বেসামাল_প্রেম #জান্নাতুল_নাঈমা #পর্ব_৫৭

0
650

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫৭

মা হওয়ার পর সেরা মুহুর্তটি পায়নি হৈমী। যারা মা হয়েছে তারাই জানে তাদের সেরা মুহুর্ত কোনটি। সৃষ্টিকর্তা হৈমীকে সেই অনুভূতি থেকে বঞ্চিত করেছে। হয়তো সেই অনুভূতিটুকু থেকে বঞ্চিত করার পেছনেও কোনো না কোনো মঙ্গল রয়েছে। রুদ্রর নিয়ে আসা ভিডিয়ো গুলো দেখছে আর চোখে অশ্রু ঝড়াচ্ছে মেয়েটা। অসহায়ের ন্যায় পাশে বসে আছে রুদ্র। একবার ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখছে তার বাচ্চাদের। আর একবার দেখছে বাচ্চার মায়ের অসহায় মুখাবয়ব। হৈমী বার বার করে একটা কথাই বলছে,

-” ওরা আমার পেটে ছিল? কী কপাল আমার এখনো ওদের ছুঁয়ে দেখতে পারলাম নাহ। ”

রুদ্র স্বান্তনা দিল,

-” আফসোস করছ কেন হৈমী? হিসেব অনুযায়ী ওরা আরো এক, দেড়মাস পর পৃথিবীতে আসার কথা। এক্সিডেন্টের জন্য দ্রুত এসে পড়েছে। কান্না না করে, আফসোস না করে দোয়া করো। যেন খুব তাড়াতাড়ি আমাদের কাছে নিয়ে আসতে পারি ওদের। ”

সহসা থমকানো স্বরে হৈমী বলল,

-” ওদের নিয়ে সব কেন এক্সিডেন্টলি হচ্ছে! ”

থমকাল রুদ্র নিজেও। এক মুহুর্ত শক্ত হয়ে গেল সে। একই ভাবনা মাথাচাড়া দিল তারও। হৈমী মিথ্যে কিছু বলেনি। বিনা প্রস্তুতিতে সব কিছু হচ্ছে। যখন ওরা হৈমীর গর্ভে এলো সে জানতে পারেনি। হৈমী যখন জেনেছিল তখন সেও অবাক হয়েছিল। পুরো বিষয়টাই দূর্ঘটনার মতো হয়ে গিয়েছিল। এরপর রুদ্রকে না জানিয়ে গর্ভপাতের চেষ্টা। কাকতালীয় ভাবে হৈমীর প্রেগ্নেসি বিষয়ে রুদ্রর জেনে যাওয়া। এরপর সবটা যখন স্বাভাবিকতায় মোড় নিল তখনি আরো একটা এক্সিডেন্ট! সবটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র। হৈমীকে শুনিয়ে নিজেকে তাচ্ছিল্য করে বলল,

-” সন্তান হিসেবে হতভাগা ছিলাম। বাবা হিসেবেও হতভাগাই রইলাম। ”

হৈমী কেঁপে ওঠল। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে টলমল চোখে বলল,

-” সব আমার জন্য। ”

রুদ্র মাথা নিচু করে শ্বাস ফেলল ঘনঘন। বলল,

-” নাহ সব ঠিক হয়ে যাবে সব ঠিক করে নিব। শুধু পরা সুস্থ হয়ে ফিরুক। তুমি, আমি মিলে আমাদের সন্তানকে ঠিক আগলে রাখতে পারব। এই যে দূর্ঘটনা ঘটল এটাই যেন আমাদের জীবনের শেষ দূর্ঘটনা হয়। ”

হৈমীর শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক ভালো লাগার শিহরণ বয়ে গেল। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। রুদ্র সে চাহনি খেয়াল করে আশপাশে নজর ঘোরাতে লাগল। যেন সে হৈমীর চোখে তার জন্য যে মুগ্ধতা টের পেয়েছে। এই টের পাওয়া টুকুও গোপন করার চেষ্টা করল। তার সেই লুকোচুরি যখন হৈমী টের পেল তখন মুচকি হেসে মুখ ফিরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর নার্স এসে হৈমীকে বলল,

-” আপনি সারাক্ষণ শুয়েই থাকেন। ডাক্তার ম্যাডাম বলেছে একটু হাঁটাহাঁটি করতে। এতে আপনারই উপকার হবে আমাদের না। ”

বাঁকা কথায় রুদ্র বিরক্তি সূচক শ্বাস ফেলল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল নার্সের দিকে। বলল,

-” গতকাল সিজার আজি হাঁটাহাঁটি করবে? ওকে কি আপনাদের মানুষ মনে হয় না? ”

আজ নার্সও চটে গেল। বলল,

-” আপনি মশাই বেশি আহ্লাদ করে বউয়ের বিপদ ডেকে আনবেন। আপনার মতো ত্যাড়া পেশেন্ট পার্টি এর আগে একটাও দেখিনি! কোথায় আমাদের সাজেশন মেনে চলবেন তা না মেজাজ দেখান। মনে হয় আমরা আপনার বাড়ির শরিক! ”

হৈমী হতভম্ব হয়ে গেল। নার্স মহিলাটিকে থামতে ইশারা করল। রুদ্রর মেজাজ তো সপ্তম আকাশে ওঠে গেছে। এবার ধপাস করে নিচে পড়ার অপেক্ষা।
হৈমী ভয়ে ভয়ে বলল,

-” আচ্ছা আচ্ছা আমি হাঁটব এই এখনি। ”

রুদ্র গজগজ করতে করতে বলল,

-” তুমি চুপ করো। ”

নার্স বললেন,

-” আপনি প্রথম মা হয়েছেন, উনি প্রথম বাবা। কিন্তু আমাদের হসপিটালে আপনিই প্রথম মা হননি৷ ”

হৈমী জোরপূর্বক হেসে আমতা আমতা করে বলল,

-” আসলে আমি খুব ভয় পাচ্ছি। তাই উনিও ভয় পাচ্ছেন। কিছু মনে করবেন না। উনার একটু মাথা গরমের স্বভাব আছে। ”

নার্স মহিলাটি কিছু মেডিসিন দিয়ে চলে গেলেন। নিচু গলায় বলে গেলেন,

-” আপনার হাজব্যান্ডের একটু না বেশিই মাথা গরম করার স্বভাব আছে। সামলাতে বলবেন নয়তো বিপদে পড়বে। ”

তিনি চলে যাবার পর রুদ্র হৈমীর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল৷ বলল,

-” ওকে এটা বলার কী দরকার ছিল? ”

-” কোনটা? ”

চিবিয়ে চিবিয়ে রুদ্র বলল,

-” আমার মাথা গরম। ”

ঠোঁট টিপে হাসল হৈমী বলল,

-” মিথ্যে নাকি? ”

দ্বিগুন চটে গেল রুদ্র। হৈমী আর বেশি না ঘেঁটে বলল,

-” আমি তো ওঠার সাহস পাচ্ছি না। সাহায্য করুন কিছুক্ষণ হাঁটি। ”

রুদ্র বিচলিত হচ্ছিল হৈমী শান্ত করতে বলল,

-” আপনি অযথা হাইপার হচ্ছেন। আম্মু, রিনা কাকিও বলেছে হাঁটাহাঁটি করতে। এটা আমার জন্যই ভালো। দেখুন না পা দু’টো কেমন অবশ হয়ে আছে। এভাবে থাকতে থাকতে পঙ্গু হয়ে যাব। ”

রুদ্র রাজি হলো। হৈমীকে কোলে করে বেড থেকে নামাল। মেঝেতে পা দু’টো রাখতে পারছিল না। রুদ্রর বাহু চেপে কোনোরকমে দাঁড়াল। তার শারীরিক অবস্থা বুঝল রুদ্র। চিন্তিত হলো ভীষণ। কীভাবে হাঁটাবে এ অবস্থায়? ভাবতে ভাবতেই হৈমীর একদম পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে এমনভাবে ওর কাঁধ চেপে ধরল যে হৈমীর মাথা ঠেকল ওর কাঁধে। সম্পূর্ণ সাপোর্ট পেয়ে হৈমী এক পা আগাল। রুদ্র এক হাতে কাঁধ অপরহাতে হৈমীর একটি হাত ধরে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করল। সূচনা আর মাহের এসেছে রুদ্র, হৈমীর জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে। কেবিনের সামনে দাঁড়াতেই ওদের নজর কাড়ল দৃশ্যটি। কমলা রঙের একটি মেকসি পরা হৈমী। চুলগুলো বিনুনি করা। একটা, দু’টো চুল কপাল ছুঁয়েছে। কিছু চুল চোখের ওপরে পড়তেই রুদ্র তা ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিল। কাবলি পরিহিত বিশাল দেহি পুরুষটির বুক জুড়ে হৈমীর রুগ্ন দেহখানি। দেখতে কী যে মনোমুগ্ধকর লাগছে। মাহের দুচোখ ভরে দৃশ্যটি দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। সূচনাকে মৃদু স্বরে বলল,

-” পৃথিবীর প্রতিটি পুরুষের বুকেই তিনটি আদর্শ ঘুমিয়ে থাকে। সন্তান, স্বামী, পিতা৷ এ মুহুর্তে আমি আদর্শ স্বামীকে দেখতে পাচ্ছি। ”

মাহেরের দিকে তাকাল সূচনা। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,

-” ভাইয়ার মাঝেকার এই আদর্শ যেন আর না ঘুমায় মাহের। ”

-” মহান আল্লাহ তায়ালা উনাকে হেদায়েত দান করুক আমিন। ”
__________________________
হৈমীকে রিলিজ করে দেয়া হয়েছে। সবাই মিলে বাচ্চাদের দেখে তারপর বাড়ি ফিরল৷ হৈমীর কান্না থামছেই না৷ বাচ্চাদের রেখে সে বাড়ি ফিরবে না৷ জোরপূর্বক তাকে গাড়িতে বসানো হয়েছে। পেটে সেলাইয়ের জন্য শব্দ করে কাঁদতেও পারছে না৷ নিঃশব্দে কেঁদে হেঁচকি ওঠে গেছে। এদিকে রুদ্র সঙ্গে আসেনি। মাহের, সূচনা, হামিদা ওকে সামলাচ্ছে। রুদ্র বাচ্চাদের ওখানে রয়েছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে তারপর আসবে। হৈমীর মতো সে কাঁদতে পারছে না৷ ভেতরের উত্তেজনা দমিয়ে রাখছে। সর্বোচ্চ চেষ্টায়। যতদিন বাচ্চাদের সুস্থভাবে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে না যাবে ততদিনে এক মুষ্টি স্বস্তি বা শান্তি কোনোটাই মিলবে না৷

মাহের, সূচনা মিলে হৈমীকে দোতলায় রেখে আসতে উদ্যত হলো। সকাল থেকেই শরীর ভালো না সূচনার। এ কয়েকটা দিন বেশ ধকল গেছে তার। ঠিকভাবে খাওয়া, ঘুম কিচ্ছু হয়নি। বাবুদের নিয়ে চিন্তা, হৈমীর দেখাশোনা। বাড়ি টু হসপিটাল। হসপিটাল টু বাড়ি করে রাত, দিন পার করেছে। এ মুহুর্তে শরীর খারাপ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। হৈমীকে নিয়ে যেতে বেগ পেতে হলো বেশ। সূচনা অসহায় মুখে মাহেরকে বলল,

-” মাহের, আমার শক্তিতে কুলচ্ছে না৷ তুমি এক কাজ করো পাঁজা কোল করে নাও ওকে। ”

সূচনার মুখের অবস্থা দেখে হকচকিয়ে গেল মাহের। সহসা বুকটা ধক করে ওঠল তার। এ কয়েকদিন এই মেয়েটার ওপর একেবারেই নজর দেয়া হয়নি। অথচ মেয়েটা রাতদিন এক করে তার বোন, বোনের সন্তানের জন্য খেটে গেছে। মাথা নাড়াল মাহের বলল,

-” তুমি গিয়ে রেস্ট করো। ”

হৈমীকে রুমে রেখে সূচনার কাছে এলো মাহের। হামিদা সঙ্গে এসেছে। হৈমীর যত্নে ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আপাতত সূচনাকে সময় দেয়া প্রয়োজন। আবহাওয়া বেশ শীতল। তবুও ফ্যান জুড়েছে সূচনা। মাহের অবাক হলো। বলল,

-” তোমার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে? ”

-” ভীষণ অস্থির লাগছে মাহের। কাউকে একটু বলবে আমাকে এক গ্লাস শরবত করে দিতে? ”

সময় অপচয় না করে জলদি নিচে চলে গেল মাহের। রিনা কাকিকে দিয়ে শরবত পাঠাল উপরে। তার সূক্ষ্ম বুদ্ধিতে চট করেই ধরা পড়ল বিশেষ কিছু। মনে মনে বলল,

-” উপরওয়ালার লীলাখেলা বোঝা বড়োই মুশকিল! যা ভাবছি তাই যদি সত্যি হয়… ”

এক মুহুর্ত চোখ বুজল মাহের। বুকের ভেতরটায় উত্তেজনা শুরু হলো। ত্বরিত চলে গেল কাছাকাছি এক ফার্মেসীতে। ফিরে আসার পর সূচনার হাতে প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট কীট দিতেই আচমকা বিস্ফোরিত চোখে তাকাল সূচনা। জিভ কেটে বলল,

-” আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম মাহের। আ’ম সরি… ”

ঈষৎ হেসে মাহের বলল,

-” ইট’স ওকে। এ’কদিন আমাদের ওপর যা গেল। খেয়াল না থাকাই স্বাভাবিক। যাও… আমার হার্টবিট ফার্স্ট হয়ে গেছে। ”

সহসা নিজের বুকের বা’পাশে হাত রাখল সূচনা। আচম্বিতে চোখ পড়ল মাহেরের স্তব্ধ দৃষ্টিতে। কাঁপা স্বরে বলল,

-” আমারো… ”

……..
হাত, পা ক্রমাগত কাঁপছে সূচনার। মাহের তাকে শক্ত করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছে। একে বোধহয় মহান আল্লাহর নেয়ামত বলে। মাহের আনন্দে দিশেহারা হয়ে বলল,

-” আমাদের কারো সঙ্গে আর খারাপ হবে না সূচনা। বোনের ঘরে যে নেয়ামত এলো সেই উছিলায় এবার আমাদের ঘরেও নেয়ামত ঢেলে দিলেন সৃষ্টিকতা। ”

চোখ দু’টি বন্ধ সূচনার। মাহের বুকে মুখ গুঁজে আছে সে। ডানহাতটা পেটের ওপর আলতো ছুঁয়ে। সেই হাতের ওপর আলগোছে মাহেরের হাত পড়ল। সূচনা খুশিতে, লজ্জায় মুখ তুলতে পারল না আর। মা হবে সেও মা হবে। সে ব্যর্থ নয়, সে অক্ষম নয়। চোখ গলে পানি পড়তে শুরু করল এবার। টের পেয়ে মাহের বলল,

-” ডোন্ট ক্রাই সূচনা। ইউ আর প্রেগন্যান্ট। সো, উই উইল বি ফাদার এণ্ড মাদার। ”
_________________________
শেখ বাড়িতে আরো একটি খুশির সংবাদ। এই সংবাদে সূচনা, মাহেরের পর সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন হামিদা বেগম। এ কয়েকদিন রুদ্র হৈমীকে নিয়ে এত বেশি বিভোর ছিল যে বাচ্চাদের সব দায়িত্ব সূচনা আর মাহের পালন করেছে। হসপিটাল ছুটোছুটি, ডক্টরদের সঙ্গে বুঝ, পরামর্শ সব৷ সচক্ষে সেসব দেখে হামিদা সৃষ্টিকর্তার নিকট কত আকুতি করেছে। সূচনার বাচ্চাদের প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা তার মাতৃ হৃদয়কেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। অবশেষে তাদের চাওয়া পূর্ণ হলো। সৃষ্টিকর্তা মুখ তুলে চেয়েছেন। আর কোনো খারাপ কারো সাথে না হোক। হৈমীর বাচ্চা দু’টো সহিসালামতে হৈমীর বুকে ফিরুক। তার দুই ছেলে, মেয়ের সুখ কানায় কানায় পূর্ণতা পাক এই কামনাই করল হামিদা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here