অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৫৮||

0
1114

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৮||

৯৫.
রুমের বাইরে থেকে অরুণিকার ফুঁপিয়ে কান্না করার শব্দ পেয়ে দরজায় ঠোঁকা দিলেন আরবান তালুকদার৷ অরুণিকা কড়া নাড়ার শব্দ শুনে চোখ মুছে দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়ালো। আরবান তালুকদার ভেতরে এসে অরুণিকার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে না বলতেই তার চোখ বেয়ে টপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আরবান তালুকদার ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“কি হয়েছো আমাকে বলো? অরুণিকা, আমি তো তোমার বাবার মতোই। আমাকে বলো মা, কি হয়েছে?”

অরুণিকা তার টেবিলে রাখা ছবির ফ্রেমটি হাতে নিলো। তিন ফ্রেমের ছবিযুক্ত ফ্রেমটির একপাশের ছবিটি ছোটবেলায় তার বাবা-মার সাথে তোলা, অন্যপাশেরটি তার জন্মদিনের দিন পুরো পরিবারের সাথে তোলা হয়েছিল, আর মাঝখানের ছবিটি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই ছয় পুরুষের ছবি। অরুণিকা মাঝখানের ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তো বাবাকে দেখি নি, কিন্তু বাবার পরিবর্তে আমি আরাফকে পেয়েছি। যাকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি। আমি মাকে দেখি নি, কিন্তু মায়ের পরিবর্তে তাহমিদকে পেয়েছি, যে সবসময় আমার খাওয়া-পরার খেয়াল রাখে। আমি দাদা-দাদিকে কাছে পাই নি, কিন্তু তাদের পরিবর্তে ইমনকে পেয়েছি, যে সবসময় আমাকে আরাফ আর ইভানের বকুনি খাওয়া থেকে বাঁচায়। আমি বড় ভাইয়াদের দেখি নি, কিন্তু ইভানকে পেয়েছি, যে আমাকে ভাইয়ের মতোই আগলে রেখেছে, আর দরকার হলে শাসনও করে। যাকে আমি খুব ভয় পাই, কিন্তু তবুও অনেক বিশ্বাস করি। আমি মনের সব কথা ভাগ করার জন্য রকস্টারের মতো বন্ধু পেয়েছি, যে আমাকে কখনো কাঁদায় নি। আমি পাশে থাকার মতো একজন বিশ্বস্ত কাজিন হিসেবে আহনাফকে পেয়েছি, যে আমাকে হাসায়, আমার সাথে ঝগড়া করে, আবার সব ঠিক করে নেয়৷ ও আমাকে বুঝতে পারে। কিন্তু এতোগুলো মানুষ যদি হঠাৎ নিজের কাছেই মিথ্যে হয়ে যায়, তখন কি করা উচিত? যাদের আমি এতো বিশ্বাস করি, যারা না থাকলে আমার কোনো অস্তিত্বই থাকতো না, তারা যদি আমার কাছে বেইমান হয়ে যায়, তখন আমি কোথায় আশ্রয় নেবো? কাকে বিশ্বাস করবো? কার ভরসায় বেঁচে থাকবো?”

অরুণিকা কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় বসে পড়লো। আরবান তালুকদার অরুণিকার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“তুমি হঠাৎ এমন কথা কেন বলছো? কে তোমার সাথে বেইমানি করেছে?”

“সবাই। ওরা আমাকে একদমই ভালোবাসে না। সম্পত্তির ভাগ নেওয়ার জন্য আমার যত্ন নিয়েছিল। আর ওরা আহনাফের সাথে এইজন্যই আমাকে বিয়ে দিচ্ছে।”

“তোমাকে কে বলেছে এসব?”

“কাল একটা আংকেল এসেছে, উনিই বললো।”

আরবান তালুকদার চুপ করে থেকে বললেন,
“তুমি নিজেকে প্রশ্ন করো। যারা তোমাকে এতো বছর ধরে বাবা-মার অভাব অনুভব করতে দেয় নি, তারা কি তোমার সাথে বেইমানি করবে?”

“আমি তো চাই এসব সত্য না হোক। তাহলে আংকেলটা কি মিথ্যে বলেছে?”

“দেখো, অরুণিকা। ব্যাপারটা পজিটিভ বা নেগেটিভ দুই ভাবেই নেওয়া যায়। তোমার নামে ৫০ ভাগ অংশ লিখিত আছে, এটা সত্য। কিন্তু এর মানে এই না যে আহনাফ সেই ভাগ পাওয়ার জন্যই তোমাকে বিয়ে করছে। হয়তো আরাফ তোমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে চোখের আড়াল করতে চায় না। আর শুনেছি, তোমাকে কলকাতায় এডপশনের জন্য একটা এনজিওর পক্ষ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে তোমাকে ফেরত পাওয়ার জন্য আহনাফ বিয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। কারণ ছ’জন যুবক বয়সী ছেলে তোমার মতো উঠতি বয়সী মেয়েকে বড় করার দায়িত্ব নিয়েছে, এটা আসলেই অনেক জটিল কেইস ছিল। তাই তোমার নিরাপত্তার জন্য সেই এনজিও থেকে অনেক কাঠখড় পোড়ানো হয়েছিল, কিন্তু অবশেষে ছ’জনই তোমাকে পেয়েছে। কারণ কি জানো?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “না, কারণ কি?”

“কারণ হচ্ছে, ওদের মনোবল। তোমার প্রতি ওদের ভালোবাসা।”

“এটাতো সম্পত্তির প্রতি ভালোবাসাও হতে পারে।”

“হতেও পারে। অসম্ভব কিছু না। কিন্তু একটা কথা বললাম না, একটা জিনিসের দু’টি দিক আছে পজিটিভ আর নেগেটিভ। তুমি নেগেটিভ ভাবলে, তোমার সাথে খারাপটাই হবে। আর পজিটিভ ভাবলে, ভালো কিছু হবে।”

“আমি এখন কি করবো?”

“নিজেকে কিছুদিন সময় দাও। এখন যেহেতু তোমার মাথায় একটা প্রশ্ন চলে এসেছে, তাহলে তাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো। হয়তো তাদের ভালো কিছু তোমার চোখে পড়বে, যা তোমার মনের সন্দেহ দূর করে দেবে। আবার হয়তো খারাপ কিছু নজরে আসবে, যেটা তোমাকে সত্যের কাছে নিয়ে যাবে।”

বিকেলে আহনাফ অরুণিকার ঘরে এলো। অরুণিকা আহনাফকে দেখে বলল, “তুমি!”

আহনাফ অরুণিকার কাছে এসে বলল,
“কি হয়েছে, অরু? গতকাল থেকেই মুখ ভার করে বসে আছো!”

“তুমি যাও! আমি একা থাকবো।”

আহনাফ অরুণিকার হাত দু’টি নিজের হাতে আবদ্ধ করে নিলো আর অরুণিকার দিকে ঝুঁকে বলল,
“তোমার চুপ হয়ে থাকাটা পুরো ঘরটাকে মৃত বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। তুমি কেন বুঝো না, তোমার মন খারাপ হলে সবাই কতো কষ্ট পায়।”

অরুণিকা আহনাফের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমিও পাও?”

আহনাফ শান্ত চোখে তাকিয়ে ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে বলল,
“আমার সব হাসি-কান্না তোমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তোমার কাছেই আমার সব কিছুর সমাপ্তি। তুমি ছাড়া কে আছে আমাদের? কেইবা আছে আমার?”

“বাকীরা নেই?”

“ভাই আর বন্ধু আছে। তুমি তো ভাই না, বন্ধুও না। তুমি আমাদের সাহস, প্রেরণা, শক্তি, আর আমার….”

আহনাফ ধীর কন্ঠে শ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ভালোবাসা।”

এক অদ্ভুত মায়া ছিল এই শব্দে। এই শব্দটি শুনেই অরুণিকার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে হুট করে আহনাফকে জড়িয়ে ধরলো। অরুণিকা আচমকা জড়িয়ে ধরাতে আহনাফ চমকে উঠলো।

অরুণিকা যেদিন থেকে সব কিছু বুঝতে শিখেছিল, উপমার মাধ্যমেই তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আরাফ আর আহনাফদের কাছ থেকে ঠিক কতোটা দূরত্ব রাখলে তাদের সম্পর্কটা মানানসই হবে। অরুণিকা যেহেতু ছ’জনের কোলেই বড় হয়েছে, তাই তাকে এটা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার কোল ছাড়ার বয়স হয়েছে। এরপর একদিন অরুণিকাও সব বুঝতে শুরু করে, যখন আরাফ আর তূর্য তার পাশ ঘেঁষে বসা বন্ধ করে দেয়। এখন খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউই অরুণিকার হাত ধরে না। তবে আহনাফ খুব অধিকার নিয়েই সেই হাতটি ধরে রাখে। আহনাফের সাথে এই দূরত্বটা তার কখনোই ছিল না। কিন্তু এতো কাছ থেকে জড়িয়ে ধরাটা আজ প্রথম অনুভব করছে আহনাফ। তার এই মুহূর্তে খুব শান্তি লাগছে। তার বুকটা এক মিষ্টি প্রশান্তিতে ভরে গেছে। অরুণিকা সেই বুকে শান্তি খুঁজে পেয়েছে। সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কিন্তু আহনাফ তাকে আঁকড়ে ধরার সাহস পাচ্ছে না। কোনো অজানা কারণেই তার হাত কাঁপছে। আলগা করে সে এক হাত উঠিয়ে অরুণিকার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অরুণিকা তখন বলে উঠলো,
“আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি। আমার কাছে তোমাদের চেয়ে কেউ গুরুত্বপূর্ণ না। আমি তোমাদের অনেক বিশ্বাস করি। আমি জানি, তোমরা আমার সাথে কখনোই প্রতারণা করবে না।”

আহনাফ অরুণিকার চুল থেকে হাত সরিয়ে নিলো। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো, সে অরুণিকাকে ইমানের ব্যাপারে মিথ্যে কথা বলেছে। সে ইমানকে সেদিন অরুণিকার কথা বলে নি। ইমানও বিয়ের কথা বলে নি। সব আহনাফের বানানো ছিলো৷ কিন্তু এই সত্যটা অরুণিকা জানলে কি হবে তাদের সম্পর্কে? আহনাফ অরুণিকাকে সরিয়ে দিলো। অরুণিকা ইতস্তত ভাব নিয়ে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
“সরি। ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম।”

কথাটি বলেই অরুণিকা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আহনাফ মনে মনে ভাবলো,
“অরু সব জানার আগেই আমি ওকে নিজের করে নেবো। একবার বিয়ে হয়ে গেলে, ও আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। ও আমার ভালোবাসা। আমার দশ বছরের অপেক্ষা, আমার প্রাপ্তি, আমার স্বপ্ন, আমি সবকিছুর সমাপ্তি। আমি এতো উদার নই যে আমার ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো হাতে তুলে দেবো। ওকে আমি নিজের মতো করে ভালোবাসবো। ও আমাকে বিনিময়ে ভালোবাসুক, বা না বাসুক, তাতে আমার কিছুই আসে যায় না।”

৯৬.

অফিস রুমে শান্ত হয়ে বসে আছে ইভান। তার হাতে শাহেদ মির্জার ছবি। খুব সূক্ষ্মভাবে সে ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সে শাহেদ মির্জার সব তথ্য কয়েকবার করে পড়ছে। হঠাৎ তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সে চেয়ারে আয়েশ করে বসে বলল,
“মিস্টার শাহেদ মির্জা, তোমার দুর্বলতা আমি ধরে ফেলেছি। এখন তোমাকে সেই দুর্বল দিক দিয়েই আমি আঘাত করবো। খেলা শুরু হয়ে গেছে। আমি আমার এক চাল দিয়ে দিয়েছি। এখন অপরপাশ থেকে তোমার চাল দেখার অপেক্ষায় আছি, মিস্টার শাহেদ মির্জা!”

এদিকে সাহিল তার অফিস রুমে রাহিকে বসিয়ে রেখেছে। রাহি বিরক্ত হয়ে বলল,
“সাহিল, কি করছো তুমি? আমাকে এই বদ্ধ রুমটাতে আটকে রেখে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছো তো খেয়েই যাচ্ছো! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

সাহিল চেয়ার ছেড়ে উঠে রাহিকে কাছে টেনে এনে বলল,
“তাহলে তুমি কেন বুঝতে পারছো না, তোমাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”

রাহি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“আগে এই কাজ ছাড়ো, তারপর আমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখো।”

“এটা আমার ব্যবসা, এটা আমার স্বপ্ন, আর তুমি আমার ভালোবাসা, আমার দ্বিতীয় স্বপ্ন। আমি একটা ছেড়ে অন্যটা ধরতে পারবো না। আমার দু’টোই প্রয়োজন।”

“সারাদিন কেউ না কেউ তোমাকে হুমকি-ধামকি দেবে। সাহিল, তোমার জন্য আমাদের সন্তানরা এমন পরিবেশে বড় হবে, যেখানে কোনো নিরাপত্তা নেই।”

সাহিল রাহির হাত দু’টি তার দুই চোখে ঠেকিয়ে বলল,
“বিশ্বাস করো, আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, রাহি। বিয়ে করবো তোমাকে। প্লিজ রাজি হয়ে যাও। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না।”

রাহি সাহিলের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“ভালোবাসি, সাহিল। ভালোবাসি তাই তোমাকে এই পথ থেকে সরে আসতে বলছি। আমরা চাইলে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারবো। এই মিডিয়া, বডিগার্ড এসবের বাইরে একটা জীবন আছে। স্বাধীনতা আছে। যেখানে খুন হওয়ার ভয় নেই। যেখানে মৃত্যুর জন্য একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করার সুযোগ আছে, মানুষকে নয়। কিন্তু তোমার জীবনটা এমন হয়ে গেছে, তুমি মানুষকে ভয় পাচ্ছো, বডিগার্ডের উপর বডিগার্ড রাখছো, নিজেকে বাঁচানোর জন্য যা যা করার সব করছো, ভেবে চিন্তে পা ফেলছো। অথচ আমি চাই, পা ফেলার আগে শুধু একটাই জিনিস ভাববো, আজ আমি কতোটুকু পথ শান্তিতে পাড়ি দিতে পারবো।”

সাহিল রাহির কথা শুনে বলল,
“তোমার এসব কাব্যিক কথাবার্তা বন্ধ করো। আমার তোমাকে যেকোনো মূল্যে প্রয়োজন। আমি আজ আবার বাবাকে নিয়ে তোমাদের বাসায় যাবো। আশা করি, এবার আমাকে ফিরিয়ে দেবে না।”

সাহিল রাহির হাত ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে এসে বসলো, আর বলল,
“আমি গার্ডকে বলে দিচ্ছি, তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেবে।”

রাহি কিছুক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে সাহিলের দিকে তাকিয়ে থেকে তার কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়লো।

অন্যদিকে শান্ত দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন শাহবাজ খান। পেছন থেকে তার স্ত্রী বলে উঠলেন,
“ওরা বেঁচে আছে কিভাবে এটাই ভাবছো? আমিও এটাই ভাবছি। এও ভাবছি, ওরা এতোদিন কোথায় ছিল?”

শাহবাজ খান কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি চুপ করে আছেন। তার স্ত্রী আবার বলে উঠলেন,
“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা বেঁচে আছে শুনে তুমি একটুও অবাক হও নি।”

শাহবাজ খান বললেন,
“এখানে অবাক হওয়ার মতো কিছুই নেই৷ ওরা বেঁচে আছে, এটা অবাক হওয়ার বিষয় না। ওরা আমার কেউই না।”

“অরুণিকা তো তোমার ভাগ্নি।”

“হ্যাঁ, এটাই ভাবছি। ও আমার ভাগ্নি, আর ও এতো বছর আমাদের কাছ থেকে দূরে ছিল। ওর বাবা-মার পর আমরাই ওর আপনজন। কিন্তু ওকে বড় করেছে ওর বাবার বন্ধুর ছেলেরা। এমনটা হওয়া উচিত ছিল না।”

“আরাফ আর আহনাফ তো ওর চাচাতো ভাই। ওরা কি মেয়েটার কম অযত্ন করেছে? যা-ই হোক, বড় তো হয়েই গেছে। শুনেছি আহনাফের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার না এই সম্পর্কটাতে মত নেই। চলো দেশে ফিরি। মেয়েটাকে আমাদের সাথে আমেরিকা নিয়ে আসি। তৈমুরকে তো বিয়ে দেবো ভাবছি। অরুণিকার সাথেই না হয় ওর বিয়েটা হয়ে যাক। আর তৈমুর তো আহনাফের চেয়ে ছোট। এতো বড় ছেলের সাথে মেয়েটার বিয়ে দেওয়াটা ভালো হচ্ছে, বলো? অরুণিকা যখন হয়েছিল, ছেলেটা কত্তো বড় ছিল।”

“দশ-এগারো বছরের ছিল তখন। আসলে তুমি ঠিকই বলেছো। অরুণিকার দায়িত্বটা আমাদের নেওয়া উচিত ছিল। আর এখন অরুণিকার দায়িত্ব আমাদেরই নেওয়া উচিত। আর তৈমুরের সাথে বিয়ে হলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকবো।”

শাহবাজ খান এসব বলে আবার চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি ঠিক কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করছেন তা ধরতে না পেরে তার স্ত্রী মিনিট খানিক দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন।

কিছুদিন পর,
ইমনের বিয়ের বাজার করার জন্য ইভান একাই আজ মার্কেটে এসেছে। সে দোকানের সামনে দিয়ে হাঁটছে আর ভাবছে কোন দোকানে ঢুকবে। হঠাৎ তার সামনে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে হাত নাড়িয়ে বলল,
“আমাকে চিনেছেন?”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“বদমাশ লোকেদের হাত থেকে প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করা সেই মেয়েটি, তাই না?”

সানায়া হালকা হেসে বলল,
“আমার ভাগ্যের উপর ভালোই পরিহাস করলেন, দেখছি।”

“আপনার তো সেই কপাল! বডিগার্ড নিয়ে ঘুরাঘুরি করা চাট্টিখানি কথা নয়।”

সানায়া চোখ ছোট করে বলল, “খোঁচা দিচ্ছেন?”

“মোটেও না। তা আজ আপনার বদমাশ লোকগুলো কোথায়?”

সানায়া হেসে বলল,
“চিন্তা করবেন না, কড়া আদেশ আছে। ওরা মার্কেটের বাইরেই আছে। ভেতরে ঢুকতে দেই নি।”

ইভান হাসলো। হঠাৎ কি ভেবে বলল,
“আপনি কি আমার একটা সাহায্য করবেন? আসলে অরুণিকার জন্য একটা শাড়ি কিনতে এসেছি। একটা পছন্দ করে দেবেন? আমার আসলে শাড়ির ব্যাপারে কোনো আইডিয়া নেই।”

“অবশ্যই করে দেবো। তা আপনি কি শুধু শাড়ি কিনতে এসেছেন?”

“না, ইমনের বিয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করবো।”

“তো বর কোথায়?”

“নিজে পরার জন্য কিনতে এসেছি। বর আলাদা ভাবে বাজার করবে। আর আপনি?”

“ও, আমিও কিন্তু বিয়ের বাজার করতে এসেছি, আপনার মতোই।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কার বিয়ে?”

“ভাইয়ার বিয়ে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রাহির সাথে। আসবেন কিন্তু বিয়েতে!”

ইভান রহস্যময় হাসি দিলো। সানায়া ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এভাবে মুখ বাঁকিয়ে হাসলেন কেন?”

ইভান হেসে বলল,
“ভাবছি দু’জনেরই ভাইয়ের বিয়ে, কি মিল আমাদের!”

সানায়া ইভানের কথায় অন্যদিকে তাকালো। আর আনমনে হাসতে লাগলো। ইভান সানায়ার হাবভাব দেখে বলল,
“কোথায় হারিয়ে গেলেন?”

“না, সত্যিই বলেছেন। আমাদের খুব মিল।”

এদিকে প্রায় দুই ঘন্টা ধরে একটার পর একটা দোকানে যাচ্ছে সানায়া, আর তার পিছে পিছে যাচ্ছে ইভান। ইভানের রাগে মুখ লাল হয়ে গেছে। তার বাম হাতে পাঁচটা ব্যাগ, আর ডানহাতে ছয়টা। সানায়ার হাতে শুধু দুইটা ব্যাগ, এতেই সে কিছুক্ষণ পর পর ব্যাগগুলো ইভানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কখনো চুল ঠিক করছে, কখনো ব্যাগ থেকে টাকা বের করছে। সানায়া কোনো ভাবেই ইভানের পিছু ছাড়ছে না। সানায়ার এই একটা স্বভাব, কেউ তার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করলে, সে মানুষটিকে ছাড়তেই চায় না। যেমনটা এই মুহূর্তে ইভানের সাথে হচ্ছে। ইভান বিরক্ত হয়ে বলল,
“ব্যাগগুলো বরং গাড়িতে তুলে রাখুন।”

সানায়া ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, বদমাশ লোকগুলো আমাকে দেখলে এবার পিছু ছাড়বে না। ওরা নিচেই দাঁড়িয়ে আছে। দেখছেন না কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিচ্ছে।”

ইভান উপায় না দেখে বলল,
“সত্যি বলতে কি আমার মাথা ঘোরাচ্ছে। কাল রাতে ঘুমাই নি তো তাই।”

সানায়া ব্যস্ত হয়ে সবগুলো প্যাকেট নিয়ে নিলো। আর ইভানকে বলল,
“চলুন, ডাক্তারের কাছে যাই।”

ইভান ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“আরেহ, না না। ডাক্তার দেখানোর মতো খারাপ লাগছে না।”

“না আপনাকে যেতেই হবে ডাক্তারের কাছে। চলুন।”

সানায়া হনহন করে সামনে যেতে লাগলো। ইভান মুখ ছোট করে বিড়বিড় করে বলল,
“কোন নাছোরবান্দার পাল্লায় পড়লাম! আল্লাহ, মুক্তি দাও আমাকে।”

সানায়া ইভানকে ডাক্তারের কাছে নিয়েই গেলো। যদিও ইভান আরাফের চেম্বারেই এসেছে। সানায়া আরাফের নামফলক দেখে বলল,
“আরাফ তো স্কিনের ডাক্তার। আপনার তো মাথা ঘুরাচ্ছে।”

“ওই একই কথা৷ এলার্জির কারণেই মাথা ঘুরাচ্ছিল।”

“এলার্জির কারণে মাথা ঘোরায় নাকি?”

ইভান চোখ ছোট করে বলল,
“আমার ঘোরায়!”

আরাফের কেবিনে ঢুকতেই আরাফ ভ্রূ কুঁচকে ইভানের দিকে তাকালো। সানায়া বলল,
“আপনার বন্ধুর এলার্জি বেড়ে গেছে। এলার্জির কারণে মাথা ঘোরাচ্ছে।”

আরাফ অবাক হয়ে বলল,
“এলার্জি! কিসের এলার্জি।”

ইভানের চোখের ইশারায় আরাফ আবার বলে উঠল,
“ওহ হ্যাঁ, হ্যাঁ এলার্জি আছে তো। অনেক এলার্জি আছে। ওর এলার্জির একমাত্র ওষুধ…”

ইভান ইশারায় কিছু একটা বলতেই সানায়া ইভানের দিকে তাকালো। আর বলল,
“হাত দেখিয়ে কি বলছেন উনাকে?”

আরাফ বলল,
“কিছু বলে নি, মাথা ঘোরাচ্ছে বোঝাচ্ছিল। ওর এই মুহূর্তে বিশ্রাম করা উচিত।”

ইভান বলে উঠল,
“হ্যাঁ, আমার খুব খারাপ লাগছে।”

সানায়া বলল,
“আরাফ, আপনি ওষুধ লিখে দিন।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“ওষুধ তো বাসায় আছে। ওগুলোই খেয়ে নেবো।”

সানায়া মাথা নেড়ে ইভানকে ধর‍তে যাবে ইভান বলল,
“আমি ঠিক আছি। আপনি বাইরে যান।”

সানায়া বের হতেই ইভান বলল,
“এই মেয়ে আস্ত একটা জোঁক। আমার মাথার সব রক্ত খেয়ে নিয়েছে। পুরো মার্কেট শুধু বকবক করেছে, আর আমার হাতে বস্তা ধরিয়ে দিয়েছে।”

আরাফ বলল, “কিসের বস্তা?”

“বিয়ের বাজার।”

“ইমনের?”

“জ্বি না। গেলাম তো সেই উপলক্ষেই, কিন্তু এই মেয়ে আমাকে দিয়ে নিজের সব জামা পছন্দ করিয়েছে। পুরো মার্কেট তুলে নিয়ে এসেছে গাড়িতে। ইচ্ছে তো করছিলো সবগুলো ব্যাগ দিয়ে মেয়েটাকে চেপে ধরে মেরে ফেলি।”

“আচ্ছা, এখন পানি খা।”

আরাফ পানি এগিয়ে দিতেই ইভান গটগট করে পানি খেয়ে বলল,
“আচ্ছা, আমি বাসায় যাচ্ছি। কাল থেকে সব মার্কেট তোরা করিস। আমি আর ওই মার্কেটের মুখ দেখতে চাই না।”

এদিকে চেম্বার থেকে বের হতেই রাহির মুখোমুখি হয়ে গেলো আরাফ। রাহি আরাফকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলল,
“কেমন আছেন?”

আরাফ বলল, “জ্বি ভালো।”

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“বাসায়।”

“ওহ আচ্ছা। সময় হবে আপনার?”

“কেমন সময়?”

“আমার একটু স্কিনে সমস্যা হচ্ছে।”

রাহি তার হাত দেখিয়ে বলল,
“এই দেখুন কেমন যেন দাগ হয়ে যাচ্ছে।”

আরাফ ভালোভাবে দেখে বলল,
“এটা ফাংগাল ইনফেকশন। আমি আপনাকে একটা ক্রিম লিখে দিচ্ছি ওটা এই জায়গায় লাগালে ঠিক হয়ে যাবে।”

আরাফ ব্যাগ থেকে লেখার জন্য কাগজ বের কর‍তে যাবে তখনই রাহি বলল,
“পাশে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চাইলে ওখানে গিয়েও বসতে পারি।”

আরাফ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আচ্ছা, চলুন।”

এদিকে রাহি আর আরাফ রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই সাহিল গাড়ির কাঁচ তুলে ড্রাইভারকে বলল,
“বাসায় চলো।”

আর সে মনে মনে ভাবছে,
“রাহি কি সত্যিই আমার কাজের জন্য আমাকে বিয়ে কর‍তে চায় নি, নাকি ওর না চাওয়ার কারণ আরাফ চৌধুরী? যদি এর কারণ আরাফ চৌধুরী হয়, তাহলে মিস্টার চৌধুরীর কপালে দুঃখ আছে।”

চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here