Mr_Husband,পর্ব_১৩,১৪

0
3424

#Mr_Husband,পর্ব_১৩,১৪
#লেগিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_১৩

ঘুমের ঘোরে মুনের পেটের উপর থেকে শাড়ি টা সরে গেছে। যার কারণে মুনের হলুদ ফর্সা পেট কিছুটা দৃশ্যমান হয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে আঁধারের মাথায় রক্ত উঠে যায়। এই কারণেই আঁধার মুন কে আগেই সাবধান করে দিয়ে ছিল যাতে মুন শাড়ি না পরে। কিন্তু আঁধারের কথার অবাধ্য হয়ে মুন আজ শাড়ি পরলোই। মুন নিজেকে গুটিয়ে ঘুমাচ্ছে। এ জন্য কেটে যাওয়া আঙ্গুলে চাপ লেগে তার থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আঁধার খেয়াল করলো মুন কিছুক্ষণ পর পর হঠাৎ করেই কেঁপে কেঁপে উঠছে। আঁধারের চোখ যায় মুনের কোলের উপর রাখা ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে। আঁধার সোজা গিয়ে খুব রুড ভাবে মুনের হাতের ব্যান্ডেজ খুলতে লাগলো। মুন ঘুমের মধ্যে নিজের হাতে ব্যথা অনুভব করে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করতে পারছে না। শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে। আঁধার ব্যান্ডেজ টা খুলে ফেলে দিতেই মুনের হাতের এই অবস্থা দেখে যেন ওর মাথায় ওঠা রক্ত গুলো টগবগ করে ফুটতে শুরু করে। আঁধার মুনের হাত ধরে এক টানে ঘুমন্ত মুন কে উঠিয়ে দাঁড় করায়। মুনের হাতে কালো রেশমী চুরি ছিলো। আঁধার মুনের হাত এতো শক্ত করে ধরেছে যে চুরি গুলো মটমট করে ভেঙ্গে ওর হাতে ঢুকে যায়। মুন আধো আধো চোখে আঁধারের দিকে তাকায়। মুনের কোনো খেয়াল’ই নেই যে ওর হাতে চুরি ভাঙ্গা কাঁচ ঢুকে গেছে। আঁধার কে দেখে মুন হেসে বলল,

—“Mr.Husband আপনি এসে গেছেন?”

আঁধার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—“হাউ ড্যার ইউ?”

মুন অবুঝ স্বর বলল,

—“মানে?”

আঁধার হুংকার দিয়ে বলল,

—“তোমার সাহস কি করে হয় আমি বারন করার পরও কিচেনে যাওয়ার।”

মুন আঁধারের হুংকার শুনে ভয়ে চোখ, কান বন্ধ করে নেয়। আঁধার মুনের বাহু শক্ত চেপে করে ধরে
আবারো বলল,

—“আমি বারবার করে বলেছিলেন যে শাড়ি পরবে না। তারপর ও তুমি আমার অবাধ্য হয়ে তাই করেছ। বলো কে দিয়েছে তোমাকে এতো সাহস?”

মুন ব্যথায় প্রায় কেঁদেই দিয়েছে। মুন কাতর কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

—“আমার খুব লাগছে। প্লিজ ছাড়ুন।”

আঁধার মুনের পোড়া হাত টা ওর সামনে ধরে। তারপর চেঁচিয়ে বলল,

—“পাকামি করে হাত পোড়ানোর সময় মনে হয় নি যে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে? তাহলে এখন কেন লাগছে? আর যেটা করার যোগ্যতা নেই সেটা করতে যাও কেন?”

শেষ কথাটা মুনের ইগোতে গিয়ে লাগে। মুন শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে আঁধার কে ধাক্কা দেয়। আঁধার কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। মুন চিৎকার করে বলল,

—“কজ আমি শুধু আপনাকে খুশি করতে চেয়ে ছিলাম। আজ আমাদের বিয়ের ছয় মাস পুর্ন হয়েছে তাই আমি রান্না না জানার স্বত্বেও শুধু আপনার জন্য নিজ হাতে আপনার পছন্দের কিছু রান্না করতে চেয়ে ছিলাম। আরে আমার হাত পুড়ে গেছে তাতেও আমার কোনো ভ্রুক্ষেব ছিল না। বিশ্বাস করুন ততটা কষ্ট হয়নি যতটা এখন আপনার কথা গুলো শুনে হচ্ছে।”

—“যাস্ট স্যাট আপ। কে বলেছিল আমাকে খুশি করার জন্য এসব করতে? আমি নিজে বলে ছিলাম তোমাকে?”

মুন ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

—“আপনার কাছে কারো ফিলিংসের কোনো মূল্য’ই নেই। সত্যি’ই আপনি একটা হার্ট লেস পার্সন। যার মন বলতে কিছু নেই।”

আঁধার টি টেবিলে সজোরে লাথি মেরে গর্জন করে বলল,

—“হ্যা হ্যা! আমি হার্ট লেস পার্সন। আমি অনুভূতি শূন্য মানব। যার হৃৎপিণ্ড তোমাদের মতো নরম তুলোর মত নয় বরং শক্ত পাথরের মতো। যে পাথর লোহা দিয়ে আঘাত করেও কেউ ভাঙ্গতে পারবে না। আমি তোমাদের মতো মানুষের তুচ্ছ অনুভুতি গুলোকে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন বোধ করি না।”

বলেই আঁধার রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মুন কাঁদতে কাঁদতে ওভাবেই নিচে বসে পরে আর বলে,

—“আপনি সত্যিই খুব খারাপ Mr.Husband”

মুন চিৎকার করে করে কাঁদছে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কেনো হচ্ছে তা ওর অজানা। মুন না পেরে চুরি ভিঙ্গা কাঁচ উঠিয়ে বাম হাতে একেরপর এক টান দিতে লাগলো। সাথে সাথে ফিকনি দিয়ে ডালিমের মতো লাল রক্ত গড়িয়ে পরতে লাগলো। সাদা টাইলসের ফ্লোর রক্ত লাল হয়ে গেল। মুন ছোটবেলা থেকেই এরকম। যখন’ই ওর রাগ হয় অথবা কষ্ট হয় ও তখন’ই নিজেকে আঘাত করে রক্ত ঝরায়। এটা ধীরে ধীরে বদভ্যাসে পরিনত হয়। মুন জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছে। কিন্তু এই চিৎকার কেউই শুনতে পায় না। এই চার দেয়ালের মধ্যে’ই আবদ্ধ থেকে যায়। শুধু এই চার দেয়াল আর রুমের জিনিস পত্র গুলোই সাক্ষী থেকে রায় মুনের কষ্টের। সারাদিন না খাওয়ার কারণে এমনিতেই শরীর দুর্বল। আবার হাত পুড়ে যাওয়ায় জ্বর এসেছে। তার উপর এখন আবার হাত কাটার কারণে প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। সবকিছুর ধাক্কল মুন নিতে না পেরে ও ভাবেই জ্ঞান হারায়। চোখের কোণিশে বেয়ে বিন্দু বিন্দু জল পরছে।

.

রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে যায়। আবার সকাল পেরিয়ে রাত। কিন্তু আঁধার কাল রাতের পর আর বাসায় ফেরেনি। এদিকে ১১:৫৬ বাজে মুন সারা দিনেও দরজা খুলেনি। আরমান রেজওয়ান, আরিফা রেজওয়ান, আলিয়া, চুমকি সবাই খুব চিন্তিত। সকাল থেকে রুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে কিন্তু মুন খুলছে না। দরজা ভাঙ্গতেও পারছে না। আর রুমের ডুবলিকেট চাবি ও আঁধারের কাছে থাকে। কি করবে কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। সকাল থেকে আঁধার কে ফোনে ট্রাই করছে। কিন্তু ফোন সুইচ অফ। টেনশনে আরিফা রেজওয়ানের বিপি হাই হয়ে গেছে। তাই আরমান রেজওয়ান তাকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। আলিয়া জোর করে আরিফা রেজওয়ান কে রুমে নিয়ে গিয়ে রুয় পালিয়েছে। আরমান রেজওয়ান সিঙ্গেল সোফায় দু ভ্রুর মাঝে আঙ্গুল চেপে বসে আছে। আর আলিয়া বড় সোফায় বসে এখনো আঁধার কে ফোনে ট্রাই করছে। ঠিক ১২ টার সময় রেজওয়ান মেনশনে পা রাখে আঁধার। আরমান রেজওয়ান আঁধার কে দেখেই উঠে দাঁড়ালো তারপর গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,

—“কাল রাত থেকে আজ রাত অবধি কোথায় ছিলে আর কি করছিলে?”

আঁধার দরজার কাছে দাঁড়িয়েই আরমান রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো,

—“একটা কাজে ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছিল।”

—“তাহলে ফোন কেন বন্ধ ছিল তোমার?”

—“ওখানে নেটওয়ার্ক ছিল না।”

—“এখন তাহলে কেন বন্ধ বলছে?”

—“আসার সময় ফোন চুরি হয়ে গেছে।”

—“নিজের স্ত্রীর খোঁজ খবর রাখার কোনো প্রয়োজন মনে করো?”

আঁধার ভ্রু কুঁচকে আলিয়ার দিকে তাকায়। আলিয়া বলল,

—“মিষ্টি কাল রাতে তুমি যাওয়ার পর থেকেই হয়তো এখন পর্যন্ত দরজা খুলে নি। অনেক ডেকেছি দরজা ধাক্কিয়েছি কিন্তু কোনো রেসপন্স পাইনি।”

আঁধার আলিয়ার পুরো কথা শুনলো ও না। মুন কাল রাত থেকে দরজা খুলে নি শুনেই আঁধার ঝড়ের গতিতে রুমের দিকে গেল। তারপর দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে ধমকের সুরে বলল,

—“মুন এক্ষুনি দরজা খুলো বলছি। নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। মুন! আমি কিন্তু দরজা ভেঙ্গে দিবো। আর আমি যদি দরজা ভেঙ্গে রুমে ঢুকি তাহলে তো জানোই সেটা খুব বেশী ভালো হবে না তোমার জন্য।”

ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স পাওয়া গেল না। হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন ভয়েরা আঁধার কে জেঁকে ধরলো। ভয় বলতে কোনো শব্দ আঁধারের Dictionary তে ছিল না। ভয়েরা আঁধার কে কখনো কোনো পরিস্থিতিতে’ই কাবু করতে পারেনি।
তাহলে আজ কি হলো। আঁধারের বুকের বাম পাশে থাকা হৃৎপিণ্ড টা কেন জানি জোরে জোরে লাফাচ্ছে। আঁধারের মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে ‘মুনের কিছু হয়নি তো?’ আঁধার জানে মুন খুব বেশী ইমোশনাল। ছোটখাটো বিষয়েও ইমোশনাল হয়ে পরে। ওর সাথে একটু জোর গলায় কথা বললেই কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দেয়। সেখানে তো কাল রাতে আঁধার ওর সাথে অনেক বেশি বাজে ব্যবহার করেছে। আঁধার আর কিছু ভাবতে পারছে না। যত ভাবছে ততোই যেন ভয়ে রা ওকে জেঁকে ধরছে। এর’ই মধ্যে আরমান রেজওয়ান আর আলিয়া ও এসে পরে। আঁধার কিছু না ভেবেই দরজায় সজোরে এক লাথি মারে সাথে সাথেই দরজার লক ভেঙ্গে দরজা খুলে যায়। আর নিচে পরে থাকা মুন কে দেখে সবাই আঁতকে উঠে।
ফ্লোরে রক্ত শুকিয়ে আছে। মুন নিচে পরে আছে। হাতে রক্ত জমাট বাঁধা। আঁধার খুব প্রিয় কিছু হারানোর ভয় অনুভব করছে নিজের মধ্যে। আঁধার ছুটে গিয়ে মুনের মাথাটা নিজের কোলের মধ্যে নেয়। গালে হালকা চড় মুন কে ডাকতে লাগলো,

—“মুন! মুন! মুন কি হয়েছে তোমার? কথা বলো প্লিজ। অ্যাম সরি। আমি আর কখনো তোমার সাথে মিস বিহেভ করবো না। রুড হয়ে কথা বলবো না। ধমকাবো না। আর কখনো পানিসমেন্ট ও দিবো‌। এন্ড আমি তোমার বন্ধু হতেও রাজি। শুধু বন্ধ না খুব ভালো বন্ধু। তাও প্লিজ কথা বলো তোতাপাখি।”

—“ভাই! ভাই মিষ্টির কিছু হবে না। আগে ওকে বেডে শোয়াও। ওর অনেক বেশী ব্লিডিং হয়েছে। তাড়াতাড়ি ফাস্টেড করতে হবে। নাহলে ইনফেকশন হতে পারে।”

আঁধার তাড়াতাড়ি মুন কে কোলে তুলে নিলো। তারপর ওকে বেডে শুইয়ে দিলো। আলিয়া তাড়াতাড়ি গিয়ে গরম পানি আর ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। আঁধার মুনের পালস রেট চেক করলো অনেক লোক। দুদিন ধরে কিছু খায় নি তার উপর আবার শরীর থেকে এতো ব্লাড বের হয়ে গেছে। এতো ধাক্কল নিতে পারছে না মুনের শরীর। আঁধার প্রথমে গরম পানি দিয়ে ভালো করে মুনের হাত টা পরিষ্কার করে নিলো। তারপর ব্যান্ডেজ করে দিলো। পুড়ে যাওয়া হাতটাও ড্রেসিং করে দিলো। মুনের অনেক জ্বর উঠেছে। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আলিয়া বলল,

—“ভাই আমি মিষ্টি’র শরীর মুছে দেই তাহলে যদি ওর জ্বর কিছুটা কমে।”

আঁধার বের হতেই দেখে আরিফা রেজওয়ান ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসছে। আরিফা রেজওয়ান আঁধার কে কিছু না বলেই রুমে চলে যায়। আর দরজা লাগিয়ে দেয়। আরমান রেজওয়ান অনেক আগেই চলে গেছেন নিচে। সে খুব চিন্তিত কবির খান যদি এসব শোনে তো কেলেংকারি হয়ে যাবে। মেয়েকে নিয়ে সেই খুব বেশি সিরিয়াস। মেয়ের গায়ে ফুলের টোকাও সে সহ্য করে পারে না। আঁধার নিচে গিয়ে চুমকিকে ভেজিটেবল স্যুপ, দুধ আর ডিমের মিল্ক শেক বানিয়ে উপরে নিয়ে যেতে বলল। আরিফা রেজওয়ান মুনের মাথা। জ্বল পট্টি দিচ্ছে আর আঁধার মুন কে স্যুপ খাওয়াচ্ছে। আলিয়া কে আঁধার পঠিয়ে দিয়েছে রেস্ট নিতে। আরিফা রেজওয়ান কে ও বলেছিল কিন্তু তার এক কথা মুনের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত সে কোথাও যাবে না। আঁধার মুনকে স্যুপ আর মিল্ক শেক খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়। আরিফা রেজওয়ান জ্বল পট্টি দিতে দিতে বেডের পাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু আঁধারের চোখে ঘুম আসে না আঁধার জ্বল পট্টি দিতে থাকে। আর এক দৃষ্টিতে মুনের শুকনো মায়া ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে থকতেই কখন যে রাত পার হয়ে যায় আঁধার তা জানেই না।

চলবে,

#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_১৪

মুনের অবস্থা খুব করুন। এখনো জ্ঞান‌ ফেরেনি। জ্বর ও একটুও কমেনি বরং আরো বেড়েছে। তাই ইমিডিয়েটলি ওকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে। মুনের শরীরে রক্তের শূন্যতা তার উপর হাত কাটার কারণে প্রচুর পরিমাণে ব্লিডিং হয়েছে। তাই এখনি ইমিডিয়েটলি ওকে রক্ত দিতে হবে। না হলে খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেতে। হসপিটালে শুরু এক ব্যাগ রক্ত আছে আরো দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। আঁধার আর আরমান রেজওয়ান রক্ত নিতে বাইরে গেছে। আলিয়া সিটে বসে কান্নাকাটি করছে। আরিফা রেজওয়ান নামাজ পড়ে মুনের জন্য দোয়া করছেন। কবির খান এখনো কিছু জানেন না। তাকে কিছু জানানো হয় নি।

.

তিন দিন পর মুনের সেন্স ফিরে। সেদিন’ই হসপিটালের সব ফরমালেটি পূরণ শেষ করে মুন কে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেদিন থেকেই সবাই আরো বেশি মুনের খেয়াল রাখতে শুরু করে। আলিয়া মুনের অজ্ঞান অবস্থায় আঁধার যা যা বলেছিল সব বলে মুন কে। মুনের নিজের কান কে বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হয়। আঁধারের পাথরের মনে মুনের জন্য একটা অদৃশ্য অনুভূতি জন্ম নেয়। সেই অনুভুতির মানে আঁধারের জানা নেই। এভাবে দিন যেতে লাগলো। মুন এখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু দিন দিন মুন আঁধার কে ইগনোর করতে শুরু করে। খুব বেশী প্রয়োজন না হলে আঁধারের সাথে কথা বলে না। ওর থেকে দূরে দূরে থাকে। আঁধার যেদিন বাসায় থাকে সেদিন মুন আলিয়া অথবা আরিফা রেজওয়ানের রুমে গিয়ে গল্প করে সময় কাটায়। আর রাতে আঁধারের আগে খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে চুপটি মেরে শুয়ে থাকে। ইদানিং আঁধার বুকের বাম পাশে হঠাৎ করেই চিনচিন ব্যথা শুরু হয় কেমন যেন খালি খালি অনুভব হয়। আবার মুন কে দেখলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যায়। আঁধারের কাছে এখন মুনের সব কিছুই ভালো লাগে। কিন্তু মুনের এই ইগনোরেন্স আঁধার আর সহ্য করতে পারছে না।আঁধার মুন কে একদিন একা পায় সেদিন ওর হাত পা বেঁধে বেডের উপর বসায় আর নিজেও ওর পাশে বসে। মুন ছাড়া পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে। যা দেখে আঁধার বাকা হেসে বলল,

—“ছোটাছুটি করে কোনো লাভ নেই। আমি না চাইলে তুমি আমার বাঁধন থেকে কখনোই ছাড়া পাবে না। কারণ তুমি আমার বন্দিনী।”

মুন কটমট করে তাকায়। মুনের তাকানো দেখে আঁধার নিঃশব্দে হাসে। তারপর হঠাৎ করেই চোখ মুখ শক্ত করে গম্ভীর স্বরে বলল,

—“কি হয়েছে তোমার? আমাকে ইগনোর করছো কেন?”

আধার মুনের মুখে তখন টেপ লাগিয়ে দিয়েছিল। তাই মুন রেগে মনে মনে বলল,

—“মুখে টেপ মেরে দিয়ে প্রশ্ন করলে উওর কি আমি তোর মুখ দিয়ে দিবো শালা খবিশের বাচ্চা খবিশ?”

—“না না আমার মুখ দিয়ে দিবে কেন? নিজের মুখ দিয়েই দিবে। দাঁড়াও আমি টেপ টা খুলে দিচ্ছে।”

মুন আবারো মনে মনে ত্যাড়া উওর’ই দিলো,

—“বসে আছি ভালো লাগছে না যে আবার দাঁড়াতে বলছিস?”

আঁধার মুনের মুখ থেকে টেপ টা খুলে বলল,

—“নেও মুখ খুলে দিয়েছি এবার বলো কি সমস্যা?”

—“আমার কোনো সমস্যা নেই আপনার থাকলেও থাকতে পারে।”

আঁধার চোখ ছোট ছোট করে বলল,

—“মানে?

—“কিছু না। আমার বাঁধন খুলে দেন আমার কাজ আছে।”

—“খুলবো। তার আগে বলো আমাকে ইগনোর করার কারণ কি?”

—“আপনার কেন মনে হচ্ছে যে আমি আপনাকে ইগনোর করছি?”

—“তুমি ইগনোর করছো তাই আমার মনে হচ্ছে। তুমি আমার সাথে প্রয়োজনের বাইরে খুব বেশি কথা বলো না। আমার থেকে সবসময় দূরে দূরে থাক। এগুলো কে কি বলে?”

মুন এবার চেঁচিয়ে বলল,

—“হ্যা হ্যা আমি আপনাকে ইগনোর করছি। কারণ আমি আপনার যোগ্য না। আমার কোনো যোগ্যতা নেই আপনার পাশে দাঁড়ানোর। সেটা আপনি আমাকে সেদিনই বুঝিয়ে দিয়ে ছিলেন।”

আঁধার ও এবার রেগে গেল। আঁধার সেদিন ওকে অযোগ্য বলে নি। শুধু এটুকু বুঝাতে চেয়েছে যে ও যেটা পারে না সেটা না করাটাই ভালো। আঁধার মুনের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—“সবসময় তিন লাইন বেশী বোঝাটা কি তোমার জন্ম গত রোগ? অন্যরা তাও দু লাইন বেশী বুঝে আর তুমি………স্টুপিড একটা।”

মুন চেতে বলল,

—“আপনি স্টুপিড।”

—“দিন দিন সাহস কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে তোমার।”

—“একদম ভয় দেখাবেন না বলে দিচ্ছি। আমি আপনাকে মোটেও ভয় পাই না।”

আঁধার চোখ ছোট ছোট করে বলল,

—“আচ্ছা?”

—“সেদিন আমি যখন অজ্ঞান ছিলাম তখন কি বলে ছিলেন সেগুলো মনে নেই?”

—“কি বলেছিলাম?”

আঁধার ভাবার এ্যাকটিং করে বলল। মুন মনে করিয়ে দিয়ে বলল,

—“নো ধমক, নো রুড বিহেভ, নো পানিসমেন্ট।”

আঁধার ভুলে যাওয়ার ভান করে বলল,

—“সত্যি এরকম কিছু বলে ছিলাম? আমার তো কিছু মনে পরছে না।”

—“কিইইইই?”

মুন তেড়ে গেল আঁধারের দিকে। কিন্তু হাত পা বাঁধা থাকায় কিছুই করতে পারলো না। আঁধার হাসতে লাগলো। আর আঁধার কে হাসতে দেখে মুন ও হেসে দিলো। আবার দু’জনের খুনসুটি শুরু হয়ে গেল। এই ঘটনাটিই হয়তো ওদের ভালোবাসার প্রথম ধাপ ছিল। আঁধারের মনে মুনের জন্য প্রথম কোনো অজানা অনুভুতির শুরু।

.

মুন নির্জন অন্ধকার রাস্তায় প্রাণপণ চেষ্টা করে দৌড়াচ্ছে। আজ যদি ওই নরপিশাচদের হাতে পরে তাহলে হয়তো কাল সকল পত্রিকার হেডলাইন ও হবে। সবাই ওকে ধর্ষিতা বলেই জানবে। আর এই ধর্ষিতার উপাধি নিয়ে অন্তত মুন বাঁচতে পারবে না। তাই আজ ওকে দৌড়াতে হবে। মুন মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছে। সে যেন কোনো দেবদূত পাঠিয়ে দেয় ওকে বাঁচাতে। মুনের মন শুধু একজন মানুষকেই এখন এই সময় সাহায্যের জন্য চাইছে আর সে হলো আঁধার। মুন দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় কিছুর সাথে বেজে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। মুন মাথা তুলে দেখে একটা মাক্স পরা লোক চেয়ারে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে। আর তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে চারজন মুখুশধারী লোক। আর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আরো দশবারো জনের মতো। মুনের চুল গুলো এলোমেলো হয়ে ঘামে ভেজা মুখের সাথে লেপ্টে আছে। চোখে মুখে ভয়। ভয়টা নিজের আত্ম সম্মান হারানোর। মুন করুন দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো। মুনের সাদা রঙের কুর্তির হাতা ছেড়া। হাতে আঁচড়ের দাগ রক্ত বেয়ে বেয়ে পরছে। মুনের বুকে ওড়না নেই যার কারণে ওর শরীরের ভাঁজ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বসে থাকা লোকটি ইশারা করতেই সবাই নিজের চোখ নিচে নামিয়ে নিলো শুধু একজোড়া জ্বলন্ত আগুনের গোলার মতো চোখের অধিকারী ছাড়া। AR এক দৃষ্টিতে মুনের দিকে তাকিয়ে আছে। এর’ই মধ্যে ওই নরপিশাচ গুলো মুন কে ধাওয়া করতে করতে ওখানে পৌঁছে যায়। তাদের একজনের হাতে মুনের পরনের সাদা রঙের কুর্তির ওড়না। লোকটা বিচ্ছিরি ভঙ্গিতে মুনের ওড়না টা নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রান শুকে মুনের দিকে তাকায়। ওই নরপিশাচ গুলো তখনো AR কে খেয়াল করে নি। নাহলে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস ও ওরা পেত না। মুনের চোখে জল টলমল করছে। ও AR এর দিকে কুরুণ চোখে তাকায়। ওর চোখ যেন বলছে ‘আমাকে প্লিজ এই নরপিশাচদের হাত থেকে বাঁচান। নাহলে এরা আমাকে খুবলে খুবলে খাবে।’ হঠাৎ করেই AR চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। ওই নরপিশাচ গুলো’র মধ্যে একজন কিছু বলতে যাবে তার আগেই AR ওদের ইচ্ছে মতো মারতে লাগলো। AR মারতে মারতে সব গুলো কে আধ মরা বানিয়ে ফেলেছে। সবাই শুধু পাথরের মূর্তির মত দেখছে। তার হাতে মুনের ওড়না ছিল AR ওই ছেলেটার গলা চেপে ধরে হুংকার দিয়ে বলল,

—“আমার জিনিসে হাত দেয়ার তোরা সাহস পেলি কোত্থেকে? জানিস এর শাস্তি কি? এর একটাই শাস্তি আর সেটা হলো মৃত্যু।”

বলেই AR নিজের ব্যাক পকেট থেকে গান টা বের করে একেরপর এক গুলি চালাতে লাগলো ছেলেটার বুকে। গুলির শব্দ মুন ভয় পেয়ে যায়। নিজের কানে হাত চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নেয়। AR সবগুলো নরপিশাচ কে মৃত্যু পুরিতে পঠিয়ে দেয়। AR মুনের সামনে হাঁটু ভেঙ্গে বসে। তারপর ওর গায়ে ভালো করে ওড়নাটা পেঁচিয়ে দেয় আর নরম সুরে বলে,

—“ভয় পেয়ো না মনপাখি আমি আছি তো।”

মুন তখনো চোখ খোলে নি কিন্তু AR এর মিষ্টি কন্ঠে এমন কথা শুনে মুন সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। মুনের কন্ঠ স্বর টা খুব চেনা চেনা লাগে। মনে হয় আগেও শুনেছে। AR চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আঁধার গাড়ি নিয়ে আসে। আঁধার গাড়ি থেকে নেমেই ছুটে আসে মুনের কাছে। মুনের এরকম অবস্থা দেখে ওকে বুকের বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। আঁধার মুনের কাছে গিয়ে ওকে আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মুন ও আঁধার কে জরিয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এভাবেই কিছুক্ষণ কেটে যায় আঁধার মুনের গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,

—“তুমি ঠিক আছো তো তোতাপাখি?”

মুন কাঁদতে থাকে কোনো জবাব দেয় না। আঁধার আবারো বলল,

—“হুঁশ! একদম কান্না করবে না। আমি এসে গেছি। এখন আর কিছু হবে না।”

আধার মুন কে ধরে গাড়িতে বসায়। মুন তখনো কাঁদছিল। বাড়িতে গিয়ে এ বিষয়ে কেউই কিছু বলে না। রাতে আঁধার সোফায় ঘুমাচ্ছে হঠাৎ করেই মুনের কান্নার আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। আঁধার ধরফরিয়ে উঠে মুনের কাছে যায়। মুন আজ কের ঘটনাটাই হয়তো স্বপ্নে দেখছে। ওর মনে গেঁথে গেছে ঘটনা। আঁধার মুন কে শান্ত করার জন্য ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে। মুন আস্তে আস্তে আবারো আঁধারের বুকে ঘুমিয়ে যায়। আঁধারের নিজের প্রতি’ই রাগ লাগছে। কেন ও মুন কে একা ছেড়ে ছিল। কেন সাথে যায় নি। আঁধার ঘুমন্ত মুন কে প্রমিস করে আর কখনো ওকে একা ছাড়বে না। সারাজীবন ওকে এভাবেই নিজের বুকের মাঝে আগলে রাখবে।

.

সেদিনের পর থেকে আঁধার আর কখনো মুন কে একা কোথাও ছাড়ে নি। মুন ও আর দ্বিতীয় বার সাহস করেনি একা কোথাও যাওয়ার। আঁধারের মনে মুন কে হারানোর ভয় যেন আঁকড়ে ধরে ছিল। তাও একবার না দু’বার। সব’ই ঠিক চলছিল। দু’জনের মধ্যে একটা অদৃশ্য টান, একটা অদৃশ্য অনুভূতি জন্ম নিয়ে ছিল। একজনের জন্য আরেকজনের মনে মায়া জন্মে ছিল। কিন্তু ওদের দুজনের কাছে আসাটা হয়তো কারো সহ্য হলো না। শুক্রবার দিন আঁধার আর মুন ঘুরতে বেরিয়ে ছিল। মুন খুব খুশি ছিল। ওরা শপিং করে লাঞ্চ করতে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। আঁধার মুনের পছন্দের সব কিছু অর্ডার করছিল। মুন আর আঁধার খাওয়া শুরু করে। হঠাৎ আঁধারের ফোনেকল আসে। আঁধার হাসি খুশি ভাবেই কল অ্যাট্যান্ড করতে ওয়াশ রুমে চলে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর গম্ভীর মুখে ফিরে আসে। এসেই ভারী গলায় বলল,

—“মুন আমার একটা কাজ আছে। তোমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আমাকে যেতে হবে।”

মুন অবাক হয়ে আঁধারের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর কিছু না বলেই চুপচাপ উঠে গাড়িতে গিয়ে বসে। আঁধার মুন কে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ওকে কিছু না বলেই চলে যায়। মুনের কিছুটা খারাপ লাগে। মুন মন খারাপ করে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। আরমান রেজওয়ান, আরিফা রেজওয়ান, আলিয়া, মুন সবাই ড্রইং এ বসে গল্প করছিল। আসিক, আপন, অয়ন, আর ইশী মানে আঁধারের বন্ধুরাও এসেছে। আলিয়া আপনের দিকে তাকিয়ে আছে। আপন ও কিছুক্ষণ পর পর ঘুরে ফিরে আলিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। মুন বুঝতে পারে ওদের মধ্যে কোনো খিচুড়ি পাকছে। মুন আলিয়কে হালকা ধাক্কা মেরে ওর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

—“ও হো তলে তলে টেম্পু চালানো হচ্ছে বুঝি? চালিয়ে যাও আমি তোমার সঙ্গে আছি। এমনিতেও ছেলেটা দেখতে খারাপ না। আবার পুলিশ অফিসার। খুব মানাবে।”

আলিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মুন খিলখিল করে হাসছে। কিন্তু এই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মেইন ডোর খোলা ছিল। আঁধার পাঁজা কোলে করে একটা মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। আঁধারের কোলে অন্য একটা মেয়েকে দেখে মুনের হাসি নিমিষেই মিলিয়ে গেল। উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালো। মুনের চোখে মুক্তোর মতো অশ্রু গুলো চিকচিক করছে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here