#গল্প: অঘমর্ষণ (চতুর্থ পর্ব)
লেখা: মারইয়াম জামীলা
________
৮.
কল রিসিভ করার পরক্ষণে অপরিচিত কণ্ঠের সালাম পেয়ে লামিজা খন্দকার প্রথমে কিছুটা অবাক হলেন, বাসার ল্যান্ডফোনে সাধারণত কাছের কেউ ছাড়া কল করার কথা না। সেই নব্বইয়ের দশকের এই সোনালী রিসিভারটা ব্যবহৃত ইশরাকের সাথে কথা বলার প্রয়োজনে। ছেলেটা সুইডেনের কোনো বহুতল ভবনের জানালা খুলে দিয়ে রিসিভারে কান পাততো, এদিকে হাজার মাইল দূরে বসে প্রিয় মানুষটার কথা শুনতে পুরান ঢাকার ঘেঁষাঘেঁষি করা দু’তিনতলা বিল্ডিঙের গ্রিল ধরে বসে রিসিভার থেকে ভেসে আসা কণ্ঠের অপেক্ষায় থাকা হতো। ডাকবাক্সের দিকে দৌড়ে গিয়ে হলদে খামটা ছিঁড়ে সবার আগে টেপ বের করে এনে শোনার আগ্রহ থাকত। গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে লাইন কাটা হলে যা বিরক্তি ধরে যেত, আহ! কত রাত কেটে গিয়েছে এই রিসিভার কানে ধরে পাশেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই দিন আর এখন নেই। নেই সেই বৈবাহিক সম্পর্কটাও। সময়ের সাথে সাথে বয়ে চলায় এই ল্যান্ডফোন হয়ে গিয়েছে এক রকম শোপিসের ন্যায়। মাঝেমধ্যে দু’একবার ইলেক্ট্রিসিটির সংকটে পড়ে গিয়ে কিংবা মোবাইল ফোনের ব্যালেন্স ফুরালে হয়ত এক কি দুই বছরে একবার প্রবাসী বোনের সাথে কথা হয়। ইশরাকের সেই পুরনো মুখস্থ করা টিয়েন্টি নাম্বারটা পর্যন্ত আজ মনে পড়ে না। এই এতগুলো বছর পরে বোন কিংবা কাছের একজন বান্ধবি বাদে রিসিভার থেকে কারো কণ্ঠ পাওয়াটা বেশ চিন্তারই কথা। সালামের উত্তর দিয়ে লামিজা সাধারণ প্রশ্নটা করলেন, “কে বলছেন?”
– “আন্টি আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি আপনার মেয়ে মেহুলের বন্ধুবর প্রতিবেশী অর্ণা। সে আপনাকে জানাতে বলেছে যে আপনি যেন শেষবারের মতো গিয়ে তার সাথে মিরপুরের সানসেট রুফটপ লাউঞ্জে শেষবার দেখা করেন। নাম্বারটা সে তার বাবার ডায়েরি থেকে নিয়ে আমাকে দিয়েছে।” ওপাশের কণ্ঠটা বলল।
– “কী নাম বললে? মেহুল?”
– “জি, আপনার মেয়ে মেহুল।”
বেগম খন্দকার কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন। এই নামের মেয়ে তো দূরের ব্যাপার, কোনো চেনা মেয়েই তার নেই। দৃঢ় কণ্ঠে রিসিভার মুখে কাছে টেনে নিয়ে জানালেন, “দেখুন, আপনি কে কোথা থেকে কার কথা বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মেহুল নামে টিভির পর্দার এক মডেল ছাড়া আমার জানা কেউ নেই। হয়ত ভুল নাম্বারে কল দিয়েছেন।”
ওপাশের কণ্ঠটা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আন্টি প্লিজ শুনুন, লাইন কাটবনে না। নাম্বারটা ঠিকই আছে। মেহুলের খুব কাছের আমি। ওর পারিবারিক কিছু বিষয় সেজন্য জানা আছে। ওর খুব ছোটবেলায় বাবা মায়ের তালাক হয়ে যায়। এক বছর আগে করোনায় ওর বাবাও মারা যায়। এখন সে দাদুর বাড়িতে থাকছে, হোস্টেলে থেকে পড়ছে যদিও তবে প্রায় ক’দিন বাদেই আসে। আমাদেরই বিল্ডিংয়ে বাসাটা। আপনি প্লিজ ওর কথাটা একবার মনে করে দেখুন।”
– “দেখো মামণি, কথায় বোঝা যাচ্ছে তুমি আমার ছোট তাই ‘তুমি’ করে বলছি। বিশ্বাস করো, আমার আসলে কোনো মেয়ে নেই। দুইটা ছেলে আছে, তাদের একজন ক্লাস ফাইভে আছে আর অন্যজন পড়ছে নটরডেমে। আমি কেন তোমাকে মিথ্যা বলতে যাব? আমার তো কোনোদিন কোনো মেয়ে হয়ইনি।”
ওপাশ থেকে মেয়েটা কিছু একটা ভাবছে বোঝা গেল। তারপর আস্তে করে বলল, “আপনি সত্যিই মেহুলের মা নন?”
– “না।”
– “আমাকে মামণি বলে ডেকেছেন কিন্তু, এই সম্পর্কের দাবি রেখে একটা জিনিস চাইব?”
– “দেয়ার মতো হলে মানা করব না। কিন্তু কী চাও?” হঠাৎ ব্যাপারটা মাথায় খেলে যেতেই লামিজা দ্রুত যোগ করলেন, “আচ্ছা, তুমি কি আমাকে ওই সানশেড ছাদে যেতে বলবে?”
– “সানসেট রুফটপ লাউঞ্জ; নয়তলা সানফ্লাওয়ার মার্কেটের ছাদে রুফটপে একটা কফিশপ আছে, রেস্টুরেন্টও বলা যায়।… হ্যাঁ সেটাই বলতে চাচ্ছি। অন্তত একবার ওর সাথে কথা বলুন প্লিজ। সে অনেক বছর ধরে আপনাকে ‘মামণি’ ভেবে আসছে।”
– “কিন্তু একটা অচেনা জায়গায় অচেনা একটা মেয়ের সাথে কেন আমি সাক্ষাত করব?”
– “মেয়ের মতো কেউ একজন আপনাকে অনুরোধ করছে, রাখবেন না?”
লামিজা বেগম অনেকটা মুহূর্ত চুপ থাকলেন। অপরিচিত কণ্ঠটাকে কি বিশ্বাস করা যায়? এই নাম্বারটা ঠিক কীভাবে পেল সেটাও তো একটা প্রশ্ন। বললেন, “আমার নাম জানো তুমি?”
– “উঁ… লামিজা আখতার না?”
লামিজা আবার কিছুটা সংশয়ে ঘুরপাক খেলেন। প্রাক্তন স্বামী আখতারুজ্জামান ইশরাক থেকে তার নামটা তখন ছিল লামিজা আখতার। মেহুল কি তবে ইশরাকেরই পরবর্তী সংসারের মেয়ে? কিন্তু তা হয় কী করে? হলে কি মেহুল ‘মামণি’ বলে ইশরাকের দ্বিতীয় স্ত্রীকে চিনত না? দ্বিধান্বিত মনেই জানালেন, “আচ্ছা, কখন যেতে হবে আমাকে?”
– “কালকে সকাল দশটা এগারোটার দিকে।” ওপাশে প্রফুল্লচিত্তে একটা “ইয়েস” শব্দ আস্তে করে শোনা গেল। তারপর উৎকণ্ঠিত গলায় অর্ণার কণ্ঠে ভেসে এলো অবিশ্বাস্যতা, “আন্টি সত্যিই তাহলে আপনি যাচ্ছেন! থাংক ইউ আন্টি, চার কোটিবার থ্যাংক ইউ।”
লামিজা বেগমের কপালের ভাঁজ কিছুটা দূরীভূত হলো, অর্ণার বিদায়ী সালাম শুনে রিসিভারটা রাখতে রাখতে চিন্তা করলেন, চার কোটিবার কখন কেউ কাউকে ধন্যবাদ দেয়?
৯.
ওপাশে ফোনের লাইনটা কেটে গেল। সভয়ে শ্বাস চাপল অর্ণা। সবটা সে ঠিকঠাক বলেছে তো? মেহুলের দেওয়া চিরকুটে বোকামো ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব সে দিয়েছে কী? যদি লামিজা খন্দকারের কোনো মেয়েই না থাকে তবে মেহুল কে? এতবছর আগের ল্যান্ডলাইন নাম্বারটাও মহিলা খোলা রেখেছেন, অর্ণার এমন একটা ডিভোর্স হলে সে কী করত? বস্তায় ভরে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে চেঁচামেচি করত হয়তো বা, “যা, তোরা সব জাহান্নামের হাওয়া খেয়ে আয়। ভুলেও আমার ছায়া তো দূর, ত্রি-সীমানাও মাড়াবি না।” তারপর শুরু হতো একের পর এক যুদ্ধ, মন আর মস্তিস্কের বিবাদ। এই কৃষ্ণকুমারীর আর বিয়ে হবে না কি বিচ্ছেদের গ্লানি বয়ে জীবনের বোঝা টানতে হবে?
অর্ণার আকাশ কুসুম কল্পনায় ছেদ পড়ল কলিংবেলের আওয়াজে। দরজার কাছে যেতে যেতে মন ঝেড়ে ভাবনাগুলো খালাস করতে করতে ভাবল, ধুর! কী যা তা ভাবিস না তুই অর্ণা!
দরজার পাল্লা মেলে চৌকাঠে দাঁড়ানো অপরিচিত মুখটা দেখে সালাম দিয়ে প্রশ্ন করল, “আপনাকে ঠিক চিনলাম না, কার কাছে এসেছেন?”
– “হৃদয়বান মানুষীর কাছে।” মেয়েটা সরলভাবে শীতল মুখে বলল।
– “অ্যাঁ?” ভ্রুকুটি করল অর্ণা।
– “এই বাসায় অর্ণা যে আছেন, উনাকে ডাকুন। কথা আছে।”
– “সামনে যাকে দেখছেন সেই আপনার আকাঙ্ক্ষিত মানুষী।”
উত্তরটা জানাবার পর আচানক অপ্রস্তুত অবস্থায় মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ে অর্ণাকে জাপটে ধরল। উল্লাসে ফাটা কণ্ঠে বলল, “ও-ও-ও-ও অর্ণা-আ-আ-আপু-উ-উ-উ-উ-উ।”
অর্ণা বুঝতে পারল না এরকম মানসিক অবস্থায় মেয়েটাকে ঠিক কী বলা যায়। কোনোক্রমে নিজেকে ওর বাহুবন্ধন হতে মুক্ত করে বলল, “আপনি প্লিজ শান্ত হন আর পরিচয়টা দিন।”
– “আমি অঘটনঘটনঘটীয়ান মেহুলের বান্ধবি ওর খোঁজে এসেছি।”
– “কোন টনটনগঠন হুল?” উত্তেজনায় চাপা পড়েছিল সঠিক উচ্চারণ। তাই মেয়েটার কথা অর্ণা সম্পূর্ণ কর্ণপাত করেনি।
– “অঘটনটনীয়ান, সুন্দর করে বাংলা বলবেন। মেহুলের উপাধি এটা।”
– “ও আচ্ছা, মুটকি মেহুল। ওর উপাধি অঘটনটনীয়ান না, অঘটনঘটনঘটীয়ান। আর তোমার নামটা কিন্তু বললে না এখনো।”
– “আয়েযা।”
– “ও, সেই বদ্ধ উন্মাদিনী! মেহুলের কাছে অনেকবার শুনেছি, আসো ভিতরে। জুতা খুলে সু-র্যাকে রাখো।” মুচকি হাসল অর্ণা। সরে ভেতরে প্রবেশের জায়গা করে দিল আয়েযাকে।
– “আমি জানি, বলতে হবে না। বাসস্থান হচ্ছে অতি উত্তম তীর্থস্থল। আচ্ছা, এবার বলেন তো ঐ বদমাশিনী আমার নামে আর কী কী প্রলাপ গেয়ে গেছে?” জুতা রেখে ভেতরে ঢুকে ড্রইংরুমে এসে বসল আয়েযা।
– “হি হি হি, আর কিছু বলেনি। তো বাসা চিনলে কীভাবে?”
– “মেহুল আমাকে ঠিকানা দিয়েছিল। ও বলতো, মোড়ের গাঢ় ধূসর বর্ণের বিল্ডিংটার পাশের বিল্ডিং ওদের বাসা। যদি নিচ তলা থেকে উত্তমমধ্যমের শব্দ আসে তাহলে শিওর হওয়া যাবে। লিফটের আটে এসে সবগুলো দরজার বেল চেপে দেখতে হবে কোন বাসায় দরজা খোলার পরিবর্তে চেঁচামেচি শোনা যায়, সেটাই ওদের বাসা। আর যে দরজায় হাতের কাজ করা কোনোকিছু ঝুলিয়ে রাখা হবে সেটা আপনাদের বাসা।”
– “হুহ্, খুব কঠিন ছিল ঠিকানাটা।” ছোট করে শ্বাস ফেলল অর্ণা।
– “তো? মেহুলের খবর ওর বাসাওয়ালারা জানে না, বলেছে হোস্টেলেই আছে। আপনি জানেন কিছু?”
– “কী বলছ? ও তো আমার কাছে গতকালকেই বিকালের পর এসে অনেকক্ষণ আইন বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিয়ে গেছে। বাসায় যায়নি তাহলে?” ভ্রু বাঁকিয়ে হঠাৎ অর্ণা বলল, “আচ্ছা, ওর চেহারায় তো ভালো কিছুর আভাস ছিল না তখন। কী হয়েছে তোমার জানার কথা না?”
আয়েযা থেমে যায়। হঠাৎই উৎফুল্লতার বদলে চোখে ভর করে আতঙ্ক। বলল, “কিছু বলেছে আপনাকে?”
– “একটা কাগজ ধরিয়ে হাবিজাবি লিখে বলেছে ওর মামণির সাথে শেষবার দেখা করবে কোনো রেস্টুরেন্টে। ওখানে নাম নাম্বার সহ আরও কিছু লিখে দিয়েছে।”
– “কল করেছেন?”
– “হ্যাঁ, কিন্তু উনি জানালেন মেহুল নামে কাউকে চিনেন না। এখন পর্যন্ত কোনো মেয়েকেই জন্ম দেননি না কি।”
ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে টেনে ছেড়ে দিল অর্ণা। বারকয়েক এমনিটা করার ফুলে লাল হয়ে উঠেছে ওষ্ঠাধর। চিন্তিত মুখে বলল, “একদিন ও আর আমি হোস্টেলের বাইরে গিয়েছিলাম। শরৎচন্দ্রের প্রাতঃভ্রমণ বলা যায় সেটাকে। আমার তাড়া ছিল তাই দ্রুতই ফিরে এলাম। ও কিছু কেনাকাটা করে ফেরার পথে ওকে অনেকগুলো ছেলে মিলে টিজ করে। মেহুল যে করেই হোক ফিরে এসে আমাকে জানায় কথাটা। ওইদিন রাতে দেখি ছেলেগুলো মেহুলকে যেভাবে বিরক্ত করেছে, গায়ের স্কার্ফ টেনে খুলে মৌজমাস্তি করার কুৎসিত কথাবার্তা শুনিয়েছে সেগুলো তারা দূর থেকে ভিডিও করে টিকটক, লাইকির শর্ট ভিডিও আকারে ছেড়েছে। কয়েকটা ওদের ফেসবুক গ্রুপেও দিয়েছে। ব্যাপারটা মেহুল জানত না। চারপাশে কানাপড়া হচ্ছিল চরমে। তাও ব্যাপারটা আমিই ওকে জানতে দিইনি। ভাবলাম, কয়েকদিন বাঙালির আপামর অভ্যাস এক আলোচনায় পড়ে থেকে মুখে খই ফোটানো। তারপর সব ভুলে যাবে মানুষ। কিন্তু একদিন আমরা রেস্টুরেন্টে যাওয়ায় ওখানে ওই ভিডিওর কিছু বাজে দর্শক এসে মেহুলকে বিরক্ত করে আর ভিডিও সম্পর্কিত কিছু কথা বলে। ফিরতে ফিরতে ওর জিজ্ঞাসায় ওকে সব বলেছিলাম। ও রেগে বলেছিল, এরকম মেয়াদোত্তীর্ণ ঘি সোজা আঙুলে না উঠলে চামচ দিয়ে খোঁচাতে হয়। তারপর আমাদের আরও কথাবার্তা হলো। আমি আমার মতো কোচিং করতে চলে আর ফিরে এসে জানতে পারি মেহুল হোস্টেলে আসেনি। কী জানি, কী করতে গিয়েছে।” একটানা কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আয়েযা। মুখাবয়বে স্পষ্ট কষ্টের অনুরণন।
– “আল্লাহ না করুন, আমার মনে হচ্ছে ও আত্মহত্যা করতে গেছে। নয়ত শেষবার বলল কেন?”
– “ও বেআইনী কিছু করবে না।” আয়েযার কণ্ঠে দৃঢ়তা।
– “বাংলাদেশে আত্মহত্যা বেআইনী হতে পারে, কিন্তু মেহুল তো আইনের বিশ্ব ভাণ্ডার; ওর নিশ্চয়ই জানা আছে সুইজারল্যান্ডে আত্মহত্যা বৈধ কাজ। সেটা ভেবে যদি করে?”
অর্ণার কথায় আয়েযার লোম দাঁড়িয়ে যায়। দু’জন দু’জনের দিকে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক চেয়ে থাকে।
১০.
সকাল থেকে টানা গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে। আকাশ জুড়ে থমথমে মেঘালয়। এরকম পরিবেশেও শহরের একটা অংশ দারুণ উত্তপ্ত। একটা নয় তলা উঁচু ভবনের চারপাশ মানুষে ঘিরে রেখেছে। কারো কারো উঁচু করে ধরে রাখা ক্যামেরা, কারো কপালে হাত রেখে বৃষ্টির আড়াল বানিয়ে নয়তলার বারান্দায় দাঁড়ানো মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা, কেউ কেউ ছাতা মাথায় আশপাশ দেখছে কোনো মিডিয়াকর্মীদের চেহারা দৃশ্যমান আছে কি না দেখতে, কেউ কানাঘুঁষায় নিরত। ভিড়ের একপাশ থেকে লামিজা খন্দকার হতাশ হয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ আগেই প্রবেশপথ হতে ফিরে এসেছেন। কাউকেই ভেতরে ঢুকতে অনুমতি দিচ্ছে না গার্ডরা। নিকটবর্তী পুলিশ ফাঁড়িতেও খবরটা এক ফাঁকে চলে গিয়েছে। ভিড়ের মাঝে লামিজা বেগমের দৃষ্টিগোচর হলো ব্যাতিক্রমী কাজে রত এক কম বয়সী মেয়েকে। ডান কাঁধকে ভরসা করে পিঠে ব্যাগ ঝুলছে, হাতে স্প্রে পেইন্ট, অন্য হাত নেড়ে মেয়েটা ভবনের সামনের খোলা জায়গাটা জনমুক্ত করতে বলছে। মাঝে মাঝে পুলিশী কায়দায় মুখে থাকা হুইসেলটা বেজে উঠছে। লামিজা ওর কাছে ঘেঁষে অতি সাধারণ ভাষায় জিজ্ঞাসা করলেন, “এখানে কী হচ্ছে জানো কিছু?”
– “আমি মাত্রই ব্যাপারটা জানতে এসেছি।” স্প্রে পেইন্টের বোতলটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে রাস্তায় নিচু হয়ে বসে উত্তর দিলো মেয়েটা। একবারের জন্যও প্রশ্নকর্তার দিকে ফিরবার সময় নেই ওর।
– “তারমানে কিছুই জানতে পারোনি?”
মেয়েটা কী যেন একটা লিখতে যাচ্ছিল রাস্তায়, ফিরে তাকিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে দার্শনিক ভঙ্গিমায় বলল, “একটা মেয়ে যে কি না হেনস্তার শিকার হচ্ছে দিনকে দিন। রাস্তায় কিছু ছেলেরা যাকে নিয়ে তামাশা করে তার সাথে বিশ্রী কিছু আচরণ করে ভিডিও ক্লিপগুলো টিকটক লাইকিতে ছেড়ে দিয়ে ভাইরাল প্লে-বয় হচ্ছে, বেশ কিছুদিন ধরে যাকে আশেপাশের সবার অপবাদ সহ্য করে বেঁচে থাকার মৃত শখ নিয়ে ভেতরে ভেতরে ধসে যেতে হচ্ছে, পারিবারিক সামাজিক সবভাবেই মেয়েটা নিজেকে দোষী হিসেবে দেখতে পাচ্ছে… আচ্ছা সে মেয়ের পক্ষে কি আদৌ বিবেকের সাথে আত্মবিশ্বাস নিয়ে লড়াই করে বেঁচে থাকা সম্ভব?” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তরটা নিজেই মিলিয়ে বলল, “সম্ভব। কারণ সে সারা জীবন সুনাগরিক হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু পাশে তো কাউকে থাকতে হবে তাই না? এত মানুষ আছে আশেপাশে অথচ এরা অযথা জটলা ছাড়া আর কিছুই বাঁধাতে পারছে না।”
লামিজা এই উত্তরের সারমর্ম কিছুই বুঝতে পারছেন না, শুধু বুঝেছেন, এখানে কোনো মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টায় আছে বিভিন্ন সামাজিক মানসিক চাপে পড়ে। পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, “মেয়েটার বাবা মা নেই?”
– “মেয়েটার আসল বাবা মায়ের পরিচয় সে নিজেই জানে না। যার তত্ত্বাবধানে বড় হয়ে বাবা সম্বোধন করতো তিনি যে গত হয়েছেন সেই শোক-মাতমের দিনও অতীত। উত্তরাধিকার হিসেবে সে বাবার কাছ থেকে একটা জিনিসই পেয়েছে, বিশ্বাস করা যায় কি যায় না এমন একটা ডায়েরি। সেখানে তার বাবার একমাত্র প্রাক্তন স্ত্রীর বর্ণনাই তার সম্বল। ওর প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানা গেছে শেষবার ‘মা’ হিসেবে ঐ মহিলার চেহারাটা সে দেখতে চায়।”
– “ও।” মুখ থেকে অস্ফুট আওয়াজ বের হলো লামিজার। যেন ঘোলাটে পথে এবার কিছুটা স্বচ্ছ জলের মুখ দেখলেন। বেকার দর্শক জনতার দৃষ্টি অনুসরণ করে ভালোভাবে উপরে দেখতে চেষ্টা করলেন। মাথায় উড়ে এসে জুড়ে বসছে চিন্তার ঢল।
আচ্ছা, এই কি তাহলে মেহুল? ইশরাক তবে আর বিয়ে করেনি? বিয়ে করলেও অবশ্য ইশরাকের নিজের ঔরসে তো কোনো সন্তান আসার কথা না। তাহলে এই মেয়েটা কার? দত্তক নেওয়া বাচ্চা না তো? যদি তাই হয় তবে মেয়েটা লামিজাকে ‘মামণি’ ভাবাটা তো ঠিকই আছে। ইশরাকের কথা ভাবতেই পুরনো অনুভূতি হু হু করে নাড়া দিয়ে গেল তার মনে। লোকটা তবে মারা গিয়েছে এতদিনে? আহ্।
পরক্ষণেই সব চিন্তার গোড়া উপড়ে ফেলে বর্তমানের কথা ভাবলেন, আসল বাবা মায়ের মতোই উনাদের মেয়েটা একটু পরেই ইহজগৎ থেকে হারিয়ে যাবে। লামিজার কিছু করার নেই এমনিতেই। করলেও বা কোন দিনের সূর্য তিনি রাতে উঠাতে পারতেন? তার তো নিজের বলে সংসার আছে। এই মেয়েটা না তার অতীতের অংশ আর না বর্তমানের। শুধুই একটা পরিচয় অথবা ক্ষণচারী আবেগেই বাস্তবে একটা ঠিকানার ভিত দাঁড়াতে পারে?
(চলবে, ইনশাআল্লাহ)