# বিকেলে ভোরের ফুল : পর্ব — ১ #
আমি শিরিন রশীদ….. গল্প লিখি — দুতিনটা গ্রুপের সদস্য, সেখানেই গল্প দেই…. বিভিন্ন ধরনের গল্প…… ভৌতিক, অলৌকিক, মধুর প্রেম ফ্যান্টাসী ইত্যাদি, আমার প্রচুর অনুরাগী…. সবার কাছে থেকে অনেক প্রশংসা পাই…. শুভাকাঙ্খী এই সুন্দর মনের মানুষগুলো আমার লেখা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েন, পছন্দ করেন।
সবার এই ভালো লাগা আমাকে লিখতে উৎসাহিত করে, প্রেরণা দেয়।
গ্রুপগুলো সব পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত…. আমার সঙ্গে সবার খুবই ভালো সম্পর্ক, বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব একদম অকৃত্রিম, আমি অভিভূত ওদের ব্যবহারে।
আমি বাংলাদেশের ঢাকায় থাকি, দুরত্ব, ভিন্ন ধর্ম কিছুই বাঁধা হয়নি…. সবাই আমাকে অত্যন্ত আপন করে নিয়েছে…. আমিও।
দেবনাথের সাথে আমার আলাপ পরিচয় এই গ্রুপের মাধ্যমেই…. আমার গল্প দারুণ পছন্দ করে… বিভিন্ন কাজ — লেখা সেরে খুব কম সময়ই পাই, তারপরও ওর সাথে মেসেঞ্জারে লিখে ভাবের আদান প্রদান চালাই এবং এভাবেই এক সময় ভালো লাগা ও ভালোবাসা….. হ্যাঁ ফেসবুক প্রেম….
একটু আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা বলে নেই….. আমি বিবাহিত কিন্তু বিবেকহীন পাষন্ড স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় আমি তালাক নিয়ে নেই, সেও অনেক বছর হলো, এরপর থেকে আমি একাই…. দ্বিতীয় কাউকে চিন্তা করার ইচ্ছে বা রুচি হয়নি…. জানি সব মানুষ সমান হয় না তবুও মন সায় দেয়নি।
আমার কোনো সন্তান নেই, আমি স্কুলে চাকরী করি, গল্প লিখি….. আমার চলে যায়, আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ নেই…. দুএকজন যারা আছে, তাদের সাথে মেলামেশা করি না, ভালো লাগে না, আমি একা থাকতেই পছন্দ করি… একজনের বাসায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি….. নিজের মত করে দিন কাটাই….. আমি বেশ আছি।
ভালোই ছিলাম কিন্তু দেবু ( দেবনাথকে আমি দেবু বলি ) এসে সব এলোমেলো করে দিলো…. প্রথম প্রথম ওর সাথে তেমন কথা বলতাম না কিন্তু পরে ওর সম্মোহনী শক্তির কাছে হেরে গেলাম…. দেবুকে আমার কথা সবই বলেছি, কিছু গোপন করিনি…. সব শুনে এবং জেনেও ওর আমার প্রতি আগ্রহ বা ভালোবাসা একটুও কমেনি, বরং ওর অকৃত্রিম সহানুভূতি, ভালোবাসার টানে আমি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।
দেবু বিয়ে করেনি, একসময় কলেজের এক সহপাঠিনীর প্রতি দুবর্লতা থাকলেও সেটা মাঝপথেই শেষ হয়ে গেছে, পরিণতি পায়নি…..
তারপর দেবু আর কারো দিকে তাকিয়ে দেখেনি… ওরও একটা ছোট বোন ছাড়া কেউ নেই, মা বাবা আগেই মারা গেছেন, বোনটার বিয়ে দিয়েছে,স্বামীর সাথে বিদেশে থাকে, ও এখন একা…. নিজের বাড়ি আছে কলেজ স্ট্রীটে, পুরনো কাজের মানুষ নিয়ে থাকে, নিজের যেটুকু জায়গা দরকার, রেখে বাকীটা ভাড়া দেয়া…. নামকরা একটা পত্রিকা অফিসের সম্পাদক….. ছোট খাট কিছু ব্যর্থতা ছাড়া দেবু ভালোই আছে…
তো এই হচ্ছে আমাদের দুজনের জীবন কাহিনী…..
আমরা মানসিক ভাবে কেউ অসুখী নই, শুধু নিঃসঙ্গতা বিষন্ন করে রাখতো…. কিন্তু দুজন দুজনকে পেয়ে সব ভুলে নতুন ভাবে শুরু করার চিন্তা ভাবনা করছি…..
আমরা কেউ কিন্তু সেভাবে কাউকেই দেখিনি, কার বয়স কত সেটাও জানতে চাইনি…. কোনো কৌতূহল ছিলো না এই ব্যাপারে, বয়স – সৌন্দর্য যদি প্রেমের জন্য অপরিহার্য হোতো তবে সেটাকে প্রেম নয় মোহ বলা হয়…. সাধারণত দেখেছি…. সামান্য কমেন্টের সূত্র ধরেই কেউ কেউ জানতে চায়…. বয়স কত? ছবি দেন ইত্যাদি…. বিরক্ত লাগলেও কায়দা করে এড়িয়ে যেতাম…. ভদ্রতা….
কিন্তু দেবু কখনো এই ধরনের কথা বলেনি তাই ওকে অন্য সবার থেকে আলাদা মনে হওয়ায় আমি ওর প্রতি আকৃষ্ট হই।
প্রায় দেড় বছরের মত ওর সাথে কথোপকথন বজায় রইল…. ততদিনে আমরা আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছি… একে অপরকে জেনেছি…. ফোনে কথা হয়েছে কিন্তু সে খুব কম….. আমরা তো উভয়ই ব্যস্ত….. এরপরই দেবু সিদ্ধান্ত নিলো যে আর আমাদের দূরে থাকার দরকার নেই….. আমাকে একদিন বেশ রাতেই ফোন দিলো… জানে যে আমি রাত জেগে লিখি, স্কুলের কাজ থাকলেও করি… আমাদের দৈনন্দিন রুটিন আমাদের মুখস্ত।
আগে থেকে কিছু বলেনি তাই অত রাতে ওর ফোন পেয়ে চমকে উঠলাম, ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করলাম….
— কি হয়েছে দেবু? শরীর ভালো তো?
— ব্যস্ত হয়ো না, আমি ভালোই আছি (একটু চুপ করে থেকে ), ভালো লাগছে না, মন খারাপ।
—- ( উদ্বিগ্ন হয়ে ) কেন মনের আবার কি হলো?
—- শিরিন, সত্যি করে বলতো, আমার জন্য তোমার খারাপ লাগে না? চাও না আমাকে আরো কাছে পেতে?
—- ( একটু নীরবতা ) চাই দেবু… আমারও তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে… কিন্তু…
—- আবার কিন্তু কেন, চলে এসো আমার কাছে।
—- কেন তুমিও তো আসতে পারো?
—- না, তুমি এলেই ঠিক হয়, তোমাকে আমি মাথায় করে রাখবো।
—- ( হাসলাম ) আমার ওজন কত জানো? তুলবে কিভাবে?
— কত শুনি?
— এই নব্বই কেজি
—- ওরে বাবা, হার্ট এ্যাটাক হয়ে যাবে যে আমার,
যাক যা বলছিলাম, আমি এই বয়সে কাজ ছেড়ে দিলে নতুন জায়গায় নতুন কাজ খোঁজা মহা ঝামেলা, তাই বলছিলাম তুমিই চলে এসো।
—- বাঃ, আর আমার বুঝি কাজ নেই?
—- তোমার স্কুলের কাজ তো? ছেড়ে দাও, তোমাকে তো আমি চাকরী করতে দেবো না তবে গল্প লিখবে অবশ্যই।
— বেশ তো, নিজে বয়সের বাহানায় কাজ ছাড়তে রাজী নয় আর আমার বুঝি বয়স হয়নি?
— তাই নাকি, শুনি কত বয়স তোমার?
এই প্রথম আমাদের মধ্যে বয়সের প্রসঙ্গে কথা উঠলো…. কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম….
—- আগে তোমারটা শুনি
— (হা হা হা করে হাসলো ) কত আর, এই ৬০ প্লাস
— তামাশা করছো?
— না, সিরিয়াস
—- আমি ৬৮ মাইনাস
— এটা আবার কেমন, নাঃ বিশ্বাস হচ্ছে না…. আচ্ছা শোনো…. আমার কিন্তু মাথায় টাক, দাঁতও দুএকটা নড়বড় করছে, আমার হাইট হচ্ছে টেনেটুনে পাঁচ ফিট…..ছোটখাট একটা ভুড়িও আছে, এখন ভেবে দেখো টাকলু, বাটকু, ভুড়িয়ালা বর চলবে?
— আমারটা শুনবে? কোমরে ব্যথা পায়ে বাত… ঠিক মত হাঁটতে কষ্ট হয়, ইদুঁরের লেজের মত এক গুছি চুল, তাও আবার মেহেদী দিয়ে রঙ করে রাখি নইলে পাকা চুল দেখা যাবে…. এইবার তুমি বলো… এই বিউটি কুইনকে নেবে?
অপর পক্ষ খানিকক্ষণ চুপ…. তারপর বললো….
— দেখো আমি ধর্মেন্দ্র নই যে আমার হেমা মালিনী লাগবে…. তুমি যদি আমার দৈহিক ত্রুটি মেনে নিতে পারো, আমিও পারবো… আমরা ভালোবেসেছি দেহকে নয়… দুটি উষ্ণ হ্নদয়ের পরস্পরের অনুভূতি আবেগকে…. মন আমাদের উভয়ের জন্য তৈরী হয়েছে…. সেই মনের চোখে তুমি অপরূপা…. চলে এসো শিরিন, যত জলদি পারো… আমি অপেক্ষা করছি।
আমার আর কোনো দ্বিধা থাকলো না…. পাসপোর্ট ছিলোই, ভিসার জন্য আবেদন করলাম…. কথা রইলো আমরা কেউ কাউকেই দেখতে চাই না…. প্লেনে যাওয়া ঠিক হলো… বিমানবন্দরে উভয় উভয়কে চিনে নেব…. সব প্রস্তুতি শেষ হলে দেবুকে জানিয়ে দিলাম কখন নামবো দমদম বিমানবন্দরে।
যাত্রার আগের রাতে সহজে ঘুম এলো না… যা করতে যাচ্ছি সেটা কতটুকু সঠিক সিদ্ধান্ত? একদম অনিশ্চিত একটা অচেনা জীবন শুরু করবো, সফল হবো কি?
আর চিন্তা করতে চাইনা…. সময়ই বলে দেবে নিয়তি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাকে।।
#চলবে #
এই গল্পের বিষয়… চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক…. কল্পনা করে লেখা এই গল্পটির সত্যতা না খোঁজাই ভালো, কারো সাথে মিলে গেলে সেটা কাকতালীয় এবং সেক্ষেত্রে আমি দুঃখিত…. ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।
নাজনীন রাহমান *****