#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৫||
১০.
দরজার কটকট শব্দে আহনাফের ঘুম ভেঙে গেলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে সে বারান্দায় এসে দেখলো দু’জন মহিলা তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“জ্বি, কিছু বলবেন?”
তাদের মধ্যে একজন বললেন,
“আমি পাশের বাড়ির। ওই যে কাল রাত্তিরে আমার বর তোমাদের এই বাড়ি নিয়ে এলো, আমি তারই গিন্নী। তোমাদের সাথে দেখা করতে এসেছি। এ হলো আলেয়া আপা।”
আহনাফ তালা খুলতে খুলতে বলল,
“সবাই এখনো ঘুম৷”
“সমস্যা নেই। আমরা ছোট্টো বাবুনটিকে দেখতে এসেছি৷ সে তোমাদের বোন?”
“জ্বি।”
আহনাফ দরজা খুলতেই ইভান আর তাহমিদও উঠে চলে এলো। আলেয়া আপা বললেন,
“এমা, এতো ছেলে মানুষ? তাহলে ছোট্ট বাবুনটা কোথায় ছিল?”
সালেহ আলীর স্ত্রী সুরাইয়া আলেয়াকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আহনাফ আর ইভান বাকীদের ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে একপাশে দাঁড়ালো। অরুণিকা হাত-পা ছড়িয়ে পুরো খাট দখল করে ঘুমোচ্ছে। আলেয়া আপা মশারী উঠিয়ে অরুণিকার গালে হাত রেখে বললেন,
“এতোটুকু একটা বাবুন অনাথ হয়ে গেলো? এই বাবুনটা আমাকেই দিয়ে দাও। আমি ওকে দেখবো।”
আহনাফ আর আরাফ একসাথেই বলে উঠলো,
“অরুকে আমরা দেবো না।”
কথাটি বলেই দু’জনই একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। সুরাইয়া অবাক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালেন। আলেয়া আপা হেসে বললেন,
“আরেহ বাবা, আমি তো এমনিতেই বললাম। তোমাদের বোনকে নিচ্ছি না, বাবা। আমাকে সালেহ ভাইজান বলল, ওকে একটু দেখতে। তাই এলাম।”
এবার সুরাইয়া বললেন,
“তোমাদের যিনি পাঠিয়েছেন, রহমত সাহেব, উনি আমার বরের ভাই। আমার বর বাংলাদেশী। আমিই কলকাতার। শুনেছি, তোমাদের বাবা-মা একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তোমাদের আত্মীয়-স্বজনও নেই। তাই তোমাদের এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখানে সবাই জানবে আমরা তোমাদের আপন চাচা-চাচী। সবাইকে এটাই বলবে কিন্তু। আলেয়া আপা আমার বাসায় কাজ করেন। উনি বাবুনকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেখে যাবে। তোমরা তো কাজে বা পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকবে। স্কুলেও যাবে। তখন বাবুন আমাদের সাথেই থাকবে। আর ও তো মেয়ে মানুষ। প্রয়োজনে আমি আসবো ওকে দেখতে।”
এবার আলেয়া আপা বললেন,
“পাশের বাড়ির মহিলার কতো বছর সন্তান হয় না। এই বাবুন একবার যদি তার নজরে পড়ে!”
আলেয়া আপার কথা শুনেই ছ’জনের মুখ শুকিয়ে গেলো। আলেয়া আপা তাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
“আবার ভয় দেখিয়েছি কিন্তু।”
এবার ইমন হেসে বলল,
“এমন ভয় দেখাবেন না, খালা। ওকে আমরা দেখতে পারবো। আমরা ছ’জন কি এইটুকু মেয়েকে খাওয়াতে পারবো না? আমরা খেলে ও অবশ্যই খাবে। আমরা না খেলেও ও খাবে।”
সুরাইয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“বাহ, তোমরা বাবুনকে কতো ভালোবাসো! দেখো, আপন বোন নয়, তবুও এতো ভালোবাসছো। আর আমার দু’টো ছানা আছে। সারাদিন ঝগড়াঝাঁটি করে বাড়িটা মাথায় তুলে রাখে। ওদের পাঠিয়ে দেবো এদিকে। বাবুনের সাথে খেলবে। তা বাবুন সোনার নাম কি?”
আরাফ বলল, “অরুণিকা চৌধুরী।”
হঠাৎ বারান্দার সামনে তেরো-চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“ও খালা, তুমি এই ঘরে? আমি তোমায় তোমার বাড়িতে খুঁজে এলাম।”
সুরাইয়া পেছন ফিরে হাতের ইশারায় মেয়েটিকে ভেতরে ডাকলেন। মেয়েটি ঘরে ঢুকতেই একনজর পুরো ঘরটি দেখে নিলো। তারপর এক এক করে ছ’জনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগলো। ইমন ইভানকে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এই মেয়ে আমাদের এভাবে দেখছে কেন?”
ইভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এতো সুন্দর ছেলে আগে দেখে নি তো তাই।”
“ভাই, তোর সামনে আমি তো কিছুই না। একটু গরিবের মতো দাঁড়া।”
ইভান চোখ বড় বড় করে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন মুখে হাসি টেনে তাহমিদের পাশে এসে দাঁড়ালো। এবার সুরাইয়া মেয়েটির সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন,
“এ হলো আমাদের মহল্লার লক্ষী। আমাদের মেয়ে, শতাব্দী। তোমাদের মুখোমুখি বাড়ির দু’তলায় থাকে। ওর বাবা স্কুলের মাস্টার। সবাই মাস্টারমশাই বলেই ডাকেন।”
শতাব্দী হেসে বলল,
“আর আমাকে মাস্টারের মেয়ে বলেই ডাকে৷”
শতাব্দী অরুণিকার পাশে গিয়ে বলল,
“এ মেয়ে কি ওদের?”
শতাব্দীর কথা শুনে আরাফ ছাড়া সবাই হাঁ হয়ে গেলো। তাহমিদ অবাক কন্ঠে বলে উঠল,
“আমাদের মেয়ে! কিভাবে সম্ভব?”
আরাফ বলল,
“ও আমাদের বোন। ছোট বোন।”
শতাব্দী বলল,
“সেটাই তো বুঝিয়েছি। আপনাদেরই তো। বাইরের কারো তো নয়। আমি তো আর আপনাদের ওর বাবা বলছি না। ভাই-ই বুঝিয়েছি। কথা না বুঝলে কি আর করার।”
ইভান ভ্রূ কুঁচকে শতাব্দীর দিকে তাকালো। আর মনে মনে বলল,
“এই মেয়ে একে তো ভুলই বলেছিলো। এখন কথা ঘুরিয়ে আমাদের ভুল প্রমাণ করতে চাইছে।”
সুরাইয়া তাগাদা দিয়ে বলল,
“অরুণিকা তাহলে ঘুমাক। আমাদের পানি ধরতে হবে। আচ্ছা, তোমাদের তো বলা হয় নি। মহল্লায় সকাল আর বিকেল দু’বেলা পানি দেবে। পানি ধরতে না পারলে সারাদিন পানি ছাড়াই থাকতে হবে।”
আহনাফ বলল,
“ওয়াশরুমে তো কল ছিল! কিন্তু পানি আসে নি।”
“আরেহ আসবে কিভাবে? ট্যাংকই তো নেই। পানি বাইরে থেকে নিয়ে এসো। পরে যখন ট্যাংক লাগাবে তখন আর দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে হবে না। তোমাদের প্রয়োজন হলে এই বাড়ির মালিককেই বলতে পারো। তিনি আবার এখানে থাকেন না। ওদের বাড়ি দিল্লীতে। এখানে একটা লোক এসে টাকা-পয়সা নিয়ে চলে যায়।”
“মাসে কতো টাকা দিতে হয়?”
“তোমাদেরটা সাড়ে তিন হাজার।”
ইমন বলল, “অনেক কম।”
এবার শতাব্দী বলল,
“কম মনে হলে আরো বড় বাড়িতেই উঠতে পারতো। হুহ, বড়োলোকি ভাব!”
শতাব্দীর এমন কথায় ইভান রেগে গেলো। চোয়াল শক্ত করে সুরাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“চাচী, আপনাদের লক্ষী মেয়েটা হয়তো একটু বেশিই কথা বলে। তা মাস্টারমশাই কি কখনো বলে নি বোকারা একটু বেশিই বকবক করে।”
শতাব্দী নাক টেনে বলল,
“দেখেছো, খালা। এই লোক তোমার সামনে আমাকে বোকা বললো!”
তূর্য মুখ চেপে হেসে বলল, “ইভান লোক!”
ইভান কিছু বলতে যাবে তার আগেই সুরাইয়া তাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আলেয়া আপাও শতাব্দীর গালে হাত রেখে বললেন,
“অতিথিদের সাথে এভাবে কথা বলে না। এখন চলো।”
শতাব্দী যাওয়ার আগে ইভানের দিকে চোখ ছোট করে তাকালো। তাহমিদ হাত দেখিয়ে ইশারায় শতাব্দীকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিলো। শতাব্দীও অভিমানী মুখে বেরিয়ে পড়লো। সে বেরুতেই তাহমিদ গেইটের মুখে তালা লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সে এখনো তাহমিদের দিকে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাহমিদ চোখ ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। ভেতরে ঢুকতেই দেখলো তূর্য আর ইমন ইভানকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। তূর্য কিছুক্ষণ পর পর টিটকারি দিয়ে বলছে,
“এই লোক, মশারী তোল। যা পানি ধর। এই লোক, যা নাস্তা বানা। ক্ষিধে পেয়েছে।”
ইভান রাগে ওয়াশরুম থেকে দু’টো বালতি নিয়ে পানি ধরার জন্য বেরিয়ে গেলো। ইভানের পিছু পিছু আরাফ আর তূর্যও গেলো।
১১.
ঘুম ভাঙতেই আহনাফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো অরুণিকা। আহনাফ হাত ধরে অরুণিকাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে বলল,
“উঠো, তোমাকে ব্রাশ করিয়ে দেবো।”
ইমন আহনাফের কথা শুনে অবাক কন্ঠে বলল,
“তুই ওকে ব্রাশ করিয়ে দিবি? অবাক লাগছে!”
“হ্যাঁ। এখানে অবাক লাগার কি আছে?”
“এতোদিন এই কাজ তো আরাফ করতো। হঠাৎ তুই!”
“অদ্ভুত কথাবার্তা বলে মাথা খারাপ করিস না তো। আরাফ আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি?”
“তুই তো আবার বাচ্চা-কাচ্চা পছন্দ করিস না। এখন বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব নিচ্ছিস, তাই বললাম।”
তাহমিদ মনোযোগ দিয়ে রুটি বানানোর জন্য ময়দা মাখছিলো। সে বিরক্তির সুরে বলল,
“ইমন, তুই এই বিষয়টা বাড়াচ্ছিস কেন? তোর কি আর কোনো কাজ নেই? যা গিয়ে আরো কয়েকটা বালতি ভর্তি করে আন। একবেলায় সব পানি নিয়ে আসলে, আরেক বেলা আরাম করতে পারবি।”
ইমন বলল,
“পানি তো সব তোরই লাগবে। এখন নাস্তা বানাচ্ছিস। তারপর ধোয়া-মোছা সব তুই-ই করবি।”
“তো ঘরটা কি আবর্জনার স্তূপ হবে? পরিষ্কার তো করবোই। তুই আমার কাজে নাক গলাবি না। ঘরের মধ্যে যদি এক ইঞ্চিও ময়লা হয়, তোকে আমি দ্বিতীয়বার ঘর পরিষ্কার করতে দেবো।”
ইমন চুপচাপ বেরিয়ে পড়লো। আহনাফ অরুণিকাকে হাত-মুখ ধুইয়ে দেওয়ার পর বলল,
“তুমি প্রতিদিন এভাবে ব্রাশ করতে পারবে?”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “না।”
“তাহলে তোমাকে প্রতিদিন হাত-মুখ কে ধুইয়ে দেবে?”
অরুণিকা আঙ্গুল দিয়ে আহনাফের দিকে ইশারা করে বলল, “তুমি।”
তারপর দাঁত দেখিয়ে হেসে দিলো। আহনাফ চোখ ছোট করে বলল,
“কালকে ব্রাশ করা না শিখলে, ব্রাশটা মুখে ঢুকিয়ে সেলাই করে দেবো।”
আহনাফ শীতল কণ্ঠে কথাটি বলল, তাই অরুণিকা বুঝলো না এটা তার উপর বিরক্ত হয়ে বলেছে নাকি খুশি হয়ে বলেছে। সে ভাবলো, হয়তো কোনো জ্ঞান দিয়েছে। তাই সে গায়ে মাখলো না। সে লাফিয়ে লাফিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। গলির সামনেই কয়েকটা বাচ্চা খেলছে। অরুণিকা গ্রিলের ফাঁকে পা দিয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে তাদের খেলা দেখার চেষ্টা করছে। তাদের মধ্যেই একজন অরুণিকার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“এই বাবু তোমার নাম কি?”
অরুণিকা হেসে বলল, “অরুণিকা। আমিও খেলবো। আমাকে ওইটা দাও।”
বাচ্চাটির হাতে একটা লাটিম ছিল। অরুণিকা সেটি নেওয়ার জন্যই হাতটি গ্রিলের বাইরে বের করে দিলো। তখনই ইভান দুই বালতি পানি নিয়ে ধপ করে গ্রিলের দরজার সামনে রাখতেই অরুণিকা ভয়ে গ্রিল থেকে নেমে পড়লো আর দৌঁড়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। অরুণিকাকে দৌঁড়ে যেতে দেখে ইভান ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। বিড়বিড় করে বলল,
“আমি কি ওকে বকলাম নাকি? অদ্ভুত!”
আজ প্রথম তাহমিদ রুটি বানিয়েছে। দেশে রহমত চাচা দোকান থেকে সকালের নাস্তা কিনে এনেছিলেন। এখানে আসার পর সে ভাবলো, যেহেতু তার রান্নাবান্না করতে ভালোই লাগে, তাহলে ছোটখাটো এসবের মাধ্যমেই শুরু করা যাক। দোকান থেকে রান্না করা মুগডাল কিনে এনেছে তূর্য। তা দিয়েই তাদের সকালের নাস্তা শেষ। সুরাইয়া নাস্তা বানিয়ে পাঠাবে বলেছিল, কিন্তু আরাফ বারণ করে দিয়েছে। এখন তাদের স্বনির্ভর হওয়া দরকার। যখন তখন তারা আর মায়ের হাতের নাস্তা খেতে পারবে না, বাবাও তাদের শখ পূরণ করার জন্য পাশে নেই। এখন তারা নিজেরাই নিজেদের হাত ধরবে আর নিজেদের শখ পূরণ করবে।
নাস্তা খাওয়ার পর সবগুলোই তাহমিদ পরিষ্কার করে ফেললো। তাকে ইভান সাহায্য করেছিলো। এরপর ছ’জন মিলে কাজ ভাগ করে নিলো। কেউ কাপড় ধুয়ে শুকাতে দিলো, কেউ ঘর পরিষ্কার করলো, কেউ সব গুছিয়ে রাখলো। এবার তারা বসে বসে দুপুরের রান্নার জন্য কি কি প্রয়োজন তা লিখতে লাগলো। রহমত চাচা সালেহ আলীর কাছে তাদের খরচের টাকা পাঠাবেন। এই মাসেরটাও হয়তো পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো যখন তারা জানলো, তাদের খরচের তুলনায় তারা মাসে খুব কম টাকা পাবে। এমন হলে তো সব টাকা খাওয়া-দাওয়ার পেছনেই শেষ হয়ে যাবে। তারা কি স্কুলে ভর্তি হবে না? তারা ছ’জনই এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। কিন্তু এখন তো আর পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব না। নতুন করেই স্কুলে ভর্তি হতে হবে। তবে টাকার যা সংকট, হয়তো চারজন পড়াশুনা করবে, বাকীরা বসে থাকবে। কিন্তু তারা তা করবে না। হয়তো সবাই পড়াশুনা করবে, নয়তো কেউ-ই করবে না। এসব নিয়েই আলোচনা করার এক পর্যায়ে তূর্য বলে উঠলো,
“আমার গিটারটা বাসায় ছিলো। ওটা তো এখন ছাই হয়ে গেছে। ওটা সাথে থাকলে গান গেয়েও কিছু টাকা আয় করতে পারতাম। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ কতো কন্টেন্ট তৈরী করে। আর আমি ওতোটাও খারাপ গায় না।”
তখন আহনাফ আফসোস করে বলল,
“বাবা বাইক কিনে দিয়েছিল, ওটাও হয়তো ছাই হয়ে গেছে।”
অরুণিকা এক পাশে বসে আরাফের ফোন দেখছিলো। সে হঠাৎ আরাফের দিকে ফোনটা ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“মা কোথায়? আমি মায়ের কাছে যাবো।”
অরুণিকার কথা শুনে ইভান বলল,
“এক কথা বারবার বলতে ভালো লাগে না। বললাম তো মা অসুস্থ। সুস্থ হলে দেখা করবে।”
“না, মা সুস্থ। আমি মায়ের কাছে যাবো।”
আহনাফ রাগী কন্ঠে বললো,
“মা আল্লাহর কাছে চলে গেছে। আর কখনো আসবে না। এখন চুপ করো।”
অরুণিকা আহনাফের কথা শুনে আরাফের পাশে এসে বসলো। তারপর তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“মা আর আসবে না?”
আরাফ অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আসবে। কিন্তু যেদিন তুমি লক্ষী মেয়ে হবে সেদিন আসবে। এখন তো তুমি দুষ্টুমি করছো। তাই আগে ভালো মেয়ের মতো আমরা যা বলবো, তাই শুনতে হবে।”
অরুণিকা মুহূর্তেই মায়ের কথা ভুলে বলল,
“আমাকে ওই খেলনটা দেবে?”
“কোন খেলনা?”
“ওই যে বাবুটা খেলছিল খেলনাটা দিয়ে।”
ইভান বলল,
“খাওয়ার টাকা নেই, তুমি খেলনা খুঁজছো? কোনো খেলনা চলবে না। একে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেই ভালো হবে।”
“আমি স্কুলে যাবো না। আমি খেলবো।”
হঠাৎ বারান্দার বাইরে থেকেই শতাব্দীর কন্ঠের স্বর পাওয়া গেলো। সে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে চোখ ঢুকিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ইভান বারান্দায় এসে বলল,
“কি সমস্যা?”
শতাব্দী স্বাভাবিক কন্ঠে বললো, “বাবু কোথায়?”
“বাবু!”
“আপনার বাবু না। ছোট্ট বাবুটার কথা বলছি। ওই যে যখন এসেছিলাম, ঘুমিয়ে ছিল।”
অরুণিকা মেয়েলী কন্ঠ শুনে দৌঁড়ে এলো। শতাব্দীকে দেখে থমকে গেলো। শতাব্দী হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“বাবু আমার সাথে খেলবে?”
অরুণিকা কিছু বলার আগেই ইভান বলল,
“না, ও এখন বাইরে যাবে না।”
শতাব্দী তার পেছন থেকে একটা বিড়াল ছানা বের করে বলল,
“বাবু খেলবে ছানার সাথে?”
অরুণিকা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বিড়ালের বাচ্চাটির দিকে। ইভান গ্রিলের দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“খেললে ভেতরে এসো। অরুণিকা বাইরে যাবে না।”
তাহমিদ সাথে সাথেই আটকে দিয়ে বলল,
“না, না, অরুণিকাকে নিয়ে আসছি। এই বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে ভেতরে আসবে না। আমি মাত্র ঘর পরিষ্কার করেছি।”
তারা অরুণিকাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো৷
মহল্লাটির শেষ মাথা পর্যন্ত মোট আটটি বাড়ি। এখানে অনেক পরিবারই থাকে। সবাই খোলামেলা বসেই গল্প করছে। দেখে মনে হবে এক পরিবারের। কেউ মোড়ায় বসে পত্রিকা পড়ছে। কেউ বা একসাথে বারান্দায় বসে শাক পরিষ্কার করছে। আর বাচ্চারা পুরো গলিতেই ছুটোছুটি করছে। আরাফ বাচ্চাগুলোকে দেখে বলল,
“অরুর বন্ধুর অভাব হবে না।”
আহনাফ বলল,
“এদের সাথে বন্ধুত্ব করবে?”
“কেন সমস্যা কোথায়?”
“দেখছিস না কিভাবে একটা আরেকটার সাথে চুলোচুলি করছে। অরুকে মারলে?”
আরাফ বলল,
“স্কুলের মাঠে খেলতে গিয়ে কতোবার মার খেয়েছিস মনে আছে? এসব তো চলবেই।”
“আমার অরুর জন্য ভয় লাগছে। ও তো মেয়ে। আর এটা অপরিচিত শহর, ভিন্ন দেশ। কিছু হয়ে গেলে, আমরা কি করবো? ওকে কিভাবে দেখে রাখবো?”
ছ’জন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অরুণিকাকে দেখছে। অরুণিকা গেইট দিয়ে বেরিয়ে বিড়াল ছানাটার পেছন পেছন ছুটছে। সেটিকে আদর করছে। আর কিছুক্ষণ পর পর তাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। অরুণিকার এই মিষ্টি হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছে আজ সে অনেক খুশি।
চলবে-