচার দেওয়ার পর তুই তো আর ফোন দিসনি তাই না? তোদের মধ্যে কথাও হয়নি।’

‘ফোন দেইনি। কিন্তু কথা হয়েছিল আজ ছাদে। সামনা-সামনি।’

‘সমস্যা নেই। আসল কথা হচ্ছে, তোর যতই খারাপ লাগুক তুই ফোন করবি না। ম্যাসেজও করবি না। এরপরের বার দেখা হলে আগ বাড়িয়ে কথাও বলবি না। ও যদি কথা বলতে আসে তুই একটু এড়িয়ে এড়িয়ে কথা বলবি। বলতে গেলে এভোয়েড করবি।’

‘শা’লা! এমনিতেই ওর মন পাই না। এভোয়েড করলে তখন তো আরও পাব না।’

‘আহা! প্যারা কেন নিচ্ছিস? মাঝে মাঝে ইগনোর করেও ভালোবাসা পাওয়া যায় জানিস? এইযে তুই এখন আর ও-কে ফোন করিস না, ম্যাসেজ করিস না; আমি শিওর এখন ও তোকে মিস করে।’

‘সত্যিই?’

‘আলবৎ।’

‘তাহলে ও নিজে থেকে একটা ফোন বা ম্যাসেজ কেন করে না?’

‘বোকার মতো প্রশ্ন করছিস কেন? ও নিজে বিচার দিয়েছে। এখন আবার নিজেই ফোন করবে? ইগো বলতেও তো একটা কথা আছে।’

‘নিকুচি করেছি এমন ইগোর!’

‘হ্যাঁ, কর। তুইও ইগো দেখাবি। ইগনোর করবি। তখন দেখবি ও নিজেই কেমন সুড়সুড় করে লাইনে চলে আসে।’

‘আর যদি না আসে?’

‘আসবে আসবে। তবে যদি দেখিস আসলেই আসতেছে না, কথা বলে না তখন তুই নিজে থেকে যোগাযোগ করবি। তবে হ্যাঁ, ভুলেও উলটা-পালটা কথা বলে রাগিয়ে দিবি না। সুন্দরমতো গাম্ভীর্য বজায় রেখে কথা বলবি।’

‘আপাতত আমার কী করা উচিত?’

‘আপাতত ও-কে ওর মতো থাকতে দে। আর তুই ইগনোর করতে থাক।’

কাব্য ভারী দীর্ঘশ্বাস নিয়ে একটু টেনে টেনে বলল,’ঠিক আছে!’
_________
সব খোঁজ-খবর নেওয়া শেষে দুই পরিবার বিয়েতে সম্পূর্ণ মতামত দিয়েছে। রুহানিয়া আর দিশা এখন গ্রামে। জিহাদ তার পরিবার নিয়ে পাকা কথা গ্রামে এসেই ঠিক করেছে। বিয়ে হবে তিন মাস পর। আপাতত জিহাদ এবং রুহানিয়া চুটিয়ে প্রেম করছে। সময়, সুযোগ পেলেই দুটিতে মিলে সারাক্ষণ ফোনে গুজুরগুজুর করতেই থাকে। রাত প্রায় দুটো বাজে। দুজনের কারও চোখেই ঘুম নেই। জিহাদ অসহায় ভঙ্গিতে বলে,

‘একটা কথা বলব রুহি?’

রুহি সম্মতি জানিয়ে বলল,’জিজ্ঞেস করার কী আছে? বলে ফেলুন।’

‘তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।’

‘প্রতিদিনই তো ভিডিয়ো কলে কথা হচ্ছে।’

‘ভিডিয়ো কলে দেখা আর সামনে থেকে দেখা কি এক হলো? দু’সপ্তাহ্ হয়ে গেছে সামনা-সামনি দেখা হয় না।’

রুহানিয়া ঠোঁট টিপে হেসে বলল,’তাহলে এখন কী করা যায়?’

‘তুমি ঢাকায় আসো।’

‘এখন ঢাকায় কী করে যাব? বাবা-মা’ই বা কী ভাববে?’

‘কেউ কিছু ভাববে না। শুধু তুমি রাজি হলেই হলো। বাকিটা আমি সামলে নেব।’

‘আপনি সামলে নেবেন মানে?’

‘চৈত্রীকে দিয়ে বলাব। ওর কথা তোমার বাবা-মা ফেলতে পারবে না।’

‘ওহ আচ্ছা! এখন আমার বোনকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করছেন?’

‘এভাবে কেন বলছ? তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।’

রুহানিয়া হেসে বলল,’মজা করেছি। বাড়িতে যদি ম্যানেজ করাতে পারেন তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।’

জিহাদ খুশি হলো।
.
পরেরদিন সকালেই তিতাসকে নিয়ে চৈত্রীর কলেজের সামনে হাজির হলো জিহাদ। চাইলে ফোনেই কথাগুলো বলা যেত। তবে জিহাদের মনে হয়েছে সামনা-সামনি ভালোমতো বুঝিয়ে বলা যাবে। ওদের দুজনকে দেখে চৈত্রী একটু অবাকই হলো। আনমনে সে কাব্যকেও খুঁজছিল। কিন্তু সে আসেনি! যারপরনাই মন খারাপ হলো তার। এই ক’দিনে কাব্য সত্যিই আর কোনো ফোন করেনি। ম্যাসেজ করেনি। এমনকি সামনেও আসেনি। এবং অবাক লাগলেও সত্যি যে, চৈত্রী কাব্যকে ভীষণ মিস করেছে। আর এখনো করে। কতবার সে নিজ থেকে কল দিতে গিয়েও ফোনটা আবার রেখে দিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এক সময় এই ছেলেটাকেই তার বিরক্ত লাগত। চরম বিরক্তিকর মানুষ ছিল চৈত্রীর কাছে। আর এখন কিনা তার শূন্যতাই চৈত্রীকে জ্বা’লি’য়ে মা’র’ছে! সময় বুঝি এভাবেই বদলে যায়? কী-ই বা আর করার আছে। চৈত্রী তো আর যেচে কাব্যকে মিস করতে যায়নি। কাব্য নিজেই তার অভ্যাসে পদার্পণ করেছিল। আর এখন সময় বুঝে পালটেও গেছে। নাকি চৈত্রী নিজেই তাকে বদলে যেতে বাধ্য করেছে?

তার চিন্তা-চেতনার রেশ কাটে জিহাদের প্রশ্নে। জিহাদ জিজ্ঞেস করে,

‘তোমার এখন সময় হবে তো?’

চৈত্রী একবার হাত-ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলল,’ক্লাস শুরু হতে এখনো পঁচিশ মিনিট বাকি। বিশ মিনিট দেওয়া যাবে।’

জিহাদ প্রসন্ন হয়ে বলল,’এটাই অনেক।’

কলেজের পাশের একটা ক্যাফেতে বসল ওরা। চৈত্রী আনমনে জিজ্ঞেস করে ফেলল,

‘আজ অফিস নেই আপনাদের?’

জবাবে জিহাদ বলল,’আমি ছুটি নিয়েছি। তিতাস কাব্যর জন্য যায়নি।’

ভ্রুকুটি করে চৈত্রী জানতে চাইল,’উনার কী হয়েছে?’

‘অসুস্থ একটু।’ বলল তিতাস। সঙ্গে আড়চোখে চৈত্রীকে তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে মনের ভাবও বোঝার চেষ্টা করে নিলো।

চৈত্রী অবশ্য কিছু বলল না। অনেকটা মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল। জিহাদ নিজের প্রসঙ্গে এসে সবটা খুলে বলল। এবং অনুনয়ও করল চৈত্রী যেন তার অনুরোধে রাজি হয়ে যায়। দ্বিমত করেনি চৈত্রী নিজেও। কারণ রুহানিয়াকে ছাড়া এখন তার নিজেরও রুমে ভালো লাগে না। কাব্যর মতো রুহি নিজেও তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। সেদিনই বিকেলে কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরে মায়ের কাছে বায়না ধরল চৈত্রী রুহানিয়াকে নিয়ে আসার জন্য। মেয়ে তার বড্ড জেদি জানে। তাই সে বলেছে,

‘ঠিক আছে। তুই নিজেই ফোন করে বল।’

চৈত্রী সত্যি সত্যিই ফোন করে কাকা আর কাকিকে মানিয়ে নিয়েছে। কালকের সকালের ট্রেনেই যেন রুহানিয়াকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই হুকুম জারি করেছে। দিশাকেও সাথে পাঠাতে বলেছিল। তবে পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে দিশার যাওয়ার পারমিশন আপাতত হয়নি। কিছুটা মন খারাপ হলেও চৈত্রী মেনে নিয়েছে। কথা শেষ করে রুমে এসে অনেকক্ষণ পায়চারি করেছে। কাব্যর অসুস্থতার কথা শুনে মনটা বিষন্ন হয়ে ছিল সারাদিন। ক্লাসেও মন বসেনি। এমনটা যে কেন হচ্ছে কে জানে! অবশেষে সে কল করতে গিয়েও অদৃশ্য এক দেয়ালের উপস্থিতি টের পেয়ে কল করতে পারেনি।

জেসমিন বেগমকে বলেছে আগামীকাল সে কলেজে যাবে না। স্টেশনে যাবে রুহানিয়াকে আনতে। একটা দিনের কথা ভেবে জেসমিন বেগমও আর বাধ সাধেনি। শুধু জানতে চেয়েছিল সাথে জিহাদ যাবে কিনা। চৈত্রী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলেছে। প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসেছিলেন শুধু তিনি। সারা রাত তার ভালো করে ঘুমও হলো না। যার দরুণ সকালে ঘুম ভেঙে দেখল চোখ দুটি লাল হয়ে আছে। সে হাই তুলে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে গোসল করে সাদা রঙের একটা থ্রি-পিস পড়ে। ভেজা চুল তাই আর বাঁধেনি। সকালের নাস্তা সেড়ে বেরিয়ে পড়েছে জিহাদের সাথে। স্টেশনে পৌঁছে দেখল সেখানে কাব্য আর তিতাসও আছে।

কাব্য যখন জেনেছে চৈত্রীও জিহাদের সাথে স্টেশনে আসবে তখন থেকে তার মন উতলা হয়ে আছে চৈত্রীকে দেখার জন্য। কতদিন সরাসরি দেখা হয় না। কথা হয় না। মাঝে মাঝেই সে দূর থেকে লুকিয়ে চৈত্রীকে দেখত। কিন্তু এতে তার মন ভরত না। তাই এতদিন পর এমন একটা সুযোগ পেয়ে মোটেও হাতছাড়া করতে রাজি হয়নি। বন্ধুর বেগতিক অবস্থা দেখে জিহাদ কিংবা তিতাস কেউই না করতে পারেনি।

চৈত্রী গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মাঝখানে তিতাস দাঁড়ানো। কাব্য ছটফট করছিল কথা বলার জন্য। কিন্তু কীভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। অন্যদিকে কাব্যকে এতদিন পর দেখামাত্র চৈত্রীর অভিমানের পারদ তরতর করে বাড়তে থাকে। অথচ মানুষটার ওপর অভিমান করার কোনো অধিকারই তার নেই। তবুও যেন অদৃশ্য এক অধিকার যেচে এসে তার মস্তিষ্কে জোর খাটাচ্ছে। তিতাস কাব্যর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ভাবতে লাগল কীভাবে দুজনের কথা বলিয়ে দেওয়া যায়। হুট করেই খেয়াল হলো কাব্য নিজেও সাদা শার্ট পরেছে। আচমকা যেন বিশাল এক আইডিয়া আকাশ থেকে তার ওপর পড়ল। ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

‘কী ব্যাপার? দুজনেই দেখছি ম্যাচিং ম্যাচিং। প্ল্যানিং বুঝি?’

চৈত্রী ঝুঁকে একবার আড়দৃষ্টিতে কাব্যর দিকে তাকাল। রাগান্বিত স্বরে বলল,

‘প্ল্যানিং কেন হতে যাবে? সে সাদা পরবে জানলে কস্মিনকালেও আমি আজ সাদা পরতাম না।’

মুখে এই কথা বললেও মন যেন বলছিল অন্যকিছু। এতদিন পরও চৈত্রীর এমন কঠোরতা দেখে মনে মনে আহত হয় কাব্য। তিতাসের সেদিনের বুদ্ধি সব বিফলে গেল! সে চৈত্রীর মনে কোনো জায়গা করে নিতে পারেনি। এখনো কাব্য তার কাছে বিরক্তিকর একজন ব্যক্তি। অন্তত কথাবার্তায় তো সেটাই প্রমাণিত। কাব্য আর কিছু না বলে বসে পড়ল। শরীরটা ভালো লাগছে না। জ্বর এখনো কমেনি। চৈত্রীর সাথে দেখা হবে এই খুশিতে মন এতক্ষণ উৎফুল্ল থাকলেও, চৈত্রীর স্পষ্ট বাক্যে তার সকল উৎফুল্লতা উবে গিয়ে মনে একরাশ কষ্ট ভর করেছে। কাব্যর নিরবতা দেখে চৈত্রী ভীষণ অবাক হলো। আগের কাব্য তো এমন ছিল না।

চৈত্রী জিহাদের কানে কানে কিছু বলে কাব্যর পাশে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসল। তিতাস নিশ্চুপ হয়ে কাব্যর অন্যপাশে বসে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। কিছুক্ষণ বাদে জিহাদকে দোকান থেকে আসতে দেখে চৈত্রী উঠে এগিয়ে যায়। জিনিসগুলো নিয়ে ফের এসে কাব্যর পাশে বসে।

‘নিন।’

কাব্য অবাক হয়ে তাকায় চৈত্রীর দিকে। চৈত্রী ভ্রুঁ কুঁচকে রেখেছে। কাব্যকে তাকাতে দেখে কুঁচকানো ভ্রুঁ আরও কিছুটা কুঁচকে ফেলে। জিজ্ঞেস করে,

‘ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? জ্বরে তো দেখি একদম কাবু হয়ে গেছেন।’

কাব্য নিশ্চুপ।

চৈত্রী বলল,’জ্বরের জন্য বুঝি এনার্জি কমে গেছে? নাকি জ্বরের আগে থেকেই আমায় মানানোর এনার্জি কমে গেছে? সেদিন মনে হয় এনার্জি বিস্কুট সম্পূর্ণ খাননি। নিন, এখন এনার্জি বিস্কুট খেয়ে আপনি ফের আমায় মানানোর জন্য এনার্জি তৈরি করুন। আর আমি ঝগড়া করার জন্য এনার্জি তৈরি করি।’

কাব্য হেসে ফেলে। তার চোখে পানি চলে আসে। জ্বরের প্রভাবে নাকি খুশিতে সেটা সে বুঝতে পারছে না। তিতাস আর জিহাদ এতক্ষণ চুপচাপ ওদের দেখছিল আর কথা শুনছিল। চৈত্রীর স্বাভাবিক ব্যবহারে ওরাও ভীষণ খুশি হয়। এর মাঝেই ট্রেন এসে পড়ে স্টেশনে। জিহাদ তিতাসের উদ্দেশ্যে বলল,

‘চল আমরা গিয়ে রুহিকে খুঁজি।’

তিতাস মাথা নাড়িয়ে বলল,’ঠিক আছে।’

চৈত্রী বিস্কুটের প্যাকেট ছিঁড়ে এগিয়ে দিয়ে বলল,’হা করে তাকিয়ে আছেন কেন? এনার্জি বিস্কুট খান আর এনার্জি বাড়ান।’

কাব্য এবারও হাসে। বলে,’তোমার হাতটা কি একটু ধরতে দেবে চৈত্র?’

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here