মাশুল (প্রথম পর্ব)

0
405

#মাশুল (প্রথম পর্ব)

“কেমন আছো শিলা?”

প্রশ্নটা করতেই উপস্থিত সবার সামনে অঝোরে কাঁদতে শুরু করে দিল আমার প্রাক্তন ! হঠাৎ করে তৈরী হওয়া এই পরিস্থিতির জন‍্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। প্রচন্ড আবেগে আমার চোখেও পানি, লুকানোর চেষ্টা করিনি।

দশ বছর পর শিলার সাথে আমার দেখা, ডিপার্টমেন্টের রিইউনিয়নের অনুষ্ঠানে। ভার্সিটিতে আমার আর শিলার সম্পর্ক ছিল ওপেন সিক্রেট। পরিচিত বা বন্ধুরা খুব ভালো করেই জানে আমাদের সম্পর্কের ঐ গভীরতাকে। তাইতো হঠাৎ করে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরী হওয়াতে কেউই অবাক হয়নি। বরঞ্চ দুজনকে স্পেস দিতে সবাই নিরাপদ দুরত্বে সরে গেল।

আমি আর শিলা দুজনেই একটানা কেঁদে যাচ্ছি, নিঃশব্দে। আমার খুব ইচ্ছা করছে ওর হাতটা আলতো করে ধরি, ঠিক আগের মতো করে। তবে পারিনি। ভীষণ আপন এই মেয়েটার উপর যে অধিকার হারিয়েছি সেই দশ বছর আগে!

যদিও আজো পযর্ন্ত প্রতিটা দিন আমি শিলাকে মনে করে যাচ্ছি, আমার জীবনে ওর অস্তিত্ব অনুভব করি প্রতিটা মুহুর্ত। তারপরও শিলার কাছে এখন আমি নিছকই এক পরপুরুষ। তাইতো এমন একটা ইমোশনাল মোমেন্ট তৈরী হওয়ার পরও দুরত্ব রাখতে হচ্ছে সচেতনভাবে।

গল্পটা কোথা থেকে শুরু করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না! খুব সহজ সরলভাবে শুরু হওয়া একটা ইনোসেন্ট প্রেমের গল্প যে পরবর্তীতে এতোটা জটিল হয়ে উঠবে, তা কখনোই ভাবিনি। শিলা আর আমার প্রথম পরিচয়ের মুহুর্তটা দিয়েই কি এই গল্পের শুরু হবে?

আপনারা কি বলেন?

হ‍্যাঁ, কাহিনী শুরু করার জন‍্য ঐ মুহূর্তটাই সম্ভবত এই জীবন নাটকের সবচাইতে ভালো সিকোয়েন্স।

আমি নেহাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরুর প্রথম দিনই সহপাঠী শিলার প্রেমে পড়ে গেলাম। ব‍্যাপারটা অনেকটা লাভ এট ফার্স্ট সাইট টাইপের মতো! তবে ভালোবাসা আমার দিক থেকে তখন এক তরফাই। প্রথম প্রথম শিলা আমার আগ্রহটা বুঝেও পাত্তা দেয়নি। তারপরও চিনে জোকের মতো লেগেছিলাম, ভালোবাসা পাবার আশায়।

প্রথম দেখার প্রায় আটমাস পর শিলার মুখ থেকে “হ‍্যাঁ” শুনার আগ পযর্ন্ত আমাকে প্রতিনিয়ত কঠিন পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়েছে। আমি পড়াশোনায় মনোযোগী, সেই সাথে শ্রেনী পরীক্ষা গুলোতেও বেশ ভালো করছি। শিলার প্রতি আমার পূর্ণ মনোযোগ আর সর্বোপরি ওর সাথে গল্পটাও ততোদিনে বেশ জমে উঠেছে।

একটা সময় পর একজন আরেকজনকে মিস করতে শুরু করি। কিছুদিন পর সবকিছু মিলেই দুজনে যেন এক আত্মা। শুরু হলো দুরন্ত ভালোবাসার আরেকটা গল্পের পথচলা।নৈসর্গিক এক পরিবেশে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক‍্যাম্পাসে।

আমাদের দুজনের রসায়ন এতোটাই ভালো ছিল যে, অল্পদিনের মধ‍্যেই ক‍্যাম্পাসের পরিচিত জুটি হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেলাম। সারাক্ষণই একসঙ্গে থাকা, মানিকজোর।

শিলা খুলনার মেয়ে, ইউনিভার্সিটির হলেই থাকে। ওর প্রীতিলতা হলের চারশ চৌদ্দ নাম্বার রুমের গল্প এতটাই শুনেছি যে চোখ বন্ধ করে ওর রুমটাকে কল্পনা করতে পারি। আমিও ভার্সিটির হলেই থাকি। ভাসানী হলের দুশ ছয় নম্বর রুমে। ভার্সিটির জীবন স্বপ্নের মতো শুরু হলো শিলাকে পেয়ে।

বলতে গেলে সকালে ক্লাস শুরু হওয়া থেকে রাতে মেয়েদের হল গেট বন্ধ হওয়া পযর্ন্ত, আমি আর শিলা। দুপুরে ল‍্যাবে একসাথে প্রাকটিকাল করা, বিকালের দিকে লাইব্ররীতে একসঙ্গে পড়ার চেষ্টা, সন্ধ্যায় প্রান্তিক বা ডেইরী ফার্মগেটে চা সিংগাড়ার আড্ডায় আর রাতে ওর হল গেটের সামনে বসে রাজ‍্যের গল্প আর দুজনের খুঁনসুটি। এই বাধা ধরা লাইফে কখন যে অনার্স শেষ করে ফেললাম টেরই পাইনি।

বন্ধুরা অবাক হলো, তুমুল প্রেমের মধ্যেও আমার অনার্সের ভালো ফলাফলে। এরপর অর্গানিক কেমেস্ট্রির থিসিস গ্রুপে মাস্টার্সটাও শুরু করে দিলাম নামকরা এক অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে। শিলার অনার্সের রেজাল্ট অবশ‍্য গড়পড়তা। কিন্তু তাতে ওর মন একটুও খারাপ নয়, আমার ভালো ফলেই সে অনেক খুশী। গল্পের এই পযর্ন্ত কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। দুজন উচ্ছ্বল তরুণ তরুণীর বাধ ভাঙ্গা প্রেম আর ওদের উত্তাল দিনগুলোর আনন্দে ভেসে থাকার সময়।

অনার্সের ফলাফলের পর এক ছুটি শেষে বাড়ি থেকে এসে শিলা এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ জানায়। ওর বাবা বিয়ের আলটিমেটাম দিয়েছে! পাত্র শিহাব, আর্মি অফিসার। ছেলেটা শিলা ও শিলার পরিবারের অনেকদিন ধরে চেনা। পাত্র শিলাকে বিয়ে করতে খুবই আগ্রহী। এমনকি ভার্সিটিতে ওর ছেলে বন্ধু আছে, এরকম একটা ইনফরমেশন জানার পরও!

বিয়ের কথা ওর কানে আসতেই, শিলা ওর পরিবারের কাছে ওর অবস্থান জানিয়ে দেয়। বাবা মাকে স্পষ্ট ভাবেই বলে, বিয়ে করলে সহপাঠী নেহাল নামের ছেলেটাকেই ও বিয়ে করবে, অন‍্য কাউকে নয়!

শিলার বাবা মায়ের কানে নেহালের কথাটা অনেকদিন আগেই এসেছিল। কিন্তু শিলা আর নেহালের সম্পর্ক যে এত গভীর, তা আগে ওরা বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল নিছক বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

নেহালের ব‍্যাপারে খোঁজ নিতেই শিলার বাবা জেনেছে, ছেলেটা চাঁদপুরের এক স্কুল শিক্ষকের কনিষ্ঠ ছেলে। পরিবার খুবই সাধারণ। সর্বোপরি, চাল চুলোহীন সহপাঠী এক ছেলের সাথে শিলার বিয়ে হবে, বিষয়টি ওর বাবা মা কিছুতেই মেনে নেয়নি। নেহালের সাথে শিলার বিয়ে হবে না! শিহাবকেই বিয়ে করতে হবে, কথাটা বাবা মা জোর দিয়েই শিলাকে জানিয়ে দেয়।

সেই ছুটি শেষে ভার্সিটিতে ফিরে আসার পর শিলা ওদের বাসায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো খুলে বলে। আমাদের দ্রুত বিয়ে করে ফেলাটাই যে এ সমস্যার একমাত্র সমাধান, সেটাও আমাকে বোঝাতে চাইলো। সত‍্যি বলতে কি, এখন বিয়ে করতে হবে কথাটা শুনেই আকাশ থেকে পড়লাম! এ ধরনের একটা পরিস্হিতির মুখোমুখি হতে হবে, তা আমার মাথায় কখনো আসেনি।

চার ভাইবোনের সংসারে আমিই সবচেয়ে ছোট। একমাত্র বোন আমার ইমিডিয়েট বড়, মাস্টার্সের রেজাল্টের জন‍্য অপেক্ষা করছে। তখনো বিয়ে হয়নি! আমার বড় দুই ভাইও অবিবাহিত। তার উপর আমার নিজের কোনো আয় রোজগার নেই। পারিবারিক ভাবে বিয়ে করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব একটা বিষয়!

তারপরও শিলার পরামর্শে তড়িঘড়ি করে বাড়ি গেলাম। আমার মাকে সাহস করে সব ঘটনা খুলে বললাম। আমার সবচাইতে বড় ভাই এলাকারই একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। সবকিছু শুনে আমাকে প্রচন্ড বকাঝকা করে বাড়ি থেকে এক প্রকার তাড়িয়েই দেয়।

এ ঘটনার পর ভাইয়েরা টাকা পয়সা আগে যা কিছু দিত, সেটাও বন্ধ করে দেয়। আমি অবশ‍্য এখন ওদের বিন্দুমাত্র দোষ দেই না। ঐ সময়ে আমাকে বিয়ে করানোর মতো পরিস্থিতি পরিবারের অনুকূলে ছিল না। বিশেষ করে একমাত্র অবিবাহিতা বোনটার কথা চিন্তা করে হলেও!

সেবার বাড়ি থেকে ব‍্যর্থ মনে ফিরে, ভার্সিটির কাছের বন্ধু বান্ধবীদের সাথে বিষয়টি নিয়ে শলা পরামর্শ করলাম, কেউই বিয়ে করার পক্ষে মত দেয়নি! তাইতো এতো বড় সিদ্ধান্তটা নেওয়ার সাহস পেলাম না। নিজেকে অনেক অসহায় বলেই মনে হল।

আমি এক প্রকার বাধ‍্য হয়েই শিলাকে বলি “বাবা মাকে একটু বুঝিয়ে রাখো। আরো কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে বল। ততোদিনে আমি পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকুরী ম‍্যানেজ করে ফেলবো! এ মুহূর্তে বিয়ে করা আমার পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব নয়।”

শিলা আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো। কিছুই বলেনি। তবে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকানোর কথাটা আমার এখনো মনে আছে। আমাদের চার বছরের সম্পর্কে সেদিনই প্রথমবারের মতো শিলার চোখে কনফিউশন, থতমত খেলাম।

এরপর থেকেই আমাদের সম্পর্ক একটু একটু করে শীতল হতে থাকে। ঐ সময় বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত যে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল, এটা শিলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরপরই বুঝেছিলাম। সেই ভুলের মাশুলটা কিন্তু আজো দিয়ে যাচ্ছি, বেশ চড়া দরে।

আমার সিদ্ধান্ত শোনার মাস খানেক পর এক ঈদের ছুটিতে শিলা বাড়ি যায়, অজানা আশংকা নিয়েই। সেবার বাড়ি যেতেই শিলা টের পেলো, ওর বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। আমাকে ফোনে সাথে সাথে কথাটা জানিয়ে দেয়। আমার কাপুরুষ মন কিন্তু তখনো আশায়, শিলা হয়তো এই বিয়েটাকে থামাতে পারবে।

মেয়েটা কিন্তু ওর সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছিল, শিহাবের সাথে যাতে বিয়েটা না হয়। এক পর্যায়ে অসহায় শিলা আমাকে খুলনা আসতেও বলে, পরিবারের সামনে যেন শেষবারের মতো এসে দাড়াই।

পাত্র শিহাবের ফোন নাম্বারটাও আমাকে ম‍্যানেজ করে দেয়, ওর সাথে যেন আমি কথা বলি। কোনটাই করতে পারিনি! কেন জানি পুরো বিষয়টি থেকেই পালাতে চেয়েছিলাম, হয়তো মেরুদন্ডহীন এক অসহায় ছাত্র বলেই।

সবকিছুর চাপ সহ‍্য করতে না পেরে, আমি নেহাল কাপুরুষের মতো ফোন বন্ধ করে রাখলাম। শিলা অবশ‍্য তারপরও অন‍্য বন্ধুদের মাধ‍্যমে আমার সাথে বিভিন্ন ভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলো। আমি পালালাম! কাপুরুষের মতো! সবকিছু থেকেই !

(দশ পর্বে সমাপ্ত। দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল। ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here