সূর্যোদয় #পর্ব_৪৫ #কারিমা_দিলশাদ

0
845

#সূর্যোদয়
#পর্ব_৪৫
#কারিমা_দিলশাদ

বারান্দায় বসে ঐশী কিছু নোটস তুলছে। জয় তার পাশে বসে কিছু কাজ করছিল। হঠাৎ করে সে কাজ করা বন্ধ করে দিয়ে ঐশীকে বলে,

“ এই বউ…”
“ হুমম..।”
“ আমার ভালো লাগছে না।”
“ তো?”
“ আসো গল্প করি।”
“ আচ্ছা আপনি শুরু করুন। আমি শুনছি।”

রাতের বেলায় সারাদিন কে কি করে না করে তা দুজনই দুজনকে বলে। তেমনি জয় আজকের এক পেশেন্ট নিয়ে কথা বলা শুরু করে তার সাথে। খুব ইন্টারেস্টিং কে’স নাকি। ঐশীও নোট করা বাদ রেখে আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকে। টিনএজের একটা মেয়ে। তার বাবা মার সাথে এসেছিল জয়ের কাছে কিছু সমস্যা নিয়ে। বাবা মা মেয়ের প্রতি খুবই কনসার্ন। মেয়ে খায় না, পড়ে না, প্রায় নাকি এই অসুখ সেই অসুখ লেগেই থাকে, মাথা ব্যাথা করে আরও অনেককিছু। সবশুনে জয় মেয়েটার সাথে একা কথা বলতে চায়, তখন মেয়েটা নাকি বলে সে একজনকে ভালোবাসে। কিন্তু ছেলেটা তাকে বাসে না। সে তার মনের কথা ছেলেটাকে বলেছে আর ছেলেটা তাকে রিজেক্ট করেছে। এসব নিয়ে মেয়েটা ডিপ্রেশনে।

জয় তার বাবা মা’কে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে বলেন, নিজে যতটুকু করার দরকার, বোঝানোর দরকার বুঝিয়েছে। তারপরও একজন এক্সপার্টের কাছে দিয়েছে, যেন কোনো রকম কোনো ক্ষতি নাহয়। আবেগের বয়স বলে কথা। টিনএজ, আবেগ, মোহ, অনুভূতি এসব নিয়ে কথায় কথায় হঠাৎ করে জয় ঐশীকে জিজ্ঞেস করে,

“ এই তুমি কখনো প্রেম করো নি সেটা তো জানি। কিন্তু কখনো কাউকে ভালোও লাগে নি? কারো উপর অন্য কোনো ফিলিংস আসে নি?”

“ স্বামী হয়ে এসব জিজ্ঞেস করছেন?”

“ আরে আমি তো ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করলাম।”

“ এটা ক্যাজুয়াল বিষয়! তা কোন স্বামী বউকে এসব জিজ্ঞেস করে?”

“ উফফ তুমি খালি কথা প্যাচাও। আমি কৌতুহল থেকে জিজ্ঞেস করলাম। দেখো আই থিংক কম বেশি সবারই কোনো না কোনো সময়, কোনো বয়সে কাউকে না কাউকে ভালো লাগে। তোমার লাগে নি?”

“ উহুম…” ঐশীর জবাবে জয় খুশি হয়। তারমুখে বড়সড় একটা হাসি ফুটে উঠে। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। ঐশী আবার বেখেয়ালিতেই বলে উঠে,

“ তবে একজন ছিল। এসপি সাহেব। ওই যে… রেস্টুরেন্টে দেখেছিলেন না? যার সাথে আমার ইন্টু পিন্টু আছে ধারণা করে আপনি দেবদাস হওয়া ধরে ছিলেন। উনি কিন্তু আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। যেদিন আপনি আমাকে প্রথম প্রপোজ করেছিলেন তার আগের দিন। উনি ভালোই ছিল।” – জয়ের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে একটু ঢোক গিলে বলে,

“ ভালো মানে? কেমন ভালো? ইউ লাইক হিম?”

“ না না। ওমন না। উনি ভালো ছিল এটা বলেছি। নম্র, ভদ্র আরকি। বাট উনার পরিবার পুরাই…. ও মাই গড!! ”

“ ওহহ…আচ্ছা।
আচ্ছা আমি? আমায় কেমন লাগে?” – ঐশী এবার ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। জয় উৎসুক হয়ে তার জবাবের জন্য চেয়ে আছে। ঐশী এবার ভ্রু কুঁচকে বলে,

“ হুয়াট রাবিশ! আপনি আমার হাজব্যান্ড ডাক্তারসাহেব। আপনি নিজেকে অন্য কারো সাথে কেন তুলনা করছেন? বিয়ের আগে আমার কাছে সব পুরুষ সমানই ছিল। কারো উপর আমার কোনো ফিলিংস ছিল না। ওই এসপিকে তার আচার-ব্যবহারে ভালো লেগেছিল দ্যাটস ইট। আপনি আর অন্য কেউ কি এক হলো? নিজেকে কেন অন্য কারো সাথে কম্পেয়ার করেন। বাই দ্যা ওয়ে এসব কথা আপনিই আগে শুরু করেছিলেন। এখন এমন বলছেন কেন?” – জয় ঐশীর কথায় মনে মনে খুব খুশি হয়। সে যেন এমন কিছু শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিল। তবুও সে অভিমানের ভান করে বলে,

“ কারণ তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই বলো না। তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না ঐশী। আমি তোমাকে কত ভালোবাসি জানো? তাই নিজে নিজেই তোমার মুখ থেকে কিছু শোনার চেষ্টা করি। ” – ঐশী হেসে জয়ের গাল টেনে ‘চু চু’ শব্দ করে বলে, “ ইশশ বেচারা।” জয়ও হেসে দেয়।

ঘটনাটা এখানে শেষ হলেই পারতো। কিন্তু হঠাৎ করে ঐশীর মাথায় শ’য়তানি ভর করে। যদিও জানে বিষয়টা অনুচিত। তবে এই মুহূর্তে তার জয়কে খুব জ্বালাতে ইচ্ছে করছে। সে জয়ের হাসিকে ফুল স্টপ লাগাতে বলে,

“ বাট আজকে না একটা ছেলেকে দেখেছি বুঝলেন। উফফফ সেইইইই হ্যান্ডসাম। এটাকে আগে পেলে নির্ঘাত এটাকেই বিয়ে করতাম।” – বলেই সে বারান্দা থেকে উঠে হাতের বইগুলো নিয়ে ঘরে চলে যায়। ঐশী মিটিমিটি হাসছে আর বিছানা ঠিক করছে শোয়ার জন্য। এরমধ্যেই জয় ঝড়ের বেগে রুমে এসে ঐশীকে তার মুখোমুখি দাঁড় করায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ কে ছেলেটা? নাম কি? কি করে?”

“ সিজান। খুববববব কিউট। পুরাই মাশাল্লাহ। আমি তো ফিদা৷ আপনি তার ধারেকাছেও নেই।
এই আপনি দেখবেন ওকে? ছবি আছে আমার কাছে। দাড়ান।” – ঐশী ছবি বের করতে নিলেই জয় অত্যন্ত ঝাঁজের সাথে বলে উঠে,

“ তোমার কিউট তুমিই দেখো। আমার এসব দেখার দরকার নেই।” – বলেই বিছানার এক কোণায় গিয়ে শোয়ে পড়ে। জয়ের কথায় ঐশী মুখে হাত দিয়ে হাসতে থাকে। একটু পর সে গিয়ে জয়ের পাশে বসে থাকে। জয় চুপ করে শুয়ে আছে।

কিন্তু বিষয়টা জমলো না। সে ভেবেছিল জয় হয়তো রেগে যাবে। বাট একি! এ তো হাবাগোবা মানুষের মতো কিছু না বলেই শোয়ে পড়লো। আরে মাঝে মাঝে তো একটু ঝগড়াও দরকার। অপেক্ষা করার পরও জয় যখন কোনো রিয়েক্ট করলো না তখন সে লাইটটা অফ করে শোয়ে পড়ে। দুই মিনিট না যেতেই জয় উঠে লাইট দিয়ে ঐশীর উপর উপুড় হয়ে শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে। বিষয়টা এতো তারাতাড়ি ঘটে যে ঐশী অবাক হয়ে যায়। জয় রীতিমতো রাগে ফুসঁছে।

“ কে ছেলেটা হ্যা? আমার ভালোবাসায় তোর মন ভরে না তাই না? আরেকজনের উপর তুই ফিদা হোস? কে ওই ছাগল দেখা….” – ঐশী মাথা ঝাকিয়ে ফোন থেকে ছবিটা বের করে জয়ের দিকে ফেরায়। জয় ফোনটা ছু মে’রে নিয়ে দেখেই ধপ করে ঐশীর উপর থেকে সরে পাশে বসে পড়ে। জয়ের মুখটা এখন জোঁকের মুখে লবণ পড়ার মতো হয়ে গেছে। ঐশী উঠে বসে ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসছে। জয় একবার ঐশীর দিকে তাকাচ্ছে আবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। আবার ঐশীর দিকে তাকালেই ঐশী ভ্রু নাচিয়ে ফোনের দিকে ইশারা করে বলে,

“ সিজান। আমার কিউটি….” — জয় এবার গোবেচারা মুখ করে ঐশীর দিকে তাকায়। ঐশী জোরে হেসে উঠে। তা দেখে জয় বলে,

“ এসব কি ধরনের ফাজলামি? ” — বলেই আবার আগের মতো করে শোয়ে পড়ে। ঐশী হাসতে হাসতে জয়ের কাঁধে দুহাত রেখে তাতে নিজের মুখ ভর দিয়ে বলে,

“ এটা একধরনের পাগলামি। একটু দেখলাম, একটু মজা নিলাম। একটু ঝগড়া করতে চাইছিলাম। বাট আপনি খুবই বোরিং টাইপ মানুষ। জমলো না বিষয়টা। আমি তো আপনার শোয়া দেখে ভাবলাম আমি অন্যায় কিছু করলেও আপনি বুঝি মুখ বুঝে অবলা পুরুষের মতো সব সয়ে যাবেন। বাট না। আপনি তো দেখি একদম গোখরা সাপ। কেমন ফুসফুস করছিলেন। ওয়াও ডাক্তার সাহেব! আপনার রাগটা না খুব কিউট।” – বলেই হেসে দেয়। জয় তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালে সে হাসি বন্ধ করে নেয়।

“ বাই দ্যা ওয়ে বাচ্চাটা কিউট না?” – জয়ের জবাবের অপেক্ষা না করেই বলতে থাকে,

“ একটা স্টুডেন্টের ভাই। এত্তো কিউট আর এত্তো শান্ত পিচ্চিটা। আমার তো পিচ্চিটাকে খুব মনে ধরেছে। অন্যান্য বাচ্চাদের মতো দুষ্টু না। এত্তো কিউট করে কথা বলে মাশাল্লাহ। সত্যি বলছি আপনি এর ধারে কাছেও নেই।” – ঐশীর এমন তরো কথা শুনেও জয় কিছু বলে না। কেবল চেয়ে থাকে।

“ বাই দ্যা ওয়ে আপনি একটা বাচ্চার উপর এত্তো জেলাস!!” – বলেই ঐশী হাসতে থাকে। এবার জয় ওদিক ফিরে ঘুমের ভান করে।

“ সরিইইই…ডাক্তারসাহেব? এই ডাক্তারসাহেব?” – জয়ের উত্তর না পেয়ে সে এবার জয়ের উপর দিয়ে গিয়ে জয়ের মুখ দেখার চেষ্টা করতেই, জয় ঐশীর কোমর ধরে ওকে ওর সামনে এনে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। ঐশী জয়কে হাসানোর জন্য ওর কোমরে কাতুকুতু দিতেই জয় লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। ঐশী প্রথমবেলায় ভয় পেলেও পরে চোখমুখে খুশি ফুটে উঠে।

“ এই আপনার কাতুকুতু আছে?”

জয় আমতা আমতা করে বলে, “ না।”

“ না মানে? ওয়াও কি লাফ দিলেন ডাক্তারসাহেব। আবার দেই।” – বলেই ঐশী আবার জয়কে কাতুকুতু দিতে শুরু করে। আর জয় জোরে জোরে হাসতে থাকে। একপর্যায়ে জয়ও ঐশীকে কাতুকুতু দিতে শুরু করে। কেউই ছাড়ার পাত্র না। দুজনের হাসির শব্দে ঘরটা মুখরিত।

এভাবেই মান-অভিমান আর খুনসুটিতে তাদের সময় কাটতে থাকে।

—————————————-

ঘুমের মধ্যে তীব্র উত্তাপ এবং কারো গোঙানি শুনে ঐশীর ঘুম ভেঙে যায়। আচানক ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিষয়টা বুঝতে একটু সময় লাগে তার। নিজেকে ধাতস্থ করে বুঝতে পারে, জয় তীব্র জ্বরে পুড়ছে। সবটাই অসময়ের বৃষ্টিতে ভেজার ফল। হঠাৎ করে আজকে বিকালবেলায় বৃষ্টির আগমন হয়। আর ঐশীর সেই বৃষ্টিতে ভেজার শখ হয়। মূলত ঐশীর জিদের কাছে হার মেনে বউকে সঙ্গ দিতে সেও নেমে পড়েছিল। এখন সেটার ফল পাচ্ছে।

ঐশী এখন কি ছেড়ে কি করবে বুঝতে পারছে না। সে লাইট জ্বালিয়ে থার্মোমিটার এনে আগে জ্বরটা মেপে দেখে। ১০৩ ডিগ্রি। তাপমাত্রা দেখে ঐশীর মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। ঐশীর এখন নিজেকে থাপ’ড়াতে ইচ্ছে করছে। কেন যে ভিজতে গেলো সে।

ঐশী তারাতাড়ি করে জলপট্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করে, জলপট্টি দিতে শুরু করে। জয় প্রলাপ বকছে। ঐশীর চোখ দিয়ে নিরবে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কয়েকঘন্টার ব্যবধানেই মানুষটার মুখটা শুকিয়ে এটুকু হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ধরে জলপট্টি দেওয়ার পর সে জয়কে ডাকে,

“ ডাক্তার সাহেব একটু উঠার চেষ্টা করুন প্লিজ। আপনার শরীরটা একটু মুছে দেই।”

জয় প্রথমে না না করলেও ঐশী জোর খাটিয়ে জয়ের শরীরটা ভালো করে মুছে দেয়। এরপর আবার ওকে শুইয়ে দিয়ে রান্নাঘরে যায় একটু স্যুপ বানাতে। যাওয়ার আগে স্মৃতির রুমে উঁকি দিয়ে দেখে স্মৃতি ঘুমিয়ে পড়েছে। ও জেগে থাকলে ওকে একটু জয়ের পাশে বসতে বলতো। এখন বেশ রাত। তাই ইলোরা ইয়াসমিনকে ডাকাটাও তার উচিত মনে হয় না। তাই আর ডাকেও না। সবাই আজকে একটু তারাতাড়িই শুয়ে পড়েছিল।

স্যুপ বানিয়ে জয়কে জোর করে কয়েক চামুচ খাইয়ে ওষুধটাও খাইয়ে দেয়। এরপর শুইয়ে দেয়। জয় বারবার বউ বউ, মা মা আর আব্বু আব্বু করে অনবরত প্রলাপ বকছে। জয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঐশী সেসব মুখ বুজে শুনছে। এরমধ্যেই শুনে জয় বলছে,

“ বউ তুমি আর মা আমাকে ছেড়ে যেও না কখনো হ্যা? তুমি গেলে আমি কিন্তু কান্না করবো। মা গেলেও কান্না করবো। আব্বু তো ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। তোমাকে না আমি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবো। তাহলে আর যেতে পারবে না। দরকার পড়লে গরু ছাগলের মতো বেঁধে রাখব…..”

এমন কথা শুনে ঐশীর হাসিও পাচ্ছে আবার কষ্টও লাগছে। ঐশী জয়ের কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। তাপমাত্রা বেশি বুঝে আবার জলপট্টি দেওয়া শুরু করে।

—————————————-

ফজরের আযান দিচ্ছে । ঐশীর বুকে মুখ গুঁজে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে জয়। সারাটারাত ঐশী এক সেকেন্ডের জন্যও চোখ বন্ধ করে নি। সারারাত জয়ের সেবা করেছে। যে কিনা কখনো কারো অসুস্থতার জন্য রাত জাগে নি। সেই আজ সারাটা রাত স্বামীর সেবা করেছে। কিন্তু তারমধ্যে ক্লান্তি বা বিরক্তির কোনো ছিটেফোঁটা নেই। আছে কেবল চিন্তা, অনুতাপ আর জয়ের জন্য কষ্ট।

লোকটা এমনিতেই খুব ছেলেমানুষী করে। জ্বর এলে যেন আরও ছেলেমানুষ হয়ে যায়। ঐশী বিয়ে করতে চাইতো না ঠিক। তবে সব মেয়েদের মাঝে যেমন বিয়ে, সংসার, স্বামী নিয়ে কিছু এক্সপেক্টেশন থাকে, তেমনি ঐশীরও ছিল। একসময় সে চাইতো তার স্বামী কেয়ারিং হবে, যে তাকে সম্মান করবে, ভালোবাসবে। পরে সে আস্তে আস্তে বুঝতে পারে এসবই আসলে ভ্রম। এগুলো কল্পনাতেই সম্ভব, বাস্তবে নয়। কিন্তু জয় তা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। সে যেমন জীবনসঙ্গী একসময় চাইতো জয় ঠিক তেমনই।

যদিও জয়ের এতো ছেলেমানুষী তার পছন্দ ছিল না। তবে যে তাকে এতো সুন্দর একটা পরিবার দিয়েছে, যার কাছ থেকে সে তার প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছে, এত্তো কেয়ার পাচ্ছে, এত্তো ভালোবাসা পাচ্ছে তার এটুকু সে মেনে নিতে পারবে না? এমন একটা জীবনসঙ্গী পেলে আর কি লাগে একটা মেয়ের?

জয় এবং তার পরিবার কখনো তাকে কোনোকিছু করতে বাঁধা দেয় না। বরং তাকে সবসময় সাপোর্ট দেয়। জয় এখনও সময় পেলেই ঐশীকে আনা নেওয়া করে। আর ইলোরা ইয়াসমিনের তো ঐশীর ডান্সক্লাসের প্রতি বেশ আগ্রহ। তিনি বেশ কয়েকবার গিয়েছেনও নৃত্যশৈলিতে। ঐশীর পড়াশোনা নিয়েও বেশ তৎপর তিনি।

জয় ঐশীর সব বিষয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে নজর রাখে। ঐশী জয়ের সাথে এখন সবকিছু বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে শেয়ার করে। তাদের সম্পর্কটা অনেকটা বেস্টফ্রেন্ডের মতো। সারাদিন বাইরে কি করেছে তা জয়কে না বললে তার ভালো লাগে না, জয়ও ঠিক তেমন। জয়ের উপর অটোমেটিক তার বিশ্বাস-ভরসা তৈরি হয়েছে।

যে তাকে জীবনের সব আনন্দ, স্বাচ্ছন্দ্য, প্রাপ্য সম্মান, যত্ন, ভালোবাসা দিচ্ছে। তার একটু ছেলেমানুষী সে সহ্য করতেই পারে। বরং আজকাল এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। জয় এখন ওর সাথে ছেলেমানুষী না করলেই বরং তার ভালো লাগে না। খালি খালি লাগে। এমন একটা জীবনসঙ্গীর এমন ছোটো ছোটো আহ্লাদী মেনে নেওয়া কোনো ব্যাপার না। হোক না লোকটা একটু ছেলেমানুষ। জয় যেমন ঐশীর জীবনসঙ্গী, তেমন সেও তো জয়ের জীবনসঙ্গী। জয় যদি তার এতো এতো বদঅভ্যেস মেনে নিতে পারে, তাহলে সে জয়ের ছেলেমানুষী মেনে নিতে পারবে না!

এসব ভেবেই তার চোখ দিয়ে একফোঁটা প্রাপ্তির জল গড়িয়ে পড়ে। সে জয়ের কপালে একটা চু’মু একে দেয়। এরপর সাবধানে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। ওযু করে নামাজ আদায় করে। ঐশীর প্রতি মোনাজাতে এখন জয়ের জন্য কল্যাণ কামনা থাকে।

নামাজ শেষে কিছু সূরা পাঠ করে জয়ের সারা শরীরে ফু দিয়ে দেয়। জয়ের শরীরের তাপমাত্রাটা এখন একটু কম। রান্নাঘরে গিয়ে সবার জন্য নাস্তাও বানিয়ে নেয়। ইলোরা ইয়াসমিন উঠে ছেলের জ্বরের কথা শুনে অস্থির হয়ে পড়ে। জ্বর আপাতত কমেছে আর জয় ঘুমাচ্ছে বলে তাকে অস্থির হতে মানা করে ঐশী। জয় উঠলে তাকে খাইয়ে দেয় ইলোরা ইয়াসমিন।

—————————————-

জ্বরটা জয়কে বেশ ভালোই ভুগিয়েছে। যদিও সে এখন একদম সুস্থ। হাসপাতালে যাওয়ায়ও শুরু করে দিয়েছে। এই চারদিনে জয় এক নতুন ঐশীকে দেখেছে। ঐশী এই কদিন জানপ্রাণ দিয়ে জয়ের দেখভাল করেছে। জয় বুঝতে পারছে ঐশী আস্তে আস্তে তার উপর দূর্বল হয়ে পড়েছে। এই কদিন ঐশী নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছিল। চোখে মুখে জয়ের জন্য চিন্তা-কষ্ট স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তার চিন্তায় যে মেয়েটার চোখ ভিজে উঠতো সেটাও সে বেশ ভালো করেই জানে। রোগী দেখার ফাঁকে এসব ভেবেই জয় হেসে উঠে।

এরমধ্যেই জয়ের ফোনে ঐশীর কল আসে। সে মুখে হাসি নিয়েই কলটা রিসিভ করে। ঐশী তার বাসায় যাবে সেটাই জানায় জয়কে। জয়কে নিজের খেয়াল রাখতে বলে আরও টুকটাক কথা বলে ফোন রেখে দেয় ঐশী।

—————————————-

ঐশী তার বাবার বাসায় এসেছে। বেশ কয়েকদিন ধরে তার মা বাবা তাকে আসতে বলছিল। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই আসে নি। বিয়ের এই সাড়ে চারমাসে সে দুইবার বাবার বাসায় এসেছে। এখন বাসায় আসলে তার বাপ মায়ের এই অতিরিক্ত আহ্লাদ তার খুব বিরক্ত লাগে।

এসেছে অনেকক্ষণ হলো। যাইহোক ঐশীকে তো আর না খেয়ে যেতে দিবে না। তাই ঐশী খাবার টেবিলে বসে গেছে খেতে। ঐশীর দুপাশে তার মা আর বড়খালা বসে আছে। সে বুঝতে পারছে তারা কিছু বলতে চায় তাকে। ঐশী বুঝেও না বোঝার ভান করে খাচ্ছে।

ঐশীর মা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

“ এই তোর ওই ননদ এহনো তোরার বাসাতেই থাহে?”

ঐশী খেতে খেতেই জবাব দেয়, “ কে?”

“ ওই যে তোর শাশুড়ী যারে পালতাছে ছোট থিকা।”

ঐশী খাওয়া থামিয়ে তার মায়ের দিকে তাকায়। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ থাকবে না কেন? কই যাবো ও?”

“ না ভর্তি পরীক্ষা না দিতাছে? ”

“ হুমম…. চট্টগ্রাম হইছে, রাজশাহীতে ওয়েটিং এ আছে। এহন দেখি কি হয়।”

“ এতো না পড়াইয়া বিয়া দিলেই তো পারস। মাইনসের পোলাপানরে আর কতই টানবি তোরা?” — ঐশী তার বড় খালার কথায় কোনো জবাব দেয় না।

“ শোন আমি তোর মা। তোর খারাপ তো আর চাই না। সোজাসাপ্টা কই। তোর ননদরে ভালো একটা ছ্যারা দেইখা বিয়া দিয়া দে। অনেক তো পালছে। এহন আবার ভার্সিটি ভর্তি হইতাছে। বিয়া দিয়া দিলে জামাইয়ের টাকায় পড়বো নি। তোরার নিজেরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। আর জামাই যে বিদেশ যাইতাছে। একটা বাচ্চাও তো নিলি না। এহনই একটা বাচ্চা নিয়া নে। নইলে আবার কহন কি হইয়া যায়। বাচ্চা থাকলে জামাইয়ের একটা পিছুটান থাকবো। মায়ের কথা শোন। জীবনে তো কোনো কথা শুনলি না। এহন শুইনা দেখ, তোরই লাভ হবো।”

ততক্ষণে ঐশী খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে এসে আবার চেয়ারে বসে পড়েছে। হাত মুছতে মুছতে হাসিমুখে বলে,

“ এহনও শুনবো না। আমার এতো লাভের দরকার নাই। আমার সংসার, কহন কি করা লাগবো তা আমিই ভালো জানি। আমার ননদ, ভালো কইরা শোনো আমার ননদ। পালিত হোক আর যা খুশি তা হোক। আমার শাশুড়ী ওরে নিজের মেয়ের মতো ছোট থেইকা বড় করতাছে। আমার জামাই ওরে আপন বোন মানে। ওরার কোনো সমস্যা নাই, আমারও কোনো সমস্যা নাই। তাই ওর বিষয়ে কি ভালো হবো না হবো তা ভাবার জন্য ওর মা ভাই আছে, আমি আছি। আমরা জানি ওর জন্য কি উচিত।
আমার শাশুড়ীও আমারে এহন পর্যন্ত বাচ্চা নেওয়া না নেওয়া নিয়ে কিছু বলে নাই। আমি জানি সে এখনও এমন কিছু চিন্তাও করে নাই। বাচ্চা দিয়া যদি জামাই ধইরা থাকা লাগে, অমন ধইরা থাকা আমার লাগবো না। বিদেশ গিয়া ঠিক থাকার হইলে এমনেই থাকবো। বাচ্চা লাগবো না, আমরাই যথেষ্ট।” একদমে কথা বলে একটা শ্বাস নিয়ে আবার বলে,

“ শোনো মা। আমার সংসার আমার মতো কইরা চালাইতে দেও। তোমার সংসারে কিন্তু আমি কোনো কথা বলি নাই। তোমার সংসারে একটা ডিম ভাজতে গেলেও দশবার ভাইবা চিন্তা তোমার কাছ থিকা অনুমতি নিয়া ভাজতে হইছে। তাই আমার সংসারে তুমি নাক গলাবা না। আমার সংসারের জন্য কি ভালো হবো তা আমি বুঝবো। ওইডা কেবল আমার সংসার না, ওইডা আমার পরিবার। আর আমি আমার পরিবার নিয়া খুব খুব খুব সুখে আছি শান্তিতে আছি। যা আমি তোমরার কাছ থিকা কোনোদিন পাই নাই। তাই আমার পরিবার, আমার সংসার থিকা দূরে থাইকো। আসি।”

আর কিছু না বলে তার মা খালাকে পিছনে রেখে সে বাসা থেকে বের হয়ে আসে। সংসার জীবনে অন্যকারো দখলদারি না মানায় ভালো। হোক সে মা। আমাদের সমাজে এমন অনেক সংসার আছে যা মায়ের প্ররোচনায় ধ্বংস হয়ে যায়। ভালো চায় ভালো চায় বলে সংসারের ক্ষতিটা তারাই করে দেয়। আজকে যদি ঐশী তার মায়ের কথা শুনে কোনো স্টেপ নিতো তাহলে এখন যেই সুন্দর সংসার বিদ্যামান তা কি ভবিষ্যতে থাকতো? কখনোই না।

ঐশীর মায়ের মতো এমন মায়েরা মেয়েদের কানে কুমন্ত্রণা দিয়ে সংসারে অশান্তির সৃষ্টি করে। সংসার কেবল স্বামী স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে না। পরিবেশ, পরিস্থিতি ভেদে তা ভিন্ন হতে পারে। তবে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে মিলেমিশে থাকাটাই অন্যরকম একটা তৃপ্তি।

#চলবে

[ কপি করা নিষেধ। কেমন লাগলো জানাবেন।

আশা করি নেক্সট পর্বে শেষ হয়ে যাবে। একটা পর্বই করতে চেয়েছিলাম। বাট একটা পর্ব করলে অনেক বড় পর্ব হয়ে যাচ্ছিল। আর সমস্যার কারণে এতটুকুই লিখতে পেরেছি। আগে কিছুটা লিখা ছিল। আশা করি বিষয়টা আপনারা বুঝবেন। 🙂🙏]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here