অঘমর্ষণ (দ্বিতীয় পর্ব)

0
303

গল্প: অঘমর্ষণ (দ্বিতীয় পর্ব)
লেখা: মারইয়াম জামীলা

৪.

– “…আরে রাখ তো আরবের হাত কাটা আইনের কথা। যেকোনো হোস্টেলে চুরির ঘটনাটা ভুরি ভুরি। আজকে তো শুধু সাবান চুরি গেল, এর আগে টুথপেষ্ট, স্যান্ডেল, হেয়ার ব্যান্ড এমনকি শুকনো খাবার থাকলে ওটাও ফাঁকে ফাঁকে গায়েব হয়ে যায়।” নকশিকাঁথায় সুঁই গেঁথে নিয়ে বলল অর্ণা। মেয়েটার গুণের শেষ নেই। দুধ আর গুড়ের বিশ রকম পিঠা বানাতে পারে, বেত দিয়ে বসার চেয়ার বানাতে জানে, জর্জেট শাড়িতে রংতুলির নকশা পারে, উলের সুয়েটার-টুপি বানিয়ে ফেলে, ইত্যাদি এতরকম কাজ জানা সত্ত্বেও তার বিয়ে হচ্ছে না। সৃষ্টিকর্তা তাকে শারিরীক সৌন্দর্য ছাড়া সব সৌন্দর্যই দিয়েছেন। অবশ্য মেয়েটার অত আপত্তিও নেই, বয়স কুড়ি ছাড়িয়ে এগুলো এই তো ক’বছর, বুড়ি তো সবেই হলো সে। এখন কেবল পড়াশোনায় জানপ্রাণ ঢেলে একটা ভালো অবস্থানে যাওয়ার চিন্তা অর্ণার। ছুটিতে বাসায় ফিরলে প্রতিবেশী মেহুল আসে, কখনো কাঁথায় নতুন সেলাই বা নকশা তোলার অনুরোধ নিয়ে, কখনো ঘরে তৈরি বাঙালি খাদ্যের সুগন্ধের টানে। তবে আজকে মেহুলের আগমণ অপ্রত্যাশিত। হুট করে ব্যাগপত্র ছাড়াই দরজায় কড়া নেড়ে হাজির। সরস আবদারশূণ্য মুখ, ব্যগ্র অভিব্যক্তি, অর্ণার মনে হচ্ছে, মেহুল বয়সের আগেই যথেষ্ট বদলে গিয়েছে।
– “ইচ্ছে হচ্ছে এই সাবান চোর মশাইকে অ্যারিজোনা পাঠিয়ে দেই। সাবানের উছিলায় হেদায়েত পেয়ে যাবে। কিন্তু চুরির ‘চ’ও করার সাহস হবে না।” উরুতে কিল মারল মেহুল। ওষ্ঠদ্বয় শক্ত করে চেপে ধরেছে।
– “অ্যারিজোনায় কেন?” কপালে ভাঁজ ফেলল অর্ণা।
– “ওখানের আইনমতে সাবান চুরি করলে সেই সাবান দিয়ে চোরকে গোসল করানো হবে, সাবান শেষ না হওয়া পর্যন্ত।”
– “খুব একটা কঠিন আইন না, তবে অনেকটা মজার। জ্বর ঠাণ্ডায় কাবু হলে সেটাও তো বরপ্রাপ্তি, শীতকাল হলে তো মহাসুখে চোরানান্দ।” সেলাই শেষ করে সুতোয় গিট্টু লাগিয়ে সুঁইটাকে সেদিনের মতো নিস্তার দিয়ে কৌটায় রেখে দিলো অর্ণা। এতক্ষণে মেয়েটা আলোচনায় টক-মিঠে স্বাদ খুঁজে পেয়েছে। বলল, “শুনেছি নিচতলার আংকেল প্রায়ই আন্টিকে বেদম পেটান, বউপিটানো নিয়ে কোনো আইন আছে তোমার জানামতে?”
– “উঁম-ম-ম বউ পিটানো না?” কপালে ভাঁজ পড়ল মেহুলের।
– “হ্যাঁ, অ্যাপার্টমেন্টের নিচতলার আংকেল আর বাজারের পেছনের বস্তির স্বামীগুলো উপযুক্ত বিচার পাওয়াতে কোন দেশে পাঠানো দরকার?”
– “আরকানসাসে পাঠানো যায়। ওখানে মাসে একবার করে বউ পেটানো বৈধ। দুইবার পিটিয়ে ফেললে জরিমানা গুনতে হয়।” ভেবে বলল মেহুল। এখনও ভাবছে, বউ মারনেওয়ালাদের নরক বলে কোন ভূখণ্ড উল্লেখযোগ্য?
– “ধুর, এই দেশে গেলে তো শুধু প্রহার প্রক্রিয়ার মাত্রা কমবে, বন্ধ হবে না। ভালো কোনো দেশ নেই?”
– “ভালো? উম্-ম… বাস্তবে মেয়েদের পক্ষে ভালো কোনো দেশ নেই। আমার জানামতে মেয়েদের জন্য ভালো দেশ হলো বাংলাদেশ। মধ্যবিত্ত হলে কিলাও, ঝাটাও, বকে বকে মহল্লা ছড়াও আর ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখো। উচ্চবিত্ত হলে স্বামী গোলাম আর নিম্নবিত্ত হলে বউ বান্দী।”
– “আচ্ছা? তাহলে আমি যে কেন এত অশান্তিতে আছি বলতে পারো? সারাদিন যে আত্মীয় স্বজনরা বলে বেড়ায় এই মেয়ের কলি যুগে আর বিয়ে লেখা হয় নাই কপালে, সেটা?”
– “সে তো দেশের কয়টা মানুষের দোষে। অন্য সমাজে যেটা ওঝা এই সমাজে সেটাই বোঝা। তুমি না হয় জীবনানন্দের মতো চিল-শালিকের বেশে কলি পরবর্তী যুগে এসে বিয়ের পীড়িতে বসে গেলে।”
অর্ণা হেসে বললো, “আমার মনে হয় না পৃথিবীটা এত খারাপ। খুঁজে-টুজে দেখ না মেয়েদের জন্য ভালো আইন আছে কোন পুরুষশাসিত দেশে।”
– “আচ্ছা ভাবছি, যে দেশে সবার আগে সূর্য ওঠে সেখান থেকেই ভাববো চলো। জাপানে আমার মতো মোটা মানুষ আছে মাত্র তিন পারসেন্ট। কারণ, ওদের আইন বলছে ছেলেরা ৩১ ইঞ্চি আর মেয়েরা ৩৫ ইঞ্চির বেশি কোমরের স্থুলতা বাড়াতে পারবে না। বাড়ালেই দণ্ড। এই দেশে কোনো মেয়েকে কোনো ছেলে প্রপোজ করলেই তা এক্সেপ্ট করা ফরজ হয়ে যায়। মেয়েদের মত না থাকলেও না করা যাবে না। থাইল্যান্ডে ত্রিশ বছরের বেশি অবিবাহিত নারীরা আইনত দেশের সম্পত্তি। আমেরিকার গুয়াম নামের অঙ্গরাজ্যে কুমারিত্ব মানে অভিশাপ। এই শাপ দূর করার জন্য পেশাদার পুরুষ থাকে ওদের। কুমারিত্বের অভিসাপ দূর করে সনদ নিয়ে তাদের বিয়ে করতে হয়। আবার অনেক দেশে কুমারিত্বের গুরুত্ব এত বেশি যে কুমারী না হবার অপরাধে বিয়ে পর্যন্ত ভেঙে যায়। আমেরিকার আরেক প্রদেশ কলাম্বিয়া, সেখানের কালি এলাকায় এই ব্যাপারে আরও এক তলা বোকামি আছে, বাসর রাতে ওখানে বরের শাশুড়ী মানে মেয়ের মানের উপস্থিতি থাকতেই হয়। ‘কেন’ সে প্রশ্নটা আর করতে যেও না। আরেক প্রদেশ উতাহ, অ্যাম্বুলেন্সে কোনো মেয়ে যদি আকাম-কুকাম করে বসে তার ছবিসহ সব কীর্তিনামা পত্রিকায় আসবে। আর পুরুষদের বেলায় যদি জানতে চাও তো আইন ভেঙচি কেটে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিবে, ব্যাস; অপরাধই না সেটা। ফ্লোরিডাতে বিবাহিত মেয়েরাই কেবল রবিবারে স্কাই ডাইভিং করতে পারবে না। বিবাহিতা হবার অপরাধে বলিভিয়াতে এক গ্লাসের বেশি ওয়াইন মেয়েরা খেতে পারে না। আর পাশের দেশ ভারতের নারী অধিকারের কথা না হয় এখন বাদই থাকল।” অনর্গল বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেহুল। কপালে ভাঁজ ফেলে ধৈর্য নিয়ে সামনের মানুষটা জিনিসপত্র গোঁছানোর ফাঁকে ওর কথা শুনছে। শুকনো মুখে বলল, “তুমি অবশ্য ঠিকই বলেছ, পৃথিবীটা অতও খারাপ না, নেভাডার আইনে উল্লেখ আছে, কোনো ব্যক্তিতে বউ পিটানোর অপরাধে আধঘণ্টা বেঁধে রেখে বুকে ‘ওয়াইফ বিটার’ পোস্টার সেঁটে দেওয়া হবে।”
– “বেঁধে পিটানোর শাস্তি হলে আইনটা যথার্থ হতো।” মেহুলের হতাশ চোখের প্রতি তাকিয়ে মাথা নাড়ল অর্ণা। “তো পড়াশোনা ভালোই করেছ দেখছি। যদি জানতে চাই বড় হয়ে কী হতে চাও তবে কী উত্তর দেবে?” সুঁচের ছোট বোতলের ছিপি আটকে সুতোর কাঠের বক্সে ভরে পাশে সরিয়ে রাখল অর্ণা। কোলবালিশ কোলে রেখে তাতে কনুয়ের ভর দিয়ে হাতের তালুতে থুতনি ঠেকিয়ে গল্পশোনার ভানে বসল সে।
– “একজন সুশীল শিক্ষিতা সুনাগরিক হবো।”
– “আমার মনে হয় আইন নিয়ে পড়াটা তোমার জন্য ভালো। এই দেশে একজন যোগ্য নারী উকিল বাড়বে তাহলে।”
– “আইনের রক্ষকরাই এখন সবচে’ বড় ভক্ষক তা কি জানো? যারা আইনের উপর ডিগ্রি নিয়ে আদালতে আইনের যুক্তিতে মামলা লড়ে তারাই আসলে আইন বেচে খায়। যারা খায় না তাদের আইন নিয়ে পড়াশোনা করা আর পদ্মফুলে গোবর জন্মানোর শখ একই, আপাতত আমাদের দেশের জন্য। আমি আইন কিনে বেচে নিজের পেশা বানাতে চাই না, আইনের পোশাক নিয়ে দাঁড়িপাল্লায় খোঁড়া যুক্তি রেখে একপাশ ভারি করতে চাই না। অপরাধীর পক্ষেও কোনো না কোনো আইনের ছাত্র লড়াই করে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করে আসল নির্দোষকে সাজার উপযুক্ত বানাতে। আমি আইনের সেই জঘন্য ছাত্রী হতে চাই না।” বলতে বলতে মেহুলের মুখে আঁধার ছেয়ে আসে।
পরিবেশটা হাল্কা করতে অর্ণা দ্রুত বলল, “বাদ দাও, বলেছিলে আজকে কাঁথায় কলমিলতা তুলতে শিখবে। আমি তাহলে এঁকে রাখা কাগজের নকশাটা নিয়ে আসি?”
– “সে তো আগেরবার এসে বলেছিলাম শিখব। এখন আর ইচ্ছে করছে না, তোমাকে অন্য একটা কথা বলতে এসেছিলাম।”
– “গুরুত্বপূর্ণ কিছু? শুরু থেকেই তোমাকে মনে হচ্ছে খুব ধকলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ? মন-টন অন্য কোনো কারণে খারাপ নয়তো?” মেহুলের দিকে কাছিয়ে আসে অর্ণা। ওর বাহুতে হাত রেখে কথাটা বলল সে।
মেহুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কয়েক মুহূর্ত থমকে তাকায়, নাক শব্দ করে টেনে হাতের পিঠ দিয়ে ঘষে বলল, “মামণিকে বলবে যেন আমার সাথে শেষবার এসে সানসেট রুফটপ লাউঞ্জে দেখা করে।”
– “শেষবার?” আশ্চর্যান্বিত চোখে মেহুলের কাঁধ ঝাঁকায় অর্ণা। “কোনো খারাপ কিছু হয়ে থাকলে আমাকে বলতে পারো, নিজের সর্বোচ্চ বুদ্ধি দিয়ে সমাধান দিতে চেষ্টা করব।”
– “থ্যাংকস আপু, তবে ভয় পাওয়ার মতো কিছু না। পরে বলব, যদি আবার আসি কখনো।”
মেহুল আর প্রশ্নের অবকাশ অর্ণাকে দিতে গেল না, এক টুকরো চিরকুট ওর মুঠোয় গুঁজে দিয়ে খাট থেকে নেমে “আসি” বলেই বিদায় নিল।

৫.

-“গতরাতে আমাদের গ্রুপে শেয়ার হওয়া ভিডিওটা দেখেছিস? ছিঃ, ম্যাডামরা জানলে কী বলবেন? হোস্টেলের মেয়েদের একদম নাক কাটাকাটি করে ছেড়েছে মেহুল মেয়েটা।”
– “ও মেয়েদের নাক না কাটলে কে কাটবে? মেহুল তো নিজেকে টনটনঘটিয়ান বলে পরিচয় দিয়েছিল প্রথমবার ক্লাসে এসে, মনে নাই?”
– “মনে থাকবে না আবার! এখন কোথায় ও? দুপুরের লাঞ্চ টাইমের পর থেকে লাপাত্তা হয়ে আছে। ঐ টনটনঘটিয়ানীকে পেলে…”
– “এক্সকিউজ মি আপুরা, মেহুল নিজেকে অঘটনঘটনপটীয়ান বলে পরিচয় দিয়েছিল। বাংলা ভাষার একটা দীর্ঘ স্ত্রীবাচক শব্দ, অর্থ- অসাধ্য সাধনে পটু নারী। একটা বাংলা শব্দকেও বিকৃত না করে উচ্চারণ করতে অপারগ না কি আপনারা?” হোস্টেলের ছাদে খোশ-গল্প করছিল মেয়েরা। মাঝখান থেকে ডান হাত ঢুকিয়ে প্রবেশ করেছে আয়েযা।
– “এই যে আরেকজন, এক বান্ধবি আইনের ঝুলি মেলে বসে থাকে আর অন্যজন সাহিত্য শেখায়। কী সমস্যা, তোমাকে কিছু বলেছি? নাক গলাতে এসেছে খুব।” বলল মেয়েদের একজন।
– “জি আপু, আমার নাকটা কয়েকদিন নোজপিন না পরার ফলে লম্বা হচ্ছে, তাই গলিয়ে নিচ্ছি। মেহুলকে কিছু বললে আমার সমস্যা হয়, গা জ্বলে।”
– “তাহলে যাও, মাথায় ঠাণ্ডা পানি ঢেলে আসো। ওয়ার্ডেন এদিকে এসে তোমার খোঁজ করেছেন। কৃতি বান্ধবির কারণে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তোমার জিজ্ঞাসাবাদ হবে।” অন্যজন জবাব দিলো।
– “যাচ্ছি, যাওয়ার আগে বলে রাখা ভালো যে মানুষটার সমালোচনা হচ্ছে সে সারাজীবনে নিজের হাঁড় ভেঙে ফেলবে তবু কোনো আইন ভাঙবে না। ওর সাথে যা হয়েছে তাতে ওর কোনো দোষ ছিল না। আমিই ওকে বলেছিলাম ছেলেগুলোর কথা মাথা ঝেড়ে বের করে দিতে, ব্যাপারটা ভুলে থাকতে। এমনকি ও তো আজকের আগে জানতেই পারেনি যে ওকে নিয়ে ইন্টারনেট ইদানীং কী সব কথা উঠছে আর ছড়াচ্ছে। ভিডিওটা এখন পর্যন্ত সে দেখেনি। একটা মেয়ে হয়ে স্বজাতির প্রতি সুধারণা করাটাও শিখবেন এখন থেকে।”
আয়েযা কথাটা বলে সে স্থান ত্যাগ করে ফিরছিল। কাউকে মেহুলের বিষয়ে কথা বলতে দেখলেই তার চুপ করিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। পেছন থেকে টিপ্পনী কাটা কথা শুনতে পেল মেয়েগুলোর, ওরা আয়েযাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, “কোনো কোনো মানুষের মন আর চেহারা এক রকম হয়। দেখলেই বোঝা যায় একপাশ…” আয়েযা কানে আঙুল ভরে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। বাকিটা শোনার মতো মানসিক অবস্থায় সে নেই।

– “নিশীথবনভ্রমণবিলাসিনী ভীষণউজ্জ্বলোচনপ্রাণ দক্ষিণায়নান্তবৃত্তসম্বন্ধীয় উষ্ট্রকণ্টকভোজনন্যায় নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলানুরূপ বিষমোজ্জলাবিভাসিতলোচনপ্রান্ত মন্দারঘর্ষণপীড়িতবাসুকিনিশ্বাসনির্গত মদনমদোন্মদ…” ওয়ার্ডেনের রুমের সামনে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়েযা। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করছিল বেশ শান্তিতেই, হঠাৎ তাতে বাগড়া দিলো এক সমবয়সী কণ্ঠ।
– “অ্যাই আয়েযা, কী ধ্যানে বসে গেলি এখন?”
– “ধুর দিলি তো শব্দটা ভুলিয়ে।” বলতে বলতেই আয়েযা চোখ মেলল, মেয়েটা গতবছরের রুমমেট।
– “এগুলা বাংলা শব্দ না সংস্কৃত মন্ত্র?”
– “বাংলা শব্দ। বিভূতিভূষণ, কাজী নজরুল, শরৎচন্দ্র কিংবা সাহিত্যের বড় বড় নক্ষত্রদের লেখা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া রত্মমণিকা এসব। এখন প্লিজ আমাকে একটু শান্তিতে জপ করতে দে।” বলেই আয়েযা আবারও দেয়ালে হেলান দিলো। বন্ধ লোচনে বিড়বিড় শুরু করল, “মদনমোদন্মদহলাহলকলসীতুল্য ধন্বন্তরিভাণ্ডনিঃসৃত প্রফুল্লনীলোৎপলদলতুল্য…”
– “তোর হাঁটু ধরি বোন, আজকের মতো ধ্যানভঙ্গ করিয়া মোকে ব্যাখ্যাটা বল্, দ্বিতীয়বার আমি ধ্যানে বিঘ্ন ঘটাইতে আসিব না।”
আয়েযা বিরক্ত হয়ে কোমরে হাত চেপে মেয়েটাকে লক্ষ করল। গত এক বছরে সে দারুণ ফর্সা হয়ে গিয়েছে। এক বছর আবাসিক না থাকলে কত পরিবর্তন ঘটে যায় চেহারায় সেটাই ভাবনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে আয়েযার কাছে। যখনই দেখা হয়, জানতে ইচ্ছে করে, কোন প্রসাধনীর কীর্তি এটা? কিন্তু নারীজাতির কাছে রূপ রহস্য জিজ্ঞাসা করা আর আমড়া কাঠের ফার্নিচারে দামড়া কুড়াল মারা একই কথা, এক নিমিষেই অন মুডের দফারফা। আয়েযা বলল, “ম্যাম ডেকেছেন তাই এসে উনার বেরোনোর আশায় মিনিট গুনছি। বড্ড টেনশনে আছি দেখে এখন পর্যন্ত আমার পড়া সমস্ত কঠিন শব্দ স্মরণ করার কাজে মস্তিষ্ককে নিয়োজিত করেছি যাতে বেশি নার্ভাস না হয়ে যাই। আমার পরীক্ষীত একটা টেনশন-চিকিৎসা, বড় বড় শ্বাস ফেলে বাংলা ভাষার দীর্ঘতম শব্দগুলো চোখ বন্ধ করে এক ধ্যানে ভেবে চললে দুনিয়ার বাকি ঝামেলার কথা ভুলে যাই।”
– “অর্থ জানিস?”
– “নিশীথবনভ্রমণবিলাসিনী অর্থ, রাতে যে নারীর অরণ্যে ভ্রমণ করতে ভাল্লাগে; ভীষণউজ্জ্বলোচনপ্রাণ অর্থ, যার প্রচণ্ড চকচকানো চোখ আছে; দক্ষিণায়নান্তবৃত্তসম্বন্ধীয় অর্থ…”
– “থাক ভাই, আমার আর জেনে লাভ নেই। তোর সাহিত্য দর্শন শব্দার্থ নিজের ঝোলাতেই রাখ। আচ্ছা ম্যাম কেন ডেকেছেন?”
– “ঘাস কাটাতে।”
– “হ্যাঁ?”
– “আরে ভাই ম্যাম কেন ডেকেছেন তা আমি কী করে বলি! উনি আসুক পরে দেখা যাবে। অর কুছ?
– “বিরক্ত হচ্ছিস, আচ্ছা তাহলে আসি। আর শোন একটা কথা, আজকে সকাল থেকেই কোনো উদ্ভট অযুহাতে ম্যামের ঘিলু প্রচণ্ড চটে আছে। তুই বেশি একটা ঘাঁটাবি না উনাকে না হলে চটপটি বানিয়ে ফেলবে। শুনেছি ক্লাস নাইনের মেয়েদের সাথে বেত নিয়ে এক ধাপ সাপলুডু খেলা শেষ, লাঞ্চ ব্রেকের আগে দেখলাম কানের বারান্দা ছুটিয়ে থাপ্পড় দিয়েছেন একজনকে। আজকে বিকালে…”
মেয়েটা আরেকটু গল্প বলার মতিগতিতে ছিল, নব মোচড়ানোর আওয়াজ পেয়ে দ্রুত পায়ে চম্পট দিলো।
রুমের দরজা খুলে স্বাভাবিক চেহারায় ওয়ার্ডেন মহিলা বেরিয়ে এসে আয়েযার দিকে তাকালেন।

(চলবে… ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here