“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৭

0
3631

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে আরাফ তার আলমারি থেকে যা টাকা ছিলো বের করলো। মাত্র চার হাজার টাকা পাওয়া গেছে। নাজিয়া আরাফকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে দেখলো আরাফ টাকা গননা করছে। আলমারি থেকে চেক বই নিয়ে দেখছে। নাজিয়া পাশে এসে বললো,
– কত আছে?
– কেশ চার হাজার, আর ব্যাংকে জমা আছে আঠারো হাজার। ডেবিট কার্ডে কত আছে দেখতে হবে।
– খাবার গরম করেছি, এখানে নিয়ে আসবো?
– এসো।
নাজিয়া খাবার রুমে নিয়ে এলো, এইটুকু সময়ে আরাফ স্কুলের জন্য রেডি হয়ে গেল। আরাফ খাওয়ার সময় নাজিয়া আলমারিতে খুটিনাটি করে তার জমানো টাকা ও গহনা বের করলো। আরাফের কাছে এসে বললো,
– এখানে সাড়ে এগারো হাজার টাকা আছে। আর বালা এবং কানের দুল বিক্রি করলে পঞ্চাশ হাজারের মতো উঠে আসবে। অযথা ঘরে পড়ে আছে, এগুলো বিক্রি করে দাও।
আরাফ অবাক তার কথা শুনে! সে ঋণ পরিশোধের জন্য গহনা বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলছে! আরাফ বললো,
– মাথা খারাপ তোমার! বাবা-মায়ের দেওয়া বালা বিক্রি করে দিতে চাইছো শ্বশুরের ঋণ পরিশোধের জন্য!
– সমস্যা কি, নিজের পরিবারের জন্যই তো করছি। পরে আবার টাকা হলে গড়ে দিও।
– নাজিয়া, গড়ে দিও বললেই গড়া হয় না। সেই সুযোগ আর আসবে না কখনো। শেষ সম্বল তোমার এটুকু। গহনা বিক্রির কথা দ্বিতীয়বার তুলবে না। রাখো এগুলো।
বেশি কিছু বললে আরাফ রেগে যাবে তাই নাজিয়া কিছু বললো না। গহনা নিয়ে আলমারিতে তুলে রাখলো। আরাফ বললো,
– টাকা আবার রাখছো না কেন! এটাও রাখো।
– টাকা নিতে সমস্যা কোথায়!
– টাকাও লাগবে না। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
– এটা কেমন কথা! বিপদে কি এগিয়ে আসবো না! অযথা তো দিচ্ছি না! তাহলে? নাকি আমাকে এই পরিবারের কেউ মনে করো না! তাই নিতে পারছো না!
– আমি সেটা বলছি না। ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। তুমি এগুলো রেখে দাও, পরে অতি প্রয়োজনে কাজে লাগবে।
– আরাফ এটাও অতি প্রয়োজনই! আমি জানি, তুমি ইচ্ছে করে নিতে চাইছো না! এমন কেন তুমি! কেউ হেল্প করতে এলে সেটা গ্রহণ করবে না অথচ নিজে চিন্তা করে করে পাগল হয়ে মরবে! মাথা কি তোমার একাই আছে চিন্তা করার জন্য! কাল সারারাত যে একটুও ঘুমাতে পারোনি সেটা কি আমার অজানা! আমাকে এমন পর পর ভাবছো কেন! এই টাকা দিয়ে কি করবো আমি! আমার প্রয়োজন কি তুমি মেটাও না! তাহলে তোমার প্রয়োজনে আমি কোনো কাজে আসতে পারছি না কেন!
তাকে এখন ইগনোর করলে উল্টাপাল্টা ভাববে তাই আরাফ খাওয়ার দিকে মনযোগ দিয়ে বললো,
– ওকে রাখো।
খাওয়া শেষ করে নাজিয়ার এগারো হাজার টাকাসহ তার চারহাজার টাকা নিয়ে মোট পনেরো হাজার টাকা নিয়ে আলফাজ সাহেবের রুমে এলো। আলফাজ সাহেবের পাশে বসে দৃষ্টি নিচে নামিয়ে বললো,
– বাবা, এখানে পনেরো হাজার টাকা আছে। ব্যাংকে কিছু আছে, বিকেলে নিয়ে আসবো। তোমার কাছে কে কত টাকা পাবে বলো আমাকে। যা পারি দিয়ে আসবো।
আলফাজ সাহেব ছেলের দৃষ্টি নিচে দেখে নিজে খুব অপরাধ বোধ করলেন। হ্যাঁ, অপরাধ তো করেছেই! খুব বড় অপরাধ করেছে সন্তানদের কাছে লুকিয়ে। আর সন্তানরা এখন মাথায় ঝোক নিয়ে দৌড়াচ্ছে! কিছুক্ষণ আগে আশিক এসে তার টিউশনি থেকে আয় করা দশ হাজার টাকা দিয়ে গেছে। এখন আবার আরাফ এসেছে টাকা নিয়ে! তিনি আরাফের কাছে বললো,
– ক্ষমা করে দিস বাবা! খুব বড় অপরাধ করেছি আমি। পারলে ক্ষমা করে দিস এই বুড়ো বাপকে!
আরাফ মাথা উঁচু করে আলফাজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি বলছো এসব, বাবা! তুমি পিতা হয়ে কেন সন্তানের কাছে ক্ষমা চাইবে! ক্ষমা তো আমি চাইবো তোমার কাছে! কেননা তোমার যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে পারিনি এখনো! তাইতো বাবার ঋণের বোঝা টানতে পারছি না! এমনকি পরিবারের সদস্যদের কোনো খোজ খবর রাখতে পারিনা কখন কি হয়! জনগণ বাবার উপরা হাত তুলে, আর আমি কিছু বলার সামর্থ্য রাখি না! ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিত, তাই না বাবা! কুলাঙ্গার ছেলে আমি!
কথাগুলো বলতে বলতে আরাফের চোখ ভেজা ভেজা হয়ে উঠেছে! আলফাজ সাহেব স্পষ্ট দেখেছে এই দৃষ্টি আজ খুব কষ্ট প্রকাশ করছে! তিনি চুপসে গেলেন ছেলের কথায় এবং নিজেকে অপদার্থ ভাবতে লাগলেন!
আয়েশা বেগম এতোক্ষণ তাদের পাশেই বসে ছিলেন। তিনি উঠে আলমারি থেকে টাকা এনে আরাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এখানে বিশ হাজার আছে। দশ হাজার আশিক দিয়ে গেছে আর দশ হাজার আমি তোদের দেওয়া টাকা থেকে জমা করেছিলাম।
– আশিক টাকা কোথায় পেল?
– টিউশনি করে না দুইটা। সেই বেতনই জমা করছে। নে ধর।
আরাফ টাকা নিয়ে একসাথে করলো। বাবার কাছ থেকে লিস্ট করে নিলো কে কত পাবে। এই পয়ত্রিশ হাজার টাকা সে দেনা পরিশোধ করে একটু দেড়ি করেই স্কুল গেলো।
নাজিয়া খাবার এনে দিলো আলফাজ সাহেবকে।
– বাবা, খেয়ে নিন। না খেয়ে থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আপনার ছেলে ওষুধ এনে দিয়ে গেছে। ভাত খেয়ে ওষুধ খাবেন।
অত:পর আয়েশা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আম্মা, আপনার জন্য এখানে নিয়ে আসবো?
– লাগবো না! বাড়িতে মরা পড়ে আছে এদিকে আরেকজন আছে খাবার নিয়ে! কোনো চিন্তাই নেই! থাকবোই কি করে! নিজের বাপ এমন পরিস্থিতিতে পড়লে না বুঝতো!
আয়েশা বেগম এমন ভঙ্গিতে কথা বললেন যেন নাজিয়ারই সব দোষ! তবুও নাজিয়া তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। আয়েশা বেগমের খাবারও চুপচাপ রেখে নিজের রুমে এলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে একবার দেখলো, অত:পর আরাফের পড়িয়ে দেওয়া চেইনটা গলা থেকে খুলে হাতে নিলো। আলমারি খুলে মায়ের গড়ে দেওয়া বালা জোড়া হাতে নিলো। চোখে তার পানি টলমল করছে! নিচের দিকে তাকিয়ে থাকায় গাল না গড়িয়ে পানি সোজা মেঝেতে পড়ছে! অত:পর চোখ মুছে কানের দুল, চেইন ও বালা জোড়া নিয়ে আলফাজ সাহেবের রুমে এলো। আলফাজ সাহেব এখনো খাবারে হাত লাগায় নি। নাজিয়া তার গহনা এগিয়ে দিয়ে বললো,
– বাবা, এগুলো বিক্রি করলে প্রায় ষাট হাজারের অধিক টাকা উঠে আসবে। আপনি এগুলো বিক্রি করে দিন। আপনার ছেলেকে জানানোর প্রয়োজন নেই। ও এমনিতেই অনেক টেনশনে আছে। আপনি আপনার কথা বলে এই টাকা গুলো দিলে ওর টেনশনটা কমবে।
– কি বলছিস মা! গয়না বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করবো! টাকার ব্যবস্থা এমনিতেই হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। এগুলো নিয়ে যা।
আয়েশা বেগম বলে উঠলো,
– কে, পরে টাকা হলে গয়না গড়ে দেওয়া যাইবো না!
– তুমি চুপ থাকো! সবসময় বেশি বেশি! তোমার গয়না দিবা!
– হু, সব দিয়া নিঃস্ব হইয়া বইসা থাকি! ঘরে যে একটা মাইয়া আছে, তারে বিয়ে দেওয়ার সময় লাগবো না! সেই চিন্তা কি কেউ করে! সব তো আমার মাথায় নিয়েই বসে থাকতে হয়!
নাজিয়া বললো,
– আম্মা ঠিক বলছে বাবা। টাকা হলে পরে গয়না গড়ে নেওয়া যাবে। এখন প্রয়োজন বলেই তো কাজে লাগাচ্ছি। তাছাড়া এমনিতে ঘরে পড়েই থাকে অযথা!
নাজিয়া গহনা আলফাজ সাহেবের কাছে রেখে ঘরে চলে এলো। খুব কষ্ট লাগছে তার! মনে মনে ক্ষমা চাইছে, “আরাফ, ক্ষমা করে দিও! আমি তোমার কথা অমান্য করেছি। কি করবো বলো! পরিবারের কারোর মুখই দেখার মতো না! সবাই মিলে এতো টেনশনে আছো, আমি দেখতে পারছি না এসব!”
ক্লাস শেষ করে কোচিং করলো আরাফ। যেসকল শিক্ষার্থীদের বেতন বাকি আছে তাদের বলে দিলো যেন টাকাটা দেওয়ার চেষ্টা করে। সেখান থেকে বেরিয়ে চলে গেলো ব্যাংকে। চেক বইয়ে আঠারো হাজারসহ ডেবিট কার্ড মিলে মোট পঁচিশ হাজার টাকা তুলেছে। সেগুলোও পরিশোধ করে বাড়ি ফিরে এসেছে। রাতে বাবার কাছে বসে কাকে কত পরিশোধ করেছে তার হিসেব দিলো।
বাড়িতে সংসারের সকল কাজকর্ম নাজিয়া একা করে যাচ্ছে আর বাইরে আরাফ! আশিককেও তেমন দেখা যায় না বাড়িতে। সংসারের অবস্থা দেখে আয়াতও আর টাকা চায় না ভাইয়ের কাছে। সে কলেজ যাওয়া বন্ধ রেখেছে। আশিক প্রতিদিন সকাল আটটার দিকে বেরিয়ে যায়, আরাফও কোচিংয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়েছে। লোকজনদের কাছে বলে এক মাসের সময় নিয়েছে। সকাল সকাল বেরিয়ে কোচিং, স্কুল আবার বিকেল সন্ধ্যায় কোচিং সেড়ে রাতে বাড়ি ফিরে। বেলা শেষে সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি ভেসে ওঠে চেহারায়। তা দেখার মতো মানুষ একজনই, সে হলো নাজিয়া। কাকে কত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে সে জানে না। তবে এটা জানে অর্ধেকটা পরিশোধ হয়ে গেছে আর বাকিটা একমাস পরে পরিশোধ করবে। আর তার বিশ্বাস, তার গয়না দিয়েই অর্ধেকটা পরিশোধ হয়ে গেছে।
.
জহিরুল ইসলাম ও মেহেরুন ইসলাম এসেছে নাহিদাকে দেখতে। নাহিদার বাড়িতে তাদের আপ্যায়ন খুব ভালোই হয়েছে। নাহিদাকেও পছন্দ হয়েছে ভীষণ। এ বাড়িতে অনেক্ষন সময় কাটিয়ে নাহিদার বাবামায়ের সাথে গল্পগুজব করলেন এবং উনাদের বাড়িতে দাওয়াত করলেন।
এদিকে নিয়াজ উদ্দিন টেনশনে আছেন মেয়েকে বিয়ে দিবে কি না! আরও একবছরের বেশি বাকি নাহিদার অনার্স শেষ হওয়ার। আবার অফিসের বস ঝেকে ধরেছে বিয়ে দেওয়ার জন্য।
তারা চলে যাওয়ার পর আবার নাজিয়ার সাথে আলোচনা করলো এ বিষয় নিয়ে। নাজিয়াও বললো, পরিবার যদি ভালো হয় এবং তারা যেহেতু পড়াশোনা করাতে চায় তাহলে নাহিদার মতামত নিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেই ভালো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here