অনুগল্পঃ_একটু_চাওয়া

0
1171

#অনুগল্পঃ_একটু_চাওয়া
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

বিয়ের প্রথম রাতে আমি দেখলাম আমার স্বামী অন্য একটা মেয়ের ছবি বুকে নিয়ে কাঁদছে। বড় একটা ঘোমটা টেনে বিছানায় বসে ছিলাম আমি। বিয়ের প্রথম দিনই অন্য একটা মেয়ের ছবি নিয়ে স্বামীকে কান্না করতে দেখলে কারই বা ভালো লাগে। হয়তো এই সৌভাগ্যটা তার কপালেই লিখা ছিলো।
বাসর রাতেই আমার স্বামি তৌসিফ আমায় সোজাসুজি ভাবে বলে দিয়েছে, আমি যেনো কখনোই তার কাছে স্ত্রীর অধিকার না চাই। তার স্ত্রীর অধিকার চাওয়ার মতো একজনই ছিলো সে হলো, মাহিয়া আপু। আমার স্বামী তৌসিফের প্রথম স্ত্রী। বিয়ের দুই বছরের মাথায় ‘মুনতাহা’ কে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে সে। এরপর আর বিয়ে করেনি সে।
মুনতাহার এখন পাঁচ বছর। মায়ের শুন্যতায় মেয়েটা কেমন মন মরা হয়ে থাকে সারাক্ষন। বার বার তার বাবাকে গিয়ে বলে,
– আমার আম্মু কই বাবাই, সবার আম্মু থাকে আমার আম্মু নেই কেনো? আমারও আম্মু চাই। আমার আম্মুকে এনে দাও আমার কাছে।
,
,
আমি আঁখি মধ্যবিত্য পরিবারের একটা মেয়ে। অনার্স ২য় বর্ষে পড়ি। আমার স্বামী তৌসিফ বিয়ের আগে একবারও দেখেনি আমায়। আমার শাশুরি ই আমায় দেখে তার ছেলের বৌ বানিয়েছে। বড় ঘরের প্রস্তাব, ছেলেও ভালো। সব শুনার পর বাবাও রাজি হয়ে যায়। আর বাবার মতের বাইরে কিছু বলার সাহসও আমার কখনো ছিলো না। তাই তার মতের উপরই সব কিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে।

মুনতাহা সব সময় আমার পাশে বসে থাকে। প্রয়োজন না থাকলেও সারাক্ষন আম্মু আম্মু বলে ডাকতে থাকে। মনে হয় শব্দ গুলো এতোদিন বন্ধি হয়ে ছিলো বুকের ভেতর।
হুটহাট আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরে। আমার স্বামী প্রয়োজন ছারা আমার সাথে তেমন একটা কথা বলে না।
প্রথম দুই একদিন খুব খারাপ লাগতো আমার। কিন্তু এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। পরিবারের সবাই খুব ভালো অল্প কিছুদিনেই খুব আপন করে নিয়েছে আমায়। এখন আমি এই পরিবারেরই একজন। মাঝে মাঝে মনে হয় এটা আমারই পরিবার। মুনতাহা ও সত্যিই আমারই মেয়ে।

গোচগাছ আমার বরাবরই খুব পছন্দ। কিন্তু লোকটা খুব আগোছালো, চলা-ফেরা জিনিস পত্র সব আগোছালো হয়ে থাকে।
সে অফিসে চলে গেলে আমি সব গোচগাছ করছিলাম। তখনই একটা ডায়রি হাতে পেলাম আমি। ডায়রিটা হতে নিয়ে দেখলাম অনেক কিছুই লেখা ডায়রির পাতায়। যদিও কারো অনুমতি ছারা কিছু দেখা অপরাধ, তবুও নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই আগ্রহটা একটু বেশি আমার। খুলে দেখি অনেকদিন ডায়রিটায় কিছু লিখা হয় না। কয়দিন আগের শুধু কয়েএকটা লেখা দেখলো শেষ পাতায়।
“সরি রে আমার মিহু পাখিটা। স্বপ্ন ছিলো সারা জীবন একসাথে কাটাবো দুজন। কিন্তু আমার সেই স্বপ্নটা ভাগ্যের হয়তো পছন্দ হয়নি। নিয়তি কেড়ে নিয়েছে তোমাকে আমার কাছ থেকে। জানো মুনতাহা মাঝে মাঝে খুব কাঁদে তোমার জন্য। সে তোমাকে না দেখলেও, তোমার জন্য তার চোখে মুখে শুন্যতার ছাপ ঠিকই ভেসে উঠে। খুব মায়া হয় মেয়েটার জন্য। প্রতিদিনের মতো আজও তোমায় খুব মিস করছি আমি। তোমার মতো তো কেও হাত দিয়ে চুলে আর বিলি কাটে না। কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় না। শুধু মাঝে মাঝে স্বপ্নে এসে হাতছানি দিয়ে চলে যাও। আমি আজও তোমায় ভালোবাসি রে মিহু পাখি। সারা জীবন বাসবো। যাই হোকনা কেনো? তোমার প্রতি ভালোবাসাটা একই থাকবে সারা জীবন। ভালোবাসি খুব।

আমি ডায়রিটা একজায়গায় যত্ন করে রেখে দিলাম। সময় হলে পড়ে দেখবো। তখনই হাতে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। বাবা ফোন দিয়েছে। ফোন রিসিভ করে বারান্দায় চলে গেলাম আমি।
কথা শেষে ডায়রিটা নিয়ে বসলাম,,,,
,
,
দুপুরে খুব সাহস নিয়ে ওকে ফোন দিলাম। কেমন জানি নার্ভাস ফিল হলেও ফোনটা ধরে রইলাম কানের কাছে।
– হ্যালো,,,
– খেয়েছেন?
– নাহ্,,,
– কখন খাবেন?
– পরে,,,
– সময় মতো খাবার না খেলে শরির খারাপ হয় জানেন না? খেয়ে নিন।
তৌসিফ কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে রইলো। মাহিয়ার কথা মনে পরলো হুট করে। সে ও তো এভাবে রোজ নিয়ম করে ফোন দিতো। তৌসিফ ছোট্ট করে বললো,
– হুম আচ্ছা,,,
বলেই ফোন রেখে দিলো।
,
শিতল হাওয়া বইছে। ছাদের এক পাশে দাড়িয়ে আছে সে। আমি একটা কফি বানিয়ে তার পাশে দাড়ালাম। তার দিকে কফির কাপ টা বাড়িয়ে আমি আবার হাটা ধরলাম। সে পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললো,
– তোমার কপি কোথায়?
আমি চুপ করে রইলাম, কারণ আমি কফি খাই না। তবে এবার থেকে অভ্যাস করতে হবে।
,
আমি ডায়রিটা পড়তাম মাঝে মাঝে। মাহিয়া আপুকে নিয়ে অনেক কিছুই লেখা আছে এই ডায়রিতে। সত্যিই তাদের ভালোবাসাটায় অন্য রকম একটা ফিল ছিলো৷ যা চোখ বন্ধ করে মাহিয়া আপুর জায়গায় নিজেকে বসালে উপলব্দি করা যায়।

আমি খাটে ঘুমাই, আর সে ঘুমায় সোফায়। গভির রাতে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছি। ঘুম আসছেনা কিছুতেই। সোফায় সুয়ে থাকা মানুষটা কেমন যানি শব্দ করছে। তার পাশে গিয়ে বসলাম। দেখি জ্বরে গা পুরে যাচ্ছে।
তাকে ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলাম। এতো রাতে আমি কি করবো? বাবা মা কে ডাকা কি ঠিক হবে?
না তারা মুরুব্বি মানুষ। ঘুম থেকে ডেকে তোলা ঠিক হবে না। একটা বাটিতে পানি আর একটা কাপর এনে জলপট্টি দিতে থাকলাম তাকে। সে আমাকে বার বার ঘুমাতে বলছিলো। কিন্তু তাকে এভাবে রেখে আমার কিছুতেই ঘুম আসছিলো না।

আমি সারা রাত তার মাথার কাছে বসে ছিলাম। আর জ্বর কমা অব্দি জলপট্টি দিতে থাকলাম। সকালে তার ঘুম ভাঙলে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। তার চোখের ভাষায় আমি কিছু না বুঝলেও এটা বুঝতে পারছি, সে হয়তো আমাকে কিছু বলতে চেয়েও পারছে না।
সেদিন সে আর অফিসে যায় নি। তার পাশে সারাদিন থাকার সৌভাগ্য হলো আমার। তার সেবায় নিয়োজিত থাকলেও খুব ভালো লাগছিলো আজ। আজ আমি তার এতো কাছে বসে ছিলাম সারাদিন সেও কিছু বলেনি।
,
সময়টা ছিলো বিকেল। মুনতাহা আমার হাত ধরে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে এলো। আমার চোখে একটা কাপর বেধে বললো, কানামাছি খেলবে। আমার চার পাশে ঘুরতে থাকে মুনতাহা। মনে অসম্ভব আনন্দ সাথে প্রশারিত হাঁসি। তৌসিফ কখন এসেছিলো বুঝতে পারিনি। ছাদের এক পাশে দাড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলো আমাদের দিকে।
আমি চোখ বাধা অবস্থায় এখনো মুনতাহাকে খুজছি। মুনতাহা তৌসিফকে টেনে এনে আমার সামনে দাড় করালো।
কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে যেতেই কেও একজন ধরে ফেললো আমায়। চোখ থেকে কাপর টা সরিয়ে দেখি সে আমায় ধরে আছে। পাশে মুনতাহা নেচে নেচে হাত তালি দিচ্ছে। একটা লজ্জা জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেখান থেকে দৌড়ে চলে যাই আমি।
আমি রুমে এসে বসে আছি। মুনতাহা দৌড়ে এসে বললো,
– আম্মু আম্মু তারাতারি রেডি হও আমরা ঘুরতে যাবো, বাবাই নিয়ে যাবে।

সে একটা নীল পাঞ্জাবি পড়ে নিলো। আমিও একটা নীল শাড়ি সাথে নীল চুড়ি পড়ে নিলাম। মুনতাহা আমাদরের মাঝখানে এসে দাড়িয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তোমাদের খুব মানিয়েছে বাবাই।
বিকেলটা ছিলো আমাদের। সাথে অন্য রকম একটা আনন্দ। তার কাছে আমার একটু চাওয়ার মাঝে এই আনন্দটাও অন্যতম।
মাহিয়া আপুর কবর জিয়ারত করে এলাম আমরা। ফিরার পথে তার চোখে দেখতে পেলাম বিষণ্নতার ছাপ। আমি ও হাটছি তার সাথে। আমাদের দুজনের দুইটি আঙুল ধরে মাঝখানে হাটছে মুনতাহা। সময়টা আজ সত্যিই সুন্দর।
,
,
পরদিন সকালে সে অফিসে যাওয়ার সময় আমি পেছন থেকে ডাক দিয়ে তার সামনে গেলাম। তার টাইটা বাধা হয়নি ঠিক করে। ঐ যে বলছিলাম ‘বেখেয়ালি’।
টাইটা ঠিক করে তার দিকে চেয়ে বললাম,,
– মাহিয়া আপুর মতো আমার জন্যও কি, ফেরার পথে ফুল আনতে ইচ্ছে করেনা?
সে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমাকে চমকে দিয়ে হুট করেই আমার কপালে একটা চুমু একে দিলো। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
– তুমি আসলেই মাহিয়ার প্রতিবিম্ব।
সে চলে গেলো, আমি এখনো সক্ড হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে আমার ‘একটু চাওয়া’ আমি আজ পেয়ে গেছি।

,,,,,,,,,,,,,,সমাপ্ত,,,,,,,,,,,,,,,

~~ ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here