অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-১০||

0
1594

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১০||

১৮.
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর নতুন শ্রেণিতে উঠতে গিয়েই সংকটে পড়তে হচ্ছে ছ’জনকে। এই মাসে সালেহ আলীর কাছে কোনো টাকা আসে নি। গতমাসের সঞ্চয় করা টাকা দিয়েই তাদের এই মাস কাটছে। রহমত চাচা কেন হঠাৎ টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন, সেটাই এখন ভাবনার বিষয়।

এদিকে ছ’জনের পক্ষে নতুন শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার মতো টাকা নেই। এখন পড়াশুনা ছাড়াও তাদের পক্ষে সম্ভব না। আপতত দু’জনকে ভর্তি করানো সম্ভব। তাই সিদ্ধান্ত হলো কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাকী টাকা জোগাড় করতে হবে, নয়তো ইভান আর আরাফই এই বছর নতুন শ্রেণিতে ক্লাস শুরু করবে।

বিকেলে সুরাইয়া তার সন্তানদের নিয়ে অরুণিকাদের ঘরে এলেন। সুরাইয়া আর সালেহ আলীর তিন সন্তান। ডুমুর তাদের বড় মেয়ে, সে শতাব্দীর বয়সী। বাঁধন অরুণিকার চেয়ে বছর তিনেক বড়। আর খোকার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। তাহমিদ সুরাইয়ার বাচ্চাদের দিকে এক নজর তাকিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালো। এদিকে ডুমুর খালি পায়ে বিছানায় উঠে বসলো। তাহমিদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই সুরাইয়া বললেন,
“শুনলাম, তোমাদের স্কুলের ভর্তির জন্য নাকি টাকা নেই!”

তাহমিদ চুপ করে রইলো। তূর্য বলল,
“হ্যাঁ, চাচী। আমাদের তো টাকার দরকার ছিল। রহমত চাচা টাকাটা পাঠাচ্ছেন না, তাই এতো ঝামেলা হচ্ছে।”

সুরাইয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“তোমরা রহমত ভাইয়ের ভরসায় থেকো না। উনি বড্ড ঝামেলায় আছেন। কাল তোমাদের চাচা বলছিলেন, উনার উপর নাকি হামলা হয়েছে। কে নাকি রাবার বুলেট ছুঁড়েছে।”

সুরাইয়ার কথা শুনে ছ’জনই অবাক হলো। ইভান জিজ্ঞেস করলো, “কে করেছে এমন?”

“আমি তো জানি না, বাবা। তবে উনার পক্ষে এখন আর প্রতি মাসে টাকা পাঠানো সম্ভব না। এতোদিন যেই টাকা পাঠাচ্ছিল, ওগুলো কিভাবে দিয়েছেন জানি না। শুনলাম তোমাদের বাবা-চাচাদের একাউন্টে অনেক টাকা আছে। সেগুলো তোমরা ছাড়া আর কেউ উঠাতে পারবে না। এখন তোমাদের তো আর ওখানে যাওয়াও সম্ভব না।”

ইমন বলল,
“ওই টাকাগুলো উঠাতে পারলে আমাদের আর এখানেই থাকতে হতো না।”

“হ্যাঁ, ভালো বাসা নিতে পারতে। কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্য তো তোমাদের এখন সবকিছুই সহ্য করতে হবে। রহমত ভাই থেকে সব শুনলাম। তোমাদের পরিবারের সাথে যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে। বাবুনটার জন্য বেশি খারাপ লাগে। অল্প বয়সে কতো কিছু দেখে ফেলেছে!”

সুরাইয়া কিছুক্ষণ পর আবার বললেন,
“আসল কথায় আসি, যেই কারণে আমি এখানে এলাম।”

তারা ছ’জনই সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সুরাইয়া বললেন,
“তোমরা চাইলে কাজ করে খেতে পারো। তোমাদের চাচা বলছে, এভাবে অন্যের ভরসায় থাকলে তোমরা সামনে এগুতে পারবে না। কারণ আগামী মাস থেকে হয়তো দু’তিন মাস পর পর রহমত ভাই টাকা পাঠাবেন। পাঠাবেন এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

আহনাফ বিরক্তির সুরে বলল,
“তাহলে উনি কেন আমাদের ভরসা দিয়েছিলেন? আমরা ছ’জন একসাথে কিভাবে পড়াশুনা করবো? তাছাড়া খাওয়ার খরচ, থাকার খরচ ছাড়াও অনেক খরচ হয়ে যাচ্ছে। অরুর এখন পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। ওকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। এতোকিছু আমরা কিভাবে সামলাবো?”

সুরাইয়া ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,
“পাশের বাড়ির মুন্নি আপার অনেক বছর সন্তান হয় না। তারা একটা সন্তান দত্তক নিতে চাইছিল!”

সুরাইয়ার কথা শুনে সবার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। আরাফ চেঁচিয়ে বলল,
“চাচী, প্লিজ, এমন কথা আর বলবেন না।”

সুরাইয়া বললেন,
“জানি বাবা, এসব শুনে তোমাদের খারাপ লাগছে। কিন্তু তোমরা…”

আহনাফ সুরাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমরা কাজ করবো। কাল থেকেই কাজ খোঁজা শুরু করবো।”

তূর্য বলল,
“আমাকে সিনথিয়া আপুর খালা কাজ দিবেন বলেছিলেন। আমি ভালোই গান করতে পারি। হয়তো গান গেয়ে কিছু টাকা আয় করতে পারবো।”

তাহমিদ বলল,
“আর আমি তো খাবার বিক্রি করতে পারবো।”

ইভান বলল,
“আমি আমার চেয়ে ছোট বাচ্চাদের পড়াতে পারবো। আরাফও পারবে।”

ইমন কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আমি তো কিছুই পারবো না।”

আহনাফ কোণা চোখে ইমনের দিকে তাকালো৷ তারপর সুরাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ইমনকেও আমরা একটা কাজে ঢুকিয়ে দেবো।”

অরুণিকাকে দত্তক দেওয়ার কথা উঠতেই ছ’জনের মধ্যে এক ভয়ংকর উত্তেজনা চলে এলো। সুরাইয়া তা দেখে মনে মনে হাসলেন। তিনি এটাই চেয়েছিলেন। অন্তত তাদের মাঝে যদি একটু মানসিক গতি আসে, তাহলে এই সমস্যা তারা খুব সহজে কাটিয়ে উঠতে পারবে। কারণ সুরাইয়া জানে রহমত সাহেবের পক্ষে এতোগুলো ছেলেকে পড়াশুনা করানো সম্ভব না। উনার অবস্থা এখন খুবই খারাপ৷

সুরাইয়া অরুণিকার পাশে বসে বললেন,
“এই বাবুন, সকালে বাড়ি এসে বাঁধনের সাথে আরবি পড়তে বসো।”

এরপর আরাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“মৌলভী সাহেব খুব ভালো মানুষ। তোমাদের সমস্যার কথা বললে উনি টাকা নেবেন না। আর এখনই তো আরবি শেখার বয়স।”

ইমন বলল,
“আরবি কেন শিখতে হচ্ছে? আমি কতো আগে পড়েছি। মনেই নেই। এগুলো মনে থাকে না। আরেকটু বড় হলে নামাজ শিখলে চলবে।”

সুরাইয়া মুখে হাত দিয়ে বললেন,
“ওমন কথা বলছো কেন, বাবা? ও কি তাহলে কোর’আন শিখবে না? আর তোমরা দেখি নামাজ-দোয়াও পড়ো না। বাবুন তোমাদের দেখে কি শিখবে বলো? তোমাদের বাবা-মা নেই। ও এখন শিক্ষা-সংস্কৃতি, আদব-কায়দা সব তোমাদের দেখেই শিখবে। আমি যেহেতু তোমাদের চাচীর মতো। আমার তো এতোটুকু দায়িত্ব আছে, তাই বললাম। কিছু মনে করো না।”

তারা চুপ করে রইলো। এদিকে অরুণিকা পায়ের উপর পা তুলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন দেখছে। এই মেয়ের অর্ধেক সময় কার্টুন দেখতে দেখতেই কেটে যায়। সুরাইয়া চলে যাওয়ার পর আরাফ এসে অরুণিকার হাত থেকে ফোনটা কেঁড়ে নিলো। অরুণিকা সাথে সাথেই ক্ষেপে উঠলো। মোবাইল নেওয়ার জন্য বার-বার আরাফের কাছে জেদ করতে লাগলো। আহনাফ বিরক্ত হয়ে এক ধমক দিতেই সে ধপ করে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজলো। এরপর তাকে টেনেও আর বিছানা থেকে তোলা গেলো না। দিন দিন অরুণিকার জেদ বাড়ছে তো বাড়ছেই। এভাবে জেদ বাড়তে থাকলে, ওকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই কষ্টকর হয়ে যাবে।

দুই সপ্তাহের মধ্যেই ইভান আর আরাফ অনেক গুলো টিউশন পেয়ে গেলো। সবগুলোই শতাব্দীর বাবা খুঁজে দিয়েছেন। এখন মাস শেষ হলে এই টাকাগুলো দিয়ে তারা নতুন শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে। কিন্তু তাদের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই টাকা লাগবে, কারণ ভর্তির সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই ছ’জন মিলে সিদ্ধান্ত নিলো সালেহ আলী, মাস্টারমশাইসহ মহল্লার মধ্যে যাদের অবস্থা ভালো, তাদের থেকে কিছু টাকা ধার নেবে। কিন্তু এই ধার নিতে গিয়েই তাদের অনেক লজ্জায় পড়তে হলো। অনেকেই মুখের উপর না করে দিয়েছে, আবার অনেকে খোঁচাও দিয়েছে। কারণ কেউই বিশ্বাস করতে চাইছে না যে তাদের পক্ষে টাকাটা ফেরত দেওয়া সম্ভব। তবে যারা বিশ্বাস করে টাকা ধার দিয়েছিল, তাদের আশাহত হতে হয় নি। পরের মাসেই আরাফ আর ইভান টিউশনের পুরো টাকাটা দিয়ে তাদের ঋণ শোধ করে ফেলে। কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো তখন, যখন দেখলো ঋণ শোধের পর তাদের হাতে আর কোনো টাকাই অবশিষ্টই ছিল না।

যেই টাকা আছে তা দিয়ে হয়তো ঘর ভাড়া দিতে হবে, নয়তো খাবারের খরচ। মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়ে ছ’জনের পুরো মাস চালানো মোটেও সম্ভব না। এখন এই মাসে আর কি কি দেখতে হবে, সেটা ভাবতেই তাদের মাথাটা আরো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

(🔔পর্ব ছোট হয়ে গেছে। তাই আগামীকাল বড় করে দেবো।)

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here