অঘমর্ষণ (তৃতীয় পর্ব)

0
219

#গল্প: অঘমর্ষণ (তৃতীয় পর্ব)
লেখা: মারইয়াম জামীলা

৬.

ওয়ার্ডেনের সামনে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে আছে আয়েযা। মুখে সামান্য রা নেই। দু’একবার আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে সে বরাবরই।

মহিলা ওয়ার্ডেন ধমকে উঠলেন, “দুই বেলা করে ক্যান্টিনে খাবার খাওয়ার অভ্যাসটা এত করে বলার পরেও ছাড়তে পারোনি, ফলাফল তো চোখের সামনেই দেখেছ না-কি? সকালের দিকে ভিসি এসেছিলেন, হোস্টেলের মেয়েরা আজকাল টিকটক লাইকি অ্যাপে কী সব করে বেড়াচ্ছে সে খবর উনার কানেও পৌঁছে গিয়েছে। একাডেমিক কাউন্সিল সেদিনই মিটিঙে ওয়ার্নিং দিয়েছেন, এসবে হোস্টেলের সুনাম নষ্ট হয় বিধায় কিছু ছাত্রী ছাঁটাই করা হবে। তাও যদি তোমাদের আক্কেল ঠিকানায় আসে। নিজেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছ সারা হোস্টেল টৈ টৈ করে, পড়াশোনা তো দু’দিন বাদেই লাটে তুলবে। এরকম স্টুডেন্ট দিয়ে আমরা কী করব?”

– “স্যরি ম্যাম। বিশ্বাস করুন, মেহুল এ ধরনের মেয়েই না। রুমমেটরা সবাই জানে যেকোনো আইনের প্রতি সে কতটা…” মিনমিন করে ভীতু কণ্ঠে আয়েযা জবাব দিতেই যাচ্ছিল কিন্তু পূর্বের পুনরাবৃত্তি অনুযায়ী তাকে কৈফিয়তটা অসম্পূর্ণই রেখে দিতে হয়।

– “মেহুলকে হোস্টেলে ফিরে আসতে দেখেছিলে তুমি?”

– “না ম্যাম।”

– “খেতে যাওয়ার সময় কোনো ব্যাগ বা এ জাতীয় কিছু নিয়েছিল জিনিসপত্র নেওয়ার মতো?”

– “না ম্যাম।”

– “ছেলেগুলোকে চেন তুমি?”

– “না ম্যাম, কেবল মুখটা পরিচিত। এলাকায় মাস্তানি করে বেড়ায়। গায়ে পড়ে ঝামেলা করার অভ্যাস আছে। সেদিন আমাদের সামনে এসে অযথাই ওরা…”

– “মেহুলের পেছনে কেন লাগলো?”

– “ডাকাত যদি জিজ্ঞেস করেন কেন কার বাসায় ডাকাতি করতে গেলে ওরা কী যুক্তিপূর্ণ কোনো জবাব দিবে ম্যাম?”

– “মেহুল কি জানে না ও কে নিয়ে কী হয় না হয়? তাও বাইরে গেল কোন সাহসে আবার ক্যান্টিনে যাওয়ার নাম করে? বাসা থেকে বস্তা বস্তা টাকাকড়ি দিচ্ছে না কি?

– “না ম্যাম, আসলে…

– “ম্যাম ম্যাম না করে ঠিক করে কথা বলো আয়েযা।”

– “ওকে ম্যাম।”

– “আবার…?”

– “স্যরি ম্যাম… না আসলে… খালি স্যরি।”

ভদ্রমহিলা কোমরে হাত রেখে বড় করে রাগত শ্বাস ছেড়ে আড়চোখে আয়েযাকে দেখলেন। বললেন, “তোমার সাথে ওকে শেষবার দেখেছে সবাই, সত্যমিথ্যা ঘটনা তো আমরা কেউ দেখি নাই। এটাই প্রমাণ করে যে তুমি ওকে পালাতে সাহায্য করেছ, করে না?”

– “জি… না… না-না ম্যাম, বিশ্বাস করেন ম্যাম। স্যরি, ‘ম্যাম’ না। আপনি চাইলে দেখে আসতে পারেন, ওর সব জিনিস রুমেই পড়ে আছে। তাছাড়া ও পালাবেই বা কেন? আমার মনে হয় কিছুদিন ধরে ওর সাথে যা কিছু হয়েছে সে জন্য একটু আপসেট। রিক্যাক্স হতে একটু গিয়েছে হয়ত, রাতে শোয়ার সময়ের আগেই ফিরবে। আমিই ভুল করেছি, ওকে সবটা আগেই বলা দরকার ছিল।”

– “যা কিছু ওর সাথে হয়েছে, না? যা হয়েছে ওর দোষেই হয়েছে। নিজেই দোষ করে আবার আপসেট হয় একটুখানি! অনেক বড় হয়েছ না তোমরা? বাসায় জানাব ফোন করে?”

আয়েযা কাঁদো কাঁদো গলায় বারবার অনুনয় করে বাসায় কল করা থেকে ওয়ার্ডেনকে থামাল। ভদ্রমহিলা ওকে সময় দিলেন আজকের রাতের আগেই মেহুলের খবর দিতে।

৭.

রুমে ফিরে এসে ধপাস করে বালিশে ঘাড় ফেলে শুয়ে পড়ল আয়েযা। মুখে দীর্ঘশ্বাস ছুটছে কিছুক্ষণ বিরতিতে। ভাবনায় গহীনে জড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে দুই এক ফোঁটা করে পানি গড়িয়ে গেল ডান-বামে। এই হোস্টেলে তাকে যখন প্রথম তার মা রেখে যায় তখন তার বয়স অনেক কম। বাবার এক্সিডেন্টে মৃত্যুর পর মা দ্বিতীয় বিয়ের পিড়িতে বসেন। তবে তার সাথে যার বন্ধনে জড়াবার কথা ছিল সে আয়েযাকে রাখতে নারাজ ছিলেন। বছরে দু’চারবার ছুটিতে মায়ের কাছে যাওয়া ছাড়া এটাই তার নিত্য আবাস। কিছু বছর আগে মেহুল যখন প্রথম এই রুমে থাকতে এসেছিল সেসময়কার কিছু স্মৃতি তার খুব করে মনে আছে।

…মেহুল নিজের নিচু পায়ার উপর দাঁড়ানো বিছানাটা দু’ভাঁজ করা ওড়না দিয়ে ঝেড়ে নিচ্ছে। অন্য দু’জন রুমমেট গিয়েছে গোসলে। আয়েযা সে সময় ক্যান্টিন থেকে খেয়েদেয়ে মাত্র এসেছে। কিছুক্ষণ পরেই ঘুমের সময়, উঠে আবার কোচিঙের তাড়া। ক্লান্ত শরীরে যেই না রুমে পা রেখেছে মেহুল গলা উঁচিয়ে বলল, “খবরদার। পবিত্র জায়গায় প্রবেশের সময় জুতা খুলে প্রবেশের আইন আছে। জানো না?”

– “হ্যাঁ আছে তো? এটা গীর্জা, মন্দির না প্যাগোডা হুম?”

– “এটা বাসগৃহ। অতি উত্তম তীর্থস্থল।”

– “তুমি কে হে বাপু আমাদের রুমে এসে আমাকেই কায়দা কানুন পড়াচ্ছো? এসব বলার কে তুমি?”

– “মারজানা মেহুল আখতার, এখন থেকে এই উত্তম তীর্থস্থলের একজন বাসিন্দা। যাও, জুতা বাইরে খুলে ভেতরে ঢুকো।”

আয়েযা কথা শুনলো না, হনহন করে প্রবেশ করে সরাসরি স্টিলের ছোট আলমারি হাতিয়ে জামাকাপড় বের করে গোসলখানার দিকে রওনা হলো।

– “সম্ভাব্য মিস আয়েযা!” পেছনে ডাকল মেহুল।

– “সম্ভাব্য কার নাম? আমি শুধু আয়েযা।” দাঁড়িয়ে পড়ে আয়েযা।

– “নিশ্চিত ছিলাম না যে তুমিই সে কি-না, বাকি দু’জনের সাথে আলাপকালে তোমার কথাও হয়েছিল। বড্ড নিয়মতান্ত্রিক আর ভালো ছাত্রী না কি তুমি, সমগ্র সামাজিক কায়দা বেশ করে তোমার জানা আছে; ওরা তো এমনই বলল তবে খোলসের ভেতরটায় আমি তো দেখছি ভিন্ন।”

– “শোনো মারজানা ম্যাডাম, মার্জিনের ভেতরে থাকো, ওকে?”

– “ভেতরেই আছি। মেহুল কোনোদিন মার্জিন ক্রস করে না।”

– “মেহুল না মে মাসের মৌমাছির হুল! যা ভনভন করতে পারে, উফ আল্লাহ! এই মেয়ের সাথে দিনানিপাত করার মতো ধৈর্য দিন আর না হয় মাটি ফাঁক করে দিন, এই মেহুল সেই ফাঁকায় পড়ে নিখোঁজ হয়ে যাক।”

– “ইয়া আল্লাহ, ইয়া মাবুদ, মাটির ফাঁকটা একটু বড় করে করার অনুরোধ জানাচ্ছি। আমিও এর সাথে থেকে থেকে তিক্ততা বাড়াতে চাই না।”

– “জায়নামাজ আছে, এলার্ম ঘড়ি আছে, তাহাজ্জুদের সময়ে নেয়ার জন্য ধার দিচ্ছি মুটকি মেহুল। যাও, ভালোমতো দোয়া-খায়ের শেষ করো।”

– “তুমি কিন্তু মুটকি ডেকে আমাকে অপমান করলে? তুমি জানো কাউকে অবমাননা করার শাস্তি কী?”

– “জানি না। তবে বাকস্বাধীনতার বিষয়ে জানি, আমাদের সংবিধানের তৃতীয় বিভাগে মোলিক অধিকারের ৩৯তম অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘…প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ অতএব ইহা আমার বাক্শক্তির স্বাধীন প্রয়োগ। বুঝেছ?”

– “আমাকে একদম আইন শিখাবা না তুমি। বেসামরিক ও রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিয়ার) মানবাধিকার সনদ এর সংশোধিত ১৯ নং অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী বলা আছে যে, ‘…এইসব অধিকারের চর্চা বিশেষায়িত নিয়ম এবং দায়িত্বকে ধারণ করে; তবে যদি এই চর্চার দ্বারা কারো সম্মান হানি হয় বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তবে কিছু ক্ষেত্রে এর অবাধ চর্চা রহিত করা হয়।’ দন্ডবিধির ৪৯৯ ধারা অনুযায়ী, যে ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা এমন হবে জেনেও উদ্দেশ্য মূলক শব্দাবলি বা চিহ্নাদি বা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে এমন ভাবে কোনো নিন্দা প্রণয়ন বা প্রকাশ করে, তা হলে ওই ব্যক্তির মানহানি করেছে বলে ধরা হবে। তারপর আরও আছে…”

– “ছাইড়া দে মা, কাইন্দা বাঁচি। কী একজন এসেছে, হুহ!” হাত জোড় করে ব্যঙ্গ করলো আয়েযা।

– “আমি কী একজন না, মেহুল আমার নাম। উপাধিও আছে, অঘটনঘটনঘটীয়ান। চাইলে মুটকির জায়গায় এটা ব্যবহার করতে পারো?”

– “কী? অঘটনটনীয়ান?” আয়েযা হাসি চাপল।

– “একটা বাংলা শব্দ উচ্চারণ করতে পারো না? অঘটনঘটনঘটীয়ান। এর অর্থ…”

– “যেই মেয়ে কি না অসাধ্য কাজ আঞ্জাম দিতে পারদর্শী! হা হা হা… আমাকে বাংলা শব্দার্থ শিখাতে এসো না প্লিজ। আইন নিয়ে কয়েক লাইন পড়ালেখা করে নিজেকে অঘটনটনীয়ান বলছ?”

– “অঘটনঘটনঘটীয়ান।” পুনরায় শুধরে দিলো মেহুল।

– “ঐ একটা হলেই হলো।”

– “বাংলা শব্দে… আচ্ছা যাক ছেড়ে দিচ্ছি। যদি কিছু না মনে করো তবে একটা আপত্তিকর কথা বলে ফেলি?”

– “এতগুলো আপত্তিকর কথা অলরেডি বলেছ, এখন দু’পাঁচ ক্লাস বাড়তি আপত্তিকর কথা বললে কী হবে আমার? বলো শুনি।”

– “তোমার গলার বামদিক থেকে নিয়ে গালসহ যে ছড়ানো দাগটা আছে ওটা কি এসিড অ্যাটাকৈর জন্য হয়েছে? না মানে দেখ, আমি কিন্তু আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি যে কথাটা শুনে কষ্ট পাবে না তুমি।”

আয়েযা থমকে তাকায়, পোড়া স্থানে হাত রেখে অশ্রু নিয়ন্ত্রণ করে। রসিকতার আবেশ নিমিষেই উধাও ওর চেহারা থেকে। ক্ষতটা সেরেছে অনেকদিন আগেই, তবু না দাগ মুছেছে মন হতে না শরীর হতে। স্বর খাদে নামিয়ে স্থির ভঙ্গিতে বলে, “ভালো হবে যদি এ বিষয়ে আর কথা না বলো।”

– “তাহলে শেষ একটা কথাই বলি, যেদিন এ হোস্টেল থেকে পড়াশোনা শেষ করে বের হবো, ঐদিন ওকে ঠিক বিচারের আওতায় এনে সাত থেকে চোদ্দ বছরে সশ্রম জেল খাটানোর ব্যবস্থা করব।”

– “এটা কোন তীর্থস্থানের আইন?”

– “তীর্থস্থানটা হলো এই দেশ। এটা দুই হাজার দুই সালের এসিড দমন আইন। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত আছে। যেহেতু তোমার চোখ নষ্ট হওয়া বা অঙ্গহানির মতো কিছু হয়নি আর তুমি মারাও যাওনি তাই এর শাস্তি জরিমানায় পঞ্চাশ হাজার টাকা আর জেলে…”

– “আচ্ছা থাক, আমি গোসলখানায় যাচ্ছি, পরে কথা হবে।”
আয়েযা জানে, শাস্তি ভুক্তভোগীরই শেষ পর্যন্ত হয়, সমাজ তার মুখেই থু থু ছিঁটায়। নিক্ষেপকারী আজীবন একটা বাহ্যিক সুন্দর চেহারা নিয়ে বেঁচে থাকে। তাও তার পক্ষ হয়ে কেউ দুটো কথা যেখানে বলেছে সেখানে অল্পতুষ্টিই উত্তম অবলম্বন।

পরবর্তী কোনো একদিন শীতের ভোরে হাত পায়ে লোশন মাখার সময় মেহুল ডেকে বলেছিল আয়েযাকে, “তুমিও লাগাতে পারো আমার কাছ থেকে, ঘ্রাণটা দুপুর পর্যন্ত ছড়াবে। ঠোঁট থেকে শুরু করে হাত পা মুখ সবকিছুর কী হাল বানিয়ে রেখেছ শীতের দিনে!”

– “লাভ কী তক্বের যত্ম-আত্মি করে? সেই একটা পাশ দেখেই তো সবার রুচি উঠে যায়। সামাজিক মর্যাদার চিন্তা করে আমার বাসায় পর্যন্ত একটা লোক আমাকে মেয়ে বলে মানতে চাচ্ছে না সেজন্যে।” মুখ ভার করে জবাব দেয় আয়েযা।

– “তুই কি লিজ্জি ভেলাসকুয়েজ না কি রে?” মেহুলের মুখে ‘তুই’ সম্বোধনের আচানক কারণটা ঠিক বুঝে উঠল না আয়েযা। বলল, “উনি আবার কে? প্লাস্টিক সার্জারি করা এসিড পোড়া রোগী?”

– “না, যা আছে তাই নিয়ে সুখে থাকা মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত নারী বলা হয় উনাকে। বাহ্যিক সৌন্দর্য যে মনের সৌন্দর্যে প্রভাব ফেলে তারই এক দৃষ্টান্ত উনি। আরেকজনও আছেন এরকম। নাম, মেরি অ্যান ওয়েবস্টার। একটা সময় রূপের ঝলক উপচে পড়ত মুখাবরণে। ধীরে ধীরে রোগাক্রান্ত হয়ে চেহারাটা জৌলুশ হারাতে হারাতে ভীষণ রকম কুৎসিত হয়ে উঠে। স্বামী হারান দ্রুতই। সংসারের টানাটানি ঘুচাতে, বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে কুৎসিত চেহারা নিয়েই অংশ নেন নানান প্রতিযোগিতায়। কে কতটা বাজে দেখতে, কোন বাজে চেহারার মানুষটা অঙ্গভঙ্গির দ্বারা বেশি মানুষকে হাসাতে পারেন এ জাতীয় প্রতিযোগিতা করে উনি পুরস্কার জিতে এনে সন্তানদের চাহিদা মেটাতেন। চিন্তা করে দেখ, কী পর্যায়ে বুকে কষ্ট চাপা দিয়ে মুখে হাসি ফোটালে এমনটা করা সম্ভব? লিজ্জি বা মেরির মতো তো তোকে হতে হয়নি না? তাও তোর এতখানি দুঃখ! এবার এসে একটু লোশন নে’। তুই ওজনে আমার অর্ধেক, বেশি একটা খরচ হবে না আমার কাছ থেকে আশাকরি।”

আয়েযা মৃদু হাসে। সময়ের ধারাবাহিকতায় বন্ধুত্বটা পাকাপাকি হয়ে ওঠে একসময়। রুমমেটরা ডাকে, মটু পাতলুর লেডিস ভার্সন।
আয়েযাই যে নিজের সুখ দুঃখের কাহিনি শোনাবার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে মেহুলকে বেছেছিল তা নয়, মাঝে মাঝে নানান বিরস আবদার বয়ে এনে মেহুলের গল্পগুলোও শুনতে চাইত।
মেহুলের বয়স যখন ষোলোটা বসন্ত পেরিয়ে ক্রমিক সতেরো বসন্ত উপভোগ করছে সে সময়ে তার মাথার উপর থেকে বাবা নামক গাছের ছায়াটা বিলীন হয়ে যায়। বাবার স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে ওর হাতে ভাগ্যের পরিহাসে এসে যায় বাবার ডায়েরি। সেই নব্বইয়ের দশক হতে সেখানে কলমের কালি পড়েছে। সারা ডায়েরি জুড়েই নানান প্রণয় আখ্যান, কিন্তু গল্পের নায়িকা একজনই। অর্ধেকে এসে নায়িকার উপস্থিতি প্রায় চোখেই পড়ে না দিনলিপির পাতায়। কিছু বিয়োগের মর্মাহত ছাপ ছাপ কষ্টের মতো ছন্দই চোখে পড়ে কেবল। অবশ্য বাবা হারানোর পর থেকে আত্মীয়দের মুখ থেকে মেহুল একাধিকবার শুনেছে, সে কোনো এতিমখানার দত্তক নেওয়া না হয় রাস্তার কুড়ানো মেয়ে। মেহুল অবশ্য এসব কথায় আজও দ্বিধান্বিত। এসব গল্পের শ্রোতা হিসেবে কোনো কাছের মানুষ মুখের কাছে কান পেতে আঁখিজলে সিক্ত গালগুলো মুছে দেয়নি আগে। আয়েযা মেয়েটা সে অভাব পূরণ করেছে। যদিও মেহুলের বিপরীত মেরুতে তার স্বভাব আর কথাবার্তা, তবুও ওর সাথে তর্কের খাতিরে মেহুলের আইনচর্চাটা জমে যায়। এই প্রতিবন্ধী প্রজন্মের মাঝে তো যোগ্য বিতার্কিক পাওয়াও মুশকিল।

রুমে ক্লাস শেষে অন্যদের ফেরত আসতে দেখে দ্রুতই অশ্রু লুকিয়ে ফেলল আয়েযা। অতন্দ্র রজনীতে ভাবতে শুরু করল, পালিয়ে কি মেহুলদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া যায়? বন্ধুত্বের খাতিরে সামান্য হোস্টেল পালানোর অপরাধ আর তেমন কী? মেহুলকে পাওয়া যাবে কি না ওদের বাসায় তা আয়েযার জানা নেই। তবে মেহুলের বাসায় কোনো খবর না থাকলেও ওদের প্রতিবেশী অর্ণাপুর কাছে থাকবে।
জীবনে পাগলামি তো কম করা হলো না, একবার হোস্টেল পালানোর অভিজ্ঞতা থাকলে মন্দ কী? ছাত্রীজীবনে মেহুলের মতো ডিমভর্তা হয়ে থাকার চেয়ে একটু অনিয়ম মোটেও খারাপ না।

(চলবে… ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here