রোদেলা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু পর্ব: ৩৩

0
720

#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৩৩

পরদিন ওদের ফিরে যাবার কথা থাকলেও সেদিন ওদের যাওয়া কেন্সেল হলো। আরো একটা দিন থাকতে চায় সবাই। দুইদিনে দেখে যেন মন ভরে নি সবার। তাছাড়া একরকম শাড়ি আর পাঞ্জাবী পরার কথা সবাই বেমালুম ভুলে গেছে। এই শাড়ির অযুহাতে একটা দিন আরো থাকতে চায় নাতাশা, আর এ্যামী। এত সুন্দর শাড়ি এত সুন্দর জায়গায় পরবার জন্য তৈরী করা। না পরলে এত আয়োজন সবই পানিতে।
যেই ভাবনা সেই কাজ। সেদিন রাতেই সকলকে জানানো হলো কাল ওরা ফিরছে না।

রোদেলা যেন এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচে। এত সুন্দর একটা জায়গা মন ভরে দেখা হলো না ওর ঐ অশোভন লোকটার জন্য। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পরলো ও। অনেকদূর পর্যন্ত হাঁটার কারনে পা অসম্ভব ব্যাথা করছে।
প্রিসিলা ঘুমে পানি পানি অবস্থা…

রোদেলার ঘুম আসছে না, তাই বারান্দার থাই-গ্লাস টেনে বারান্দায় গেলো ও। বারান্দা থেকে বীচের ভীউ না দেখা গেলেও জায়গাটা সুন্দর গাছগাছালিতে ভরা। মাঝে মঝে বেদীর মতো বসার জায়গা রয়েছে। কৃত্রিম ঝড়না, আর মাটির তৈরী কিছু পাখিও রয়েছে সেখানে। বাহারী রঙের অধুনা বাতির সৌন্দর্য আর স্থাপত্য শৈলী এর সৌন্দর্যের প্রধান কারন। পুরো জায়গাটায় চোখ বুলাতেই চোখ পরলো একটা বেদীতে। কেও একটা বসে আছে সেখানে সিগারেট হাতে। অল্প সময় পরই হাতের জ্বলজ্বল করা ডায়েল দেখে
বুঝলো কে বসে আছে সেখানে। হঠাৎই বুকটা ছুৎ করে উঠলো ঐ রাতের কথা মনে করে। সেদিনও রোদেলা শোভনকে চিনেছিলো এই জ্বলজ্বল করা ডায়েল দেখে।
বারান্দায় দাড়িয়েই রুমের দেওয়ালে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দেড়টা বাজে।

সিগারেটের জ্বলন্ত শিখা ঠোঁটের আলিঙ্গনে ওঠানামা করছে কিছুসময় পরপর। শোভন সিগা*রেট খায় তা জানতো না রোদেলা। মনটা আদ্র হয়ে যায় রোদেলার। সন্ধ্যার পর এই মাত্র দেখলো ওকে। বেচারা এতক্ষণ লুকিয়ে রেখেছে নিজেকে রোদেলার কাছ থেকে। খেতেও আসো নি লজ্জায় কিংবা সংকোচে…
কিন্তু অন্যান্য দিন এই সেই বাহানায় কতবার দেখা হয়। বেচারার জন্য মায়া হয় রোদেলার। রোদেলা জানে ওর প্রকাশ ভঙ্গি ঠিক না হলেও ওর ভালোবাসাটা মিথ্যা না। কিন্তু আবেগে গা ভাসায় না রোদেলা, জীবণে প্রতিটি কদম ওকে বুঝেশুনে হিসেব করে ফেলতে হয়। সারা দুনিয়ার কথা বাদ এরকম কিছু হলে ওর মা-ই ওকে কথা শুনাতে শুনাতে মেরে ফেলবে। কি বলতে পারে ওর মা তা কে ভালো জানে ওর চেয়ে। তাছাড়া শোভন ওর মায়ের একমাত্র ছেলে। ওর বোন কিংবা মা কেওই চান না এ সম্পর্কটা হোক।

রোদেলার জায়গায় অন্য যে কেও থাকলে ঠিক কিছু একটা করে ফেলতো। এমন ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবার সাহস সবার নেই। এমন একটা ছেলে যে শিক্ষিত, স্মার্ট, ব্যাবসায়ী তার উপর এত ভালো পরিবার। শোভনদের পরিবার যদি মেনে নাও নেয় দিব্যি চলবে ওদের জীবণ। এটা ভেবে এক হয়ে যেতো দুজনে, পরে কি হয় দেখা যাবে। আগে তো এক হয়েই নিই… কিন্তু রোদেলা তা ভাবে না। ওর ভাবনা যতটা না আবেগময় তার চেয়ে বেশী যৌক্তিক। ওর জীবণ এমনিতেই প্যারাময়, আর প্যারা ও নিতে চায় না।

হঠাৎ বারান্দার দিকে মুখ করে তাকায় শোভন। রোদেলা দ্রুত সরে পরে ওর দেখার আগেই। কেমন একটা সিচুয়েশন…
সেখান থেকে ফিরে রুমে ঢুকে ও। মনে মনে বলে
– খাক…!
সিগা*রেট খাক না-হয় গা*জা খাক তাতে ওর কি…..?!
আর এসব ইমোশনাল ড্রমা দেখে ওর এত ভাবার কি আছে…?!

ও তো ওকে বলে নি ভালোবাসতে, বরং শুরুতেই সতর্ক করে দিয়েছে। নিজেকে মনে মনে বলে- রোদেলা তুমি ঠিক কাজটাই করছো…
ইউ হ্যাভ টু বি কুরাল, টু বি কাইন্ড…..

বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলো রোদেলা। কিছু সময় পরই ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করলো ও।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় ওর। বাথরুম থেকে এসে আর ঘুম আসে না। এপাশ-ওপাশ করতে করতে প্রিসিলাও জেগে উঠলো। সূর্য উঠবে কিছুক্ষণের মধ্যে। প্রিসিলাকে জিজ্ঞেস করলো যাবি সানরাইজ দেখতে…!?
প্রিসিলা তড়াক করে উঠে গেলো। কোনমতে তৈরী হয় দুবোন। গন্তব্য সানরাইজ….

ভোর হলেও অনেকেই হাঁটাহাঁটি করে বীচের দিকে। এত সুন্দর জায়গায় তো ঘুমাতে আসে না লোকজন…!

সবাই সানরাইজ দেখতেই আসে, কেও কেও প্রাতভ্রমণে। ভালোই লাগে সকালকার এই সময়টা। স্নিগ্ধ বাতাসে এলোমেলো অবস্থা। শার্ট কিংবা টপস পরা উচিত ছিলো। কামিজ পরে থাকায় পেছনের অংশ উড়ছে। বিশ্রী অবস্থা। রোদেলা ওর ওরনাটা মেলে দিলো পেছন থেকে। তারপর প্রকৃতি দেখায় মন দিলো ওরা। বীচের কাছে বিশাল এক ট্রলার দেখলো ওরা, দুজনে সেখানে যেতে হাঁটা ধরলো। ছবি তুলবে এটাকে অবজেক্ট করে।

সেখানে গিয়েই দেখে আবু সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছে পেছনে দুই হাত রেখে। পরনে ট্রাউজার আর টি শার্ট। ভদ্রলোক বেশীরভাগ সময় শার্ট পরে থাকেন। হাতের বোতাম আটকে,
তাই হয়তো অন্য রকম লাগছে ওদের। রোদেলা সেখান থেকে চলে আসতে চায়, আর প্রিসিলা জোরে ডাক দেয় সুফিয়ান ভাই…!

সুফিয়ান সেখানে থেকেই হাত নাড়ে, রোদেলা ভেবেছিলো ওদের দেখলেই হয়তো ওদের কাছে আসবে। কিন্তু দেখা গেলো উল্টো। তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ব্যাপারটা ভালো লাগলো রোদেলার।

সেখানে কিছু সময় থেকেই চলে এলো রুমে। মাত্র সকাল সাড়ে ছয়টা.. কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে শুয়ে পরলো আবার।

দুপুরে রোদেলাকে নিয়ে গোসলের জন্য বিচে গলো নাতাশা। বললো ব্যান্ডেজ লাগানো আছে, কোন সমস্যা হবে না। রোদেলাও মনে মনে চাচ্ছে যেতে। এখানে এসে পানিতে না নামলে এতদূর আসা বৃথা। অবশেষে ওরা সেন্টমার্টিনের পানিতে নামলো।

অনেক অনেক মজা করলো ওরা। এ্যামী আপু ওদের সাথে যোগ দিলো বয়সের পার্থক্য ভুলে। একটু পরপর ঢেউ আছড়ে পরছে এলোমেলোভাবে। কি যে মজার অনুভূতি বলার বাহিরে।

গোসলের সময় কি এক কান্ড, ভেজা জামাকাপড় শরীরে লেপ্টে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। প্রিসিলা প্যান্ট পরেছে টপস দিয়ে। রোদেলা পরেছে জিন্স আর লং শার্ট। শার্টের রং হালকা পীচ কালর হওয়ায় খুবই অস্বস্তি লাগছে ওর। জামার নিচের রঙিন স্ট্রাইপের ছোট্ট কাপড়টা ভিজা জামার উপরে তার অস্তিত্বের ঘোষনা দিচ্ছে যেন। শেষে নাতাশা ওর গামছা দিয়ে পিঠের দিকটা ঢেকে দিতে বললো। আজ একটা শিক্ষা হলো ওর। এর পর অবশ্যই অবশ্যই গাঢ় রঙের কাপড় পরে পানিতে নামবে ও। ভাগ্যিস ছেলেগুলো দলাদলি করে ছবি তোলায় ব্যাস্ত, তা না হলো পরিস্থিতি আরো অস্বস্তিকর হতো।

দুপুরে খেয়ে ঘুম দেয় ওরা। চারটায় ওদের রুমে এসে নাতাশা ওদের ডাকাডাকি করতে থাকে। তাগাদা দেয় তৈরী হতে।
নাতাশার সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি স্বভাব। তিনি এখন সবাইকে নিয়ে ফটোশুট করবে বলে সবাইকে রিসোর্টের কাছের গেইটে জমায়েত করেছে। রোদেলা শাড়ি পরে রেডি হয়ে বসে আছে, কিন্তু ওর সেখানে যেতে ইচ্ছে করছে না।
ভেবেছে রুমে বসে থাকলে হয়তো খেয়ালই করবেনা,
খোঁজও করবে না। কিন্তু ঘটনা উল্টো। দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে উনি শোভনকে পাঠিয়েছে রোদেলাকে ডাকতে। হায় কপাল যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত পোহায়….!

মনে মনে খুব বকে রোদেলা নাতাশাকে। এই মেয়েটা বড় কবে হবে…! দড়জায় নক করতেই রোদেলা একটুখানি খুলে দেখে শোভন দাড়িয়ে…! বললো-
: ভাবী আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে…!
আপনি….!? বাহ ঔষধে কাজ হয়েছে তাহলে….
: আমি আসছি আপনি যান…
: না আমার সাথেই যেতে বলেছে…
: দড়জা আটকে দেয় রোদেলা।
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে শোভন। কি আমার দায়িত্বশীল পুরুষরে… হুহ্….

উপায় না দেখে রোদেলা রুম থেকে বের হয়। দড়জা লক করে শোভনের আগে আগেই পা বাড়ায়। শাড়ি পরায় অনভ্যস্ত রোদেলা যেন এগুতেই পারছে না। সিঁড়ির দিকে নামতেই পা জড়িয়ে পরে গেলো ও। শোভন দৌড়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো।

রোদেলা কিন্তু বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরলো না। নিজেই সিঁড়ির রেলিং ধরে উঠলো। শোভন কিছুটা আহত হলো ওর এই আচরণে। দাড়িয়ে রইলো সেই সিঁড়িতেই, যেন ওর পা আটকে গেছে। রোদেলা উপরে তাকিয়ে দেখলো শোভন সেখানেই দাঁড়িয়ে। রোদেলা কটমট করে তাকিয়ে বললো-
: দাঁড়িয়ে কেন আছেন…? আপনাকে না নিয়ে গেলে আবার আপনাকে নিতে লোক পাঠাবে। চলুন…
কথাটা শুনে হেসে দিলো শোভন…!
রোদেলা চেয়ে দেখলো শোভনকে। কি সুন্দর হাসি….!
মাশাল্লাহ…! দুজন একই সাথে পাশাপাশি নামলো নিচতলায়।

রিসিপশনে চাবি জমা দিলো রোদেলা, শোভন দাঁড়ায় ততক্ষণ। তারপর দুজনে রওনা দেয়। রিসিপশনে থাকা এমন কেও নেই যে ওদেরকে ফিরে দেখেছে। অনেকে অনেক কিছু ভেবে নিচ্ছে তাদের মনের মতো। দুজনই এক ডিজাইনের শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরা। এত সুন্দর লাগছে দুজনকে যে চোখ ফেরানো দায়। ঠিক যেন কপোত-কপোতী। দুজন তৈরি দুজনেরই জন্য।

রোদেলাকে ভালোভাবে দেখলো শোভন। পা চালাচ্ছে রোদেলার গতিতে। তেমন কোন সাজসজ্জা নেই তবুও ও যেন ইশ্বরের বিশেষ যত্নে তৈরী ও । শোভনের মনে হয় “পৃথিবীর সবচেয়ে আবেদনময়ী পোশাক শাড়ি” কথাটা সত্যি… । রোদেলা যেন কোন কল্পলোকের রাজকুমারী। মাত্র শরতের মেঘ ভেদ করে মর্তে নেমেছে। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয় শোভনের। গোপনে ধন্যবাদ দেয় নাতাশাকে। পাশে হাঁটার এই সুযোগ করে দিতে। একটা ছবি যাদি কেউ তুলে দিতো, এই মানুষটাকে যদি না পাওয়া হয় ছবিটাতো থাকতো…

ছবিতে নাহয় একছত্র মালিক থাকতাম আমি এই মিষ্টি মেয়ে রোদেলার, সেটা রেখে দিতাম অনেক যত্ন করে, ভালোবেসে…

ওদের একসাথে আসতে দেখে সবাই তাকিয়ে রইলো সেদিক। কি বুঝে যেন শোভন হঠাৎ হাত ধরলো রোদেলার। শক্ত করে… রোদেলা শোভনের দিকে তাকিয়ে… কি করছে ও কি হবে এর পরিনাম তা জানাতে ও জানাতে…

সবাই যেন ওদের দেখতেই ব্যাস্ত কি হচ্ছে কি করছে তা কেউই হয়তো খেয়ালই করে নি। কল্লোলের হাতে ছিলো ক্যামেরা। খুটখাট ছবি তুললো কয়েকটা। সেই ছবিতে
রোদেলা অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলো শোভনের দিকে…

চলবে…
previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1520762401718279/
next :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1522929151501604/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here