কন্যা_সর্বনাশী (পর্ব- ৩)

0
749

#কন্যা_সর্বনাশী (পর্ব- ৩)

মাঝখানে এক বছর চলে গেছে। নীলার সাথে আবির কোনো রকম যোগাযোগ করেনি। এমন কী নীলার সামনেও আসেনি! ক্যাম্পাসেও খুব একটা আসেনি। আবিরের এমন আমূল পরিবর্তন সবার চোখে লেগেছে। বিশেষ করে দিপু আর নিরবের কাছে। আবিরকে তারা আর কাছ থেকে পায়নি। দিপু ২/৪বার বিষয়টা নিয়ে আবিরের সাথে তর্ক করতে গেছে কিন্তু আবিরের কড়া জবাবে প্রতিবারই থেমে গেছে। তাই তারাও এখন আর আবিরকে এসব নিয়ে ঘাটায় না। চুলোয় যাক আবির তাতে দিপুর কী? স্টুডেন্ট লাইফ মানেই আনন্দের জীবন, girlfriend নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময়। এই বয়সে এত সিরিয়াস হলে চলে? তাও পাত্তা না দেয়া এক দেমাগি মেয়ের জন্য! যে মেয়ে এত ছেলের প্রপোজ পেয়েও সিঙ্গেল থাকে দিপুর কাছে সে নেহায়েতই ক্ষ্যাত। ধুপধাপ রিলেশনে যাবে কয়দিন পর ভালো না লাগলে নতুন কাউকে খুঁজে নেবে এটাই তো বয়স এসবের। আর হোক সে অনিন্দ্য সুন্দরী তাতে কী? ওই এক ক্ষ্যাত মেয়ের জন্য তার বন্ধু কিনা সব ছেড়েছুড়ে সন্যাসী হয়ে যাচ্ছে! ইচ্ছে করে মেয়েটাকে ধরে এনে কোষে ২/৪টা চড় মেরে দেয়। এই কথাটা একদিন আবিরের সামনেও বলে ফেলেছিল। আবির সেদিন দিপুর শার্টের কলার চেপে ধরে নাক বরাবর ঘুষি মেরে দিয়ে বলেছিল-

তুই যদি আমার বন্ধু না হতি তাহলে আজ তোর মুখ ভেঙে দিতাম এই মুহূর্তে। দিপুও সমান তেজে তেড়ে যাচ্ছিল আবিরের দিকে। তখন তাদের বন্ধুরা তাদের ধরে ছাড়িয়ে দেয়। ব্যাপারটা আরো বড় ঝামেলায় যাবার আগেই তার সব বন্ধুরা সেদিন দুজনকে থামিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে দিপুর সাথে আবিরের সম্পর্কটা শীতল। নিরবও আবিরের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। এভাবে কেটে যায় আরও কয়েক মাস। আবির পাস করে বেরিয়ে যায়। এবং তার রেজাল্ট হয় অবিশ্বাস্য রকম ভালো। সে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যাবার পর তার খোঁজ খুব মানুষই পেয়েছে।

আবিরের এমন অন্তর্ধানে চলে যাওয়াটা সবচেয়ে বেশি অবাক করেছিল নীলাকে। যোগাযোগ না হলেও নীলা আবির সম্পর্কে যতটা সম্ভব খোঁজ রাখার চেষ্টা করেছে। যত দিন গেছে আবির সম্পর্কে তার ধারণা পাল্টেছে… আবিরের প্রতি যে নেতিবাচক ধারণা ছিল তার বরফ গলতে শুরু করেছিল। কিন্তু আবির পাস করে বেরিয়ে যাবার পর নীলা তার কোনো খোঁজই আর পায়নি। অবশেষে নীলাকে বিষয়টা ভেতরে ভেতরে ক্ষরণ করতে লাগল। আবিরের প্রতি কী তবে মনের অজান্তেই আগ্রহ কাজ করছিল?

এভাবে কেটে যায় আরও একটি বছর। নীলার জন্য ততদিনে বাড়ি থেকে পাত্র দেখা শুরু করে দিয়েছে। ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব গুলোও নীলাকে কেন যেন টানছিল না। মনের কোথায় যেন সুতো কাটা ছিল তার। যা সে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। তার তো কারো জন্য অপেক্ষা ছিল না! তাহলে কেন মনের ভেতর সর্বক্ষণ এমন করে কাঁটা বিঁধে রইত?

রাতের খাবারের পর প্রায় রোজই নীলা তার বারান্দার দোলনায় বসে চা পান করতে করতে গান শোনে। আজও তাই করছিল আর তখন হুট করেই তার ভাইয়া এসে বলল-

-কী করছিস?

আচমকা ভাইয়ার কথায় নীলা একটু চমকায়। তারপর বলে- চা আর গান উপভোগ করছি।

-আমার জন্যও এক কাপ চা নিয়ে আয় যা। দুইজন একসাথে চা পান করি।

নীলা উঠে গিয়ে ভাইয়ার জন্য চা নিয়ে আসে। তার ভাইয়া চিনি ছাড়া গ্রিন-টি পান করে তাই খুব দ্রুতই চা নিয়ে ফিরল নীলা।

সরফরাজ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল- তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?ক্লাস করিস ঠিকঠাক?

-হুম করি তো। চলছে ভালোই।

-আমার কাছে তোর বিয়ের একটা প্রস্তাব এসেছে। ছেলে ব্যাংকে সিনিয়র ম্যানেজার পদে আছে। দেখতে শুনতে খুবই ভালো। মনে হল ছেলে হিসেবেও ছেলেটা খুব ভালো…

নীলা বুঝতেই পারছিল ভাইয়া এমন কিছু বলতেই এখানে এসেছে। সে কিছু না বলে চুপ রইল।

সরফরাজ নীলার দিকে একবার তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলে চলল-ছেলের ব্যাপারে আমি সব রকম খোঁজ খবর নিয়েছি। তুই একদিন বাইরে গিয়ে ছেলের সাথে দেখা কর। তোর ভালো লাগলে তবেই আমরা কথা আগাব।

পাত্র দেখা বিষয়টা নীলাকে সব সময় কেমন বিষণ্ণ করে তোলে। সরফরাজ সেটা খেয়াল করে বলল-

“তোকে কতবার জিজ্ঞেস করেছি নিজের পছন্দ আছে কিনা? বরাবরই মানা করেছিস। অথচ পাত্র দেখার কথা হলেই তুই কেমন বিষণ্ণ হয়ে যাস। আমরা তোকে কখনোই জোর করব না সেটা তুই জানিস। তারপরও কেন এমন থাকিস বল তো?”

কিছু না ভাইয়া… আসলে তোমাদের ছেড়ে যাবার কথা মনে হলেই আমার ভেতরে কেমন শূন্যতা তৈরি হয়…

এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু এই অনুভূতিটা সব সময় থাকবে না। আমি তোর জন্য বেছে বেছে এমন পাত্রই আনব যে তোকে আমাদের ছেড়ে থাকার কথা মনেই পড়তে দেবে না। যাক কাল শুক্রবার ছুটির দিন, আমি তাহলে ছেলের সাথে কথা বলে কালই তোর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করি?

নীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- ঠিক আছে ভাইয়া।

রাতে নীলার ভাবি এসে নীলাকে বলল- কী ব্যাপার তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? বিয়ের কথা হলে তো মেয়েদের চেহারা গ্লো করে আর তুমি দেখি উল্টো! ঘটনা কী?

কিছু না ভাবি। আমি চলে গেলে তো তোমার শান্তি, জ্বালাবার জন্য কেউ থাকল না।

একদম ঠিক ধরেছ। স্মার্ট গার্ল।

আচ্ছা ভাবিরা এমন কেন বল তো, ননদদের দেখতেই পারে না?

নীলার ভাবি হেসে ফেলল। হুম তা তো বটেই। ননদ মানেই তো সংসারের যন্ত্রণা। তাই তোমাকে না তাড়ানো অব্দি আমার শান্তি নেই। ঘাড় থেকে তাড়াতাড়ি নামো না?

হুহ, তোমার কী মনেহয় এত সহজেই আমি তোমাকে জ্বালানো বন্ধ করে দেব? উহু, এতদিন তো একা জ্বালাচ্ছিলাম বিয়ে হলে জামাই আর বাচ্চা সহ জ্বালাব দেখে নিও।

ও বাবা! আমি তো সবে পাত্র দেখার কথা বলছি আর তুমি এর মধ্যে বিয়ে করে বাচ্চা অব্দি চলে গেলে? এত ফাস্ট!!!

এই যে, শুরু হয়ে গেল তোমার?

হা হা হা… শোনো তুমি যদি তোমার জামাই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমায় জ্বালাও আমিও তবে তোমাকে আমার জামাই, কন্যা, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি নিয়ে জ্বালাব। যাকে বলে “সুদে আসলে শোধবোধ”।

তাই না? ঠিক আছে, সে দেখা যাবে কে কতটা জ্বালাতে পারে।

আচ্ছা শোন, যেটা বলতে এসেছিলাম… তোর ভাইয়া বলছিল কাল বিকেল ৪টায় তোকে পাত্রের সাথে দেখা করতে যেতে হবে রেস্টুরেন্টে।

তোমরা যাবে না?

না। তোমার ভাইয়া তোমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে আসবে। তোমরা একা দেখা করো। ভালো ভাবে মন খুলে কথা বলবে। আর শুনেছি ছেলে দেখতে খুব সুদর্শন। শুধু ড্যাব ড্যাব করে তাকে তাকিয়ে দেখবে না। হাব ভাব কথাবার্তা ভালো করে যাচাই করে দেখবে। প্রয়োজনে আমাকে ফোন দিবে আমি বলে দিব। ঠিক আছে?

তোমাকে ওখানে বসে ফোন করলে তুমি শয়তানি শুরু করে দেবে। তোমাকে আমার হাড়ে হাড়ে চেনা আছে। কিন্তু তোমরা কেউ যাবে না এটা কেমন হল? তুমি অন্তত চলো তুলতুলিকে নিয়ে?

না ভাই, তোমরা যাও। এখন যাবার জন্য এতবার বলছ গেলে তখন দেখা যাবে পাত্র পেয়ে আমাদের “কাবাব মে হাড্ডি” মনে হচ্ছে। আমি ওসবে নেই। তুমি একাই যাও, ফ্রি ভাবে কথা বল। তোমাদের ভালো লাগলে তারপর আমরা সিনিয়র পাবলিক ব্যান্ড পার্টি নিয়ে তোমার সিঙ্গেল খেতাব ঘোচাতে ঝাপিয়ে পড়ব। তখন আর তোমার কথা শোনার সুযোগ হবে না আমাদের। বুঝলে?

তুমি যে কোথা থেকে কী বলতে শুরু করে দাও তার আগামাথা নেই কোন।

-এত আগামাথা দিয়ে কী হবে। আমার ওসবের দরকার পড়ে না। এখন বল কী পরে যাবে ভেবেছ কিছু?

-না।

-আমি বের করে দিয়ে যাই সব?

-না, আমি পারব।

-শোন, আমার নীল শাড়ীটা পরে যা। আমি শাড়ী গহনা বের করে দিচ্ছি।

-ভাবি কী শুরু করলে এগুলো? তুমি কী এবার আমাকে তাড়িয়েই ছাড়বে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছ?

-হ্যাঁ, ঠিক তাই। থাকো, আমি সব বের করে নিয়ে আসছি। কাল ছুটির দিন ব্যস্ততা থাকবে পরে দেখা যাবে এটা ওটা খুঁজেই পাচ্ছি না। বলে ভাবি চলে গেল।

ভাবি চলে যেতেই নীলা মনে মনে কাল দেখা করার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে লাগল।

পরদিন নীলার ভাবি নীলাকে নিজেই সাজিয়ে দিলেন। গাঢ় নীল শাড়ীর সাথে সাদা পার্লের গহনা পরিয়ে দিলেন। চুল হালকা ভাবে খোঁপা করে তাতে দুটো সাদা জারবেরা ফুল গুঁজে দিলেন। এসব দেখে নীলা ভাবির উপর বিরক্ত হচ্ছিল কিন্তু ভাবি সেসব পাত্তাই দিলেন না। সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে বললেন-

-নীলা তোকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে…! মাশা-আল্লাহ। পাত্র তোকে দেখে একেবারে কাজী ডেকে ফেললে না হয়!

-উফফ ভাবি… আমি তো রেডি, বের হব কখন?

-এই তো তোমার ভাইয়াকে বলি।

নীলাকে ওর ভাইয়া একটা কফিশপের সামনে নামিয়ে দিল। বলল- আমি আশেপাশেই আছি। কথা শেষ হলে ফোন দিস। তুই একা ফিরতে পারবি নাকি আমি নিতে আসব আবার?

আমি যেতে পারব কাছেই তো।

ঠিক আছে।

ভাইয়া আমি তাকে চিনব কী করে কিছুই তো জানালে না?

চিনতে পারবি। তোর নামে টেবিল বুকিং দেয়া আছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করলেই হবে। আর তুই কিন্তু এখন পর্যন্ত একবারও ছেলের নাম জানতে চাইলি না?

নীলা মনে মনে ভাবল- পাত্রের প্রতি কোনো আগ্রহ থাকলে তবে না জানতে ইচ্ছে হবে! আর মুখে বলল- তুমি এত কিছু বলতে পারছ নামটা কেন জিজ্ঞেস করার জন্য অপেক্ষা করছ?

তোর নিজের ভেতরে যখন জানার কোন আগ্রহ নেই তখন আমি বলতে যাব কেন? আচ্ছা ভেতরে যা। ভালো ভাবে কথা বলিস।

“ঠিক আছে” বলে নীলা ওপরে চলে যায়। ভেতরে যেতেই একজন রেস্টুরেন্ট বয় তার দিকে এগিয়ে আসে। নীলা জিজ্ঞেস করল “নীলা” নামের কোনো টেবিল বুক করা আছে কিনা? ছেলেটা তাকে পেছনের কোনার দিকের একটা টেবিল দেখিয়ে দিল। নীলা ধন্যবাদ জানিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল… খেয়াল করল টেবিলটা বেশ সাজানো। অনেক ফুল রাখা… কাছে যেতেই দেখে টেবিলের উপর বেশ বড়সর একটা গিফট বক্স। সে তখন ভাবল, ভুল টেবিলে এসে পড়েনি তো? ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ তাকে বলল-

কেমন আছো নীলা?

নীলা চমকে উঠে পেছনে তাকাল। তারপর যা দেখল তা সে বিশ্বাস করতে পারছিল না… আবির ভাই!!!

আবির আর নীলা সামনাসামনি বসে আছে। আবিরকে নিয়ে নীলার মনে জমে থাকা প্রশ্নগুলো প্রবল বর্ষণের মত আছড়ে পড়তে চাইছিল… কিন্তু কী বলবে, কীভাবে বলবে এসব নিয়ে সে অপ্রস্তুত। ওদিকে আবির শান্ত নদীর মত বসে আছে। যেন প্রতিনিয়তই তাদের দেখা হয়! আবিরই প্রথম মুখ খুলল, বলল-

-কই, কেমন আছ বললে না তো?

-ভালো আছি। আপনি?

-ভালো। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন তুমি নীল শাড়ী পরে ছিলে, আজও তাই। মনে হচ্ছে নীল রংটা যেন তোমার জন্যই তৈরি।

-নীলা মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বলল- আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন?

-এতদিন তুমি কী আমার খোঁজ করেছিলে?

-নীলা অপ্রস্তুত হয়ে যায়… না মানে, আপনি এমন করে উধাও হয়ে গেলেন… চেনা-জানা কেউ হারিয়ে গেলে তার জন্য প্রশ্ন তো আসেই।

-ও… হারিয়ে যাইনি ফিরে আসবার জন্য মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা করেছি। যেভাবে ফিরলে কেউ আমায় ফেরাতে পারবে না।

-আমার ভাইয়া কী জানে আপনি কে?

-জানে। আমি তাকে আমার গল্পের সবটা জানিয়েছি। এক মাস আগে তোমার ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, সেদিনই সোজাসাপটা সবটা বলেছি। সেদিন সে কিছু বলেনি। শুধু বলেছিল “ঠিক আছে দেখছি। আমি তোমাকে পরে জানাচ্ছি কী করতে হবে।” এর এক মাস পর ৪দিন আগে ভাইয়া আমাকে ফোন করে ডাকিয়ে নেয়। তারপর বললেন- “সরি তোমাকে দীর্ঘদিন কিছু না বলতে পারার জন্য। তুমি যখন আমার কাছে এসে নিজের সবটা খুলে বলেছিলে তোমার প্রতি আমার কোনো অবিশ্বাস জন্মায়নি। তবু আমার একমাত্র বোনের ব্যাপার তাই আমাকে নিশ্চিন্ত হবার জন্য কিছুটা সময় নিতে হল। এই এক মাস আমি তোমার সম্পর্কে সব কিছুর খোঁজ নিয়েছি। তুমি কী করো না করো সব ডিটেলস জানার প্রয়োজন ছিল আমার। জনো তো পুলিশের চোখকে কখনো ফাঁকি দেয়া যায় না। এই একমাসে এমন কিছু পাওয়া যায়নি যা থেকে তোমার চরিত্রে এতটুকু দাগ পাওয়া যায়। আমার ধারণা আমার বোনের জন্য যে নিজেকে এতটা সংশোধন করতে পারে সে নিশ্চই আমার বোনকে অনেক ভালো রাখবে। নীলাকে আমি তোমার সামনে নিয়ে আসব। তোমরা নিজেরাই ঠিক করবে তোমাদের করণীয় কী? আমি তোমাদের পাশে থাকব। তবে কাউকে জোর করব না।” তারপর কাল ফোন করে বললেন তুমি দেখা করতে আসবে। এখন আমরা মুখোমুখি বসে।

-ভাইয়াকে আপনি সব বলতে কতটা বলেছেন?

-সব মানে সব বলেছি। আমার বাউন্ডুলে লাইফ থেকে শুরু করে সব। কারণ আমি জানি তিনি পুলিশ অফিসার তার কাছে কোনো কিছু গোপন করার উপায় নেই। সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে। আর সবচেয়ে বড় কথা কী জানো যাকে নিজের ভাবা যায় তার কাছের লোকেরাও নিজের হয়ে যায়। নিজের লোকের কাছে লুকোবার কিছু থাকে না। আর আরেকটা ব্যাপার… আমি নিজেকে আড়ালে রেখেছিলাম ঠিকই কিন্তু তোমার প্রতিটা পদক্ষেপ আমার নখদর্পণে ছিল।

-এভাবে আড়ালে থাকাটা কী খুব জরুরী ছিল?

-ছিল। আড়াল করার পর তুমি আমাকে যতটা সিরিয়াসলি নিয়েছ আড়ালে না গেলে ততটা নিতে না। আর তাছাড়া…

-তাছাড়া?

-আমি নিজেকে তোমার জন্য প্রস্তুত করতে চাইছিলাম। সে কারণেও সব কিছু থেকে দূরে থাকাটা দরকার ছিল। আমি সম্পূর্ণ নিজের জগত তৈরি করে নিয়েছিলাম যেখানে শুধু নিজের পরিবার আর তুমি ছিলে। নিজেকে যোগ্য আর সব কিছু থেকে দূরে রাখতে রাতদিন এক করে পড়তাম শুধু। তাই ভালো রেজাল্ট করে বের হয়েছিলাম। চাকরিটা পেতেও খুব বেশি স্ট্রাগল করতে হয়নি। অবশ্য আমি চাইলেই বাবার বিজনেসে জয়েন করতে পারতাম কিন্তু সেটাতে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ হত না। তাই চাকরির চেষ্টা করলাম। চাকরি হবার পর নিজেকে গুছিয়ে নিতে কিছুটা সময় নিলাম। তাতে ৬মাস চোখের পলকে চলে গেল যেন। তারপর তোমার ভাইয়ার সাথে দেখা করে সব বললাম। এখন বাকিটা তুমি বলবে। নীলা নামক গল্পটাতে আবির নামটা যুক্ত হবে কী না? আবিরের গল্পে কোনো পরিণতি আসবে কিনা?

-আবির ভাই গত দুই বছর ধরে আমার জন্য পাত্র দেখা হয়েছে। অনেক ভালো ভালো পাত্র এসেছে। আপনার উধাও হবার চক্করে আমার যদি বিয়ে হয়ে যেত তখন?

-হত না। ওই যে বললাম তোমার সব কিছু আমার নখদর্পণে ছিল? তোমার জন্য কতগুলো পাত্র দেখা হয়েছে তার সবই আমি জানি। একটা একটা করে বিয়ে গুলো ভেঙেছে কে বলো?

-আপনি এসবও করেছেন? কি সাংঘাতিক ছেলে!!!

-কি করব বলো সাংঘাতিক একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম যে! তবে তুমিও যে আমার টুকটাক খোঁজ করেছ, মিস করেছ সে হিসেব রাখতেও বাদ রাখিনি।

-তাহলে কোন যোগাযোগ কেন করেননি?

-আজকের দিনটা সেই সাথে আজকের পরের প্রতিটা দিন যেন সুন্দর হয় সেই আশায়। আচ্ছা আমরা এত কথা খালি মুখে কেন বলছি? তোমাকে এখনো খাবার অফার না করাটা চূড়ান্ত অভদ্রতা হয়ে গেল… কী খাবে ঝটপট বলে ফেল। টেবিলটা বুকিং দিয়ে নিয়েছি খেতে খেতে গল্প করা যাবে। অনেক বছরের, অনেক দিনের, অনেক গল্প জমা আছে।

-আমাকেই খাবার অর্ডার করতে হবে?

-হ্যাঁ, কারণ আজ তুমি আমার অতিথি।

-নীলা মেন্যুবুকটা ওপেন করে বলল “আবির ভাই, আজকের পর থেকে দুজন মিলে অর্ডার করব, মনে থাকবে?”

-আবিরের হার্টবিট যেন থেমে যেতে চাইল! যেন হাজার বছরের তৃষ্ণা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল এক পশলা ঝুম বৃষ্টিতে। সে নীলার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর ভেতরটা পড়ে নিল। তারপর বলল-

কে আবির ভাই??? আমি ওসব ভাই টাইকে চিনি না।

-এখনো ফ্ল্যার্ট করা ছাড়তে পারলেন না?

-তুমিও তো “ভাই” বলা ছাড়তে পারছ না!

-চেষ্টা করব… সময় লাগবে একটু।

-অর্ডার করবে না কী খিদে পেটে বসে থাকব?

-নীলা অর্ডার করল। তারপর দুজনে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করল। নীলার ভাবি এর মাঝে একবার ফোন করে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা জানতে চাইল। প্রথমেই জিজ্ঞেস করল-

-তুই কী এখনো রেস্টুরেন্টে বসে আছিস?

-হ্যাঁ।

-এখনো! বাড়ি ফিরবি না না কী? না কী আজই কাজী ডেকে ফেলব?

নীলা মনে মনে বলল- “প্লিজ ডাকো” কিন্তু আবির সামনে বসা মন খুলে কিছু বলতেও পারছিল না। ওদিকে এই সুযোগটা ভাবি নিচ্ছিল। নীলা বলল- তুমি ফোন রাখবে? কথা বলতে দিচ্ছ না কিন্তু।

-ও বাবা এখনই এই অবস্থা! ছেলেকে দেখেই আমাদের ভুলে গেলি! বাকি জীবন কী করবি?

-বাকি জীবন কী করব জানি না কিন্তু তুমি এখন ফোন না রাখলে ভাইয়ার কাছে তোমার নামে মিথ্যে নালিশ করব আর বাড়ি এসে আজকের কথা কিচ্ছু বলব না।

-নীলার ভাবি কপট রাগ দেখিয়ে ফোন রেখে দেয়। নীলা একটু অপ্রস্তুত হয়ে আবিরকে বলল “ইয়ে… ভাবি ফোন করেছিল… ফোন দিয়েই ফাজলামো শুরু করে দিয়েছে।

-আবির হেসে ফেলল। হুম, বুঝতে পারছিলাম। ঠিকই আছে। তুমি কী ভেবেছ এই যে এতগুলো দিন আমাকে একা যাপন করতে হয়েছে ভাবির সাথে মিলে আমি তার শোধ নেব না?

-ও, আমার ভাবির সাথে মিলে আমার বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র!!! শুনুন আপনারা যেমন বুনো ওল হবেন আমিও তেমনি বাঘা তেতুল হব। আমার সাথে আমার ভাইয়া আছে সেটা ভুলে যাবার কোন কারণ নেই।

-ওয়াও… আই লাইক বাঘা তেতুল। আর ভাইয়াকে আমি আমার দলে নিয়ে ফেলব ও নিয়ে তুমি ভেব না।

তারপর আরও কিছুক্ষণ তারা গল্প করল। দুজনের কারোরই উঠতে মন চাইছিল না।

-নীলা বলল “এত বড় বক্সে কী আছে?

-বাসায় গিয়ে খুলে দেখবে।

-আচ্ছা চলুন অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে… বাড়ি ফিরতে হবে।

-চলো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। আর হ্যাঁ, মা বাবাকে তোমার বাসায় কবে পাঠাব?

-নীলা খানিকটা লজ্জা পেল। বলল “সে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন”

-ঠিক আছে। আর আমাদের আবার কবে দেখা হবে?

-সব কথা এখনই বলে ফেলব?

-ঠিক আছে, ফোন করব।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here