#গল্প১২৫
#জলদানব (পর্ব ৬)
টাঙ্গাইল থেকে আসার পর রাহাত নিজ কর্মস্থল চলে এসেছে। এর মাঝে ময়মনসিংহ থেকে এসপি হারুনুর রশীদ স্যারও ফোন দিয়েছিলেন কেসের অগ্রগতি জানতে। এই প্রথম রাহাত নিজেকে পরাজিত মনে হয়েছে, অপরাধীকে ধরতে না পারার ব্যর্থতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। রাহাত টাঙ্গাইলের ঘটনাগুলো সব জানিয়ে বলে, “স্যার, আমি নিশ্চিত ও কুলসুমের সাথে যোগাযোগ করবে। আমরা কুলসুমের ফোনটা নজরদারিতে রেখেছি। গফুর যোগাযোগ করা মাত্রই ওকে ধরে ফেলব এবার।”
এসপি স্যার রাহাতের মনমরা ভাবটা টের পান, উৎসাহ দিয়ে বলেন, “রাহাত, তুমি তো তাও খুনীকে চিহ্নিত করতে পেরেছ। এত বছর ধরে এই পশুটা খুন করে আসছিল, কারো নজরে আসেনি। আমি বিশ্বাস করি তুমিই পারবে ওকে ধরতে।”
স্যারের উৎসাহমূলক কথায় রাহাতের মনটা একটু শান্ত হয়। ভাবে, ক’টা দিন ছুটি কাটাবে। বউকে নিয়ে দূরে কোথাও নিরিবিলি ছুটি কাটিয়ে আসতে হবে। মাথাটা একদম জ্যাম হয়ে আছে।
*****************
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইনস্টিটিউট দেশের মানুষের জন্য বিরাট একটা ভরসার জায়গা। নতুন বিশাল দালান হয়েছে, আগের চেয়ে অনেক বেশি রোগির সেবা দেওয়া হয় এখানে। এখানকার সবাই ভীষণ নিবেদিত প্রাণ। আগুনে পোড়া মানুষ এখানে এসে একটু সুচিকিৎসার ভরসা পায়।
আজ রাতে নার্স সুফিয়া গফুরের মুখে ড্রেসিং করে দিচ্ছিল। লোকটা ভীষণ শক্ত ধাঁচের মানুষ, এই একটা মাসে একবারও ব্যথা পাবার তেমন শব্দ করেনি। অথচ এমন পোড়া রোগিদের খুব জ্বালা পোড়া হয়। আর ড্রেসিং করার সময় তো আরো বেশি ব্যথা হয়। অথচ এই লোক এমন কঠিন মানুষ, খুব বেশি আহা উহু নেই। ড্রেসিং করতে করতে নার্স সুফিয়া জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, আপনার মুখে গরম পানি পড়ল কেমনে? শরীরের আর কোথাও কিছু হইল না খালি মুখেই? আর এগুলো তো বাচ্চা পোলাপানদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। আপনি কী ভুল কইরা গরম পানি মুখে ঢালছিলেন?”
গফুর হাসতে যেয়ে মাংসাশীতে টান লাগে, কোনোমত বলে, “হ বইন, ভুল কইরা মুখে গরম পানি ঢালছিলাম।”
সুফিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আপনার চেহারাটা একদম নষ্ট হইয়া গেল।”
গফুর একটু চুপ থেকে বলে, “আপনের কাছে আয়না আছে? ডাক্তার সাব তো কইল কাইল ছুটি দিয়া দেব, দেহি চেহারা শেষ পর্যন্ত কেমুন দাঁড়াইল।”
সুফিয়া ইতঃস্তত করে বলে, “আছে, কিন্তু আপনি ভয় পাবেন।”
গফুর মাথা নাড়ে, বলে, “অসুবিধা নাই। দেহি আয়নাটা।”
সুফিয়া নার্স স্টেশন থেকে ওর ব্যাগে রাখা একটা ছোট্ট আয়না গফুরের হাতে দেয়। গফুর আয়নাটা সামনে ধরে তাকায়, একটা ধাক্কা খায়। এইটা আমি! একটা চোখ বুঁজে গেছে, মুখের চামড়াগুলো কুঁচকানো, দগদগে লাল। চামড়ার রঙটা নেই। মুখটা দেখে একটু কষ্টই লাগে, কিন্তু এই কষ্ট কিছু না। এখন ও স্বাধীন, পুলিশ আগের গফুরকে আর কোনোদিন খুঁজে পাবে না।
সেদিন ওয়ার্ডে রাত নিঝুম হলে গফুর হেঁটে বেড়াচ্ছিল। বারন্দায় হঠাৎ একটা ঘোমটা পরা মেয়ের দিকে চোখ পড়তেই মনটা উদাস হয়ে যায়। কুলসুমের কথা মনে পড়ে খুব। কতদিন কথা হয় না কুলসুমের সাথে। ভাবতে ভাবতে গফুর আবার ওয়ার্ডে ঢোকার মুখে দেখে নার্স সুফিয়া চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছে, সামনেই কম দামি একটা মোবাইল ফোন রাখা। গফুরের মাথায় হঠাৎ করেই বুদ্ধিটা খেলে যায়। আলগোছে ফোনটা নিয়ে বন্ধ করে ফেলে, তারপর ফোনটা বাথরুমে নিয়ে একটা ভাঙা কোণে ইটের আড়ালে লুকিয়ে রাখে। এরপর পা টিপে টিপে এসে নিজের বেডে ঘুমিয়ে পড়ে।
ভোর বেলাতে গফুরের ঘুম ভাঙে নার্স সুফিয়ার চিল চিৎকারে, তার মোবাইল চুরি হইছে। সে বার বার চিৎকার করে বলছে এই ওয়ার্ডেরই কেউ চুরি করেছে। সুফিয়া একজন ওয়ার্ডবয় নিয়ে সবগুলো বেড চেক করে, সব রোগিকে তল্লাশি করা হয়, কিন্তু মোবাইল পাওয়া যায় না। সুফিয়া রাগে দুঃখে অভিশাপ দিতে থাকে, যে আমার মোবাইল নিছে তার যেন বড় একটা বিপদ হয়।
গফুর মনে মনে মুচকি মুচকি হাসে, আর বিপদ। এমনিতেই সারাক্ষণ বিপদেই আছে। সেদিন সুফিয়া চলে যেতেই গফুর বাথরুমে যেয়ে চুরি করা মোবাইলটা নিয়ে আসে। তারপর বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুলসুমের মুখস্ত করা নাম্বারটায় ফোন দেয়। প্রথমে ধরে না, আবার ফোন দিতেই কুলসুম ঘুম জড়ানো গলায় ফোনটা ধরতেই গফুর সোহাগের গলায় বলে, “আমার বউ কী এখনো ঘুমায়?”
কুলসুমের শরীরটা খারাপ লাগছিল, তাই ঘুমাচ্ছিল। ওর মনে হয় ও কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে, গফুরের গলা! মুহূর্তে কুলসুম সতর্ক হয়ে যায়, ফিসফিস করে বলে, “আপনি, ফোন দিছেন!? আর এতদিন ছিলেন কই, কোনো খুঁজ নাই।”
গফুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “সে মেলা ঘটনা। তা তোর কাছে কী আমার খোঁজে পুলিশ আইছিল?”
কুলসুম একটু থতমত খেয়ে যায়, একটু চিন্তা করে বলে, “পুলিশ তো সবার কাছেই আইছিল, আপনি কী কাম করছেন যে পুলিশ আপনারে খুঁজে?”
গফুর এই কথার উত্তর না দিয়ে বলে, “তোরে খুব দেখবার মন চায়, কিন্তু এই পুলিশের জন্য পারতাছি না। দেহি, একদিন আইমু তোরে দেখতে। আইচ্ছা রাহি এহন।”
ফোনটা কেটে যেতেই কুলসুম সবার আগে সেই পুলিশ অফিসারকে ফোন দেয়।
রাহাত গাজীপুরের ওর বন্ধুর একটা ছোট রিসোর্টে করবীকে নিয়ে এসেছিল কটা দিন ছুটি কাটাতে। কিন্তু কুলসুমের ফোন পাওয়া মাত্র রাহাতের আবার আগের উত্তেজনা ফিরে আসে। দ্রুত ঢাকায় সার্ভিল্যান্স টিমের সাথে যোগাযোগ করতেই ওরা জানায়, “স্যার, জায়গাটা ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইনস্টিটিউট। আসামি সেখান থেকেই কথা বলেছে, ফোনটা এখন বন্ধ।”
রাহাত শাহবাগ থানাকে বলে পুলিশের ফোর্স যেন এখুনি সাদা পোশাকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইনস্টিটিউটের সবগুলো গেট পাহারা দেয়। সেইসাথে সবাইকে গফুরের ছবি দিয়ে দেওয়া হয়। যাতে কোনোভাবেই এখান থেকে পালিয়ে যেতে না পারে।
রাহাত তখনই করবীকে নিয়ে ঢাকায় রওনা দেয়। ভীষণ আফসোস হচ্ছে, ইশ, আজই গফুর ফোনটা দিল! রাহাত ভাবে ওর ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছাতে দুই ঘন্টা লেগে যাবে। আচ্ছা, গফুর ওখানে কী করছে? ও কী অসুস্থ না কাউকে দেখতে এসেছিল? গফুরের তো ঢাকায় কেউ নেই, তাহলে?
এর মাঝে পুলিশের লোক পুরো বিল্ডিংটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখে, প্রতিটি বেড সতর্কতার সাথে খুঁজে দেখে। কিন্তু কোথাও গফুরের চেহারার সাথে মিলে এমন কাউকে পায় না। খবরটা পেতেই রাহাতের মনটা দমে যায়, গফুরকে পাওয়া গেল না? নাহ, নিজে যেয়ে একবার খুঁজে দেখবে। গফুর যেমন ধুরন্ধর তাতে সাধারণ পুলিশ সদস্যরা নাও খুঁজে পেতে পারে।
গাজীপুর থেকে যত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে ভেবেছিল তত তাড়াতাড়ি ফেরা হয় না। বার্ন ইনস্টিটিউটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। রাহাত অত্যন্ত সতর্কতার সাথে মেল ওয়ার্ডগুলোতে ঢুঁ মারতে থাকে।
এদিকে নার্স সুফিয়া সন্ধ্যায় ডিউটিতে এসে ওয়ার্ডে অপরিচিত মানুষ দেখে তেড়ে যায়, “এই, আপনি কে? সন্ধ্যা হইতেই আসছেন মোবাইল চুরি করতে? কাইল আমার মোবাইলটা আপনিই চুরি করছেন।”
রাহাত একটু থতমত খেয়ে যায়, তারপর মুচকি হেসে বলে, “আমি তো আপনার মোবাইল খুঁজতেই আসছি, আমি পুলিশের লোক। এই যে আমার আইডি কার্ড।”
সুফিয়া একটু দ্বিধায় পড়ে যায়, অনিশ্চিত গলায় বলে, “তাই? আপনি আমার মোবাইলটা খুঁইজা দেন পুলিশ ভাই।”
এবার রাহাত নার্স সুফিয়াকে নিয়ে নার্সদের বসার জায়গায় বসে। তারপর জানতে পারে কাল রাতে ও যখন ঘুমিয়েছিল, তখনই মোবাইলটা চুরি হয়েছে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস এই ওয়ার্ডেরই কেউ না কেউ নিছে।
রাহাত ঠোঁটটা জোরে কামড়ে ধরে ভাবে, এটা নিশ্চয়ই গফুরের কাজ। চোরাই মোবাইল থেকেই সে ফোন দিয়েছে। রাহাত মোবাইল নাম্বারটা জিজ্ঞেস করতে সুফিয়া গড়গড় করে ওর নাম্বারটা বলতেই রাহাত মিলিয়ে দেখে। একই নাম্বার, তারমানে সুফিয়ার মোবাইল থেকেই কুলসুমকে ফোন করা হয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই এটা গফুর!!! ও এখানে এত রাতে কী করছিল? ও কি রোগি হিসেবে ভর্তি ছিল?
রাহাত এবার জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, এই ওয়ার্ডে বয়স চল্লিশের উপর কতজন ভর্তি আছে?”
সুফিয়া রেজিস্টার খাতাটা খুলে একবার দেখে, তারপর বলে, “বেশি না, আটজন ছিল কাইল। আইজ একজন ছুটি নিয়া চলে গেছে।”
রাহাত সোজা হয়ে বসে, ও পুরো ওয়ার্ড ঘুরে দেখেছে এখানে গফুর নেই। তাহলে সকালে যে চলে গেছে সেই গফুর!! রাহাত এবার উত্তেজনা চেপে বলে, “আচ্ছা, যে ছুটি নিয়ে চলে গেছে সে কী দেখতে এমন?”
রাহাত মোবাইল বের করে গফুরের ছবিটা দেখাতেই সুফিয়া জোরে মাথা নাড়ে, বলে, “নাহ, সেই লোকের তো মুখ পুরাটাই পোড়া, এক চোখ বন্ধ। দেখলেই ভয় লাগে। আবার কুঁজা হইয়া এক পা টাইনা হাঁটে।”
নার্স সুফিয়ার শেষ কথাটায় রাহাতের দম বন্ধ হয়ে আসে, এটা গফুর! তারমানে ওর মুখ পুড়ে গেছে, তাই এখানে ভর্তি ছিল। ইশ, আজকেই চলে গেল!?
রাহাত এবার দ্রুত জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, যার কথা বললেন তার নাম ঠিকানা দরকার। এই লোকই আপনার মোবাইল চুরি করেছে। আমি আপনার মোবাইল উদ্ধার করে দেব।”
সুফিয়ার চোখটা আশায় চকচক করে ওঠে, বলে, “স্যার, তার নাম আবু নছর, কড়াইল বস্তিতে থাকে।”
রাহাত একটু হতাশ হয়, বলে, “কোনো ফোন নাম্বার নাই? কে এই রোগীকে নিয়ে আসছিল?”
সুফিয়া এবার ভর্তির ফরমটা দেখে বলে, “স্যার পাইছি, হাফসা নামে এক মহিলা আসছিল। এই যে তার নাম্বার।”
রাহাত চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ছাড়ে, ফোন নাম্বারটা সেভ করে বলে, “আপনি কিন্তু ভুলেও কাউকে কিছু বইলেন না। তাইলে আর মোবাইল ফিরে পাবেন না।”
সুফিয়া কথা দেয় ও কাউকে কিছু বলবে না।
****************
হাফসা আজ ফার্মের মুরগী রানছে, বহুদিন পর নছর ভাই ফিরা আসছে। রাতে খেতে বসে আবু নছর উরফে গফুর বলে, “আপনি না থাকলে আমি বাঁচতাম না।”
হাফসা মুখটা মুছে বলে, “ভাই, আমার স্বামি নাই। আপনি আমার পোলাটার বিপদে যা করলেন, আমি মুখ ফিরাই নেই কেমনে। আর টাকা তো আপনিই কিছু রাইখা গেছিলেন, তাতেই কাম সারছি।”
গফুর খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলে, “আমি কাইল থেকেই ব্যবসার ধান্দায় নামমু। কাপড়ের ব্যবসা আমি ভালো জানি, মেলা লাভ।”
হাফসার চোখ চকচক করে ওঠে, “ভাই, আমি কিছু টেহা তুলছিলাম একটা এনজিও থেকে। আপনি চাইলে আপনার ব্যবসায় খাটাইতাম।”
গফুর মাথা নাড়ে, বলে, “আইচ্ছা, আইজ ঘুমাই। কাইল কতা কমু এই বিষয়ে।”
রাতে গফুর ঘুমাতে যেয়ে পোড়া মুখটায় একটু হাত বোলাতে বোলাতে হঠাৎ একটা কথা ভাবে, কাছের মানুষের মধ্যে হাফসা ওর আগের চেহারা আর নতুন চেহারা, দুইটাই একসাথে বেশি দেখেছে। হাফসারে যদি কোনোদিন পুলিশ আগের ছবি দেখায় তাহলে ও নিশ্চিত করে বলতে পারে যে আবু নছর আর গফুর একই মানুষ। ভাবতে ভাবতে গফুর সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেই। সাথে আরকটা প্ল্যান করে, হাফসার টাকাগুলাও নিয়া নিতে হইব, আবার নতুন কইরা নাও কিনব, আবার আগের অভিযানে ফেরত যাইব। একটা শিহরণ খেলে যায় গফুরের মনে।
হাফসা অঘোরে ঘুমাচ্ছিল, আজ সারাদিন অনেক খাটাখাটুনি গেছে। হঠাৎ বুকের উপর চাপ অনুভব করে, চিল্লান দিতে যেয়ে দেখে কে যেন মুখটা শক্ত করে ধরে রাখছে। গলায় ছুরি ধরা, আবু নছর ফিসফিস করে বলে, “চুপ, শব্দ করলে তুইও মরবি, তোর পোলাও মরব। টেকাগুলান কই?”
পাশে শুয়ে থাকা হাসুর কথা মনে হতেই হাফসা একদম চুপ হয়ে যায়, বালিশের নিচ থেকে টাকাটা বের করতেই গফুর ছো মেরে নিয়ে নেয়। তারপর হাফসারে এক টান দিয়ে রুমের এক কোণে নিয়ে নেয়। পুরানো নেশাটা আবার জেগে উঠেছে।
***************************
রাহাতের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম হচ্ছে, অনেক দেরি হয়ে গেল হাফসার রুম দুইটা খুঁজে পেতে। পুলিশের একটা চৌকস টিম আছে ওর সাথে। বস্তির একজন পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। হাফসার পাশেই থাকে এমন একজন বলে, এই রুমটায় নতুন ভাড়াটিয়া লোকটা থাকে।
রাহাত অ্যাকশন টিমটাকে ইশারা করতেই এক লাথি মেরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে, টর্চের জোরালো আলো পড়তেই রাহাত বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করে ঘরে কেউ নেই!! ভীষণ বোকা লাগে নিজেকে। আবার পালিয়ে গেল!
হঠাৎ কী একটা মনে হতেই রাহাত দ্রুত নির্দেশ দেয় হাফসার রুমে ঢোকার জন্য। রাহাতের অজানা আশংকায় বুক কাঁপছে, পশুটা আবার আরেকটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল না তো।
হাফসার ঘরের দরজাটা এক ধাক্কায় খুলতেই ভেতর থেকে একটা ফ্যাসফ্যাসে গলা শোনা যায়, “ঘরের ভেতরে কেউ ঢুকলেই বাচ্চা খুন হইয়া যাইব, সাবধান।”
ভেতর থেকে হাফসার আর্ত গলা পাওয়া যায়, অনুনয় করে বলে, “পুলিশ ভাই, পশুটা আমার পোলার গলায় ছুরি ধরছে, আপনারা দয়া করে চইলা যান।”
রাহাত থমকে যায়, ভেতরে একটা বাচ্চা আছে এটা খেয়াল ছিল না। এখন কী করা যায়, গফুর যেমন পশু ও যেকোনো কাজ করে ফেলতে পারে। নাহ, বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হবে। ঝড়ের বেগে রাহাতের মাথায় চিন্তা চলতে থাকে। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই একটু পেছনে এসে গফুরের প্রাক্তন স্ত্রী কুলসুমকে ফোন দেয়, তারপর কিছু কথা বুঝিয়ে বলে।
এরপর রাহাত ফোনটা লাউড স্পীকারে দিতেই কুলসুমের গলা শোনা যায়, “গফুর, আর পাপ কইরো না। বাচ্চাটারে ছাইড়া দাও।”
গফুর হিংস্র দৃষ্টিতে দরজার দিকে লক্ষ রাখছিল আর হাসুর গলাটায় ছুরি ধরে রেখেছিল। হঠাৎ ওর প্রিয় মানুষ কুলসুমের গলা শুনতেই হকচকিয়ে যায়, কুলসুম কথা বলতেছে! তারমানে কুলসুমই পুলিশরে খবর দিছে। মাথায় রাগটা আরো চড়ে যায়, হিসহিসিয়ে বলে, “তুই আবার বেইমানি করলি। তোরে আমি অনেক ভালবাসতাম, আর তুই এমন করলি। আমি তোর কতা শুনমু না, পুলিশ আগাইলেই আমি এই বাচ্চার জান শ্যাষ কইরা ফালামু।”
কুলসুম এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “তোমার পোলাও তো ওই বাচ্চার সমান, তার গলায় কেউ ছুরি ধরলে?”
গফুরের পুরো শরীরটা কেঁপে যায়, বলে, “আমার পোলা মানে???? তুই কী কস এইগুলান?”
কুলসুম নাক টেনে বলে, “হ, তোমার পোলা আছে। তোমার লাগে যহন বিয়া ভাইঙা দেই আমার তহন দুইমাস চলতাছিল। প্রথমে বুঝি নাই, পরে ওই পোলার সাথে বিয়ার পর বুঝছি। সে তহন আর বাচ্চাটা ফেলতে দেয় নাই, আমার বদনাম হইত। এমন কী তুমি ঝামেলা করতা। এই ভাইবা আর বাচ্চা নষ্ট করি নাই। আমার বড় পোলা সোহাগ তোমারই সন্তান।”
গফুরের মাথায় কোথাও যেন একটা কিছু গোলমাল হয়ে যায়, হাত থেকে ছুরিটা পড়ে যায়। কী একটা ঘোরের মাঝে বলতে থাকে, আমার পোলা, আমার পোলা…
রাহাত সুযোগটা মিস করে না, এক লাফে ওরা কয়েকজন ঘরের ভেতরে ঢুকেই এক লাথি মেরে গফুরকে মেঝেতে ফেলে দেয়। একজন পুলিশ সদস্য দক্ষ হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। হাসু এক দৌড়ে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তেই হাফসা যক্ষের ধনের মতো শক্ত করে ধরে রাখে।
গফুর তখনো বিড়বিড় করে বলছে, আমার পোলা..
রাহাত অবাক হয়ে এই পশুটার দিকে তাকিয়ে থাকে, একটা শব্দ কী ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে।
******************************
পরদিন সকালে দেশের সবকয়টা দৈনিক পত্রিকায় গফুর ধরা পড়ার সংবাদটা প্রথম পাতায় ছাপে। দেশের মানুষ গা শিউরে গফুরের লোমহর্ষক খুনগুলোর কথা পড়তে থাকে। এখন পর্যন্ত পাঁচটা খুনের হদিশ পাওয়া গেছে, তবে পুলিশের ধারণা নদীতে যেসব মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে তাদের কেসগুলো আরেকবার তদন্ত করে দেখা হলে গফুরের আরো খুনের রহস্য উন্মোচন হবে।
ত্রিশালের ওসি মনোরঞ্জন, ময়মনসিংহের ওসি শাহাবুদ্দিনের ছবিও ছাপা হয়। আর রাহাতের ছবি তো বড় করেই ছাপা হয়, সেইসাথে তার বুদ্ধিমত্তার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ আসামির কঠিন দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আশ্বাস দেন।
সেদিন রাতে রাহাত অনেক দিন পর আরাম করে রাতের খাবার খাচ্ছিল, তখন করবী জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, একটা কৌতুহল ছিল। কুলসুমের বড় ছেলেটা কী আসলেই গফুরের ছেলে?”
রাহাত মৃদু হেসে বলে, “নাহ, এটা আমি কুলসুমকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎ করেই মনে হলো, গফুর যতই পাষাণ হোক, ওকে যদি বলা হয় ওর ছেলে আছে, তাতে একটু হলেও ও অন্যমনস্ক হবে। আর আমরা সেই সুযোগটা নিয়েই ওকে গ্রেফতার করেছি।”
করবী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে যাক একটা নরপশু তো পৃথিবী থেকে কমল। কত মেয়ের যে জীবন নিয়েছে এই ভয়ংকর খুনী! মানুষের অগোচরে আরো যে এমন পশু লুকিয়ে নেই তা কে বলবে। অবশ্য রাহাতের মতো কিছু বুদ্ধিমান পুলিশ অফিসারও আছে যাদের সতর্ক চোখে এরা ধরা পড়বেই।
সেদিন বহুদিন পর করবী রাহাতের বুকের ভেতর পরম নিরাপদে একটা শান্তির ঘুম দেয়।
আর এদিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের ভেতর একটা আধবোজা চোখ, কুঁচকানো চামড়ার মুখ, একটু কুঁজো হয়ে পায়চারি করছে। ভাবছে, এখান থেকে কী করে পালানো যায়। একটা সুযোগ যদি পায় তাহলে ও কুলসুমকে খুন করবে, কারণ পরে ও জেনেছে সেদিন রাতে কুলসুম ছেলের ব্যাপারে ওকে মিথ্যা বলেছে। আর তাতেই তো পুলিশ অত সহজে ওরে ধরে ফেলতে পারল। কারাগারে রাতের অন্ধকারে প্রতিশোধের আগুনে গফুরের আধবোজা চোখও জ্বলজ্বল করতে থাকে। মনে মনে প্রতীজ্ঞা করে, প্রথম সুযোগেই ও পালাবে, কুলসুমকে যমুনা নদীতে পূর্ণিমার রাতে খুন করবে।
(আপাতত সমাপ্ত)
**গল্পটা এখানেই শেষ করেছিলাম। পরে পাঠকদের অনুরোধে ২০২৩ এর বইমেলার জন্য আরো ৬টা নতুন পর্ব লিখে বই বের হলো পেন্সিল পাবলিকেশন থেকে। অনেক ধন্যবাদ সবাইকে।
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৭/০৯/২০২১