রোদেলা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু পর্ব: ৪১

0
680

#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৪১

নাসিমা রাতে রোদেলার ঘরে গিয়ে ওর সাথে রাগারাগি করে। মুখের উপর কথা বলার সাহস ও কোথায় পেলো তা জানতে চায়। রোদেলা কোন উত্তর দেয় না। নাসিমা যেন তা আগের রূপে ফিরে এসেছে। এতদিন সব ঠিকঠাক থায় রোদেলা ভাবে ওর মা হয়তো সব ব্যাপার সামনে আসার পর অনুতপ্ত। কিন্তু না, তিনি এতদিন এক ভাইয়ের চলে যাওয়া আর আরেক ভাইয়ের অসুখে চুপচাপ ছিলেন কিছুটা। এখন যেন আবার আগের রূপে ফিরে এসেছেন।

ভালো ঘর, ভালো বর, নিজের দিকে দেখছস একবার, তোর বাবার এতসব কাহিনী, চাল নাই চুলা নাই, জেনে কে নিবে তোরে….? কত বড় সাহস মেহমান গুলারে দেখে সে উপরে উঠে গেলো। কিসের এত দেমাগ তোর। কি আছে তোর….

অথচ এই তিনিই ফোন দিয়ে কিসব বলেছিলো রোদেলাকে সেন্টমার্টিনের ঐ দিনটাতে। আর এখন…! বড় মামী কিছু বুঝিয়েছেন হয়তো। একটা মানুষের কয়টা রূপ থাকে….? নিজের মাথায় কিচ্ছু নেই, যে যা বলে তাই ঠিক, নিজের বিচার বিবেচনা বলতে যে একটা জিনিস পৃথিবীতে রয়েছে তা তার নেই। কেউ যদি বলে- আরে আপা আপনার মেয়েকে দেখলাম এক ছেলের সাথে হাত ধরাধরি করে যেতে। সে তা-ই বিশ্বাস করবেন। নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করবেন না যে আমার মেয়েটা কি এমন…?
নিজের মেয়েকেই চিনলো নাআজ পর্যন্ত। চিলে কান নিয়েছে, চিলের পিছনে ছুটা পাবলিক এরা।
অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে তিনি যখন চলে যেতে পা বাড়ালেন তখন রোদেলা সহ্য করতে না পেরে উঠে তার কথার জবাব দিল-

– বিয়ের জন্য যে এত লাফালাফি করছো, আমার বিয়ে হয়ে গেলো তোমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে হিসেব করে দেখেছো। ঘরে বসেই তো সব পেয়ে যাও, সে চিন্তা তো তোমার মাথায় নেই। আর কি বললা….

আমার এত দেমাগ কিসের….
ঐটা আমার দেমাগ না, আমার পরিবারের জন্য চিন্তা, যে আমি চলে গেলে আমার মা বোনের কি হবে…?

ভালো ঘর ভালো বরের চিন্তা আমি করি না….
আমি চিন্তা করি রাত পোহালে পরদিন চলবে কিভাবে … তোমার আছে সেই চিন্তা…? সেই ছোট্ট বেলা থেকেই তো এই চিন্তা মাথায় দিয়ে দিছো, নিজে পটের বিবি সেজে পরের সংসার সামলেছো। সবই তো খুইয়েছো, দুই দিন পর যে এই বাড়ি থেকে ও চলে যেতে হবে তখন…. আমি চলে গেলে চলবে কিভাবে ভেবে দেখেছো…?

দুইদিন আগেই তো খুব কথা শুনালো, আর এখন আসছো বিয়ের স্বপ্ন দেখাতে। কি পাইছো তুমি আমারে…. যখন যা মন চায় তাইই জোড় করে চাপায়া দিবে….
যাও তুমি…
বিয়েই করবো না আমি…
আমার জন্য এত দরদ দেখানো লাগবে না কারো…
বলে দড়জা আটকে দেয় রোদেলা।

রোদেলা কিংবা নাসিমা দু-জনেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। রোদেলার বিশ্বাস হচ্ছে নাও এসব বলেছে…
বলেছে সে এসব তার মাকে….
সেই সেন্টমার্টিন থেকে মনে মনে যুদ্ধ চলছে তার নিজের সাথে। ও কি বুঝে না ওর ভালো…? ওর কি স্বপ্ন নেই ভালো ঘর ভালো বরের…. শোভনের ভালোবাসা যে কতটুকু ওর প্রতি তা ওর চেয়ে ভালো কে জানে। এত ভালোবাসা অবজ্ঞায় ঠেলে দেয়া কি কম সাহসের কাজ। এটা ওর জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা, যা দিতে হচ্ছে ওর মা আর বোনের কথা ভেবে। ঐ পরিবারে গেলে সবসময় ওকে ছোট হয়ে থাকতে হবে। তার উপর মা বোনের জন্য যে চাকরী বাকরী কিছু করবে তাও পারবে না। কারন তারা খুবই রক্ষণশীল পরিবার। সেট কেও দেখেছে ভেবে…

তার মানে এই না যে বিয়ে ও করবে না। তবে আপাততঃ এসব নিয়ে ভাবতে চায় না ও। আবদ্ধ ঘরে অঝোরে কাঁদছে রোদেলা। জীবণ কেন ওকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করায় বার বার….
ইশ্বর আর কত পরীক্ষা নিবে ওর…?!

আর নাসিমার বিশ্বাস হচ্ছে না তিনি কি শুনেছে।
নাসিমা যেন স্বাক্ষাত অগ্নি মূর্তি। দড়জায় কড়াঘাতে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে যেন। হৈচৈ চেচামেচি শুনে বড় মামী দৌড়ে আসে…

বড় মামী নাসিমাকে শান্ত হতে বলেন। নাসিমা ব্যাঘ্র কণ্ঠে বলে-
: ভাবী, আপনি শুনলেন কি বললো ও, আমার নাকি কোন চিন্তাই নাই, আমি পটের বিবি সেজে থাকি, সব চিন্তা ওর।
: নাসিমা ও সেভাবে বলে নাই, তুমি নিজের মতো করে ভাবছো কেন…
: না ভাবি, আপনি আমাকে ছাড়েন, অনেক চিন্তা করে ফেলেছে ও, আর না, ওরে বলেন এক্ষুনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। আমি দরকার হলে ভিক্ষা করে খাবো তবুও ওর রোজগার করা ফুটা পাইও আর আমি স্পর্শ করবো না। ছাড়েন আপনি আমাকে, আমি শুধু ওকে এ কথাটাই বলবো। ছাড়েন…!

বড় মামী কিন্তু নাসিমাকে ছাড়ে না। তবুও তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় নাসিমা, দৌড়ে গিয়ে দড়জায় ধাক্কা দেয় অনবরত। রোদেলার কান্না এখন ভয়ে পরিনত হয়, কারন ও ওর মা’কে ভালো করে চিনে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি যে কতটা হিংস্র হন তার অনেক সাক্ষী রোদেলার সারা শরীরে রয়েছে।

রাত সাড়ে দশটা বাজে। পুরো বাড়ি থমথমে, যেন কোন ভুতুড়ে বাড়ি…। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলো কি না বোঝা গেলো না। রোদেলা রুমে বসে কাঁদছেই সেই তখন থেকেই।

প্রিসিলা দড়জায় নক দিলো,
আপা…
দড়জা খোল…
দড়জা খোল আপা…!
দড়জা খোলে রোদেলা। খাবার নিয়ে রুমে ঢুকে ও। এ বাড়িতে আটটার মধ্যে রাতের খাবার খাওয়া হয়ে যায়, আসলে প্রিসিলা যতটা না খাবার দিতে এসেছে তার চেয়ে বেশী এসেছে ওর বোন কোন অঘটন করছে কি না তা জানতে। ওর ভিতরে এ ভয় কেন ঢুকলো ও জানে না। প্রিসিলাকে রুমে ঢুকতে দেখে কোত্থেকে দৌড়ে ঘরে ঢুকে নাসিমা। খপ করে রোদেলার চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করে ঘর থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রিসিলার হাত থেকে খাবারের প্লেট পরে গিয়ে পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পরে ভাত, ভাজি আর বাটিতে করে আনা শোল মাছ আর আলু ফুলকপির তরকারি।

অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে নাসিমা। নোভেল, বড় মামী কেওই তাকে ছাড়াতে পারছে না এত অসুরের মতো শক্তি এসেছে তার শরীরে। প্রিসিলা কাঁদতে থাকে ভয়ে। ও এমন হবে জানলে দড়জা খুলতে বলতো না।

চুলের মুঠি তখনো তার হাতেই, ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে নিচতলা অবধি টেনে নামায় রোদেলাকে নাসিমা। রোদেলা ও অনেক চেষ্টা করছে ওর চুল ছাড়াতে। কিন্তু পারছে না। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে ও, কান্না যেন ভুলেই গেছে। খোলা কলাপসিবল গেইটের বাইরে বের করে আরেক দফা গালমন্দ করে। বলে-
: মা*গী তোদের কারনে আমার জীবন শেষ, আর তোরাই আমারে খোটা দেস, জুতা কামড় দিয়ে বের হয়ে যাবি, আর এই চেহারা দেখাবি না আমাকে। রোদেলার তখনি যেন কান্না নামক অনুভূতিটার কথা মনে হলো , শক্ত মাটির উঠোনটায় বসে পরে কান্না করতে শুরু করে ও। প্রিসিলা বড় মামার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে দেখে এসব। যদিও কাঁঠাল গাছের ফাঁক দিয়ে সব দেখা যাচ্ছে না।

প্রিসিলা দৌড়ে যায় নিচে যেতে । কিন্তু বাড়ির মেইন গেইটে তালা দিয়ে চাবি নিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে নাসিমা। কি করবে কেও বুঝে না যেন। বড় মামী জানালা দিয়ে ডাকতে থাকে রোদেলাকে। ওর মা চাবি নিয়ে দড়জা আটকে রেখেছে তা বলে নোভেল, বলে তুই একটু অপেক্ষা কর আপা, আরেক সেট চাবি আছে আলমারীতে বড়-আম্মা তা খুঁজছে।

কোন উত্তর দেয় না রোদেলা। কিছু সময় পর প্রিসিলা ওর নানীর ঘরের বারান্দার জানালা দিয়ে নিচে একটা কিছু ছুঁড়ে দিলো। প্রিসিলার মোহাচ্ছন্ন ভাব কাটলো জিনিসটা পরার শব্দে। সেখানে তাকিয়ে দেখে ব্যাগ। কোন মতে চোখ মুছে উপরে তাকায় ও। প্রিসিলাকে দেখা না গেলেও ও যে এটা ফেলেছে তা বুঝলো রোদেলা। একটু এগিয়ে দেখলো, ব্যাগে একজোড়া জুতা, ওর টাকার পার্স, আর ফোনটা টাকার পার্সে ঢুকিয়ে দিয়েছে প্রিসিলা যাতে ভেঙে না যায় । এগুলে দেখে কান্না যেন আরো বেড়ে যায় ওর। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না ও।

এমন জীবণ নিয়ে বেঁচে থাকার কোন মানেই খুঁজে পায় না রোদেলা। ভাবে ওর বন্ধু সিমিকে বলা সেই কথাটা- আমি যদি কোন দিন আ*ত্ন*হ*ত্যা করি তাহলে জানবি আমার আ*ত্ন*হ*ত্যার জন্য আমার মা দায়ী। কথাটা রেদেলার মাথার মধ্যে যেন পোকার মতো ভনভন করে। হঠাৎ চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ওর।
চোখ মোছে ও, হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও।
চুলগুলো খোঁপা করে ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে জুতো জোড়া পরে রোদেলা। তারপর বাড়ির মেইন গেট দিয়ে সোজা হাঁটা দেয় ও। নোভেল তা দেখে চিৎকার করতে থাকে…
আপা….!
আপা………..!
যাস না আপা…

চলবে…..

Previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=461358776028656&id=100064636124543
next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=468220395342494&id=100064636124543

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here