#মায়ার_জীবনী
#Nadia_Afrin
শেষ পর্ব
সময় পার হচ্ছিলো তার নিজ গতিতে।
সেই সঙ্গে কাটছিল আমার জীবনের কুৎসিত মূহুর্ত।
দেখতে দেখতে পার হলো প্রায় চারটি বছর।
সারহান আগের মতোই আছে।
সহ্য করতে করতে সয়ে গেছে সব।
সারহান বাড়ি আসে খুব কমই।
এক সপ্তাহ হলো বাড়ি এসেছে সে।
আমি ঘরে বসে ছিলাম।সারহান এসে বাথরুমে গেলো।
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে।
কাল আমি বাবার বাড়ি যেতে চেয়েছি।আমার এক চাচাতো বোনের বিয়ে।
সারহান বিয়ের দিন যাবে।
আমি আগেভাগেই যাবো।শাশুড়ি মা আবার কাল নিজের ভাইয়ের বাড়ি যাবে।তাই আমি ভাবলাম আমার গহনা গুলো রাতেই নিয়ে আসি।এছাড়াও সকাল সকাল বেড়িয়ে যাবো।কালই গায়ে হলুদ।
সব গুছিয়ে রাখবো রাতেই।
মায়ের ঘরে গিয়ে বললাম,”আমার গহনাগুলো দিন মা।আমার চাচাতো বোনের বিয়ে।গহনাগুলো পড়ে যাবো আমি।”
:,,,,,,,,”বোনের বিয়ে দেখেই কী ভারী ভারী গহনা পড়তে হবে?”
:,,,,,,,,”কেন পড়বো না মা?আমার তো আছেই সব।ভাবী,মা-কাকি সবাই পড়বে,আমি কেন পড়বো না নিজের জিনিস।”
:,,,,,,,,,,”মুখে মুখে এতো চোপা করোনা মায়া।
গহনা বন্দক রেখেছি সর্নকারের কাছে।”
আমার মাথা ঘুরে গেলো তার কথা শুনে।
চেচিয়ে বললাম,”আমার থেকে না শুনে আমার গহনা কেন অন্যের হাতে দিয়েছেন আপনি।কোন কারণে আমার জিনিস বন্দক রেখেছেন?”
:,,,,,,,,”গলা নামিয়ে কথা বলো।সাইরা,সায়মার জন্য দুটো গলার হাড় বানিয়েছি।সে-সময় হাতে ক্যাশ টাকা ছিলো না তাই তোমার গহনা বন্দক রেখেছি।
টাকা হলে আবার ফিরিয়ে আনবো চিন্তা করো না।”
:,,,,,,,,,”পাগল নাকি আপনারা।কোন সাহসে আমার গহনা গুলো এমন করলেন আপনি।ঐখানে আমার মায়ের ও মৃত দাদীর দেওয়া স্মৃতি আছে।কতো বিপদ আসা সত্ত্বেও এই গহনাগুলোয় হাত দেয় নি আমার বাবা।
আমার মায়ের বিয়ের গহনা ও আছে কিছু।”
তিনি মুখ বেকিয়ে বললেন,”তো আমি কী করবো?”
রাগে যেন মাথা আরো গরম হলো আমার।
হাত উচু করে বললাম,”আমার গহনার যদি কোনো ক্ষতি হয়েছে কাউকে ছাড়বোনা আমি।”
এ দৃশ্য বাহির থেকে দেখলো সারহান।পেছন থেকে আমার চুলের মুঠি ধরে গালি দিয়ে বললো,”আমার মায়ের সঙ্গে বেয়াদবি করিস,সাহস তো কম না তোর।”
আমার কান্না চলে এলো।কাদতে কাদতে বললাম,”তোমার মা কী করেছে শুনেছো তুমি?”
:,,,,,,,”আমার মা যা ইচ্ছা করবে।”
এ কথা শুনে আমি ঘরের দিকে যেতে যেতে বললাম,এই বাড়িতে আর এক মূহুর্ত ও থাকবো না আমি।
সারহান ও আমার পিছু নিলো।
ঘরে গিয়ে নিজের ব্যাগ গোছাতে লাগলাম।
:,,,,,,,,,”হ্যা যাও যাও।ফিরতে আর হবে না তোমার।
কোন নাগড় আছে তার কাছে যাও।এ মেয়েকে কোন কুক্ষণে যে বিয়ে করেছিলাম!
অবশ্য একে কী বলবো,এর মা-বাবাই তো এমন।নোংরা মা-বাবার নোংরা মেয়ে।”
সারা শরীর রিনরিনিয়ে উঠলো আমার।
রক্ত চক্ষুতে তাকালাম সারহানের নিকট।
দৌড়ে গিয়ে কলার চেপে ধরে চিৎকার করে বললাম,”অনেক সহ্য করেছি আর না।নোংরা হলো তুই।”
সারহান গর্জে উঠলো।আমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।কোমড়ে স্বজড়ে লাথি দিলো।
চিৎকার করে উঠলাম আমি।পাশের বাড়ির ভাবী আর সেই চাচিমা ছুটে এলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্তক্ষরণ শুরু হলো আমার।
রাহিমা ভাবী দৌড়ে এলো আমার কাছে।
হতভম্ব হয়ে বললো,”এতো রক্ত।বিষয়টা স্বাভাবিক লাগছে না।”
এতোক্ষণে মনে আমার একটি সন্দেহ তৈরি হলো।
গত দু-মাস যাবত পিরিয়ড অফ আমার।
বিষয়টি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনি আমি।
তারমানে কী আমি,,,,,
বুকে ধ্বক করে উঠলো।রাহিমা ভাবীকে অনুরোধ করে বললাম,আমায় ডাক্তারের কাছে নিতে দয়া করে।নাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
শাশুড়িমা কোনো মতেই আমাকে হাসপাতালে যেতে দেবেন না।রাহিমা ভাবী এবং চাচিয়া একপ্রকার লড়াই করে নিয়ে গেলো আমায় হাসপাতালে।
ব্যাথায় আর অজানা সঙ্কায় কেদেছি সারা রাস্তা।পেট যেন আমার ছিড়ে পরছে।
হাসপাতালে পৌঁছে ডাক্তার আমার কিছু পরীক্ষা করলো।
রিপোর্ট হাতে আসলে চিন্তিত হয়ে এগিয়ে এলো সে।
কিছুটা বিলাপের স্বরে ডাক্তার আঙ্কেল বললো,”এতো বড়ো দূর্ঘটনায় ঘটলো কী করে?উনি প্রেগনেন্ট ছিলেন।অতিরিক্ত চাপের জন্য বেবি মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।”
আমি কাদতে কাদতে বসে পরলাম।
চিৎকার করে বললাম,ঐ জা*নো*য়ারকে ছাড়বো না।
হাসপাতাল থেকে বের হতে চাইলাম।হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে।
ভাবী অনেক কষ্টে সামলালেন আমায়।
বাবার বাড়ি কল দিয়ে আসতে বললেন।
মা-বাবা এবং মিরা এলো।আমার এমন অবস্থা দেখে মিরা কেদে জড়িয়ে ধরলো।
ভাবীদের বাড়ি যেহেতু আমাদের পাশেই ছিল,তাই ঘটনা সব জানতো তিনি।
বাবা ও মাকে শুরু থেকে সবটা খুলে বললেন।রেগে একাকার হলেন বাবা।সারহানকে মারতে চাইলেন এবং বললেন,”আজকেই আমার মেয়েকে ছাড়িয়ে নেবো ঐ পিশাচের হাত থেকে।”
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,”বিয়ে দেওয়ার সময় তো এতো ভাবেন নি।যখন আমার প্রথম বাচ্চার ক্ষতি হলো তখনও চুপ ছিলেন আপনারা।
টাকা দেখে কুকুরের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন আমায়।”
বাবা কান্নায় ভেঙে পরলো।আমার হাত ধরে ক্ষমা চাইলো।মন গলে গেলো আমার।যতই হোক বাবা তো।
ছোট থেকে মানুষ করেছেন কষ্ট করে।
ভাবী ও চাচিমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরিয়ে আনা হলো আমায়।
বাবা সোজা উকিলের কাছে গিয়ে ডিভোর্স ফাইল করলেন।
শেষমেষ সমাপ্তি ঘটলো আমার সংসার জীবনের।
দীর্ঘ চার বছর পর বিচ্ছেদ ঘটলো।
একদম গুটিয়ে গেছিলাম আমি।ঠিক মতো নাওয়া-খাওয়া করতাম না।
চার দেয়ালে বন্দী করে ফেলেছি নিজেকে।
বাইরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা আমার জগত।
বাড়ি থেকে বের হই না একদমই।আশেপাশের মানুষ কেমন যেন কোণা চোখে তাকায়।
ও বাড়ির কেউ অনুতপ্ত না আজো।আমায় একটি বারের জন্য ফিরিয়ে নিতে বা কল পর্যন্ত দেয়নি।অবশ্য আমিও যেতাম না।ঘৃনা চলে এসেছে মানুষ গুলোর প্রতি।আমি আমার কাবিনের দশ লাখ টাকা দাবী করেছি।
দিয়েছে তারা।
দেওয়ার সময় হাজার একটা অভিশাপ দিয়েছে।
টাকাটা নিয়েছি জেদ করে।তবে নিজের জন্য নয়।
একটি এতিম খানা তৈরিতে দান করেছি টাকাটা।
এই জগন্য মানুষদের টাকাটা নাহয় কোনো পূর্নের কাজেই লাগলো।
আনমনে জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরের প্রকৃতি অনুভব করছি।অবসন্ন বিকেল আমার এভাবেই কাটে।
মিরা এসে আমার পেছনে দাড়িয়েছে তা খেয়াল নেই।
ওর ডাকে হুম বলে উত্তর দিলাম।
:,,,,,,,,,”তোমার ফোনে আবারো সেই অদ্ভুত ডটডট মেসেজ এসেছে আপু।”
আমি তেমন পাত্তা দিলাম না।প্রকৃতি অনুভব করতে ব্যাস্ত আমি।
ফোন নিয়ে চলে গেলো মিরা।
রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে আছি,এমন সময় ফোনের রিং বেজে উঠলো।
কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই কারো করুণ কান্নার আওয়াজে চমকে উঠলাম আমি।
কন্ঠ স্বর পরিচিত মনে হলো,তবে ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না।কল কেটে গেলো।আমি স্টিল দাড়িয়ে রইলাম।
পরদিন মিরা ঘরে এসে বললো,”তোমার চুল গুলো বেধে দেই আপু।খুব অগোছালো হয়ে আছে।”
মুচকি হেসে সম্মতি দিলাম।
বোনটা আমার এসেছি থেকে খুবই যত্ন নেয় আমার।
চুল বাধা শেষে মিরা চলে গেলো।
আমি টেবিলে মাথা ঠেকালাম।
হটাৎ,’মায়া’ ডাকে চোখ খুললাম।এ কন্ঠস্বর পরিচিত আমার।খুবই পরিচিত।
পেছনে ঘুরতেই চারবছর আগের প্রিয় মানুষটিকে দেখলাম।স্থীর হয়ে গেলো আমার দৃষ্টি।
থমকে গেলাম আমি।রায়ানের মুখ জুড়ে হৃদয় শিতল করা হাসি।
ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এলো সে।বিছানায় বসলো আয়েশ করে।
:,,,,,,,,”তুমিহ এখানে?”
রায়ান আমার দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বললো,”হুম এলাম আমার রাজরাণীকে নিতে।দেরী হলেও কিন্তু এসেছি আমি।”
আমার চোখ জলে টলমল করছিল।নিজেকে সামলাতে না পেরে হুহু করে কেদেঁ উঠলাম।
বাবা সহ মা আমার ঘরে এলো।সঙ্গে এলো রায়ানের মা-বাবা।
বাবা আমার হাত দুটো ধরে বললো,
“মারে আমি হয়ত ক্ষমার যোগ্য না।অন্ধ ছিলাম আমি মা।রায়ান আমার চোখ খুলে দিয়েছে।
তোর ভালোবাসাকে তোর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে পাপ কমাতে চাই আমি।”
আমি নিজেকে শক্ত করলাম।বিয়ে নামক সম্পর্কে আর জড়াতে চাইনা।
বললাম,”এখন আর সম্ভব নয় এটি।আমার সঙ্গে সঙ্গে রায়ানের জীবন আমি নষ্ট করতে চাইনা।আমার মতো ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করে সমাজের কাছে রায়ান ছোট হোক,তা আমি চাইনা।”
রায়ানের মা এগিয়ে এসে আমার হাত দুটি ধরে বললো,”এক বেলা না খেয়ে থাকলে সমাজ তো এসে খেতে দেয়না মা।
আমার ছেলের খুশিই আমার কাছে সব।কে কী বললো তা আমার জানার প্রয়োজন নেই।পিছে লোক অনেক কিছুই বলতে পারে।কিন্তু তাতে আমাদের কী?
তুমি আমার ছেলের জীবন থেকে চলে যাওয়ার পর সব এলোমেলো হয়ে গেছিলো তার।মৃতের মতো বেচে ছিলো এতোদিন।ভেতর থেকে শেষ হয়ে গেছিলো।
আজ আমি আমার ছেলেকে আগের রুপে পেয়েছি আবার মা।
সে আবারো মন খুলে কথা বলেছে,তোমাকে চেয়েছে আমার নিকট।
তোমার সঙ্গে কী হয়েছে সে বিষয়ে অবগত আমরা।এতে তোমার কোনো দোষ নেই মা।
আল্লাহ্ ভাগ্যে যা রাখে,তা হবেই।
আমরা হয়ত খুব বেশি ধনী নই।তবে তোমাকে খুব ভালোবাসবো মা।আমার পেটের কোনো মেয়ে নেই।এ নিয়ে দুঃখের ও শেষ নেই। তুমি আমার মেয়ে হয়ে যাওনা মা।
আমার ছেলেটাকে আবার গুছিয়ে দাও না মা।”
বড্ড আপন মনে হলো তাকে।জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কাদতে লাগলাম।
এ যেন মায়ের পরস।
জমে থাকা কষ্ট গুলো চোখের জল হয়ে বেড়িয়ে আসলো।
আমায় আংটি পড়িয়ে যেতে চাইলো তারা।কিন্তু সময় চাইলাম আমি।
মনে ভয় কাজ করছিল আমার।
ফিরে গেলো তারা।
মা ও বাবা আমার মাথায় হাত দিয়ে বললো,”এবার সব হবে তোমার ইচ্ছা মতো মা।তুমি যেটা চাইবে সেটাই হবে।”
আমি ভাবতে বসলাম।অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম জীবনকে আর একবার সুযোগ দিয়ে দেখবো আমি।দুনিয়াতে সবাই ই যদি খারাপ হতো তাহলে তো কেয়ামত এতোদিনে হয়েই যেত।
মাস কাটতে লাগলো।বিষাক্ত অতীতকে ভুলতে পেরেছি আমি।রায়ান নিয়ম করে কল দেয় আমায়।গ্রীলটি ও মেসেজগুলো আমার ভুলতে না পেরে রায়ানই দিতো।ওর মা-বাবা দুদিন পরপরই দেখতে আসে আমায়।
আমার মন খারাপ দেখলে ঘুরতে নিয়ে যায় তারা।মজার মজার কথা বলে হাসায়।রান্না করে এনে খাওয়ায়।
এর মধ্যে আমি আবার একটি চাকরি নিয়েছি।রায়ানের অবশ্য এতে আপত্তি নেই।কাজের মধ্যে থাকলে আমার মন ভালো থাকবে।
পার হলো চারটি মাস।
আমার দুই মা-বাবার,বোনের এবং রায়ানের চেষ্টায় সম্পূর্ণ সুস্থ ও চাঙা হয়ে উঠেছি আমি।
পিচ্চি বোনটা আমার কলেজ থেকে আসার সময় প্রতিদিন কিছু না কিছু নিয়ে আসে খাবার ।
ঘরোয়া ভাবে সম্পন্ন হয় আমাদের বিয়ে।আমার নতুন মা জড়িয়ে ধরে বলেছিল,”আমার মেয়েকে কিন্তু আর হাতছাড়া করবো না আমি।”
আমি হেসেছি খুব করে হেসেছি।
রায়ান আমায় পেয়ে খুশির কান্নায় ভেঙে পড়েছে।ছেলেটা আগের মতোই আছে।আমি বলতে পাগল।
বিয়ে শেষে রায়ান আমার হাত ধরে নিজের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো।
আমি তাকে দাড় করিয়ে বললাম,”আজ আমার নতুন জীবনের সূচনা হবে।
আমার অতীতমুখিকে কেন্দ্র করে একটি শেষ ইচ্ছা আছে আমার।”
রায়ান ভ্রু কুচকালো।
:,,,,,,,”ঐ বাড়িতে যেতে চাই আমি।”
রায়ান চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো।আমায় হারানোর ভয়ে আড়ষ্ঠ হলো তার মুখশ্রী।
রায়ানের গাল টিপে দিয়ে বললাম,”আমার সুখ দেখাতে চাই তাদের।
অভিশাপ দিয়েছিল,আমার আর কোনো দিন বিয়ে হবেনা।
তাই আমার সুদর্শন স্বামীকে তাদের দেখাতে চাই।”
এরপর রওনা দিলাম।
বাড়িতে পা রাখতেই বিস্ময়ে সবাই তাকালো আমার দিকে।সারহান ও আছে দেখছি।
আমার পরণের লাল টুকটুকে শাড়ি সহ গহনা দেখে তারা যা বোঝার ভালো করেই বুঝেছে।
রায়ানের দিকে ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারহান।
সাইরা তার মায়ের কানে কানে বললো,”দেখলে মা!কী দুশ্চরিত্র মেয়ে।ডিভোর্স হতে না হতেই বিয়ে করেছে।”
একথা কানে গেলো আমার।সাইরার গালে সপাট করে একটা চর বসিয়ে দিলাম।
সবাই আতঙ্কিত হলো।তবে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেলো না।
সারহানের মুখোমুখি দাড়ালাম।
:,,,,,,,”আমায় দেখে খুশি হয়েছো কীনা জানিনা।তবে তুমি নামক কীটের কথা মনে থাকবে আমার।
ঘৃণা করি তোমায়।”
সারহানের চোখ জলে টলমল করছে।
কান্নাভেজা কন্ঠে বললো,”আমার কথাকি একবারো মনে হলো না?এতো বছর সংসার করার পর ও কী আমার প্রতি বিন্দু মাত্র ভালোবাসা নেই মায়া?”
রায়ান এগিয়ে এসে বললো,”আপনার মুখে আমার স্ত্রীর সুন্দর নামটি বেমানান লাগে।বিশ্রি শোনায়।”
রায়ানকে থামিয়ে বললাম,”তোমার প্রতি বিন্দু মাত্র কোনো ফিলিংস নেই আমার মধ্যে।
তুমি এমনই মানুষ তোমার প্রতি আমার সামান্য করুণাও হয়না।
যাই হোক,ভালো থেকো।আমার নতুন জীবনে তোমার ছায়া পরুক তা চাইনা।
একটা কথা আপনারা সবাই মনে রাখবেন,আল্লাহ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেননা।”
রায়ানের হাত ধরলাম।
দরজার বাইরে এলাম।চোখ থেকে দু-ফোটা জল গড়িয়ে পরলো আমার।
রায়ান শিতল কন্ঠে বললো,
“চলো না সব ভুলে,নতুন করে শুরু করি সবটা।”
আমি হাসলাম।রায়ানের হাত চেপে ধরলাম শক্ত করে।
ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সারহান।
রাহিমা ভাবীর সঙ্গে দেখা হলো।অভিনন্দন জানালো আমায়।
_____
কারো স্পর্শে আমার চার বছরের তৃক্ত অভিজ্ঞার ছেদ কাটলো।
আমি আড় চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,”গিয়েছিলে তো দশদিনের কাজে।পাঁচদিন না যেতেই চলে এলে যে।”
রায়ান আমার কোমর জড়িয়ে ধরে ঘারের কাছে মাথা ঠেকিয়ে বললো,”তোমার জন্য মন কেমন করছিলো।
সকালে কল দিলাম তোমায়।মেহের রিসিভ করে বললো,তুমি নাকি একদম ওদের ভালোবাসছো না।খুব নাকি মন খারাপ।তাই কাজ ফেলে চলে এলাম বউয়ের মুড সুয়িং ঠিক করতে।”
আমি রায়ানের দিকে ঘুরে বললাম,”এতো মিস কিন্তু ভালোনা।তিন বাচ্চার বাপের এতো রোমান্টিক নেস ভালো না।”
রায়ান হাসলো।হাসলে খুবই সুন্দর লাগে তাকে।আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি।ভালো লাগে ভীষণ।
;,,,,,,,,,”মেহের মিহির কোথায়?”
:,,,,,,,,”ওরা মা-বাবার ঘরে ঘুমিয়েছে।পুতুল দোলনায়।”
রায়ান কোলে নিলো পুতুলকে।
:,,,,,,,,,”আচ্ছা,মেয়ের নামটা পুতুল রেখে ঠিক করলে কী?কেমন যেন নামটা।”
রায়ান পুতুলের কপালে চুমু খেয়ে বললো,”পুতুল হলো তার মায়ের মতো একটা কিউটিপাই।
তার সঙ্গে পুতুল নামটাই মানায়।আর নামটা তো সবারই পছন্দ।আমার পিচ্চি পুতুল।
বাবা-মেয়ের ভালোবাসা দেখে চোখ জুড়িয়ে এলো।সত্যিই কী আমার জীবনে এতো সুখ প্রাপ্য ছিল?
মাঝে মাঝে সব স্বপ্ন মনে হয়।
এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ আমায় এতোটা ভালোবাসা দিয়েছে যে,সকল অপূর্ণতা পূর্নতা পেয়েছে আমার।
প্রচন্ড রকমের সুখী আছি আমি।
আল্লাহর রহমতে বিয়ের তিন মাসের মাথায় ই কনসিভ করেছি আমি।
দুটি জমজ ছেলে মিহির-মেহেরের মা হয়েছি।
তারপর রায়ানেয় খুব শখের পুতুলের জন্ম হলো।
বর্তমানে খুবই সুখী পরিবার আমরা।আর্থিক দিক থেকে শুরু করে সবদিক দিয়ে অবস্থা ভালো আমাদের।পুতুলের জন্মের পর আর চাকরি করিনি আমি।বাচ্চা সামলাতে সময় কেটে যায়।
রায়ানের দুটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা রয়েছে।গরীব দুঃখী অনেক মানুষকে সাহায্য করি আমরা।
বিলাশবহুল জীবন আমাদের।
সকালে বাজারে এসেছি আমি।প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনতে।
মেহের মিহিরকে স্কুলে রেখে এসেছি।পুতুল বাড়িতে।
হটাৎ পেছন থেকে ডেকে উঠলো কেউ।
তাকিয়ে দেখি সায়লা আপুর ননদ রিমা মেয়েটা।অনেক বছর পর দেখলাম মেয়েটাকে।
আমায় জড়িয়ে ধরলো সে।
:,,,,,,,,,,”কেমন আছেন মায়া ভাবী?”
:,,,,,,,”আলহামদুলিল্লাহ।তুমি কেমন আছো?”
:,,,,,,,”আমিও খুব ভালো আছি ভাবী।একটা কাজে এসেছি।আপনাকে দেখলাম তাই চলে এলাম।”
দুজনে গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম।কফি অর্ডার করলাম।
রিমা বললো,”সারহান ভাই আর তার পরিবারের কথা জানেন কিছু?”
আমি কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম,”নাহ।”
:,,,,,,,,,,”ওদের অবস্থা বেশ খারাপ।সারহান ভাইয়ের যেই ব্যাবসা থেকে আগে লাখ লাখ টাকা আসতো সেই ব্যবসা এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
টাকা ঢালতে ঢালতে শেষ পযর্ন্ত বাড়ি, জমি সব বিক্রি করে ব্যাবসায় ঢেলেছে।তবুও চলেনি।
নদী ভাঙন শুরু হলে যেমন হাজার ব্লক ফেলার পরও ভাঙে তেমনি হয়েছে তার।চাকরির জন্য এ্যাপলাই করেও চাকরি পাচ্ছে না।
তার মায়ের অবস্থা তো আরো খারাপ।
সিড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙেছে।ডাক্তার বলেছে,সারা জীবনের মতো পঙ্গু।
সায়মা তার মায়ের গলায় ছুড়ি বাজিয়ে ব্যাংকের চেক সই করিয়ে নিয়ে সব টাকা উঠিয়ে নিয়ে কার সঙ্গে যেন পালিয়ে গেছে।একদম নিঃস্ব করে দিয়েছে।
সাইরা তার মাকে দেখা শোনা করে।মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়ে নাকি মারেও মাকে।মহিলার দেমাগ কমেছে।সারাক্ষণ কান্না করে।ভাড়া বাড়িতে থাকে বর্তমানে তারা।ঠিক মতো খেতে পায়না।
আর আমার ভাবীর দষা আর কী বলবো!
আপনি চলে আসার পনেরো দিন পরেই তার টিউমার ধরা পড়ে পেটে।অপারেশন করা হয়েছে দুবার।আবারো হয়েছে।
ডাক্তার বলেছে আর অপারেশন করা সম্ভব নয়।শেষ পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই আসতে হয়েছে তাকে।ঘরের এক কোণে পড়ে থাকে।শুকে কাট হয়ে গেছে।ব্যাথায় উঠে বসতে পযর্ন্ত পারেনা।বাচ্চাদের আমার ছোট ভাইয়ের বউ পালছে।ভাবছি ভাইকে আর একটা বিয়ে করাবো।মেয়েও দেখেছি।
পরের মেয়ে আর কতো দিন দেখবে বাচ্চাদুটোকে।
ভাবী সেদিন কোনো একটা বিষয় নিয়ে আমার ছোট ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া লাগালে ঝাটা দিয়ে তাকে মেরেছে ছোট ভাবী।ভাই কোনো প্রতিবাদ করেনি।বলেছে,এগুলো ওর পাপের ফল।
সাইরার বিয়ে হচ্ছে না।মুখ জ্বলসে গেছে।কী জানি ক্রিম ইউজ করার পর এই অবস্থা।
দেখতে বিকৃত লাগে।
মোট কথা আপনি চলে আসার বছর খানিকের মধ্যেই ওদের চুড়ান্ত পতন ঘটেছে।”
:,,,,,,,,,”সারহান বিয়ে করেনি?”
রিমা হেসে কুটিকুটি হয়ে বললো,”উনার আর বিয়ে!
খবর ছড়ে বাতাসের আগে।
ওনার সব কৃতকর্ম জানে সবাই ই।এলাকায় নাকি তাদের এক ঘর করে রাখা হয়েছে।রাস্তায় বের হলে মানুষ হাসাহাসি করে।
বছর দুয়েক আগে এক মেয়েকে দেখতে গিয়েছিল।মেয়ের বাবা তাকে দেখেই মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।আর একজন মেয়ে নাকি সবার সামনেই বলেছ,দরকার পরলে রিক্সা ওয়ালাকে বিয়ে করবো।তবুও এই কাপুরুষকে বিয়ে করবো না।মেয়েটা ছিলো দুইবাচ্চার মা।তাও রিজেক্ট করেছে তাকে।
বেচারা অপমান হয়ে বাড়ি ফিরছিলো।এলাকার যুবক ছেলেরা জুতা দিয়ে ঢিল মেরেছে তার গায়ে।
এখন আর আগের মতো ছোটলোক নেই।তবে টাকার অভাবে করুণ দশা আজ।”
আমি দীর্ঘশ্বাস নিক্ষেপ করলাম।
রায়ান ফোন করেছে।জানালো,বাচ্চাদের স্কুল আজকে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছে।আমি যেন ওদের বাড়ি নিয়ে আসি।সে ব্যাবসার কাজে বিজি।
ঘড়ির দিকে তাকালাম।
বললাম,”আজ আসি আমি।বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনতে হবে।তুমি তো কোনো কাজে এসেছো,আর আমিও স্কুলে যাবো এখন।
সময় পেলে একদিন এসো আমার বাড়িতে।এড্রেস তো জানোই।”
:,,,,,,,,,”তা তো জানবোই ভাবী।কতো বড়ো ব্যাবসায়ি আপনারা।কতো নাম ডাক।”
আমি কিঞ্চিত হেসে বিদায় নিলাম।যাওয়ার সময় এক বাটি নুডলস ও সুপ কিনে বিল মিটিয়ে দিলাম।মেয়েটা আরামছে খাবার গুলো খাচ্ছিল।আজো সহজ-সরলই আছে।
রিমার দিকে তাকিয়ে বাই দিলাম।মেয়েটা একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলো আমায়।
আমি ধীরে ধীরে হাটা ধরলাম।অতীত আজ পুরো ধোয়াশাতে পরিণত হয়েছে আমার।
সারহানের এই নিষ্ঠুর পরিণতির কথা শুনে কিছুটা খারাপ লেগেছে আমার।
আর সায়মা?মেয়েটা এতো বড়ো বিশ্বাস ঘাতকতা করলো নিজের রক্তের মানুষের সঙ্গে।
রাজনের সঙ্গে পালিয়েছে সায়মা।শুনেছি খুব খারাপ জায়গায় গিয়ে পড়েছে সে।
মেয়েটা নিজের জীবন নিজে এবং মা-ভাইকে দিয়ে নষ্ট করেছে।
আমি বার-বার বলেছিলাম তার মাকে,বোনকে ও সারহানকে।প্রতিবার তারা আমায়ই অপরাধী করেছে।
এসব ভাবতে ভাবতে বাচ্চাদের স্কুলে এলাম।
মিহির-মেহের জড়িয়ে ধরলো আমায়।
দুজনকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
সারাদিন ব্যাস্ততাতেই কেটে যায় আমার।অবশ্য বাচ্চাগুলো খুব শান্ত স্বভাবের হয়েছে।
ছোট হলেও খুব হেল্পফুল।
রাত হলো।খুব ক্লান্ত লাগছিলো দেখে ঘুমিয়েছি।মা আমার মাথায় তেল মালিশ করে দিয়ে পুতুলকে নিয়ে গেলো।বললো,আজকে রেস্ট নিতে।পুতুলকে সেই ই রাখবে।দাদী -নাতনী ভালো মিল তাদের।
আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমালাম।
রায়ান ঘরে এলো।আচমকা আমায় কোলে তুলে নিয়ে ছাদের দিকে হাটা ধরলো।
আমি কপাল কুচকালাম।বললাম,”এই রাত করে কী শুরু করলে রায়ান?”
কোনো কথা বললো না সে।
ছাদে গিয়ে আমিতো প্রচন্ড অবাক।পুরো ছাদ ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো।
মাঝখানে একটা টেবিলের ওপর কেক রাখা।
আমার সামনে হাটু মুড়ে বসলো রায়ান।
ফুল দিয়ে বললো,”হ্যাপি ম্যারিজ ডে আমার বাচ্চার মা।এই দিনে তোমায় পেয়েছিলাম আমি।”
মনে পরলো,আজ আমার বিবাহ বার্ষিকী।
দুজনে কেক কাটলাম।ক্লান্তি কেটে গেছে সেই কখনি।আসলে এই মানুষটি দেখলেই আমার প্রশান্তি আসে।
অনেক মজা করলাম।চাঁদের আলো উপভোগ করলাম রায়ানের কাধে মাথা রেখে।খুব করে সুখ সুখ অনুভব হলো।
ফজরের আযানের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এলাম।দুজনা মিলে নামাজ আদায় করলাম।
কফি বানিয়ে রায়ানকে দিলাম।
আমি টেবিলে বসে নিজের ডাইরিটি খুললাম।
লাষ্ট পেজে লিখলাম,”সুখের জোছনায় হারিয়ে গেছে অতীতের দুঃখী মায়া।”
রায়ান এগিয়ে এলো।
বললো,”কী এটা মায়া?”
আমি ডাইরিটি ড্রয়ারে রাখলাম।
পেছন ঘুরে মুচকি হেসে বললাম,’মায়ার জীবনী’।
🍀🍀সমাপ্ত🍀🍀
সবার কাছে একটি করে রিভিউ আশা করছি আমার গ্রুপে।
আমার লেখা গল্প এবং গল্প বিষয়ক আপডেট পাবেন এই গ্রুপে।
গ্রুপ লিংক,,,,,https://facebook.com/groups/463381605028401/
আশা করি পাঠকদের মন রক্ষা করতে পেরেছি আমি।
সারহানের পরিণতি কিন্তু খুবই খারাপ হয়েছে এবং ওর পুরো পরিবারেরই।
পরিশিষ্ট,,,,,,মায়া এখন অনেক সুখে আছে।
আপনারা সাবধানে থাকবানে।সারহানের মতো মানুষদের বর্জন করবেন।