প্রণয়াভিলাষী প্রথম পর্ব

0
1065

#প্রণয়াভিলাষী
প্রথম পর্ব
আফসানা

—“দোস্ত উঠ না! এভাবে সারাদিন শুয়ে থাকলে কি ভালো লাগে, বল? আমার বাসায় এসেছিস, কই ঘুরবি ফিরবি আমার সাথে। তা না করে তুই রুমের ভেতরই মুখ গুঁজে পড়ে আছিস দুইদিন ধরে। উঠ, তাড়াতাড়ি উঠ। আজকে তোকে আমার সাথে বাইরে বেরুতেই হবে। উঠ বলছি।”

শেষ পর্যন্ত ঠেলে ঠেলে শোয়া থেকে উঠালো নিম্মি। মাথা নিচু করে বসে আছে আনাহিতা। ওর মুখ দেখে ভিতর বোঝার উপায় নেই। উলটপালট, অস্থির মন নিয়ে নির্বিকার মুখে বসে আছে। ভিতরটা য/ন্ত্র/ণা/য় ফেটে যাচ্ছে খুব বিশেষ একটা কারণে। কিন্তু নিম্মির সেটা অজানা। ওকে আনাহিতা সব বললেও এই একটা ব্যাপারে কখনোই কিছু বলেনি। মাথা তুলে মুখ খুললো
—“কই যাবি আজ?”

নিম্মি চোখ কপালে তুলে বললো
—“কই যাব মানে? তুই কি জানিস না আজ কই যাব? খেয়ে ফেলছিস না-কি?”

এই রে! যদি বলে যে আসলেই ভুলে গেছে তাহলে ল/ঙ্কা/কা/ণ্ড ঘটাতে দেরি হবে না এখন। কী বলা যায় এই মুহূর্তে? কী বলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়? মনে মনে দ্রুত সম্ভব ভাবতে লাগলো আনাহিতা। কিন্তু ওকে আর ভাবতে হলো না। নিম্মি নিজেই ওর পাশে ধপ করে বসে আবারও বলতে লাগলো
—“দোস্ত, আমার না কেমন যেন লাগছে। দেখা করার কথা মনে হলেই বুক ধড়ফড় করছে। একটু পর পর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। পেটের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠছে। শরীরের জোর হারিয়ে ফেলছি ক্রমে ক্রমে। আমার কী হবে দোস্ত?” কথা শেষে আনাহিতার কাঁধে মাথা রাখলো নিম্মি।

‘কার সাথে দেখা করার কথা বলছে?’ কথাটা একবার মনে মনে বলেই আঁতকে উঠলো আনাহিতা। ধাঁ করে মনে পড়ে গেল। আল্লাহ্! নিম্মির না আজকে সাজিদ নামের ছেলেটার সাথে দেখা করার কথা! এটা ও কী করে ভুলে গেল? দীর্ঘদিনের সম্পর্ক তাদের দুজনার। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউ কাউকে দেখেনি। আজকের দিনের শিডিউল ছয় মাস আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিল ওরা দুজনে। এগারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে সেই কখনই। দেখা করে দুপুরের খাবার ওরা একসাথেই খাবে। একটার মধ্যে রওয়ানা দিতে হবে। তাই আর দেরি না করে দুজনেই চলে গেল রেডি হতে। দুজনেই বোরখা পরে রেডি হয়ে নিল। সারে বারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লো ওরা গুলশান লেক পার্কের উদ্দেশ্যে।
___

রিক্সায় বসে নার্ভাসনেসের দরুন নখ কামড়াচ্ছে নিম্মি। ওর হাতে একটা চাপড় দিল আনাহিতা। এই বা/জে অভ্যাসের সাথে ও অভ্যস্ত নয়। কাউকে এমন করতে দেখলেই ও থা/প্প/ড় লাগায়। অসন্তোষ নিয়ে বললো
—“কী শুরু করলি বল তো? নার্ভাসনেসের ঠেলায় দেখি ম/রে যাচ্ছিস। তাহলে ফিরে যাই, চল!”

নিম্মি আঁতকে উঠে আনাহিতার হাত খামচে ধরলো। নখ দেবে যাওয়ার আগেই হাত ছাড়িয়ে নিল ও। সেখানে হাত বুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো
—“এমন এলিয়েনের মতো আচরণ করছিস কেন? এমনভাবে কেউ ধরে? জ্বলছে একদম।”

—“দোস্ত তুই আশেপাশেই থাকিস, হ্যাঁ? অ/জ্ঞা/ন হয়ে গেলে যেন হাসপাতালে নিতে পারিস।”

পাগলের প্রলাপ বকছে নিম্মি। হতাশামিশ্রিত একটা শ্বাস ফেলে ওর উদ্দেশ্যে বললো
—“আগে থেকেই কীভাবে জানিস যে তুই অজ্ঞান হয়ে যাবি? আমাকে খালামণি ডাকার কেউ আসছে না-কি?”

—“এই কথা বলিস না দোস্ত। সাজিদ শুনতে পেলে নির্ঘাত হার্ট অ্যা/টা/ক করে বসবে।”

—“হ্যাঁ আমি তার কাছে যাব এসব কথা বলতে!” চোখ পাকিয়ে বললো আনাহিতা। নিম্মি আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। ততক্ষণে ওরা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে গেছে। রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে ওরা পার্কের ভেতরে ঢুকলো। ঢোকা মাত্রই নিম্মির ফোনে কল এলো। হ্যান্ডব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখে সাজিদের কল। ঢোক গিলে রিসিভড করলো ফোন। সাজিদ জানতে চাইলো ওরা কতদূর এগিয়েছে। নিম্মি উত্তর দিল ওরা মাত্রই প্রবেশ করেছে পার্কের ভেতরে। মিনিট খানেকের মধ্যেই দুইজন সুপুরুষ তাদের একটু দূরত্বে এসে দাঁড়ালো। একজনের কানে ফোন আরেকজন পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। নিম্মি বুঝলো ফোন কানে রাখা ছেলেটাই সাজিদ। সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিল ও। সর্বাঙ্গ তিরতির করে কাঁপছে।

সাজিদ ও রেজওয়ান পার্কে এসে পৌঁছেছে মিনিট দশেক হলো। রেজওয়ান তিতিবিরক্ত হয়ে বললো
—“আমাকে শুধু শুধু টেনে আনলি তোদের মাঝে কাবাবে হাড্ডি হওয়ার জন্য। এখন আমি একা কী করবো এখানে, বল তো? তোর নিব্বি এখনো আসছে না কেন? মেয়েদের জন্মই হয়েছে ছেলেদের অপেক্ষায় রাখার জন্য।”

সাজিদ চোখ থেকে রোদচশমাটা খুলে রেজওয়ানের অসন্তুষ্ট মুখের দিকে তাকালো। মৃদু হেসে বললো
—“অনার্সে পড়ুয়া মেয়েও নিব্বি, তাই না? তাহলে তো তোরটাও নিব্বি ছিল। যেহেতু সে-ও অনার্সে পড়তো।”

বলেই বুঝলো ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। রু/ষ্ট চাহনিতে রেজওয়ান তাকালো সাজিদের দিকে। উত্তরে কিছু বলবার আগেই সাজিদ সেখান থেকে সরে গেল নিম্মিকে ফোন দেওয়ার জন্য। যখন জানালো এসে গেছে, তখন সে ফোন কানে ধরে রেখেই এগোলো পার্কের প্রবেশপথের দিকে। সেখানে গিয়ে দেখলো দুইটা মেয়ে দাঁড়ানো। দুইজনের মুখই হিজাবাবৃত। একটা মেয়ে দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। কফি কালারের বোরখায় আবৃত মেয়েটা কানে ফোন ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলো এটাই তাহলে তার না দেখা প্রেয়সী। রেজওয়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো

—“যাক, তোকে আর একা বসে থাকতে হবে না। তোর সঙ্গী আছে সাথে।”

কটমট দৃষ্টিতে তাকালো সে সাজিদের দিকে। কিন্তু এখনই কিছু বললো না। এর শোধ পরে তুলবে সে।

রেজওয়ান পকেটে হাত গুঁজেই মেয়ে দুটোর দিকে এগিয়ে গেল সাজিদের সাথে। সে অলরেডি বলে ফেলেছে কোনটা নিম্মি। পাশে দাঁড়ানো পার্পল কালারের বোরখায় আচ্ছাদিত মেয়েটার দিকে তাকালো সে। আড়াআড়িভাবে দু’হাত গুঁজে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। ওরা মেয়ে দুটোর কাছে যাওয়া মাত্রই নিম্মি সালাম দিল। সালামের আওয়াজে আনাহিতা চমকে ফিরে তাকালো। চোখাচোখি হয়ে গেল রেজওয়ানের সাথে। কালো মণিযুক্ত শান্ত আঁখি মেলে ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। তড়িৎগতিতে দৃষ্টি নত করলো। এখন ওর নিজেরও নার্ভাস লাগছে। ভেবেছিল সাজিদ নামের ছেলেটা একা আসবে। নিম্মিকে তার কাছে গছিয়ে দিয়ে সে একটু একা সময় কাটাবে। এখন যদি এই ছেলেটার সাথে বসে থাকতে হয়! ভেবেই ভিতরে ভিতরে আ/ত/ঙ্ক/বোধ করছে আনাহিতা।

সালামের জবাব নিল সাজিদ। তারপর মুচকি হেসে নিম্মির দিকে তাকিয়ে বললো
—“হাই, আমি সাজিদ নেহাল। কেউ একজনের উপাধি দেওয়া ক্ষে/পা/টে প্রেমিক। আর সেই কেউ একজনটা নিশ্চয়ই আপনি!”

নিম্মি লাজুক হেসে মাথা নামালো। তাদের মাঝে থেকে আনাহিতার অস্বস্তি হচ্ছে। রেজওয়ান সাজিদকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে বললো
—“তোর ঢংয়ের কথাবার্তা বাদ দিয়ে এখান থেকে ভেতরে চল। রোদে আমার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাচ্ছে।”

সাজিদ বললো
—“আমরা আগে পরিচিত হয়ে নিই!”

—“মাথায় কি তোর ঘিলু বলতে কিছু নাই? এক জায়গায় বসেও তো কথা বলা যাবে না-কি? না এখান থেকেই বিদায় নেওয়ার ইচ্ছে?” রাগে দাঁতে দাঁত চাপলো রেজওয়ান।

সাজিদ ভ্যাবলামার্কা হাসি দিয়ে বললো
—“ভাই আমার ই/ন/সা/ল্ট করায় সবসময় এগিয়ে।” তারপর নিম্মিদের উদ্দেশ্যে বললো “চলো, কোথাও বসি।” বলেই বেশ কয়েক মিনিট হেঁটে ওরা এসে পৌঁছালো গাছগাছালির ছায়ায় পূর্ণ মুক্তমঞ্চের কাছে। এই জায়গাটা অনেক ভালো লাগে। যেদিকটাই রোদ নেই সেদিকেই এগিয়ে গেল ওরা। এই পার্কটা অনেক নিরিবিলি। সাথে নাম না জানা অসংখ্য গাছ। বুনো ফুলেদের মনমাতানো সৌরভে প্রশান্তি অনুভব করা যায়। পাখির কলরবে চারপাশ মুখরিত হয়ে থাকে সবসময়। মূলত সাজিদ প্রথমে কোনো রেস্ট্রন্টে দেখা করার কথা বলেছিল। কিন্তু নিম্মি তাতে নাকচ করে। কারণ সে শান্ত পরিবেশে দেখা করতে চায়।

সাজিদ আর রেজওয়ান সিঁড়ির পাশের বেদিতে বসলো। নিম্মিরা বসলো সিঁড়িতে। কারণ সবাই সিঁড়িতে বসলে একে অপরের মুখ দেখবে না। তাই এখন অনেকটা মুখোমুখিই বলা যায়। সাজিদ নিম্মির দিকে তাকিয়ে বললো
—“আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো!”

নিম্মি সেদিকে তাকিয়ে ছোটো করে বললো
—“না, অসুবিধা হয়নি। বাসা তো আর বেশি দূরে না।”

—“আচ্ছা তাহলে পরিচয় করিয়ে দিই।” বলেই হাসি মুখে রেজওয়ানের দিকে তাকালো। সাজিদের আগে রেজওয়ান নিজেই বললো
—“হ্যালো, আমি রেজওয়ান শেখ। সাজিদের দুইমাত্র বন্ধু প্লাস কাজিন। আমরা দুই অধম এক সাথেই কাজ করি। জানোই তো কী কাজ, তাই না?”

নিম্মি নতমুখে জবাব দিল
—“জি ভাইয়া, জানি।”

আনাহিতা ‘রেজওয়ান শেখ’ নামটা শুনে নিজের জায়গায় জমে গেছে। ওর হৃদয় হরণ করা কল্পপুরুষের নামটাও যে এটাই ছিল। সে তো ফ্রিল্যান্সার ছিল। তারা দুইজন একসাথে কী কাজ করে? নিম্মিকে কখনো জিজ্ঞাসা করা হয়নি সাজিদের পেশা সম্পর্কে। তাহলে এখন অন্তত জানতে পারতো পাশের মানুষটা সম্পর্কে। তার ভাবনা যদি সত্যি হয় তাহলে সত্যি সত্যিই কু/রু/ক্ষে/ত্র বেঁধে যাবে। প্রার্থনা করছে এটা যেন সত্যি না হয়। পরক্ষণেই ভাবে ‘ধুর! আমাকে চিনবেই বা কীভাবে? আমরাও তো একে অপরকে দেখিনি।’ আচমকা কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে হুঁশ ফিরলো আনাহিতার। মাথা তুলে দেখলো তিন জোড়া কৌতূহলী চোখ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। বেশ লজ্জা পেল ও। শুনলো সাজিদ বলছে

—“শ্যালিকা আমার কোথায় হারিয়ে গেলেন? পরিচয়টা তো এখনো পেলাম না। একজন তো ফোনে কথা বলার সময় তুবড়ি ছোটাতো। কিন্তু সামনে আসতেই সব ফুড়ুৎ। এখন আপনিও যদি কথা না বলেন বউটাকে বাগে আনবো কীভাবে?”

সাজিদের এমন খোলামেলা কথায় দুজনেই লজ্জা পেল। নিম্মি তো পারে না মাটি ফেঁড়ে অতলেই ঢুকে যায়। আনাহিতা মাথা নিচু করে রিনরিনে কণ্ঠে বললো
—“আমি আনাহিতা। নিম্মির বেস্টফ্রেন্ড।”

—“আপনার নামের আগেপিছে কিছুই নেই দেখছি।”

নিম্মি মাঝপথে বলতে লাগলো
—“আরে আছে তো। ওর আসল নাম…” চিমটি খেয়ে থেমে গেল নিম্মি। চোখ পাকিয়ে আনাহিতা ওর দিকে তাকালো। অতঃপর ফিসফিস করে বললো “আমার ব্যাপারে আর কিছু বললে এখনই চলে যাব।”

ওদের দুজনকে এমন ফিসফাস করতে দেখে রেজওয়ানের ভ্রু কুঁচকে এলো। সাজিদের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেও ভ্রু কুঁচকে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। তারপর বললো
—“এনি প্রবলেম?”

—“না ভাইয়া। আপনারা দুজনে বরং আলাদা কথা বলুন। আমি আশপাশটা ঘুরে দেখি।” ধীরস্বরে বললো আনাহিতা।

সাজিদ বাগড়া দিয়ে বললো
—“একা ঘুরবে কেন? আমার এই ব্রাদারটাকে সঙ্গী করে নাও। বেয়াই-বেয়াইন বলে কথা! একটু চেনাজানার ব্যাপারও তো আছে, তাই না? আর তুমি করে বলার জন্য কিছু মনে কোরো না, কেমন?”

—“না না ভাইয়া, কিছু মনে করবো কেন? ইনফ্যাক্ট আমি তো বয়সে আপনার ছোটোই। সমস্যা নেই।”

রেজওয়ানকে তার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরেকটু ক্ষেপা/তে বললো
—“আর একে নিয়ে চিন্তা কোরো না। সিট বুকিং হয়ে গেছে অনেক আগেই। তোমার সাথে ফ্লার্ট করবে না একদমই। ব্যাটা একটা রসকষহীন।”

রেজওয়ান ডোন্ট কেয়ার ভাব ধরে বললো
—“নো প্রবলেম। সুযোগ আমারও আসবে। তখন এই রসকষহীন ব্রাদারের কাছে এসো না কোনো সাহায্যের জন্য।”

সাজিদ ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো
—“আরে আসবো না মানে! ব্যাটা তোকে ছাড়া আমি অচল না?”

রেজওয়ান বললো
—“হয়েছে, ঢপ কম মেরে যা এখান থেকে। আমি বেশিক্ষণ স্টে করতে পারবো না। জরুরি কাজ ফেলে এসেছি তোর সাথে।”

—“তোর জরুরি কাজ তো সেই একটাই। আমার না হওয়া ভাবির কথা ভাবা। দিন গিয়ে রাতে গড়ায়, রাত পেরিয়ে ভোর হয়। তাকে নিয়ে তোর ভাবনা শেষ হয় না। কই যে ঘাপটি মেরে আছে আমার ভাবিসাহেবা!”

—“আমি বলা শুরু করলে এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি না। সো স্টপ অল দিস ননসেন্স।”

রেজওয়ানের শক্ত চোয়াল দেখে আর কিছু বললো না সাজিদ। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত সটকে পড়লো সেখান থেকে। নিম্মি আর আনাহিতা একে অপরের দিকে বোকাবোকা চাহনিতে তাকিয়ে ছিলো। তাদের দেখে বোঝা যাচ্ছে দুজনার মধ্যকার বন্ডিংটা চমৎকার।

আনাহিতা অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে রইলো। অপরিচিত একটা যুবকের সাথে একলা থাকতে হবে ভেবেই যেন হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল নীরবতায়। ওকে এভাবে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখে রেজওয়ান নিজ থেকেই আগ বাড়িয়ে বললো
—“মিস আনাহিতা, এখানেই বসে থাকবেন আপনি?”

আনাহিতা চমকে তাকালো গম্ভীর কণ্ঠস্বরের মালিকের দিকে। পায়ের ওপর পা তুলে পিছনে হাতের ভর রেখে রেজওয়ান স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে। এমন দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে গেল আনাহিতা। মেরুদণ্ড বেয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ওর দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকানোর মানে কী? লোকটার তো না-কি পছন্দের কেউ আছে। সাজিদকে তো তখন বলতে শুনেছে ও। লোকটা ক্যারেক্টারলেস নয় তো!

রেজওয়ানের এমন কোনোদিন হয়নি। অপরিচিত কোনো মেয়েকে দেখে কখনো মনে হয়নি সে তার খুব আপন। অন্যসময় কোনো মেয়ের দিকে চোখ গেলে দ্বিতীয়বার আর তাকাতো না। কিন্তু আজ যেন সব নিয়মের হেরফের হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই নিজের মধ্যে অজানা কিছু একটা অনুভব করছে। মনে হচ্ছে এই চোখদুটো সে আগেও কোথাও দেখেছে। কিন্তু কবে, কোথায় তা মনেই করতে পারছে না। আচমকা অযথাই মনে হলো এটা তার হঠাৎ করেই হারিয়ে যাওয়া সেই প্রণয়িনী নয় তো! ঘোর কাটলো হঠাৎ আনাহিতার কথায়। এমন অনর্থক ভাবনার জন্য নিজেকে ধি/ক্কা/রও জানালো। ছিঃ!

—“আপনি গিয়ে আশেপাশে ঘুরতে পারেন। আমি বরং এখানেই বসে থাকি। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।”

কপালের ডান পাশের শিরা লাফাচ্ছে আনাহিতার। মনের ব্যথার সাথে মাথার ব্যথাটাও প্রকট হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ওর যে শরীরের কন্ডিশন ভালো নয় নিম্মি তা জানে না। আসলে সে-ই বুঝতে দেয়নি। সারাদিন শরীরের প্রত্যেকটা গিঁটে ব্যথা করবে আর মধ্যরাত হলেই বিনা নিমন্ত্রণে জ্বর আসবে। আনাহিতা অবশ্য নিজেকে সামলাতে পারে শরীর খারাপ হলেও। নিম্মি ঘুমে গাধা। তাই পাশে ঘুমানোর পরও ও আনাহিতার অসুস্থতার খবর জানে না। শুধু কী অসুস্থতা! ওর জীবনে এত বড়ো একটা ঘটনা যে ঘটে গেল সেটাও তো নিম্মিকে বলেনি। অবশ্য বলবেও না। যার পূর্ণতা পায়নি সেটা ঢোল বাজিয়ে বলে কী লাভ? মনের ব্যথা মনেই না হয় লুকিয়ে চাপা পড়ে থাকুক।

রেজওয়ান আনাহিতার কথার প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। এক হাতে ভর দিয়ে সিঁড়িতে বসাবস্থায়ই খানিকটা ঝুঁকে গেল আনাহিতা। আরেক হাতে কপালের ডান পাশ ঘষছে চোখমুখ কুঁচকে। দ্রুতপদে বেদি থেকে নেমে আনাহিতার পাশে এসে বসলো রেজওয়ান। অপ্রস্তুত হয়ে জানতে চাইলো
—“হেই মিস, কী হয়েছে আপনার? আর য়্যু ওখেই?”

আনাহিতা কপালের পাশে হাত রেখে নিভু গলায় কোনোমতে উচ্চারণ করলো
—“পেইন হচ্ছে প্রচুর।”

মুহূর্তেই দুইহাতে চেপে ধরলো মাথা। গোঙাতে লাগলো অস্পষ্ট সুরে। রেজওয়ান কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তাকে বিস্মিত করে দিয়ে আনাহিতা ঢলে পড়লো রেজওয়ানের কোলে। রেজওয়ান ওকে নিজের বুকে আগলে নিল পরম মমতায়। মেয়েটার হঠাৎ কী হলো? অজ্ঞান হয়ে গেল কেন? এমন পরিস্থিতিতে এই প্রথম পড়লো রেজওয়ান। পকেট থেকে ফোন বের করে প্রথমেই সাজিদকে ফোন লাগালো। অসম্ভব অস্থিরতায় ভিতরটা সমানে কাঁপছে। তিনবারের মাথায়ও যখন ফোন রিসিভ করলো না মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল রেজওয়ানের। পরমুহূর্তেই মনে পড়লো সাজিদ প্রায় সময়ই ফোন সাইলেন্ট করে রাখে। এখনও হয়তো সাইলেন্টই। শিট! বলে ভাবতে লাগলো কী করা যায় এখন। মাথায় এলো নিম্মিকে ফোন দেওয়ার কথা। কিন্তু ওর ফোনে তো নিম্মির নাম্বার নেই। ওর কাছে নেই তো কী হয়েছে! আনাহিতার ফোনে অবশ্যই থাকবে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখলো সিঁড়িতেই পার্সটা রাখা। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো লক করা নেই। শোকরিয়া আদায় করলো রেজওয়ান। চটজলদি সোয়াইপ করলো ফোন। সাথে সাথে বৃদ্ধাঙ্গুলটা থেমে গেল সেখানেই। এবং থেমে গেল ওর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া। ভূতগ্রস্তের মতো তাকিয়ে রইলো আনাহিতার ফোনের ওয়ালপেপারের দিকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here