গল্প: অঘমর্ষণ (প্রারম্ভিকা পর্ব)
লেখা: মারইয়াম জামীলা
.
১.
সানসেট রুফটপ লাউঞ্জের এক কোণায় কাস্টমারের সর্বোচ্চ চাপ সহ্য করে দাঁড়িয়ে আছে নয় তলা উঁচুতে এই বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টটি। জোড়া শালিকের ঝাঁক ছাড়াও কিছু মধ্যবয়সী মানুষজনকেও দেখা যাচ্ছে এখানে। তরল চোষনের চুক চুক শব্দ নেই কোনো গ্লাসে, নেই চর্বনযোগ্য খাবারের সাথে দাঁত ঘষার গপগপ শব্দও; হাল্কা করে কানে বাড়ি খাচ্ছে চামচ সিরামিকের টুংটাং শব্দ আর নিচু স্বরের গুনগুন আলাপ। খোলা ছাদের নিচে মোটামুটি প্রায় সকলেই উচ্চবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যমিত্ত শ্রেণির। কোণার দিকে এক টেবিলে ব্যাতিক্রম কেবল দু’টো মেয়ে এই সুশীল শ্রেণির থেকে, ক্যান্টিনে খাওয়ার নাম করে হোস্টেল ছেড়ে মাঝেসাঝেই তারা বেরিয়ে পড়ে রুচি পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে শহরের নানান স্থানে গড়ে ওঠা টুকরো টুকরো ভোজনালয়ে। ব্যাপারটা দুই বান্ধবির কাছে আজকাল শখ থেকে শৌখিনতা লাভ করছে যেন।
পিৎজার শেষ চিলতেটাও পেটে চালান দিয়ে আয়েযার প্লেটে তাকাল মেহুল। গ্রিলের হাড্ডিগুলো চোষা তো দূর, ওগুলোর গায়ের মাংসগুলোও ঠিকমতো না খেয়েই পাশে রেখে দিচ্ছে সে।
– “তোদের মতো ভোজন অপারগ আল্লাহর বান্দীরা যে কেন নান আর গ্রিলের অর্ডার দেয় আমার বুঝে আসে না। হাড্ডি চাবাতে না জানলে আর কাটা খেতে না পারলে কেউ মাছ মুরগী খায়?” আনারসের জুসে পাইপ রেখে বলল মেহুল।
– “সিরিয়াসলি?” হেসে ছুরি আর কাটা চামচ টুং শব্দ তুলে প্লেটে রাখল আয়েযা। মেয়েটা শীর্ণকায়, খাওয়া-দাওয়া খুব একটা হজম করে কুলাতে পারে না। কিন্তু যেটুকুই পেটে চালান করবে, ভক্ষণ রীতিনীতি মেনে শাহজাদি কায়দায় করবে। গলায় রুমাল রেখে, হাতে উপযোগী সহায়ক (বিভিন্ন জাতের চামচ বা ছুরি) নিয়ে একদম মুখের মাপমতো আকারে টুকরো কেটে নিবে। এরপর সযত্নে রুটি বা সালাদে মুড়িয়ে ঠোঁটের ঈষৎ ফাঁক গলে ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁতের খুব কম নড়াচড়ায় চাবিয়ে গিলে নিবে নির্দিষ্ট সময় পরে। খাওয়ার বা চাবানোর শব্দটা পর্যন্ত স্থান-পাত্রভেদে নিয়ন্ত্রণে রাখে সে।
– “তোর কাছে কী মনে হয়? আমি সবসময় কৌতুকের ঝুলি মেলে বসে থাকি?”
– “যত সিরিয়াল, সিনেমা আর নাটক দেখেছি এই জীবনে সেখানে ঠিক তোর মতো ফোলা বস্তা জাতীয় কিছু পাবলিক থাকে যারা ভুড়িতে বা মাথায় দুটোতেই মোটা। কথাবার্তায়ও সহজেই জোকার বনে যায় আর খাওয়াতে তো মাশাল্লা বীর-বীরঙ্গনা। আমারই বা কী দোষ বল্, কাজে কর্মের এত সাদৃশ্য দেখে ভুল করে তোর মতো মহান আইন বিশেষজ্ঞকে মিলিয়ে ফেলেছি ওদের সাথে।”
– “স্বাস্থ্যবান মানুষকে নিয়ে হাসাহাসি বন্ধ কর্, ওরা অন্তত তোর মতো রোগাটে ঝাড়ুর মতো চেহারা নিয়ে বাঁচে না। আমি স্রেফ বলেছি অপচয় করা শয়তানের স্বভাব, অপচয়কারীনী শয়তানের বোন। অতএব চেটেপুটে সবটা খালাস কর্।” মেহুল পাইপে টান দিলো, এক টানেই আনারস চিপানো রস গ্লাসের তলানিতে এনে শ্বাস ফেলল।
– “স্লিম হওয়াটা কিন্তু অপরাধ না, সুন্দরী হওয়ার আলামত। কিন্তু মুটকী-ভুটকী হওয়াটা কীসের আলামত জানিস?” মেহুলকে চোখ বড় করতে দেখে নিজেই উত্তর মিলিয়ে দিলো আয়েযা, “জলহস্তীর আলামত। আমি ঢাকা চিড়য়াখানায় একটা নয়মাসের জলহস্তী দেখেছিলাম একবার, ঘ্যাস ঘ্যাস করে চিবুনি মেরে কচুরিপানা বস্তায় বস্তায় গিলে চলেছে।”
– “এই গোষ্ঠীর গুলবাজি মানুষ কখন করে জানিস? যখন সামনে বসে থাকা মানুষটা মুরগী মার্কা কোয়ালিটির হয়। আজকাল মুরগী আর মানুষে গুলিয়ে ফেলছিস বড্ড।”
মেহুলের কথায় ফিক করে হাসল আয়েযা। কাটা চামচ তুলে কেটে রাখা টুকরোটার প্রতি লক্ষ করে বসাতে গেল, কিন্তু আঘাতটা পড়ল টেবিল ক্লথে। মেহুলের দিকে তাকায় সে, আচানকই মেয়েটা প্লেট টেনে নিজের দিকে নিয়েছে।
– “কী সমস্যা?”
– “সমস্যা এতক্ষণ চলছিল, এখন শেষ করব।” বলেই হাত বাড়িয়ে হাড্ডিগুলো তুলে একাধারে চাবিয়ে চুষে পাশে রাখতে লাগল মেহুল। রুটিগুলোও ছিঁড়ে ছিঁড়ে গপাগপ মুখে পুরল। তাড়াহুড়ায় আমগম শব্দ হচ্ছে। আয়েযার কেটে রাখা টুকরো আর এক ফালি রুটির অংশ বাদে সবটা শেষ করে নিয়ে বলল, “দেখ্ তো, এবার আহার্য বলে কোনো বস্তু তোর চোখে লাগে না কি?”
– “না নেই, তো? তোর হাতে খাবার থালা গেলে সেখানে আহার্য বলে কোনো বস্তু অবশিষ্ট থাকবে এ কথা আমার দূর দুশ্চিন্তাতেও নেই আর ছিলও না।” এতক্ষণ সব কিছু দেখেও আয়েযা চুপই ছিল। জানা আছে মেহুলের স্বভাব, খাবার টেবিলে কারো কিছু খেতে কষ্ট হলে বা খুব দেরি করলে সে দাঁত-জিহ্বা-পেট সব নিয়ে হামলে পড়ে সেখানে।
– “এভাবেই খেতে হয় বুঝলি? তোর যা খাওয়ার ধরন ওটাকে অপচয় বলে। তোর উচ্ছিষ্ট ময়লার বাটি থেকে প্রত্যেক দিন কত মানুষ খুঁজে খুঁজে খায় জানিস? যে খাবার ডাস্টবিনে গড়াগড়ি খায় সেটাও কারো কারো ক্ষুধায় একটু তৃপ্তি আনে।”
– “আর তুই উচ্ছিষ্ট বলে কোনো আহার্য রাখিস না সেটা তো নির্মমতা, বেচারারা কত আশায় থাকে দুমুঠো খাবার অপচয় করবার। এখানে ভালো কী হচ্ছে? বেচারাদের জন্য সামান্য রিজিকও ছাড় দিল না তোর উদর!” হাসল আয়েযা।
– “তোদের মতো মানুষদের আসলে জার্মানে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার বুঝলি? সরাসরি জার্মান। যেই দেশে কিছুকাল আগেও দুর্ভিক্ষে মানুষ একে অন্যের বমি খেয়েছে, ড্রেনের পাশে খাবার থালা পেতে ঘুরেছে, খিদের কষ্টে পথের ধার থেকে ঘাসপাতা তুলে এনে, খাল থেকে কচুরিপানা উঠিয়ে শুধু পানি দিয়ে সেদ্ধ করে গিলেছে, সেই দেশে তোরা এমন পেট নিয়ে টিকে থাকবি কোন বিবেক সাথে করে?”
– “কেন? জার্মানেও দুর্ভিক্ষ চলছে তাহলে?”
– “দুর্ভিক্ষ না, আইনের দুর্ভাগ্য তোদের জন্য। এটা জার্মানি রেস্টুরেন্ট হলে নিজের টাকায় কেনা খাবারও যদি অপচয় করতি, জরিমানা দিতে হতো। তখন তোর মতো মানুষগুলা একটা সাইজে আসতি।”
আয়েযা হাত নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দেয়, পেট চেপে হেসে বলে, “তাহলে তো তোকেই আমি খাদক অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে নিয়ে যেতাম, এভাবে আমার প্লেটের সবটা সাবাড় করে দিবি। হি হি হা…।”
খাদ্য সংক্রান্ত আইনগুলো খুঁজে খুঁজে বলতে থাকে মেহুল। আইন বিষয়ে তার জ্ঞানের জুড়ি মেলানো মুশকিল, সুবিধা অসুবিধা সবখানে আইন তার যুক্তির পুঁজি। কিন্তু আয়েযার কাছে ভারী রসিকতা ছাড়া কথাগুলো সেরেফ এক টেবিলের বিতর্ক।
২.
– “তারপর?”
– “তারপর আবার কী, আমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করে জানতে পারলাম আমার গর্ভধারণের জন্য কোনো সমস্যাই কখনো ছিল না। অথচ এই দোষে দুষ্ট হয়ে শ্বশুরবাড়ির বাঁকা কথা শুনতে শুনতে শেষ পর্যন্ত খোলা তালাক নিলাম। যাক গে, সেও এক ভালো হলো, জীবনটা তো সুন্দর করে আবার গড়তে পারছি।” একটা দীর্ঘশ্বাস বের করে দিয়ে শুকনো মুখে তামান্নার দিকে তাকালেন লামিজা খন্দকার। মুখে বিরহের নীল ছাপ।
– “ওর জন্য এখন আর খারাপ লাগে না?”
– “প্রথম প্রথম কষ্ট হতো। ছেলেটা আমাকে কোনোদিনও ছাড়তে চায়নি। পরিবারের বিপক্ষে কণ্ঠ তুলে দৃঢ় থেকে বলেছিল, ‘বন্ধ্যা হোক আর যেটাই হোক, ওকে নিয়েই বাঁচব। দরকার হয় একটা পালক রাখব একটা বাচ্চা। সমস্যা কী, খালি জন্ম দিতে পারলেই সবাই মা হয় না আবার জন্মদানের ক্ষমতা না থাকলেও কেউ নারীত্ব হারায় না।’ আমি ভাবতাম, দরকার কী এভাবে সবার কষ্ট নিয়ে পড়ে থাকার? বেচারার সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে আমার জন্য। আমার শাশুড়ী বারবার দ্বিতীয় আরেকটা বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিল। ভাবলাম প্রয়োজন নেই, যে আসবে সে সতীনমুক্ত একটা সংসার পাবে। অথচ এখন যখন বুঝতে পারছি সমস্যাটা আসলে তারই ছিল তখন প্রায়ই এটা মনে হতো যে নিজের ভবিষ্যতই গড়তে আমি ওকে ছেড়েছি। শুরুর দিকে এসব অবশ্য খুব করে কাঁদালেও এখন মানিয়ে গেছি। মুরুব্বিদের কথায় আছে, মেয়েরা কাদামাটির সারাংশ, যে পাত্রেই ভিজিয়ে রাখবে সেরকমই পাবে।”
– “কিন্তু তোমার শাশুড়ির কথাটা ভেবে একটু খুশি হওয়া উচিত। আহ বেচারির নাতি নাতনি দেখার সুখী মুখটা!” তামান্না নিজের রসিকতায় নিজেই এক গাল হেসে ভরাল, লামিজা ঠোঁট জোর করে প্রসারিত করলেও হাসি দিতে পারলেন না। কিন্তু সম্পর্ক ক্ষয়ে যায়, পুরনো হয়, কখনো মুছেও যায় কিন্তু মনে তার অনুভূতিগুলো তাজা ক্ষত হয়ে পীড়া দেয় আজীবন, অতীত স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে থাকে।
– “তবে আমি অবশ্য তার পরবর্তী বিবাহিত জীবনকাল নিয়ে এখনও ভাবি।”
– “সত্যি? তা খোঁজ নিয়েছ দ্বিতীয় বউটা কেমন হয়েছে?”
– “সত্যি বলতে অনেক ইচ্ছা করলেও কোনোদিন জানতে চাইনি। আর যাই হোক, ব্যাপারটা আমার স্বামীকে কষ্ট দিতে পারে। তুষের আগুন ভেতরেই নিবু নিবু হয়ে জ্বলা ভালো, বাইরে আসতে দেওয়াটা ঠিক না।”
– “আরে একটু খোঁজ নিলে কোন অশুদ্ধ মহাভারতে শুদ্ধতা এসে যায় শুনি? আমার এক জায়ের কথা একবার বলেছিলাম না, আমার দেবরের সাথে মহিলার তিন নাম্বার বিয়ে হলো। ভেনেটি ব্যাগে আগের দুজনের ছবি বয়ে নিয়ে ঘুরছে মহিলা। একদিন রাতে ফোনালাপের সময় ধরা খেয়ে কী যে এক কেলেঙ্কারির কাণ্ড! পরে শুনলাম তিন তালাকের কারণে এতকাল যেতে পারেনি, এখন এই বিয়েটা করেছে হিলা করে বৈধতা আনতে, ছিঃ। আমার তো সাথে সাথেই বলে দিয়েছে, তালাক তালাক তালাক। আমার বুয়া আবার ওদের ঘরে কাজ করত, কিচ্ছাকাহিনী বলতে বলতে বেচারি ঘৃণায় চোখ বটে ফেলে বলত…”
– “থাক ভাবি, আপনার বুয়া কী বলত সে গল্প পরে শুনাবেন না হয়। চুলায় ক্ষীর বসিয়েছি। কে জানে দুধ ফুটে তলানিতে পুড়ে গেল কি না এতক্ষণে। কিসমিসের বাটিটা দেন, চলে যাই।”
এক মুঠো কিসমিসের ঠেকায় পড়ে লামিজাকে আসতে হয়েছে চার তলায়। মহিলার বাসায় এলে বা তিনি নিজেই লামিজার বাসায় এলে নিজের চোদ্দগুষ্টি তো বটেই, অন্যেরটাও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনে নেওয়ার শখ। কাজের বুয়া রেখেছেন বাছাই করে সেরা গোয়েন্দা গল্পকার দেখে। নতুন গল্পের আমদানি না হলে ভারতীয় সিরিয়াল নিয়ে আলাপ জমিয়ে ক্ষীর বানান উনি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মমতাদির মতো লামিজারও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, একটু মিথ্যা বললে কী হয়? গায়েপড়া আলাপ থেকে ছুটে আসতেই তো সামান্য মিথ্যা বলা। তাও কি এই ক্ষুদ্র পাপ তার বাপকেও ছেড়ে দেবে না?
৩.
খাওয়া শেষে মেহুল আর আয়েযা উঠতেই যাবে। টিস্যুতে হাত চেপে ঠিক মোছা হলো কি হলো এমন সময় পেছন থেকে ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ল দু’জনে।
– “আরে প্লে গার্ল যে! মজা হচ্ছে খুব তাই না? খাও আরও মজা করে, আয় রোজগার আজকাল তো ভালোই চলে তোমাদের, অফলাইনে অনলাইনে তোমাদের হরেক পদের কত মজায় মজে আছে পাড়ার সিঙ্গেল ছেলেপুলে… হা-হা-হা।”
মেহুল আর আয়েযার ঘাড় ঘুরে যায় কণ্ঠটার প্রতি। সংখ্যায় ছেলেগুলো ছয়জন। বেশভূষায় পাতি মাস্তান ভাব। বড়চুলওয়ালা একজন ওদের প্রতি মন্তব্যটা করেছে। দেখে মনে হলো নেতাগোছের মানুষ। চুলের আগায় হালকা বেগুনি রঙ, কর্ণজোড়ায় চারটে ফোঁড়া, তাতে গুঁজে দেওয়া পাতলা ধাতব রিং, হাতে রাবারের কয়েকটা ব্রেসলেট, গায়ে জড়ানো লেদারের জ্যাকেট আর পরণে ফাটা-ছেঁড়া জিন্স। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নিজের আধুনিক করার কত বৃথা প্রচেষ্টাই না করে, চুল, কান, ভ্রুজোড়া সবকিছুর সাথেই কেমন অমানবিক আচরণ! দলের বাকিদের হালও একই গলুইয়ের কাঠ দিয়ে বাঁধা। ভব্যতা বিরোধী গা ঘিন ঘিন করা বক্তব্যে অযৌক্তিক মুখ ফাটিয়ে হাসছে সবক’টা ছোকরা। দাঁত বের করা খিটখিটে হাসিতে মেহুলের রক্ত চড়ে মাথায়।
পরিস্থিতি বুঝে আয়েযা মেহুলের বাহু টেনে ধরে তাড়া দেয়, “পাত্তা দিবি না একদম, ফালতু ছেলের দল, আশেপাশে এলাকায় মাস্তানি করে বেড়ায়, বাজারের ফুটপাথের দোকান থেকে পয়সা উঠায় চাঁদা দাবি করে, এসব দিয়ে পেট আর দিন দুইটাই অমানুষের মতো কাটিয়ে দেয়। চল্, ভালোই ভালোই বিলটা দিয়ে সরে আসাই ভালো।”
ওদিকে একাদিক্রমে মন্তব্যগুলো ধেয়ে আসছেই, “আরে গুলুমুলু মোটি বেগম, তুমি তো সেই একটা জিনিস…”, “…এলাকার বড় ভাইকে যা দেখালে আজকাল, আমরাও কিছু দেখি, কী বলিস তোরা হুম?” সাথে সাথে বাকিরা মুখে শিষ বাজিয়ে তালি দিতে শুরু করে। আশেপাশের টেবিলের সবগুলো চোখ এখন মেয়েদের দিকে। কয়েকজন সম্ভবত মেহুলের চেহারাটা শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। মোটামুটি বয়স্কদের মধ্যে ফিসফাসও আরম্ভ হয়েছে।
– “কেন ছাড়ব এই লাটিম লস্করদের, এই দেশে আইন আছে না? আমার একটা পশম ছিঁড়ার অকাদ নেই আর এসেছে মজা লুটাতে। দোষ করিনি যখন, ভয়ও পাবো না। ব্যাগে ভিনেগার, সরিষার তেল আর লাল শুকনো মরিচের গুঁড়া দিয়ে পেপার স্প্রে বানিয়ে রেখেছি। এক থাপ্পড়ের সাথে ফ্রি তে একটু চোখ জ্বালানীও দিয়ে দিই না, কী বলিস?” আস্তে করে আয়েযাকে বলল মেহুল।
– “এসব বুদ্ধি এখানে রাখ, আজকে তুই ওদের চোখে সামান্য স্প্রে মারবি আর কালকে ওরা তোর চোখে আমার মতো… থাক, মেহুল আমরা এখান থেকে চুপচাপ চলে যাই, চল্।” শুকনো কণ্ঠে মেহুলের হাত চেপে ধরে আয়েযা। বিপরীতমুখী বাহুর টানে যেন আলগা করে ফেলবে। মেয়েটার চোখেমুখে ইতোপূর্বের ঠাট্টা মশকরার সব রঙ ধুয়ে নতুন আতঙ্কের নিশান।
– “কীসের চলে যাই চলে যাই করছিস? জানিস বাংলাদেশে ইভ-টিজারদের শাস্তি কী? দণ্ডবিধির ২৯৪ নাম্বার ধারা আর ৫০৯ নম্বর ধারায় কী আছে জানিস? ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ৭৫ আর ৭৬ নম্বর ধারায় কী আছে শুনবি? যদি কেউ কোনো নারীকে…”
– “তুই আমাকে এসব আইন বৃত্তান্ত পরে শুনাবি, এখন প্লিজ চল্ তুই।”
মেহুল থামে না, শক্ত গলায় ছেলেগুলোর দিকে ফিরে বলে, “সমস্যা কী হ্যাঁ? গায়ে জোর বেড়েছে না কোথাও খেয়ে-টেয়ে এসে বুদ্ধিতে চিড় ধরিয়েছ যে এসব ফাপর মারছো? নিজেরা নিজেদের মতো ভালো থাকতে পারো না?”
– “না দিদিমণি, পারি না তো। এই যে তলে তলে নিজেরা রসাতল গড়ে এত টাংকি মারছো, সহ্য হয় বলো? বলি আমাদেরও তো একটু সঙ্গ দাও। রেট বেশি দিতে পারব না বলে কী…” ছেলেটাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মেহুল ব্যাগের হাতা ধরে কষে পিঠের অংশটার বাড়ি লাগিয়ে দিলো মুখের উপর। আশেপাশে তখন দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু ওরা। ছেলেটা চুলে চিরুনির মতো হাত চালিয়ে নাক ফুলিয়ে কিছুটা তেঁতে উঠল, শ্লীল অশ্লীল কিছু শব্দ মিলিয়ে গালাগাল পর্যায়ে কিছু বলতেই যাচ্ছিল হঠাৎ টেবিল থেকে মেহুলের হাতের মাধ্যমে ওর গায়ে উড়ে এলো এক খাবলা মুখ থেকে চিবানো হাড্ডির অবশিষ্টাংশ।
আকষ্মিকতায় তেলে বেগুনে উঠেছে ছয়টা ছেলেই। কয়েক কদম বাড়িয়েও এসেছে প্রায়। অন্যান্য টেবিল থেকে নিরব দর্শকদের কয়েকজন মধ্যবয়সী লোক উঠে আসছে আগত ঝামেলার সুরাহা করতে।
এমন সময়ে ব্যাপারটা তিল থেকে তাল গড়তে গিয়েও আর গড়লো না, আয়েযা মেহুলের কব্জি শক্ত করে ধরে এক প্রকার জোর করেই টেনে নিয়ে আসে ক্যাফের ঘটনাস্থলের বাইরে। যত দ্রুত সম্ভব সে হাঁটছে, মেহুলকে আনতে হচ্ছে টেনে হেঁচড়ে। মেয়েটা উচ্চস্বরে দণ্ডবিধির ধারা পড়ছে আর ছেলেগুলোর এ আচরণের দরুন শাস্তির বিবরণী শোনাচ্ছে, “…কোনো নারীর শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে জনসমক্ষে কেহ এরুপ করিলে অনূর্ধ্ব এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড তাহাকে প্রদান করা হইবে…।”
– “আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের জিহবার কথাটা ভেবে একবার রহম কর্, আইন তে আদালত, গইন তে গায়েব। এসব ধারা ফাঁড়া দিয়ে আদৌ কী সুবিচার পেয়েছে কেউ?” আয়েযা হাল্কা শাসায় মেহুলকে।
– “আমি আইন তে আদালত বিশ্বাস করি, গইন তে গুনাহ।”
– “আচ্ছা, আচ্ছা আমার বয়োজ্যেষ্ঠা, একটু নিস্তার দে প্লিজ। মানুষ দেখছে।”
– “দেখুক, আমার কী? আর একটা জিনিস দেখলি? ছেলেগুলো কী সব কথাবার্তা বলছিল যেন আমরা কোনো ইন্টারনেট চোষে বেড়ানো স্টার। অফলাইন অনলাইন রোজগার এগুলো কেমন কথা হুম?”
আয়েযা চুপ থাকে। দু’পায়ে জোর খাটিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সে হাঁটছে। লিফট ধরে একেবারে নিচে যেতে পারলে যেন হাঁফ ছেড়ে স্বাধীন দম নেয়া যায়। মেহুল তাগাদা দিয়ে বলল, “তুই কিছু জানিস না কি? দাঁতে ছিটকিনি আটকে দম মেরে গেলি যে?”
– “দেখ মেহুল, রাগ করিস না, আমি ব্যাপারটা কালকে রাতেই শুনলাম এক সিনিয়র আপুর থেকে। ভেবেছি কথাটা খুব বড় না তাই বলিনি। কিন্তু এখন দেখছি জল গড়িয়ে জলাশয় হয়ে গেছে। রুমে ঠান্ডা হয়ে ফ্যান চালিয়ে বসে বলব তবে তোর পায়ে ধরি বোন এবারের মতো দ্রুত ফিরে চল্; আর কিচ্ছু বলিস না।”
উপস্থিত মানুষদের সীমিত আকারে জটলা থেকে নেতাগোছের ছেলেটাকেও সাঙ্গপাঙ্গরা একরকম কলজে টানাটানি করে বাইরে নিয়ে আসলো। শত হোক, মান ইজ্জত পরোয়া ওদের না-ই বা থাকল, কাপুরুষের মতো জানটা তো আছে! লোকের মুখের ফিসফাস ততক্ষণে আলোচনা মঞ্চের গুঞ্জনে রূপান্তরিত হয়েছে।
ফেলে আসা ঘটনার জের ধরে দাঁত কষে চেপে ছেলেটা বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলে দিলো, “খুব ভদ্র সাজে না মাইয়াডা? অতিভদ্রতা আমি দেইখা নিমু একদিন। শইল দেখাইয়া টেকা কামায়, আজেবাজে ছবি ছাড়ে এহন আবার ফকিন্নির মতো মুখে হাড্ডি মাইরা পুলিশ কেসের ডর দেখাইতাছে। দেখমু আমি, কেমনে ইজ্জত নিয়া বাঁইচা থাকছ আমি দেখমু তোরে, ভালো কথায় তো পাত্তা দেছ নাই…।”
(চলবে ইনশাআল্লাহ)