হৃদয় পথে এ কার ছায়া (পর্ব ১)

0
1588

#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ১)

“অসম্ভব! ওই ছেলেকে আমি কোনোদিন বিয়ে করব না। কথা তো কথা না, পুরো সাইরেন বাজায়। এত শব্দ করে কেউ কথা বলে? সোফায় পা তুলে বসেছিল। তুই আসছিস একটা অপরিচিত মানুষের বাসায়, ন্যুনতম কাণ্ডজ্ঞান থাকবে না? সবচাইতে বিশ্রী ব্যাপার হলো হাত দিয়ে একটু পরপর নাক খুঁটছিল, হাত না ধুয়ে ওই হাত দিয়েই আঙ্গুর মুখে দিলো। ইয়াক!” মনে যত রকম ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল সব উগ্রে দিল নওমী।

“তুইও তো এতক্ষণ সাইরেনই বাজাইলি। আমার কানটা এক্কেবারে শেষ।” নওমীর ভাবি শায়না একরাশ বিরক্তি নিয়ে কথাটা বলল।

“আচ্ছা বলো তো, তোমাদের পছন্দের ওই রাজপুত্রের মধ্যে এমন একটা জিনিস দেখাও, যা আমি পছন্দ করতে পারি?”

“সেটা আমি কী করে দেখাব? আমি তোর ভাইকে যখন বিয়ে করি, তার মধ্যেও তেমন কোনো গুণ খুঁজে পাইনি।”

“কিন্তু তোমাদের লাভ ম্যারেজ ছিল। বেগুন হইলেও তোমরা পাগলপারা হয়ে বিয়ে করসো।”

“শোন, একবার দেখায় কিছু হয় না। তোরা কিছুদিন কথাবার্তা বল। তুই কিন্তু মিফতাকে ভীষণ অপমান করেছিস।”

নওমীর গায়ে আগুনের আঁচে আবারও যেন ফোস্কা পড়ল, “শোনো ভাবি, যে ছেলে নাক খুঁটে হাত না ধুয়ে খাবার খায় ওই ছেলে যদি পৃথিবীর সব গুণ নিজের মধ্যে স্টোর করে রাখে তবুও তাকে আমার পক্ষে বিয়ে করা অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব।”

“এটা তোর শেষ কথা?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু মিফতা বাবার সবচাইতে কাছের বন্ধুর ভাইয়ের ছেলে। তাদের মধ্যে কথা পাকাপাকি হয়ে গেছে। শুধু হাত দিয়ে নাক খুঁটে এরপর ওই হাতেই খাবার খায়, এই ঠুনকো অজুহাতে বিয়েটা ভাঙবে না।”

“এটা ঠুককো কীভাবে? জোরালো কারণ নয়?”

“না। কারণ তোর অতিরিক্ত শুচিতার বাতিক সকলের ভালোমতো জানা আছে।”

“ভাবি, তুমি ভাইয়াকে বলো না, বাবাকে বোঝাতে…”

“স্যরি রে, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

“ভাবি…”

শায়না উঠে চলে গেল। রাগে নওমীর মাথা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে আছে। বাবাকে সে যমের মতো ভয় পায়। তাই নিজের অপছন্দের কথা সরাসরি জানাতে পারবে না। মা’কে বলে কোনো লাভ নেই, কারণ বাবার কথা তার কাছে আদর্শ লিপির নীতিবাক্যের মতো অবশ্য পালনীয়।

ভাইয়াও কতটা সাহায্য করবে সেটা নিয়ে নওমীর ঘোরতর সন্দেহ আছে। কারণ তার প্রেমে সে বাগড়া দিয়েছিল ভালোমতো। শায়না ওর বান্ধবী রায়ার বড় বোন। রায়ার সাথে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল একসময়। মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল। গলায় গলায় ভাব থেকে একেবারে ঘোর শত্রুতায় নেমে এসেছিল। তখনই ওর কানে এসেছিল, শায়নার সাথে নীরবের প্রেমের ব্যাপারটা। তাই সে ওই সম্পর্ক ভাঙার জন্য বহুত কাঠখড় পুড়িয়েছে। তাতে কেবল ধোয়া-ই ছড়িয়েছে। লাভ কিছু হয়নি। রায়া-ও আবার বন্ধু হয়ে গেছে। মাঝখান থেকে ওকে এখন সেই কৃতকর্মের ফল পাবার দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে ভাগ্য।

ওই ব্যাটা মিফতার জন্য কেন ওর জীবন ঝালাপালা হবে!

বলে কিনা, “আপনার জ্ঞান আপনার ঘরের ডিপ ফ্রিজে স্টোর করে রাখুন। ওইটা আমার যথেষ্ট আছে।”

“তোর জ্ঞান আছে নাকি তুই মূর্খ, সেটার মার্কেটিং করতে কেউ তোকে বলেছে? এতই মহাজ্ঞানী যে ভদ্রতার ভ নেই। আবার দেখা হলে এক রিম কাগজ কিনে ভদ্রতার বানান লিখিয়ে লিখিয়ে তার নাড়িনক্ষত্র পর্যন্ত শেখাব তোকে। ফাজিল ব্যাটা।”

পড়া শেষে কলমটা পর্যন্ত গুছিয়ে রাখে সে। দিনে যতবার বিছানায় বসে ততবার ঝাড়ু দেয়। বাইরে থেকে এসে সাথে সাথে গোসল না করা পর্যন্ত স্বস্তি পায় না। পোশাকে, চলনে শতভাগ পরিপাট্য না হলে কেমন অস্বস্তি হয় ভেতরে ভেতরে। আর ওই ছেলে…
ইয়াক…

***
“দেশে কি মেয়ের অভাব পড়ছে যে ওই মেয়েরে বিয়ে করতে হবে? ফালতু এ্যাটিটিউড। তোর আমি খাই না পরি যে আমারে জ্ঞান দিতে আসিস? বিয়ে করে মানুষ শান্তির জন্যে। জেনেশুনে একটা জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে শিক্ষা সফরে যাওয়ার জন্য না। এই বিয়ে বাতিল করো।”

মিফতা বাসায় এসেই হম্বিতম্বি শুরু করেছে। সে অত্যন্ত অগোছালো স্বভাবের মানুষ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি থাকে, চুলও খানিকটা এলোমেলো করে আঁচড়ানো। শুধু বাইরে যাবার আগে কেবল মাথাটা চিরুনির স্পর্শ পায়। নিজের ঘর কবে সর্বশেষ নিজে গুছিয়েছিল মনে করতে পারে না। নিজের জন্য এমন একটা মেয়ে সে চেয়েছিল, যে ওকে ভালোবেসে গুছিয়ে দেবে।

সে এলোমেলো করবে, ওর যে স্ত্রী হবে সে ভালোবেসে সব সুন্দর করে গুছিয়ে দেবে। তা না, এই মেয়েকে বিয়ে করলে এমনিতেও ওকে হিমালয়ের কৈলাশ পর্বতের মানস সরোবরে পালাতে হবে সন্ন্যাসব্রত নিয়ে। সন্ন্যাস ব্রত যদি নিতেই হয়, তবে বিয়ে করে সন্ন্যাসী হওয়া কেন, এখনই তা বরণ করে নেয়া ভালো।

বাবা রণহুংকার ছেড়ে বললেন, “সারাজীবন তোর এসব সহ্য করেছি। এবার আর করব না। এই বিয়ে না করলে তুই আমার কাছ থেকে এক কানাকড়িও পাবি না।”

“তোমার কানাকড়ি আমার দরকার নাই। আমি এখন চাকরি করি।”

“তাতে কী হয়েছে? তোর ওই চাকরি কীভাবে ছাড়িয়ে দিতে হয় সে আমার ঢের ভালো জানা আছে। মায়ের অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে একটা বাঁদর তৈরি হয়েছিস। তোকে একেবারে সিধে করে রেখে দেব।”

মিফতার মা মালা এবার কথা বললেন, “আমার আদরে বাঁদর হয়েছে মানে? কী বলতে চাও? তুমি কী করসো? তোমার কোনো দায়িত্ব নাই? তুমি জন্ম দাও নাই?”

জামিল সাহেব বুঝলেন পরিস্থিতি ঘুরে যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে বেফাঁস কথা বলে ফেলার বদ অভ্যাস তার রয়েছে। স্ত্রীর সাথে একবার ঝগড়া শুরু হলে বাড়ি মাথায় উঠবে। কমপক্ষে দুই দিন বাড়ির চুলায় আগুন জ্বলবে না। তাই গৃহ যু দ্ধ তথা তৃতীয় বিশ্ব যু/ /দ্ধ থামাতে তিনি মধ্যপন্থা বেছে নিলেন।

“আরে, সেটা বলিনি। মা হিসেবে তুমি ছেলেকে ভালোবেসেছ, শাসন টাশন তেমন পায় নাই তো। এটা বোঝালাম। তুমি মা হিসেবে কত নিবেদিত। কিন্তু তোমার এই গুণধর ছেলে তার মর্ম বুঝল?”

এবার মালা খানিকটা নরম হলেন। নমনীয় গলায় বললেন, “মিফতা, তুই এই বিয়েই করবি। নইলে আমি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে ঘরে বসে থাকব।”

মিফতা অসহায় গলায় বলল, “আমার বিয়ে করা না করার সাথে তোমার না খেয়ে বসে থাকার সম্পর্ক কী?”

“সেটা তুই বুঝবি না। ছেলেকে পেটে ধরেছি, বড় করেছি, ছেলে আর ছেলের বাপের কাছ থেকে এই প্রতিদান পাচ্ছি।” বলেই মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে শুরু করলেন।

মিফতা পড়ল উভয় সংকটে। ওই অতি জ্ঞানী বউ নিয়ে সে সারাজীবন কী করে থাকবে! ওই মেয়ে ওর মাথায় উঠে কাঁঠাল ভেঙে খাবে। কিন্তু মেয়েটা কাঁঠাল খায় তো? হঠাৎ এমন উদ্ভট প্রশ্ন কেন মাথায় এলো সে ভেবে পায় না। কাঁঠালের গন্ধ পর্যন্ত ওর সহ্য হয় না।

ওর সাধের কাঁধ অব্দি লম্বা চুলগুলো কাঁঠালের আঠায় চিপ্টে আছে ভাবতেই গায়ে একশো চার ডিগ্রি জ্বর চলে এলো। এই বিয়ে যে করেই হোক ভাঙতে হবে।

“ভাইজান, কাঁঠাল খাইবেন?”

তাকিয়ে দেখল চামেলির হাতে একটা বড় বাটিতে কাঁঠাল। পুরো পৃথিবী একসাথে ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এই ধারণা বদ্ধমূল হলো মিফতার। সে প্রায় চিৎকার করে বলল,

“আমার সামনে কোনোদিন কাঁঠাল আনবে না। আগে বলেছি না? যদি আমার চৌহদ্দির মধ্যে এই বিশ্রী জিনিসটা দেখি ওইদিনই তোমার চাকরি নট।”

“চেতেন ক্যান? চাকরি আমারে খালাম্মা দিসে। আফনেরে কাঁঠাল দিতে হ্যায় কইসে। হ্যারে জিগায়ে দ্যাহেন! তারে কী এহন আম্মার জাগা থেইক্যা নট কইরে দিবেন?”

মিফতা মাথার চুল চেপে ধরে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে সে বদ্ধ পাগল হয়ে যাবে।
…….
(ক্রমশ)
নুসরাত জাহান লিজা

(এটা একেবারেই নিখাঁদ বিনোদনের জন্য লেখা। যেমন খুশি তেমন লেখো’ টাইপের। সিরিয়াস ধরনের পাঠক হলে এড়িয়ে যেতে পারেন। কেমন লাগল ইচ্ছে হলে জানাতে পারেন। প্লটটা মাথায় এসেছিল ৩০ অক্টোবর, ২০২২ এ। সেদিন চুম্বক অংশ শেয়ারও করেছিলাম। ভালোবাসা সবার জন্য।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here