হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ১৪)

0
364

#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ১৪)
নুসরাত জাহান লিজা

মিফতাকে সেদিনই হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে দেয়া হয়েছে। যতক্ষণ হাসপাতালে ছিল, নওমীও সেখানে থেকেছে। নীরব আর মাহমুদ সাহেব এসেছিলেন। তাদের সাথেই সে বাসায় ফিরেছে।

এরপর আর মিফতার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। সেদিন যে স্বীকারোক্তি শুনেছে তাতে করে নওমীর মনে হয়েছে ওদের মধ্যে আর কথা না হওয়াই ভালো। সে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত দিতে চায় না।

মাস্টার্সে ভর্তির প্রক্রিয়া নিয়েও বেশ দৌড়ের উপরে থাকতে হয়েছে নওমীকে। ওপ্রান্ত থেকেও আর কোনো কল আসেনি। এটাও ওর মানতে কষ্ট হচ্ছে। যদি ভালোই বাসে, তাহলে এমন নিস্পৃহতা কেন দেখাবে! অন্ততঃ একবার কল করে হলেও তো বলতে পারে,

“আমি কিন্তু মিথ্যে বলিনি।” যা মিফতা বলেছিল মাথায় আঘাত নিয়ে। হৃদয়ের সমস্ত আবেগ জড়িয়ে!

তখন নওমীর মাথা কাজ করা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রবল ভয়ে। যদি গাড়িটার গতি না কমাতে পারতো, যদি.. এরকম ভয় অমূলক নয় নিশ্চয়ই। তখন কোনো কথাই অনুভব করতে পারেনি।

কিন্তু পরে যখন ভেবেছে, তখন সেই সময়টার এত স্পষ্ট ছবি ভেসে ওঠেছে, সেই সময়ে মিফতার যে অভিব্যক্তি ছিল, সব যেন ছায়াছবির মতো মানসপটে ভাসছিল। কতটা অপরিসীম সাহস হলে এভাবে ঝাপিয়ে পড়া যায়, তার জন্য কতটা হৃদয়ের গভীরতা আর বিশালতার প্রয়োজন হয় সেটা নওমীর উপলব্ধিতে ধরা পড়েছে।

এসবকিছুর পরেও বিয়ে তাকে করা যায় কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধা কাটেনি ওর। বড্ড অবিবেচক মনে হয়, মুখে লাগাম নেই, আরও অসংখ্য বিচ্যুতি তার। সবচাইতে বড় কথা অবচেতনে যে কাল্পনিক অবয়ব আঁকা সে মিফতার মতো কেউ নয়। এখানেই ওর আপত্তি।

শায়না দুই কাপ চা নিয়ে এসে ওর দিকে একটা বাড়িয়ে দিল। বিছানায় নওমীর পাশে বসে জিজ্ঞেস করল,

“কী রে! আর কত সময় নিবি? এবার তো একটা ডিসিশন তাদের জানাইতেই হবে।”

নওমী তবুও যেন নিস্প্রভ, “ভাবি, আমি বুঝতেসি না, কী করা উচিত!”

“কেন? দেখ, প্রথম থেকেই আমরা মিফতার এই জিনিসটা সম্পর্কে জানতাম। বাবা আর নীরব এরজন্যই তোরে বারবার বোঝাচ্ছিল। তুইও তো জিজ্ঞেস করতি যে এত পাত্র থাকতে ওকেই কেন সবাই পছন্দ করল? তুই এখন নিজেই দেখলি তো।”

নওমী চমৎকৃত হয়েছে ভীষণভাবে, মানুষকে চিনতে আসলেই বিস্তর সময়ের প্রয়োজন। দূরে দূরে থাকলে যেমন মনে হয়, একটু কাছে এলে অনেকসময় একই মানুষের প্রতি ধারণা আমূল পাল্টে যায়! কী অদ্ভুত এই চেনা অচেনার আলো আঁধারি খেলা! স্পষ্ট তবুও ঝাপসা।

“ভাবি, উনি নিঃসন্দেহে খুব ভালো মানুষ। তবুও কেন যেন আমি উনাকে আমার সোলমেট হিসেবে ভাবতে পারতেসি না। ফিরিয়ে দিতেও খারাপ লাগতেসে। এভাবে এগুনো কি ঠিক হবে?”

নওমী মুখে যে কথাগুলো বলল, এসব এই এক সপ্তাহ ভাবনার প্রতিফলন। ভীষণ জটিল একটা সমীকরণ যে এই সিদ্ধান্তটা। যত সমাধানের পথে এগিয়ে যায়, তত যেন জটিলতা বাড়ে। ফলাফল অসংজ্ঞায়িত থেকে যাচ্ছে বারবার।

“বাবা, আজকেই ফাইনাল ডিসিশন শুনতে চান। তুই একবার তার সাথেই কথা বল।”

শায়না যাবার আগে দেখল নওমী চায়ের কাপটা একইভাবে হাতে নিয়ে বসে আছে। একটা চুমুকও দেয়নি তাতে।

যা গ্রহণ করতেও সায় নেই, ছাড়তেও কষ্ট হয়, এর মতো বিড়ম্বনার জীবনে আর কিছুই বোধকরি নেই!

***
মিফতা প্রথম দু’দিন ভীষণ প্রতীক্ষায় ছিল, হয়তো একবার নওমীর কল আসবে। ওর কথার উত্তর না দিক, অন্তত শারীরিক অবস্থা জানতে চাইবে। এটুকু সৌজন্যবোধ আশা করা কি ভুল! শেষ পর্যন্ত একজন পাষাণীর প্রেমেই কিনা সে পড়ল, যেমন-তেমনভাবে নয়, একেবারে হাড়গোড় ভেঙ্গে!

পরেরদিকে সে বুঝতে পারল, নওমী নিজের সিদ্ধান্তে অটল আছে। একবিন্দু সরেনি। তখন একবুক অভিমান আসন গেড়ে বসল। ভেতরটা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল। ঠিক করল, সে আর কল করে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে না। নিজেকে প্রকাশ করা হয়ে গেছে, এরবেশি ওর আর তো কিছু করার নেই।

তবুও একটা ইতিবাচক মতামতের জন্য যেন অন্তহীন প্রতীক্ষা! কল এলেই মনে হয় এই বুঝি নওমী! কিন্তু প্রতিবারই হৃদয় ভাঙে।

এই কদিনে ওর মধ্যে বেশ ভালো রকম পরিবর্তন হয়েছে। নিজের অবচেতনেই হয়েছে। প্রথমদিকে যদিও পাত্তা দেয়নি, কিন্তু এখন ভালোই টের পাচ্ছে। এই তো গতকালই বাইরে থেকে এসে নিজের কাপড়টা সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে।

অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় গড়িয়ে গেলেও শুয়েই ছিল। মালা এসে জানালার পর্দা ঠিকঠাক করে দিলেন।

“তোর সাথে কিছু কথা আছে বাবু।”

মিফতা চোখ খুলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। মালাকে কেমন যেন বিষণ্ণ লাগছে। তিনি মিফতার পাশে এসে বসলেন।

“ওরা না করে দিয়েছে।”

মিফতা প্রথমে বুঝতে পারল না, মালার পরের কথায় পরিষ্কার হলো, “আমরা অন্য জায়গায় মেয়ে দেখব তোর জন্য।”

শেষ আশাটুকুরও সমাধি রচিত হলো যেন। শ্বাস ভারি হয়ে আসছিল মিফতার। একসময় যে বিয়েটা ভাঙার জন্য চেষ্টায় নেমেছিল, সেই বিয়ে ভাঙলে এতটা ভাঙচুর হবে এটা সে কখনোই ভাবতে পারেনি।

“মা, আমার মধ্যে অনেক বাজে অভ্যাস আছে। সেসব চেঞ্জ না করে মেয়ে দেখো না। তাছাড়া আমার একটু সময় লাগবে।”

মালা ছেলের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠা বেদনাটুকু পড়তে পারলেন যেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “বিয়েটা আল্লাহর ইচ্ছা। যেখানে লেখা আছে সেখানেই হবে। তুই কষ্ট পাস না বাবু।”

মিফতা নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছে প্রাণপণে, “কষ্ট হবে কেন! তোমার ছেলেকে কেউ রিজেক্ট করসে, প্রথম রিজেকশন তো? ওই একটু ইগোতে লাগসে। দুই দিনে ঠিক হয়ে যাবে।”

মিফতার অভিব্যক্তি ওর মুখকে সঙ্গ দিল না এবার। তীব্র হতাশার ছাপ সে কিছুতেই মুছতে পারল না, না মুখাবয়ব থেকে না কন্ঠ থেকে!

মালা ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, “আমি তোর মা বাবু। আমার কাছে তুই চিরকালই শিশু। আমার কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে যাস না। ওত বড় হোস না।”

মিফতা মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। কোনো কথা বলল না। কেবল মায়ের কোল ভিজিয়ে দিল চোখের জলে। সেই অশ্রুজলের সাথে কেবল ব্যথা ঝরল নিঃশব্দে।

***
মাহমুদের ঘরে ডাক পড়ল নওমীর। সে এসে দেখল পরিবারের সকল সদস্যই সেখানে উপস্থিত।

মাহমুদ বললেন, “আমার পাশে এসে বোসো।”

নওমী বসল। বাবা রেগে থাকলে তুমি করে কথা বলেন। এখন তিনি বেশ নাখোশ।

বাবা বললেন, “দেখো নওমী, বিয়েটা ছেলেখেলা নয়। তাই মনে দ্বিধা রেখে না এগুনোই ভালো। আমি জামিলকে বুঝিয়ে না করে দিলাম। এতে আমাদের বন্ধুত্বে প্রভাব পড়বে না আশাকরি।”

প্রথমে নওমী কথাটা শুনে বেশ স্বস্তিই পেল। আর এমন দোলাচালে দুলতে হবে না। স্বস্তিটুকু সাথে করেই নিজের ঘরে এসেছিল। সমস্যার শুরু হলো তারপর থেকে।

বারবার মনে হচ্ছিল, না এটা সে চায়নি। জীবন থেকে আচমকা যেন রঙ হারিয়ে ধূসর হয়ে গেল। বড্ড বিবর্ণ মনে হচ্ছিল সবকিছু। আহত মিফতার সেই আর্তি যেন ওর মনে বিষকাঁটার কামড় বসাচ্ছিল হৃদপিণ্ডে!

খুব বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল যেন, পুরো পৃথিবীটা যেন সহসা শূন্য হয়ে গেল। এর ক্ষতিপূরণ সে কী করে দেবে! শূন্যতা পূরণ করতে ওই ঘাড়ত্যাড়াকেই লাগবে নওমীর।

যে কারণগুলো ছিল প্রত্যাখ্যানের তার কোনোটাই এখন আর যৌক্তিক মনে হচ্ছে না। আর যৌক্তিক মনে হলেও ধূপে টিকছে না। মিফতাকে ওর ভালো লাগছে, এই কারণটাই যথেষ্ট সহস্র যুক্তিকে উড়িয়ে দেবার জন্য।

কিন্তু এখন এসব ভেবে সত্যিই কি কোনো লাভ আছে! সব তো শেষ করেই দিয়েছে সবাই মিলে। বড্ড দেরি হয়ে গেল হৃদয়ে আঁকা ছায়াটার স্পষ্ট অবয়বের দেখা পেতে।

দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে নওমী টেবিলে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
……….
(ক্রমশ)
শেষ পর্বের অপেক্ষা ইনশাআল্লাহ। কেমন লাগল আজকের পর্ব?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here