আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ #মাইশাতুল_মিহির [পর্ব-০৪]

0
1864

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-০৪]

‘শান্তিনিবাস’ সর্বদা প্রাণোচ্ছল থাকে। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা মিলেমিশে হাস্যউজ্জল করে রাখে শান্তিনিবাস। একে অপরের প্রতি অঢেল আন্তরিকতা প্রবল সবার। বাড়ির পরিবেশটা কোলাহলে ভরপুর। অভিজাত্য ড্রয়িংরুমে বসে জমিয়ে আড্ডা হচ্ছে। অন্যদিকে টুংটাং ধ্বনি রান্না ঘর থেকে ভেসে আসছে। বড়দের জোরপূর্বক তাদের নিজেদের কক্ষে পাঠিয়ে দিয়েছে সবাই। খেলায় হেরে যাওয়ায় আরিয়ান এখন রান্না ঘরে ব্যস্ত। এতো বড় কাজ করার জন্য তাকে সাহায্য করা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বেচারা এক হাতে পেঁয়াজ কুচি করছে তো অপর হাতে চোখের পানি মুছচ্ছে। আর বাকিদের অবস্থা হেসে মাটিতে লুটোপুটি খাওয়ার মতো। দীবা অসহায় মুখে বসে রইলো। আরিয়ানকে সাহায্য করতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু তাকে সাহায্য করতে দিচ্ছে না কেউ। তাই মন ক্ষুন্ন। কিছুসময় পর রান্না ঘর থেকে আরিয়ানের করুন কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘তোরা এতো নি’র্দয়, পা’ষাণ আগে জানতাম না। একটু তো সাহায্য করে পারিস নাকি?’

রিমি ঠোঁট চেপে হাসলো। ঠাট্টার ছলে চেঁচিয়ে বললো, ‘আর কতোক্ষন আরু ভাই?’

আরিয়ানের চাপা কষ্টসহিত কন্ঠে ধমকে উঠলো, ‘কেন খাওয়ার জন্য আর তর সইছে না?’

সাবিত ফাজলামো করে বললো, ‘আরু আজ মেনো তে কি কি আছে রে?’

আরিয়ান কটাক্ষ করে বললো, ‘হাহ্ একটা রান্না করতেই আমার বারোটা বাজতাছে। আর উনি বলতাছে কি কি আছে। মেঘ নাই আবার জল খুঁজে।’

দীবা সবার দিকে অসহায় মুখে তাকালো। তারপর মলিন কন্ঠে বললো, ‘আমি একটু হেল্প করি? ভাইয়ার একা একা করতে বেশি কষ্ট হবে।’

রাইমা তাৎক্ষনাৎ দীবাকে শাসিয়ে বললো, ‘চুপ থাক তুই। আরু যখন একা একা মিশেলিন স্টার শেফদের রেসিপি ট্রায় করে তখন? তখন একা পারলে এখনো একা পারবে। সাহায্যের দরকার নেই।’

হতাশ হলো দীবা। সাহায্য করতে না পারায় আফসোস হচ্ছে তার। নুরা উৎসুক গলায় বললো, ‘এতো সুন্দর একটা সময়ে আরব ভাই মিসিং। ভাইয়াকে ভিডিও কল দিয়ে কথা বলি কি বলো?’

সবাই সম্মতি জানালো তার কথায়। রিমি চটজলদি উঠে রুম থেকে ল্যাপটপ এনে আবরারকে কল দিলো। সন্ধ্যার পরের সময় আবরার রুমে বসে কাজ করে। তাই কল আসায় তাৎক্ষনাৎ রিসিভ করতে পেরেছে। রিসিভ করার পর ল্যাপটপের স্কিনে পরিচিত প্রিয় মুখ গুলো ভেসে উঠতেই প্রসন্ন হাসি দিল আবরার। রিমি, নুরা আর সাবিত এক পাশে আর তাদের বিপরীত পাশের সোফায় রাইমা, দীবা। তাই তাদের দুজনকে আবরার দেখতে পায়নি। প্রথমে নুরা রিমি একে একে আজকে সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলতে লাগলো আবরারের কাছে। তিনজন মিলে আরিয়ানকে সেই লেভেলের প’চাঁ’নি দিচ্ছে। আবরারও আজ মন খুলে হাসছে তাদের সাথে। তাদের হাসাহাসির শব্দ শুনে রান্না ঘর থেকে আরিয়ান ক্ষুন্ন মনে চেঁচিয়ে বললো, ‘ভাই তুমিও এদের দলে? আমি একা একা সব করছি। মায়া হচ্ছে না?’

আবরার কন্ঠে আফসোস প্রকাশ করে বললো, ‘না না। আমি একদম তোর দলে। ওরা রীতিমতো তোর সাথে অন্যায় করছে। আহারে ভাই আমার একা একা কষ্ট করছে।’

আবরারের করা টিটকারি খুব সহজে আরিয়ান ধরে ফেললো। কপাট রুক্ষতার সাথে কিছু বলার আগেই রাইমা উঠে রিমির পাশে বসে বললো, ‘আরু ভাইয়ার রান্না কিন্তু অনেক ভালো। তুমি আজও মিস করবে।’

আবরার আলতোভাবে হাসলো। বললো, ‘হ্যাঁ জানি। রিমি নুরা ছবিও দিয়েছিলো।’

সাবিত বললো, ‘তুই মিস করছোস ভাই। একবার লম্বা ছুটি নিয়ে আসিস। তখন তোকে আরিয়ান নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে।’

নুরা হেসে বললো, ‘বেশি প্রশংসা করলে পরে ফোলে উড়ে যাবে।’

আরিয়ান রান্না ঘর থেকে অত্যন্ত অসহায়ত্ব কণ্ঠস্বরে বললো, ‘কেউ তো আমাকে সাহায্য কর। এতো নি’ষ্ঠু’র কেনো তোরা? রান্না শেষে সব তো ঠিকি পেটে ঢুকাবি। তাহলে এখন একটু সাহায্য করতে পারছিস না?

দীবা এতোক্ষণ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলো। স্থান প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ আসতেই চটজলদি দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, ‘আমি ভাইয়া কে হেল্প করে আসি।’

রিমি রাইমা বিজ্ঞব্যক্তিদের মতো ভ্রুঁ কুঁচকে বললো, ‘বাবাহ্, আরুর জন্য মায়া উতলে পরছে তোমার।’

আরিয়ান রান্না ঘর থেকে গর্বিত কন্ঠে দীবার হয়ে উত্তর দিলো, ‘আমার বোন হয় বোন। ভাইয়ের জন্য মায়া থাকবে তো কার জন্য থাকবে? তোরা যে আমার কুড়িয়ে পাওয়া বোন সেটা এখন আবারো প্রমান হলো দেখ।’

দীবা এক গাল হেসে বললো, ‘আমি যাই!’

দীবা রিমিদের পিছনের দিক দিয়ে রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। আবরার ল্যাপটপ থেকে শুধু মাত্র লাল কুর্তি পরনে কোমড় পর্যন্ত ছাড়া সিল্কি চুল ওয়ালী দীবার পিছনের দিকটা দেখলো। প্রতিটি কদমের সাথে সাথে দীবার চুল গুলোও ঢেউয়ের মতো দুল খেয়েছে। আবরার পলকহীন দৃষ্টি মেলে দেখেছিলো। চেহারা দেখে নি। তবুও কেন জানি অদ্ভুত মায়া কাজ করলো মনে। ঢেউ হেলানো চুল গুলোতে দৃষ্টি আটকে গেলো। এতো সুন্দর লম্বা চুল? হঠাৎ নিজের এমন ভাবনার কারণে হকচকিয়ে গেলো। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে মাথা থেকে দীবা নামক চিন্তা ঝেড়ে ফেললো তাৎক্ষনাৎ। অতঃপর ভাই বোনদের সাথে আড্ডায় মশগুল হয়।

অবশেষে দীর্ঘ তিন ঘন্টা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরিয়ান বিরিয়ানি, বোরহানি, গ্রিন সালাত। রান্নার ব্যাপারে বেশ আগ্রহ আরিয়ানের আর ভালো রাঁধুনিও বটে। রোশান আর হোসেন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে রাত আটটায়। আরিয়ানের বিরিয়ানি করেছে শুনে খুশী হলো তারা। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। নয়টায় ডাইনিং টেবিলে সবাই এক সাথে বসে খেতে লাগলো। নিশিতা, আয়শা, রোহানা খাবার সার্চ করে দিচ্ছে সবাইকে। তৃপ্তি সহকারে খেয়েছে সবাই। প্রশংসামুখর হলো প্রত্যেকে। আরিয়ানের খাবার বরাবরই পারফেক্ট হয়।
_____________

গভীর রাত! পিনপিন নিরবতা চারদিকে। আকাশে বোধহয় মেঘ জমেছে তাইতো চাঁদ কিছুক্ষণ পরপর উঁকি দিচ্ছে। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে পরিবেশ ঢেকে আছে। বারান্দার ডিভানের উপর বসে গিটারে টুংটাং সুর তুলছে আবরার। রিমিদের সাথে কথা বলার পর থেকে কেনো যেনো ভালো লাগছে না তার। বারবার লাল কুর্তি পরা মেয়েটার কথা মনে পরছে। মনে পরছে প্রতিটি পদচরণের সাথে সাথে দুল খাওয়ানো সেই কালো চুল গুলো। শুধু তো মেয়েটার পিছনের দিকটা দেখেছিলো সে। মুখটাও ভালো করে দেখেনি। তবুও কেন বারবার মেয়েটির কথা মনে পরছে? মনটা বিষন্নতায় ছেঁয়ে এলো। কারনটা তার জানা নেই।

চোখ বন্ধ করলো। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে উপভোগ করতে লাগলো নিরব পরিবেশটা। গিটারে আঙ্গুল চালিয়ে টুংটাং শব্দ তুললো। সাথে নিজেও গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো….

হঠাৎ শহরে, বৃষ্টি এলো যে,
প্রথম পলকে ছুঁয়ে যায়,
অচেনা চোখের, অল্প কাহিনী,
বৃষ্টির ফোটারা লিখে যায়।

ঝোড়ো হাওয়া, বেপরোয়া,
নৌকো ভাসায় মেঘেরা,
চোখে চোখে, কিছু কথা,
কি যেনো বলে আমায়।

শুধু শুধু মন আমার,
কেনো যে তোমাকেই কাছে চাই।
বারে বারে কেনো যে,
তোমার দিকে এভাবে তাকাই।

শুধু শুধু মন আমার
কেনো যে তোমাকেই কাছে চাই।
বারে বারে কেনো যে
তোমার দিকে এভাবে তাকাই।
_______________

প্রতিদিন সকালের মতো আজও রোশান বারান্দার ইজি চেয়ারে আয়েশী ভঙিতে বসে আছে। হাতে তার দৈনিক পত্রিকা। যার ‘প্রথম আলো’ সংবাদ পড়ছে তিনি। গম্ভীর তার মুখখানি। রোশানের পাশে বসে চা’য়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছে নিশিতা। বেশ কিছুসময় পত্রিকা পড়ার পর নিরবতা ভেঙ্গে চোখে মুখে গম্ভীরতা বিদ্যমান রেখে রোশান বললো, ‘নিশিতা তোমার ছেলেকে বুঝাও যে বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা না।’

স্বামীর কথা শুনে ধাতস্থ হলো নিশিতা। নিশব্দে চা’য়ের কাপ টি-টেবিলের উপর রাখলো। বারান্দায় ঝুলন্ত টবে লাগানো বেবি টিয়ারসের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্ষুন্ন মনে বললো, ‘কি করবো বলো। আজকালকার ছেলে মেয়েরা এমনই। কেউ হুটহাট করা বিয়ে মেনে নেয় না। সময় লাগে খুব।’

সংবাদপত্র থেকে চোখ তুলে নিশিতার দিকে তাকালো রোশান। টেবিলের এক পাশে পত্রিকা ভাজ করে রেখে বললো, ‘দেখো নিশিতা, দীবার বাবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে উনি নিজের প্রান দিয়েছে। এই কৃতজ্ঞতা আমি কখনোই পূরণ করতে পারবো না। দীবার প্রতি আবরারের এমন অবহেলায় আমি রোহানার কাছে লজ্জিত। ধর্মীয় ভাবে ওদের বিয়ে হয়েছে। আবরার তার স্ত্রীকে তার হক থেকে বঞ্চিত করছে।’

নিশিতা আহত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আল্লাহ দীবার বাবাকে জান্নাতবাসী করোক। আমিন!’

রোশান এবার বেজায় জোড় গলায় বলে উঠলো, ‘আবরার কে চট্টগ্রামে আসতে বলো।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশিতা। ভড়াট কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘কত বছর হলো ছেলেটা রেগে বাড়ি ছেড়ে গেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রাজি করিয়ে বাড়িতে এনেছিলাম। আবার হুট করে বিয়ে দেওয়ায় ছেলেটা রাতে না খেয়ে চলে গিয়ে গেছে। প্রায় তিন মাস হলো। আর আসবে বলে মনে হয় না।’

রোশান দৃঢ়রূপে অপ্রসন্ন গলায় বললো, ‘প্রথম থেকেই আমার দীবাকে ভালো লাগতো। বিয়েটা আমি আজ নাহয় কাল দিতামই।’

‘হুট করে বিয়েটা মেনে নিতে পারে নি ছেলেটা। সময় হোক মানিয়ে নিবে সব।’

ক্রোধান্বিত হলো রোশান। কন্ঠস্বরে রুক্ষতা বজায় রেখে গম্ভীর মুখে বললো, ‘বিয়ের তিন মাস হয়েছে এখনো বলছো সময় হোক? বিয়েটা কি ছেলেখেলা মনে করে তোমার ছেলে? তুমি তোমার ছেলেকে বুঝাও নিশিতা। মেয়েটাকে মেনে নিতে বলো।’

হতাশ হলো নিশিতা। জীর্ণ কন্ঠে আশ্বাস দিয়ে বললো,’ঠিক আছে। আমি আবরারের সাথে কথা বলবো।’ বলেই খালি কাপ হাতে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো সে। ছেলের এমন খেয়ালিপনায় নিশিতা নিজেও অসন্তুষ্ট।

চলমান…

নোট : রিচেক করা হয়নি। দ্রুত টাইপ করার কারণে বানানে ভুল থাকতে পারে। ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ। হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here