#প্রার্থনায় রবে তুমি
#পর্ব ১৭
#Saji Afroz
রুমে এসে পায়চারি শুরু করে রুজাইন। এটা কী শুনলো ও! ভিন্ন ধর্মের মেয়ে ইধা! কিন্তু ওকে দেখলে এটা মনেই হয় না। অবশ্য না বোঝারও কারণ রয়েছে। কারণ ইধার চালচলনে বোঝার উপায় নেই যে ও হিন্দু! এত বড়ো ভুল রুজাইন করে ফেললো! ভিন্ন ধর্মের এক মেয়েকে মন দিয়ে বসেছে ও৷
মুহুর্তের মধ্যেই রুজাইনের মাথা ব্যথা শুরু হয়। যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে ও৷ আশপাশে যেন ঝাপসা দেখছে ও। এমন দিনও দেখবে কখনো ভাবেনি রুজাইন!
অনেকক্ষণ যাবত ওয়াশরুমে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে ইধা। অনবরত চোখ থেকে পানি পড়ছে ওর৷ মাইশা দেখে চিন্তিত হবে বলেই ওর থেকে নিজেকে আড়াল রেখেছে ইধা।
রুজাইন সবটা জেনে নিশ্চয় অনেক কষ্ট পেয়েছে। আর এটা বুঝতে পেরে ইধারও কষ্ট লাগছে।
রুজাইনকে কখনো অন্য চোখে দেখেনি ইধা। কিন্তু যেদিন ওকে রুজাইন মনের কথা জানায়, হঠাৎ-ই ইধার মনেও ভালো লাগার জন্ম নেয়। মনেহয়, রুজাইন ওর জীবনসঙ্গী হলে মন্দ হত না। ভালোবাসা বুঝি এমনি! কখন কার জন্য মনে জায়গা তৈরী হয়ে যায় বোঝা মুশকিল।
-ইধা হিন্দু! কীসব বলছ! ইচ্ছেকৃত মিথ্যে বলছ না তো?
সাদ্দামের কথা শুনে মাইশা বলল, মিথ্যে কেন বলব?
-হয়তো রুজাইনকে পছন্দ নয়, তাই এইটা বলে সরে যেতে চায়ছে।
-পছন্দ না হলে এমন একটা কারণ কেউ বলে! কত বড়ো বিষয় বুঝছ তুমি এইটা?
-রুজাইন কী বলেছে?
-কিছুই না। কথা বলো তার সঙ্গে। শান্তনা দাও।
-তাই দিতে হবে। মুসলমান মেয়ের তো অভাব নেই দেশে।
-তা ঠিক। কিন্তু আঘাত সারতে সময় লাগবে।
সাদ্দামের ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গেই রুজাইনের ফোনকল আসে। মাইশা রিসিভ করে।
রুজাইন ওপাশ থেকে বলল, কেন তোমরা এই কথা গোপন করেছ?
-ইধাকে আপনার পছন্দ হয়ে যাবে এমনটা ভাবিনি ভাইয়া।
-মাইশা ভাবী! আমার কী করা উচিত আমি কিছুই বুঝছি না। ও হিন্দু ধর্মের এটা কী তোমার বাসায় কেউ জানে না?
-না। ভিন্ন ধর্মের কাউকে আম্মু এলাউ করবে না বাসা শেয়ার করতে। এইজন্যই মূলত গোপন করা। তাছাড়া আপনার বাসায়ও একই নিয়ম। ভিন্ন ধর্মের কাউকে ভাড়া না দেওয়া। এইজন্য ইধা রায়কে ইধা বানিয়েই এই বাসায় তুলেছিলাম। আমি দু:খিত ভাইয়া! আমার জন্যই আপনার সঙ্গে এটা ঘটে গেল। আসলে ইধা এত অসহায় ছিল! আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে উঠেছিল। ওর কষ্টটা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।
-কী কষ্ট?
-ও এখানে পালিয়ে এসেছিল।
-কেন?
সবটা রুজাইনকে খুলে বলল মাইশা। এরপর ও আরও বলল, যা হয়েছে সব ভুলে যান। ভুল মনে করে সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন। অনেক ভালো মেয়ে আসবে আপনার জীবনে।
-হয়তো!
এই বলে ফোনের লাইন কাটে রুজাইন।
আজ মাইশার সঙ্গে বের হবে ইধা।
মাইশা ও সাদ্দাম যাচ্ছে কক্সবাজার হানিমুনে। ওদের সঙ্গে ইধাকে জোর করেই নিয়ে যাচ্ছে৷ ইধা একদমই রাজি ছিল না সাথে যেতে। কিন্তু মাইশা জানে, ও কখনো কক্সবাজার দেখেনি। তাই ওকে নিয়ে যাচ্ছে।
ব্যাগ নিয়ে নিচে এসে দাঁড়ায় মাইশা ও ইধা। ওদের দেখে দারোয়ান সালাম জানায়। মাইশা মালকিনের আত্মীয় জানার পর এই এলাকায় ওর সম্মানটা বেড়ে গেছে। মাইশাও এই ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করে।
ওরা সাদ্দামের জন্য অপেক্ষা করছে৷ হঠাৎ রুজাইন আসে। ওর কাঁধে ব্যাগ দেখে মাইশা বলল, ভাইয়া কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
-হু। বেড়াতে।
-আমরাও।
-গুড!
এরইমাঝে একজন মধ্য বয়সী মহিলা আসেন বাড়ি ভাড়া নেওয়ার জন্যে৷ তার কপালে সিঁদুর দেখে দারোয়ান জানায়, এখানে হিন্দু ভাড়া দেওয়া হয় না। কথাটি শুনে মহিলা চলে যান। ইধা ভ্রু কুচকে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে দারোয়ান বলল, কিছু বলবেন আপা মনি?
-হিন্দু ভাড়া দিলে কী অসুবিধে?
মাইশা ধীরকণ্ঠে ইধাকে বলল, ছাড় না ওসব!
দারোয়ান একগাল হেসে বলল, এখানে দেওয়া নিষেধ।
-হিন্দুরা কী মানুষ নয়?
-ওতশত বিষয় আমার জানা নাই৷ যেমন আমারে বলছে তেমনি করি।
এইবার মুখ খুললো রুজাইন। ও বলল, আমাদের পাশের গলিতে ইয়াশ নামের এক লোকের বিরাট বাড়ি আছে। ওখানে সব হিন্দু পরিবার থাকে। কোনো মুসলমান বা অন্য ধর্মের কেউ ভাড়া নিতে পারে না। এই মানে কী অন্যরা মানুষ নয়? আসলে মানুষ জাত এক হলেও ভিন্ন ধর্ম হলে নিয়মেও কিছু ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সেই ভিন্নতার জন্য অনেকে অন্য ধর্মের মানুষকে ভাড়া দিতে চায় না। আবার সবার মানুষিকতা তো এক নয়! অনেক বাসায় দেখবে, হিন্দু মুসলমান মিলেমিশেই পাশাপাশি থাকে।
-অনেক বাসায় থাকলেও আপনার বাসায় থাকে না। এর মানে বুঝছেন তো?
রুজাইন কিছু বলার আগে সাদ্দামের গাড়ি চলে আসে।
মাইশা ও ইধা এসে গাড়িতে বসে৷ রুজাইনের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে সাদ্দাম। এরপর সেও গাড়িতে এসে বসে৷ গাড়ি চলতে শুরু করে। রুজাইন তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
কক্সবাজার চলে এসেছে ওরা কয়েকঘন্টা হলো। পাশাপাশি রুম নিয়েছে মাইশা ও ইধা। রুমে আসার আগেই দুপুরের খাবার ওরা খেয়ে নেয়। ফ্রেশ হয়ে আরাম করে ওরা চলে আসে সমুদ্র সৈকতে। এই প্রথম সমুদ্রের বিশালতা দেখলো ইধা৷ ও হা করে তাকিয়েই রইলো। মাইশা ওকে ডাকতেই আচমকা জড়িয়ে ধরলো ওকে। মাইশা বলল, কী ব্যাপার?
-আমাকে সমুদ্র দেখানোর জন্য তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
-ভালো লাগছে না বল তোর?
-অনেক! এত সুন্দর সবকিছু!
ওরা কিছুক্ষণ একসঙ্গে সময় কাটায়। ইধা বলল, তোরা একাকী সময় কাটা দু’জনে। আমি এখানেই আছি।
সাদ্দাম বলল, আরেহ কী বলো! একা কী করবে তুমি!
-উপভোগ করব সৌন্দর্য। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। প্লিজ আপনারা আপনাদের মুহুর্তটা উপভোগ করুন।
ইধার কথাতে ওরা হাত ধরে একসঙ্গে পানিতে নামলো। ইধা পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছে।
-সমুদ্রের গভীরতা উপলব্ধি করছ?
পাশে তাকিয়ে রুজাইনকে দেখে চমকায় ইধা। ও বলল, আপনি?
-আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করাতে এলাম তোমায়।
অবাক হয় ইধা। রুজাইন বলল, আমি আসব জানলে আসতে না তুমি। তাই বলিনি তখন।
-মাইশা জানে?
-উহু! সাদ্দাম ভাই জানে।
একটু থেমে ইধা বলল, ঠিকই বলেছেন। জানলে আসতাম না।
এই বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকায় ইধা। রুজাইন ওর সামনে এসে বলল-
এই ক’টা দিন অনেক ভেবেছি। সারা দিন ভেবেছি, ভেবেছি সারা রাত! ভুলতে পারব না তোমাকে। মন দিয়ে বসেছি যাকে, তাকে ভোলা কী এতই সহজ!
ইধা জোরালো কণ্ঠে বলল, কেন এসব বলছেন! এটা কোনো ভাবেই সম্ভব না!
-সম্ভব! তুমি আমি চাইলেই সব সম্ভব। লড়াই করতে আমি প্রস্তুত৷ তুমি মনোবল শক্ত করলেই চলবে।
ইধা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, শর্ত ছুড়ে দেবেন জানি। মুসলিম হতে বলবেন আমায়। তাই তো?
-উহু৷ বিনা শর্তে তোমাকে চাই আমি৷ যেভাবে তুমি আছ সেভাবেই।
-এসব আবেগীয় কথাবার্তা।
-মনের কথা আমার। ভালোবাসার কথা বলতে পারো!
ইধা কিছু বলে না। রুজাইন বলল, অনেক ভালোবাসি তোমাকে। বিশ্বাস করো!
ইধা এখনো কিছু বলল না। এভাবে নীরবে দাঁড়িয়েই কেটে গেল অনেকটা সময়।
রাতের খাবার খেতে সবাই মিলে একটা রেস্টুরেন্টে আসলো। মাইশা এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। ও বিশ্বাসই করতে পারছে না, রুজাইন এখানে। আর রুজাইন সব জেনেও ইধাকে চায়৷ এটাও মানতে ওর কষ্ট হচ্ছে। এসবের জন্য ওর বিবাহিত জীবনে কোনো সমস্যা আসতে পারে বলেও চিন্তিত ও৷ দুই পরিবারের মধ্যে না আবার কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হয়!
.
চলবে