#জয়ী_২
রোকেয়া পপি
জয়ী ঘুমে কাদা কাদা, অথচ আমার চোখে এক ফোঁটা ও ঘুম নেই। আমি হারিয়ে গেছি বিশ বছর আগের সেই দিন গুলোতে।
পড়াশোনার প্রতি আমি বরাবরই খুব সিরিয়াস ছিলাম। আর রেজা ছিল পুরোই উল্টো।
বাবা মার একমাত্র আদরের সন্তান। শখ করে চারুকলায় ভর্তি হয়েছে। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি। বাবার বিশাল ব্যাবসা।
অন্যদিকে আমি মায়ের অনেক কষ্টের টাকায় পড়াশোনা করি। ছোট বেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর মা স্কুলের চাকরি আর টিউশনি করে আমার পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খেতো।
আর আমি ও শুধু মাত্র নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য পড়াশোনা টাকেই আমার ধ্যান জ্ঞান করে নেই।
তারপর ও কিভাবে যেনো আমি রেজার প্রেমে পড়ে যাই।
দুজন দুমেরুর বাসিন্দা হলেও আমাদের মধ্যে দারুন বোঝাপড়া ছিল বন্ধুত্বের।
রেজা আদর করে আমাকে ডাকতো জয়ী।
রেজার পাগলামি এতো বেশি ছিল যে, ক্যাম্পাসে স্যার ম্যাডাম থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা ছাত্র-ছাত্রী জেনে গিয়েছিল আমাদের দুজনের ব্যাপারটা।
কোন এক বর্ষায় ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে একগাদা কদম ফুল নিয়ে আমার হোস্টেলের সামনে এসে ফোন দিল, জয়ী নিচে নেমে আয় তোর সাথে বৃষ্টিতে ভিজব।
আমি নেমে আসা মাত্র হাঁটু গেড়ে বসে ফুল গুলো সামনে ধরে প্রপোজ করে বসলো
জয়ী আমাকে বিয়ে করবি?
সেদিন এতো লজ্জা পেয়েছিলাম, কিন্তু রেজাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য ও আমার ছিল না।
শুরু হলো রেজার সাথে আমার এক নতুন জীবন।
লুকিয়ে লুকিয়ে ঘুরতে যাওয়া, একসাথে থাকা।
এরমধ্যেই আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। রেজাল্ট ও বের হলো। আমি সর্বোচ্চ মার্ক পেয়ে বরাবরের মতো প্রথম হলাম। রেজা ও মোটামুটি রেজাল্ট করলো।
ও ওর বাবার অফিসে বসা শুরু করলো।
আমি চারুকলায় জয়েন করলাম।
ভালোই চলছিল আমাদের দিন গুলো। ঢাকায় ছোট্ট দুরুমের বাসা ভাড়া করে মা’কে নিয়ে আসলাম গাজীপুর থেকে। বিভিন্ন দিক থেকে আমার জন্য প্রপোজাল আসছে। মা অস্থির হয়ে গেছে আমার বিয়ের জন্য।
একদিন রেজা কে এনে মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মা রেজা কে খুব পছন্দ করলো।
বিপত্তি বাঁধল রেজার পরিবার থেকে।
রেজার মা বাবা কোন ভাবেই আমাকে মানতে রাজি নয়।
লায়লা বেগম বারবার রেজাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো, তোমার বাবা তার বন্ধু কে অনেক আগে থেকেই কথা দিয়ে রেখেছেন, পুষ্পকে ছেলের বউ করে এ বাড়িতে আনবেন। তাছাড়া পুষ্প সুন্দরী, স্মার্ট, বাবা মার একমাত্র সন্তান। পুষ্পোর বাবার অঢেল সম্পত্তির মালিক একসময় তুমিই হবে।
জয়ীতা তোমার সমবয়সী, বাবা নেই। অনেক কষ্ট করে বড়ো হয়েছে। তার ওপরে মেয়ে কালো।
তোমার বাবা জয়ীতাকে কখনো মানবে না।
রেজা মায়ের কথা শুনে চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলো।
মা প্লিজ, একটু বোঝার চেষ্টা করো।
আমি জয়ীতা কে ছাড়া বাঁচবো না। ও খুব ভালো মেয়ে।এতো মিষ্টি একটা মেয়েকে তুমি কিভাবে কালো বলো!
খুব ফর্সা না হলেও উজ্জ্বল শ্যামলা।
তুমি ওর সাথে কথা বলে দেখো তোমার খুব ভালো লাগবে।
লায়লা বেগম ছেলের কথা শুনে রেগে লাল হয়ে গেলেন। উনি চোখ মুখ লাল করে বললেন,
রেজা এখানে আমাদের মান সন্মান জড়িত।
তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। তোমার সব ইচ্ছে আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছি।
কিন্তু বিয়ে তোমাকে আমাদের পছন্দ মতো করতে হবে।
আমি চাইনা এ বয়সে এসে তোমার বাবা তোমার কাছ থেকে এতো বড়ো আঘাত পাক।
জয়ীতার আজ বেশ কিছু দিন ধরে শরীর অনেক খারাপ। কিছু খেতে পারে না। সবকিছু গন্ধ লাগে। খেতে গেলেই বমি আসে, বাথরুমে দৌড়ে যায়।
জয়িতার মা মেয়ের পরিবর্তন লক্ষ্য করে খুবই চিন্তিত।
রেজার মা বাবাকে নিয়ে আসার কথা থাকলেও রেজার কোন খবর নেই।
আবার মা হয়ে নিজের সন্দেহ মেয়ের কাছে প্রকাশ করতেও লজ্জা পাচ্ছেন। সে যে শিক্ষা দিয়ে মেয়েকে বড়ো করেছেন,তার মেয়ে এমন অন্যায় কখনো করতে পারে না। সে বিশ্বাস তার আছে।
জয়ীতা নিজের পরিবর্তন নিজেই বুঝতে পারছে। অফিস থেকে ফেরার পথে পেগন্যান্সি টেষ্ট কিট কিনে এনে সকালে ঘুম থেকে উঠে আগে টেস্ট করলো ।
রেজাল্ট পজেটিভ।
মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় মার জন্য। মাকে কিভাবে বুঝাবে যে আসছে, সে কোন পাপের ফসল নয়।
অথচ রেজার বাবা-মা কোন ভাবেই জয়ীকে মানতে চাইছে না। রেজার ও খুব মন খারাপ। রেজা এখন আর আগের মতো জয়ীর সাথে দেখা করতে ও আসে না। ছেলেটা এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগছে।
জয়ীতা রেজাকে ফোন করলো দেখা করার জন্য।
রেজা সাথে সাথে একরকম ছুটে আসলো জয়ীতাদের বাসায়।
কি হয়েছে জয়ী ?
তোমার শরীর খারাপ?
অফিস নেই আজ?
এতো সকালে এভাবে ডেকে পাঠালে?
জয়ীতা এক গ্লাস লেবুর ঠান্ডা সরবত রেজার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ঠান্ডা হয়ে বসো তো আগে। সরবতটা খাও।
একসাথে এতো প্রশ্ন করলে কোনটা রেখে কোনটা বলবো?
আমি ভালো আছি। কোন সমস্যা নেই।
অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই যাইনি।
চলো আজ দুজনে বাইরে নাস্তা করবো।
ঠিক আছে চলো।
একটু ওয়েট করো রেজা। মাকে বলে আসি।
মা দরজা টা লাগাও।
আমি একটু রেজার সাথে বাইরে যাচ্ছি।
কেমন আছো বাবা রেজা?
আসসালামু আলাইকুম আন্টি। জ্বী ভালো আছি।
বাবা তোমার মায়ের ফোন নাম্বরটা একটু দাও। আমি কথা বলতে চাই।
তাদের তো নিয়ে আসতে পারলে না।
আমি একটু কথা বলে দেখি।
ঠিক আছে আন্টি।
রেজা দ্রুত ভিজিটিং কার্ডের অপর পাশে মায়ের নাম্বারটা লিখে দিয়ে জয়ীতা কে নিয়ে বের হয়ে গেল।
রেজা জয়ীতাকে নিয়ে স্টার কাবাবে নাস্তা করতে এসেছে।
দুজনে চুপচাপ নাস্তা শেষ করে কফি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
কারো মুখে কোন কথা নেই।
রেজাই নিরবতা ভেঙ্গে প্রথম কথা বললো,
কি ব্যাপার জয়ী, হঠাৎ এতো জরুরী তলব?
রেজা তোমাকে আর সময় দিতে পারছি না।
একটা কিছু করো খুব দ্রুত। আমি মা হতে চলেছি।
রেজা বিস্মিত হয়ে বললো, কি বলছ জয়ি?
মাকে কোন ভাবেই ম্যানেজ করতে পারছি না।
মা মাথার দিব্যি দিয়েছে, পুষ্পকে বিয়ে না করলে মার মরা মুখ দেখতে হবে।
আমি এখন কোনদিকে যাবো বলো?
বাসার পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ যে, আমি এখন দিশেহারা।
আমার মনে হয় এই মুহূর্তে Abortion করে ফেলায় বুদ্ধি মানের কাজ হবে।
জয়ীতার চোখ পানিতে ছল ছল করছে। ও আবেগীয় কন্ঠে বললো, কি বলছো রেজা?
সেটা হয়না, কখনো না।
আমি আমার অনাগত সন্তানকে কখনো এভাবে হত্যা করতে পারিনা। তাছাড়া ওরতো কোন দোষ নেই।
জয়ী বোঝার চেষ্টা করো। আমি তো তোমাকে অস্বীকার করছি না। আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি। তোমার জায়গায় অন্য কোন মেয়েকে বসানো আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।
কিন্তু আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।
ঠিক এই মুহূর্তে তাদের কষ্ট দিয়ে কিছু করতে পারছি না। আমি তোমার কাছে হাত জোড় করে বলছি,
আমাকে একটু সময় দাও।
তোমাকে সময় দিতে বা তোমার জন্য অপেক্ষা করতে আমার কোন সমস্যা নেই।
কিন্তু মা মনে হয় বুঝতে পারছে।
মাকে কি বলবো?
মা যদি অবিশ্বাস করে আমাকে
আমি মরে যাবো।
জয়িতা কন্নায় ভেঙে পড়লো।
পঁচিশে ফেব্রুয়ারি। আজকের দিনটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। একরকম জোর করেই লায়লা বেগম রেজার সাথে পুষ্পোর বিয়েটা দিয়েছে। রেজাকে এমন প্যাচে ফেলেছে যে সেই মুহূর্তে রেজার সামনে দ্বিতীয় কোন পথ খোলা ছিল না।
রেজা যখন রাগে দুঃখে ঘরের বাইরে বের হয়ে যেতে চাইছিল, লায়লা বেগম তখন একগাদা ঘুমের ওষুধ হাতে নিয়ে দিব্যি দিয়ে বসলো।
আজ যদি তুমি পুষ্পোর বাবা মার সামনে আমাদের অপমান করো, তাহলে এই সবগুলো ওষুধ আমি একসাথে খাবো।
আমার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী থাকবে।
খুব ঘরোয়া আয়োজনে রেজার সাথে আজ পুষ্পোর বিয়েটা হয়ে গেলো। কয়েক দিন পর বড়ো করে রিসিপশন পার্টি করবে।
রেজা সকাল থেকে মোবাইল অফ করে রেখেছে।
রেজা দেখলো, পুষ্পো সত্যিই খুব সুন্দরী।যেন তেন সুন্দরী নয়, গল্পের নায়িকাদের মতোই সুন্দর।
ঠিক যেন একটা টুকটুকে লাল পুতুল, বউ সেজে বসে আছে খাটের মাঝখানে।
আজকে সকাল থেকে জয়ীতা রেজার মোবাইল অফ পাচ্ছে। কতোবার ফোন দিয়েছে সে নিজেও জানে না।
এই সময়ে টেনশন করা একদম ঠিক না। তারপরও জয়িতা নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছে না। রাত বারোটা বাজতে চলে, এখনো রেজার ফোন অফ। এমন তো আগে কখনো হয়নি। সারাদিন ব্যাস্ত থাকলে ও রাতে ঘুমানোর আগে কথা না বলে রেজা ঘুমাতে পারে না। কোন বিপদ হলো না তো!
জয়ীতার মা অনেক ক্ষণ ধরে মেয়ের ছটফটানি খেয়াল করছেন। জয়িতা তুমি এতো অস্থির কেন?
কোন সমস্যা?
মা আমার মনে হয় রেজার বড়ো সড়ো কোন বিপদ হয়েছে। সকাল থেকে ওর মোবাইল অফ। আমার খুব খারাপ লাগছে।
ঠিক আছে তুমি শান্ত হও। আমি দেখছি।
কয়দিন ধরে রেজার মাকে ফোন করব করব করছি, করা হচ্ছে না। আমি রেজার মায়ের সাথে কথা বলে দেখি।
ফোন রিং হয়ে হয়ে প্রথমবার কেটে গেল। আবার ফোন দিতে দুই বার রিং হওয়া মাত্রই লায়লা বেগম রিসিভ করলেন।
হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।
আমি কি লায়লা বেগমের সাথে কথা বলতে পারি?
জ্বী বলছি। বলুন।
কে বলছেন আপনি?
আমি জয়ীতার মা। ভালো আছেন বেয়াইন সাহেবা?
কে আপনার বেয়াইন সাহেবা?
মুখ সামলে কথা বলুন।
বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার শখ হয়েছে।
এখন বুঝতে পারছি কেন আমার সহজ সরল ছেলে টার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে ঐ রাস্তার মেয়েটা। যেমন মা তেমন তার মেয়ে।
ভাবছেন মেয়েকে আমার ছেলের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে রাজপুত্র ও রাজত্ব দখল করবেন। সে আশায় আমি লায়লা বেগম পানি ঢেলে দিয়েছি।
আর শুনুন আজকে রেজার বিয়ে হয়েছে। ওদের আজ বাসর রাত। ওদের জন্য মন থেকে দোয়া করবেন। আরেকটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন ভবিষ্যতে কখনো আমার ছেলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না।
আপনার মেয়ে কেও বলে দিবেন, আমার ছেলের দিকে যেন চোখ তুলে না তাকায়। একটা কথা ভালো করে মনে রাখবেন, চাঁদে হাত দেওয়ার চেষ্টা করলে কিন্তু হাত পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
লায়লা বেগম তার মনের ঝাল মিটিয়ে বলেই চলেছেন,
এদিকে জয়ীতার মা এতো অপমান সহ্য করতে না পেরে বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেছে। চোখ দিয়ে কষ্টের নোনা স্রোত বয়ে চলেছে।
মোবাইল পড়ার শব্দে জয়ীতা দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরছে। অস্থির হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করছে, কি হয়েছে মা ?
তুমি এমন করছো কেন?
তোমার কষ্ট হচ্ছে, কোথায় কষ্ট হচ্ছে?
আমি এখনি ডাক্তারকে ফোন করছি।
জয়ীতা পাগল হয়ে গেছে। কি করবে, কাকে ডাকবে,
একবার ডাক্তারকে ফোন করে, তো একবার দৌড়ে গিয়ে বাড়ি আলি খালাম্মাকে ডেকে আনে।
ডাক্তার আসতে আসতে সব শেষ।
জয়ীতা বুঝতে ও পারলো না আজকের দিনটা ছিল জয়িতার সর্বশান্ত হওয়ার দিন!
চলবে….