ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ২৫ লেখিকা দিশা মনি

0
112

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ২৫
লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টির হুশ ফিরতেই সে রাফসানের থেকে দূরে সরে আসে। রাফসানও হঠাৎ এমন কাণ্ডে হতবিহ্বল হয়ে গেছিল৷ আবেগের বশে পরিবেশ, পরিস্থিতি সবকিছুর কথাই তারা ভুলতে বসেছিল। মিষ্টি এখন বেশ খানিকটা লজ্জা পাচ্ছে। সাথে রাফসানও বেশ অস্বস্তিকর অনুভব করছে৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রাফসান বলে ওঠে,
“আমাদের মনে হয় এখন ফেরা দরকার। তুষারপাত বাড়ছে।”

মিষ্টি মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলে,
“জ্বি, চলুন।”

অতঃপর দুজনেই চুপচাপ কিছুটা সামনে এগিয়ে আসে। দুজনেই এতটা বিব্রতবোধ করছিল যে সারাটা রাস্তা তারা আর কোন কথাই বলে না।

মিষ্টি ও রাফসান রাফসানের ডুপ্লেক্স বাড়িটায় ফিরে এসেছে। দুজনের গায়েই তুষার মাখা। রাফসান মিষ্টিকে বলে,
“তোমার তো এর আগে কখনো তুষারপাতের অভিজ্ঞতা হয়নি৷ তাই কিছু মেডিসিন খেয়ে নিও। নাহলে অসুস্থ হয়ে যেতে পারো।”

মিষ্টি হালকা হেসে বলে,
“ঠিক আছে।”

বলেই সে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। মিষ্টি চলে যেতেই রাফসান একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তখনকার ঘটনাটা না চাইতেই বারবার তার মনে পড়ে যাচ্ছে। এসব ভাবনা কাটিয়ে নিজের ফোনটা বের করে একটা নম্বর ডায়াল করে কল লাগায় রাফসান। কিছুক্ষণ রিং হবার পর ফোনটা রিসিভ হতেই সে বলে ওঠে,
“আমার সাথে এখনই দেখা করতে চলে আসুন। এখনই মানে এখনই। আমি চাই না আর বেশি দেরি হোক৷ আর জায়গাটা আপনি জানেনই,আমাদের গোপন ডেরায়।”

অতঃপর সে ফোনটা রেখে চোয়াল শক্ত করে বলে,
“এবার সমস্ত সত্যটা আমায় যে করেই হোক জানতে হবে।”

★★
রাফসান একটা চেয়ার দখল করে বসে আছে। তার সামনেই বসে আছে তার সেই গোয়েন্দা সহযোগী। রাফসান বেশ শক্ত স্বরেই তাকে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন?”

বিপরীত পাশ্বে বসে থাকা ব্যক্তিটি উত্তর দেয়,
“হঠাৎ আপনার এমন কেন মনে হলো?”

“আমার কেন জানি খটকা লাগছে আপনার উপর। আপনি এর আগে আমাকে যথা সময়ে অনেক সঠিক সত্য দিয়েছেন। আপনার বুদ্ধিমত্তা এবং ক্ষমতা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কিছুদিন থেকে খেয়াল করছি আপনি অনেক তথ্যই গোপন করে চলেছেন। এই সন্ত্রাসী দলের মার্সেই শহরের প্রধান কে, সেই সত্য আপনার অনেক আগেই পাওয়ার কথা ছিল। কেননা, ক্রিসমাস বাজারে যেদিন হামলা হলো সেদিনই তাকে ধরার প্রায় ৮০% কাজ হয়ে গেছিল। কিন্তু তারপর থেকে কিভাবে যেন আপনি ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে দিলেন। ব্যাপার‍টা আমার কাছে ঠিক লাগছে না।”

“আপনি ভুল ভাবছেন৷ আমি কিছুই লুকাচ্ছি না। আর আমি কেনই বা কিছু লুকাতে যাব বলুন?”

“আমিও সেটাই ভাবছি। কিন্তু কি জানেন,আমার মনে হচ্ছে আপনি আসল অপরাধীকে আড়াল করতে চাইছেন। সত্যিই কি এমন কিছু? আর যদি এমনও হয় তাহলে তার কারণ কি? অপরাধী কি আপনার খুবই কাছের কেউ?”

“না, তেমন কিছু না। আচ্ছা,আপনি থাকুন। আমার কিছু জরুরি কাজ কাছে। কাল ক্রিসমাস তার প্রিপারেশন নিতে হবে তো।”

বলেই সেই ব্যক্তিটি বের হতে যাবে এমন সময় রাফসান বলে উঠল,
“কোন সত্য লুকিয়ে যদি আপনি অপরাধীকে সুযোগ করে দেন তাহলে কি আপনিও সেই অপরাধের ভাগ নিতে হবে এবং এই অপরাধের কর্মফলও আপনাকে ভোগ করতে হবে। যা নিশ্চয়ই আপনার জন্য ভালো হবে না।”

গোয়েন্দাটি কোন কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল। আর ঠিক এমন সময় সেখানে এসে প্রবেশ করল মিষ্টি। মিষ্টিকে হঠাত দেখেই রাফসান বলে উঠল,
“তুমি হঠাৎ এখানে কেন?”

“আপনি কার সাথে কথা বলছিলেন? আমি মনে হয় একটা মেয়ের কন্ঠস্বর শুনলাম। কে ছিল এখানে?”

“তেমন কেউ না।”

“আপনি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন? যদি গোপনীয় কিছু হয় তাহলে নাই বলতে পারেন। তবে মিথ্যা বলবেন না প্লিজ।”

“আসলে মিষ্টি আমাদের এই মিশনে অনেক গোপন গোপন কাজ করতে হয়। অনেকেই এই মিশনে নিযুক্ত। তাই সব কিছু এত সহজে প্রকাশ্যে আনা ঠিক নয়। বুঝতেই পারছ,এই মিশনটার উপর পুরো পৃথিবীর নিরাপত্তা নির্ভর করছে।”

“ঠিক বলেছেন আপনি। আচ্ছা, চলুন ডিনার করে নেবেন।”

“আচ্ছা, চলো।”

★★
পুরো মার্সেই শহরে আজ একটু বেশিই আলোকসজ্জা। ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুযায়ী আজ ২৫ সে ডিসেম্বর। অর্থ্যাৎ খ্রিষ্টানদের সবথেকে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ক্রিসমাস আজ। ইউরোপের শহরগুলোতে ক্রিসমাস বেশ জাঁকজমক ভাবে পালিত হয়। মার্সেইও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এবারের ক্রিসমাসটা একটু ব্যতিক্রম। নিরাপত্তার খাতিরে পুরো শহরজুড়েই কঠোর ভাবে পালিত হচ্ছে ক্রিসমাস।

এলিস মনমরা হয়ে নিজের ঘরের জানালার পাশে বসে ছিল। আজকের মতো এত বেশি একটা আনন্দের দিনেও তার মনে যেন কোন খুশি নেই। এমনি সময় ক্রিসমাস তার জীবনে আনন্দের ধারা নিয়ে এলেও এই বছর তার মন মেজাজ একদম ভালো নেই। তার বাবা মিস্টার ল্যুঁই কিছু জরুরি কাজে এখন বাইরে গেছেন, এলিজাও নিজের কাজে ব্যস্ত। আর সর্বোপরি এলিসের ভালোবাসার মানুষটা, ইয়াসিনের থেকে পাওয়া প্রত্যাখ্যান এলিসকে ভেতর থেকে একদম কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এলিস নিজের মনের দুঃখে চোখের জল ফেলে বলে,
“আমায় ক্ষমা করে দিও যিশু, তোমার জন্মদিনটা এবার আর আমি মনযোগ দিয়ে পালন করতে পারব না। আমার মনের অবস্থা যে একদম ভালো নেই।”

তবে ছোটবেলা থেকে এলিসের একটা স্বভাব আছে। যদিও সে তেমন একটা ধার্মিক নয় তবে ক্রিসমাসের দিনটা সে সারাদিন চার্চে গিয়ে প্রার্থনা করে কাটায়। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটতে দিতে চায় না এলিস। আর তাই তো এত মন খারাপের মাঝেও কোন রকমে তৈরি হয়ে রওনা দিতে চলেছে চার্চের উদ্দ্যেশ্যে। এলিসের আবার খুব একটা ভীড় ভাট্টাও ভালো লাগে না। তার পছন্দ শান্ত পরিবেশ। এজন্য সে মার্সেইয়ের একদম ভিন্নপ্রান্তে ছোট শহরতলীতে অবস্থিত সেন্ট ক্যাথেরাল গির্জায় যাওয়ার কথা ভাবছে। সেখানকার পরিবেশ বেশ শান্ত এবং শহর থেকে খানিকটা দূরে অবস্থিত হওয়ায় তেমন লোক সমাগমও হয় না।

এলিস আর বেশি না ভেবে তৈরি হয়ে নিল। সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে সেন্ট ক্যাথেরাল গির্জার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিল এলিস। দীর্ঘ ৪০ মিনিটের যাত্রার পরে অবশেষে সে পৌঁছে গেল কাঙখিত গন্তব্যে।

গির্জার সামনের সাদা মার্বেলের সিঁড়িতে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল এলিস। সারা শহর ক্রিসমাসের আলোকসজ্জায় ভরে গেলেও এখানে পরিবেশটা অনেক শান্ত, অনেক নির্জন। বাতাসে যেন বিষাদের সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। সে ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করল। গির্জার ভেতরে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ বসে প্রার্থনা করছে। মোমবাতির আলোয় মৃদু স্বর্ণালি আভা ছড়াচ্ছে পুরো চত্বর। এলিস সামনের সারিতে বসে চোখ বন্ধ করল।

“হে ঈশ্বর, তুমি কি সত্যিই আমার কষ্ট অনুভব করছো? যদি করো, তবে আমার হৃদয়ের ভার একটু লাঘব করে দাও। আমি তোমার কাছে কিছু চাই না, শুধু একটু শান্তি চাই,” মনের মধ্যে বলল সে।

এমন সময় গির্জার পেছনের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। হালকা বাতাসের সাথে কারো আসার শব্দ শোনা গেল। এলিস চোখ খুলে তাকাতেই চমকে গেল। কিছু বন্দুকধারী সন্ত্রাসী প্রবেশ করেছে চার্চে। তারা এসেই এলোপাতাড়ি চার্চে গুলি চালাতে শুরু করল। পুরো চার্চে এক মুহুর্তেই যেন হট্টগোল লেগে যায়। সবাই যে যার মতো ছুটছিল। চার্চে যে ১৫-২০ জন মানুষ ছিল তার মধ্যে ৭-৮ জন ইতিমধ্যেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। বাকিরাও প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে। এলিস এককোনে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার অন্তরাত্মা কাপছে। এমন সময় হঠাৎ এক বন্দুকধারী তার দিকে এগিয়ে এসে তার মাথায় বন্দুক তাক করে। এলিস তার চোখের দিকে তাকায়৷ এই চোখ দুটো সে চেনে। নিমেষেই তার চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। সে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“তুমি সন্ত্রাসী!”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here