রোদেলা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব : ২৮

0
800

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব : ২৮

রোদেলা দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করছে কে হতে পারে…..
হাতে থাকা ঘড়ির জ্বলজ্বল করা ডায়েল দেখে ও বুঝতে পারে এটা শোভন…

অনেক শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ও, কিন্তু ও শোভনের কাছে অতি ক্ষুদ্র। একটা গাছের কাছে ঘুরিয়ে দাঁড় করায় ওকে। রোদেলা প্রাণভরে শ্বাস নিলো, আরেকটু হলে হয়তো নিশ্বাসটা সত্যিই বন্ধ হয়ে যেতো। তারপর দ্রুত বললো-

এসবের মানে কি…?
কি পেয়েছেন আপনি….?
যা মন চাইবে তাই করবেন…?

শোভন তখনও চুপ, ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারের কারনে, কিন্তু স্পটলাইটের আলো কিছুটা এসে পরেছে রোদেলার মুখে….

ক্রুদ্ধ স্বরে রোদেলা বলে-
হাত ছাড়ুন, কেও আমাকে খুঁজে না পেলে কেলেংকারী হয়ে যাবে,

এতক্ষণে জনাবের মুখ খুললো, বললো-

: হোক কেলেংকারী, আমি সেটাই চাই….
: মানে….!
: মানে আবার কি, সোজা রাস্তায় কাজ না হলে, অন্য রাস্তায়… কথাটা শেষ করে না শোভন…
আর হ্যা কি যেন বলছিলে তুমি আবু-সুফিয়ানকে…?
“আপনি তো স্পেশাল মানুষ…..!
বাহ…! তুমি আমার সামনে রংঢং করবা, খাবার বেরে খাওয়াবা, গিন্নিপনা দেখাবা অন্যের সাথে আর আমি কি চুপচাপ দেখবো ভাবছো….?
আজ কিছু একটা হবে, তোমাকে আমি ছাড়ছি না….!

রোদেলা বলে-
আর আপনি…! নাকের সামনে দিয়ে হেডম দেখায়ে চলে যান, বাসের সিট বদলে ফেলেন, সেগুলো কিছু না….

শোভন কিছু একটা বলতে যায় ওমনিই- কল্লোলের ডাক শোনা যায়….
রোদেলা….!

তারা সিঁড়ির কাছে গিয়ে টের পেয়েছে যে রোদেলা পেছনে নেই। তাই কল্লোল একা এসেছে খুঁজতে। আবার ডাকলো
রোদেলা….!

রোদেলা কোনোমতে হাত ছেড়ে যেতে লাগলো, শোভন ওর হাতটা যেন থাবা দিয়ে ধরলো, রোদেলার হাতে থাকা গাঢ় নীল রঙের কাচের চুড়ি ভেঙে গেলো। শোভনের হাতটায় গরম কোন তরলের স্পর্শে ভিজে গেলো। সিক্সথ সেন্স শোভনকে বললো- ঐ গরম তরল রোদেলার রক্ত। রোদেলা ব্যাথায় উহ্ একটা শব্দ করতেই শোভন হাত ছেড়ে দিলো ওর। রোদেলা হাত চেপে ধরে দ্রুত হাঁটছে।

আলোতে আসায় শোভন দেখে গাঢ় লাল রক্ত রোদেলার হাতে মাখামাখি, দ্রুত শোভন ওর কাছে এসে বলে,

সরি, রোদেলা আমি বুঝতে পারিনি এমন কিছু হয়ে যাবে….
রোদেলা কিচ্ছু বলে না, দ্রুত পা চালায়, একটা সময় কল্লোল সামনে এসে পরে। শোভন কল্লোলকে বলে ভাই রোদেলার হাত কেটে গেছে। কল্লোল জিজ্ঞেস করে কিভাবে কাটলো…?
এর কোন উত্তরই শোভন কিংবা রোদেলা কেউই দেয় না।

এরপর শুরু হলো হুলুস্থুল..
এতরাত, ফার্মেসী বন্ধ, রিসোর্টে গিয়ে ফার্স্ট এইডের কথা জিজ্ঞেস করতেই তারা দ্রুত ওদেরকে সাহায্য করে। রোদেলা নিশ্চুপ বসে আছে, যেন কোন কিছুই হয় নি। ওর সাদা ওড়না দিয়ে হাতটা চেপে রাখা ছিলো এতক্ষণ। শোভন পাগলের মতো রিয়্যাক্ট করছে। নিজে গিয়ে লোক ঘুম থেকে তুলে ফাস্টএইডের বক্স আর লোক নিয়ে এসেছে।

ফাস্টএইড যে দিলো সে বললো- একটা চুড়ি ভেঙে ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলো, তাই এত রক্তক্ষরণ হয়েছে। ভয়ের কিছু নেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্তপাত বন্ধ হয়ে যাবে। কাল সকালে এখানে একটা ডাক্তার রয়েছে তার কাছে অবশ্যই নিয়ে যাবেন। যদি পরবর্তী কোন চিকিৎসা কিংবা ঔষধের প্রয়োজন হয়, তিনি সেটা দিবেন।

রোদোলাকে রুমে পৌঁছে দিলো কল্লোল, কাওকে কিছু বললো না কল্লোল, পাছে একটা হুলুস্থুল হয়, কাল সকালেই বলবে ভাবে। রোদেলা যখন রুমে ঢুকে, শেষ বারের মতো তাকয় ঐ দিকে। দেখে শোভন দুই হাত মুখের কাছে নিয়ে অনুতপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলা চোখ সরিয়ে রুমে চলে যায়।

কল্লোল শোভনকে জিজ্ঞেস করে তুই ওইখানে কি করছিলি, আর হাতই কাটলো কিভাবে….!? শোভন কি বললো কল্লোলকে তা জানা গেলো না, কল্লোল ওর রুমে গেলো, আর শোভন গেলো ওদের রুমে।

রোদেলা কিংবা শোভন কেওই ঘুমাতে পারে না এই ঘটনার কথা ভেবে। রোদেলার কষ্ট লাগে শোভনের সেই কথাগুলো ভেবে। ওর সম্মান -অসম্মান কোন পরোয়াই করে না শোভন, এটা কেমন ভালোবাসা….!? মোহ ছাড়া এসব কিছু না, সময়ের সাথে সাথে মোহ কেটে যায়…, আর সত্যিকারের ভালোবাসা সময়ের সাথে সাথে মজবুত হয়। এমন ভালোবাসা চায় না ও যেটা মোহোয় মোরা….

এদিকে শোভন অনুতাপের আগুনে জ্বলছে। নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে নিজের এসব কর্মকান্ডে। এবং খুব করে অনুভব করে, রোদেলাকে অন্য কারোর সাথে দেখা ওর পক্ষে সম্ভব না।

পরদিন সকালে রোদেলা নাশতা খেতে ডাইনিং হলে আসে না। প্রিসিলা ওর নাশতা নিয়ে যায়। কল্লোল নাতাশাকে বলে গত রাতে ওর হাত কেটে যাওয়ার ঘটনা। এ্যামি পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে

: হাত কাটলো কিভাবে…!?
কল্লোল বললো-
: আরে ঘটনার আকষ্মিকতায় জিজ্ঞেস করা হয় নি…
: ওও…, আচ্ছা শোভন তোর কেডসে রক্ত লাগলো কিভাবে…
তুইও ছিলি নাকি তখন…?
শোভন আমতা আমতা করে বলে –
: হ্যাঁ আপু আমরা একসাথেই আসছিলাম…
: তাহলে তো তোর জানার কথা কিভাবে হাত কেটেছে ওর…
শোভন কোন উত্তর খুঁজে পায় না, অসহায় ভঙ্গিতে এ্যামির বরের দিকে তাকায়, তিনি এ্যামিকে ধমকের সুরে বললেন-
: আরেহ্ কি জেরা শুরু করে দিলা….
চলো বীচে গোসলের জন্য তৈরী হও…

ঐ প্রসঙ্গ সেখনেই ক্লোজ হলো….
সবাই হুড়মুড়িয়ে গেলো গোসলের উদ্দেশ্যে।

শোভনও সর্ট প্যান্ট ও টিশার্ট পরে রওনা দেয় বীচে। ছেলে বুড়ো সবাই খুব আনন্দ করতে লাগলো। জুতা ব্যাগ আর ফোন পাহাড়ায় রইলেন বড় মামা। তাকে ভীষণ অদ্ভুত লাগছে, থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর রংচঙা শার্টে। মাথায় একটা হ্যাটও পরেছেন তিনি, হ্যাটটা নোভেলের। সব মিলিয়ে পিকুলিয়ান লুক।

ফটোগ্রাফার ছবি তুলছে সবার। যেখান থেকে পানিতে নেমেছিলো সবাই একটু পর খেয়াল হলো সবাই ঐদিকে নেই।স্রোতের ধাক্কায় ওরা কোথয় এসে পরেছে খবর নেই কাররই…

নোভেলের হঠাৎ খেয়াল হলো রোদেলার কথা। এদিক ওদিক খুঁজলো। কাওকে যে জিজ্ঞেস করবে তাও পারছে না। পানি থেকে উঠে প্রিসিলাকে জিজ্ঞেস করায় প্রিসিলা বললো আপাকে বড় মামা সকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার হাতে নতুন করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। আপা পানিতে নামতে পারবে না তাই আসে নি।

: কোথায় এখন ও….
: রুমেই আছে।

শোভন দ্রুত রিসোর্টে ফিরে যায়। রুমে গিয়ে কোনমতে গোসল করে কাপড় বদলে চিন্তা করে ওর রুমে গিয়ে কালকের জন্য ক্ষমা চাইবে কিনা… আবার ভাবে রুমে ও একা, ভয় না পায় আবার বেচারী।

ফোন করে ওকে একটু বাইরে আসতে বলবে ভাবে…
ফোনটা খুঁজতেই মনে পরে সবার ফোন ভাবীর বাবার কাছে রাখা। আসার সময় এত দ্রুত এসেছে ও যে ফোনটা আনতে খেয়ালই নেই। আবার যে বীচে গিয়ে ফোনটা নিয়ে আসবে তাও পারছে না। তাতে অনেক সময় চলে যাবে, সবার রুমে ফিরে আসার সময় হয়ে যাবে…

তারচে ভালো দড়জায় নক করে ওকে ডেকে বাইরে আসতে বলা। যেই ভাবা সেই কাজ। দড়জার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে শোভন। নক করার সাহস হয় না, কেমন বাঁধো বাঁধো ঠেকে।

মনে মনে বলে নিজেকে, এটুকুও কষ্ট ওকে হারানোর কষ্টের কাছে কিছুই না। নক করো শোভন, নয়তো হাত ফসকে গেলো রোদেলা চিরকালের জন্য ।

অনেক ভেবে দড়জায় নক করে শোভন। কোন সাড়া শব্দ নেই। একটু সময় পর আবার নক দেয়। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে
: দড়জা খোলাই…

দড়জা খুলে শোভন। আবছা আলোয় দেখা যায়, কেও শুয়ে আছে, দড়জা টেনে আবার টোকা দেয় ও। যাতে রোদেলা অপ্রস্তুত না হয়, এবার রোদেলা ফিরে তাকায়, দেখে দড়জা একটু ফাঁক। রুমবয় এসেছে ভেবে দ্রুত ওড়না নেয়। দাঁড়িয়ে গায়ের শার্টটা ঠিক করে।

রোদেলা ধীর পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দড়জা খুলে দেখে শোভন দাঁড়িয়ে। শোভনকে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় ও। আর শোভন ও হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রোদোলার দিকে।

রোদেলা….!
যার রূপের বর্ণনা দেয়া হয়নি আজ অবধি এই উপাখ্যানে।
অত্যান্ত রূপবতী কেও না সে, তবুও ইশ্বর যখন তাকে তৈরি করেছেন, সব উপাদানের মধ্যে মায়া নামক বস্তটা মাপের চেয়ে একটু বেশী পরে গেছে হয়তো….

রোদেলার গল্প উপন্যাসের নায়িকাদের মতো দুধে-আলতা গায়ের রঙ হয়তো ওর নেই, ইয়া লম্বা ও কেও না, গড়পড়তা স্ট্যান্ডার্ড সাইজ। হাসলে গালে টোল পরে না, কিন্তু চিবুকের ঐ ক্ষুদ্র টোল চুম্বকের মতো টানবে যে কাওকেই। একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালে চোখে পরবে ওর ঘারের কাছের তিলটা। যেটা দেখলেই শোভনের খুব ইচ্ছে করে ওটাকে ছুঁয়ে দিতে। এই তিলটা ও প্রথম দেখেছিলো ওর ঘরের দেয়ালে যেদিন আটক করেছিলো রোদেলাকে সেদিন। আর হ্যাঁ চোখ দুটোর কথা তো ভুলেই গিয়েছিল শোভন। রোদেলার রয়েছে গভীর দুটি রহস্যময় চোখ। ও চুপ থাকলেও ওর চোখ যেন কথা বলে অনবরত। যেই চোখেতে তাকিয়ে পার করে দেয়া যাবে পুরো জীবণটা হেসেখেলে। সরু নাক আর দীর্ঘ চুল। রোদেলার খুঁত খোঁজার চেষ্টা করেছিলো শোভন। কোন খুঁতই চোখে পরো নি ওর। একটাই খুঁত ওর পরিবার…
রোদেলা ব্রোকেন ফ্যামেলির একটা মেয়ে। আমাদের সমাজে এটা অনেক বড় খুঁত যদিও। তবুও এসব পাত্তা দেয় না শোভন। ওর ভুবন ভোলানো হাসি, মন খুলো হাসে মেয়েটা। শিক্ষিত, স্মার্ট, বুদ্ধিমতি ও…
আর কি চাই…!

সেই রোদেলা দাঁড়িয়ে আছে শোভনের সামনে। সাদা একটা শার্ট গায়ে, হাতাটা ফোল্ড করা কনুই অবধি। বিশাল ঘেড়ের সাদা স্কার্টটা এলোমেলো ভাবে ছুঁয়ে আছে সাদা ফ্লোরটাকে।
হাতের ব্যান্ডেজটাও সাদা। সাদা যে এত সুন্দর রঙ তা আগে জানা ছিলো না শোভনের। রোদেলার চুলগুলো উঁচু করে খোঁপা করা, তাই কাঁধের তিলটা যেন উঁকি দিচ্ছে শোভনের দিকে।

রোদেলা কোন প্রসাধনী ব্যবহার করে নেই এখন, গতরাতের লেপ্টে যাওয়া হালকা কাজলের ছোঁয়া আছে চোখে। তাতেই তার সৌন্দর্য জানান দিচ্ছে আপন মহিমায়। শোভন মনে মনে ইশ্বরকে বলে, আর কিছুই চাই না আমি এই পৃথিবীতে, খোদা তুমি রোদেলাকে আমার করে দাও। ঠিক তখনই যোহরের আজান হয়….

রোদলার আচ্ছনতা যেন কাটলো আজানের ধ্বনিতে। দরজাটা বন্ধ করে দিলো শোভনের মুখের উপর, ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই।

চলবে…

previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1517181125409740/
next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1518644138596772/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here