অঙ্গারের নেশা,পর্ব~১৫,১৬

0
2469

অঙ্গারের নেশা,পর্ব~১৫,১৬
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৫

আপন মানুষের হঠাৎ বদলে যাওয়া আমরা কখনোই মেনে নিতে পারিনা। আমরা ভরকাই, চমকে যাই, হতবাক হই। আর তা যদি নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষ ‘স্বামী ‘ নামক মানুষটি৷ তাহলে, আঘাতের পরিমাণ হয় আরও দগদগে। ভেতরে ভেতরে আঘাতের চিহ্ন বাড়তে থাকে। এক সময় গিয়ে সম্পর্কটাই হয়ে যায় ঠুনকো। সম্পর্কের পিলার গুলো যেনো ধ্বসে পড়ে।
তিন ঘন্টা আগের ঘটনায় মানসিক ভাবে থমকে গিয়েছিলো প্রানেশা। হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলো সুফিয়ানের ভয়াবহ রূপে। সবেমাত্র ভালোবাসতে শুরু করেছিলো সে। কিন্তু সুফিয়ানের ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান ঘর থেকে তখনই বেরিয়ে গেলো। তিন ঘন্টায় একবারও আসেনি। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কিছুসময় পরই জ্ঞান ফিরে প্রানেশার। থরথর করে কেঁপে উঠলো সে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ঘরের দরজা বন্ধ। মনে মনে ভাবলো পালিয়ে যাওয়ার কথা।
দ্রুত উঠে দরজা খুলতে নিতেই দেখলো ঘরে দরজা বাহির থেকে লাগানো। দুই একবার হাত দিয়ে বাড়ি দিলো। কেউ নেই বোঝাই যাচ্ছে। তাছাড়া এই সময়টায় সবাই সাগরের পাড়ে থাকে। বুঝে গেলো সুফিয়ান তার যাওয়ার পথ বন্ধ করেই গেছে। ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে প্রানেশা ভয়ানক এক সিদ্ধান্ত নিলো। চোখ মুছে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিলো। এখানে থেকে লাফিয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। নিচের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘ এখানে থেকে লাফ দিলে বালুর উপর পড়বো, খুব বেশি একটা ব্যাথা পাবো বলে মনে হয় না ‘

মনে মনে সাহস নিয়ে চোখ বন্ধ করে জানালার উপর দাঁড়িয়ে এক পা বাহিরে দিতেই পেছনে থেকে সুফিয়ান টেনে নিচে নামিয়ে ফেললো। প্রানেশা চমকে উঠলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আগের মানুষটাই কিন্তু চোখ মুখের ভাষা আলাদা।কয়েক ঘন্টা আগেই মুখে হিংস্রতা নিংড়ে পড়ছিলো। অথচ, এখন মুখটা ভীষণ অসহায়ের মতো। চোখে টলমল করছে ৷ সুফিয়ান বুক ওঠানামা করছে। দেখে মনে হয়, খুব ভয় পেয়ে আছে ৷ প্রানেশার হাত মুখ ভালো করে চেক করে প্রানেশাকে বিছানায় বসালো।প্রানেশা মনে মনে ভয় পাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই পাগলের মতোন ব্যবহার করছিলো অথচ এখন কেমন শিশুর মতো আচরণ। সুফিয়ান হাঁটু গেড়ে বসে প্রানেশার কোলের উপর মাথা রাখলো। হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অজস্র চুমু খেলো। প্রানেশা বুঝতে পারলো সুফিয়ান ফুঁপাচ্ছে। প্রানেশার না চাইতেও মায়া হলো৷ হাতে কবজিতে ভেজা অনুভব হতেই এক হাত সরিয়ে সুফিয়ানের মাথায় রাখলো। সুফিয়ান প্রানেশার কোল আরও শক্ত হাত ধরে বললো-
‘এমন আর কক্ষনও করবেনা প্রাণ! আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য আমার সব হারিয়েছি।কিন্তু তুমি হারিয়ে গেলে আমি মারা যাবো প্রাণ। চলে যাওয়ার আগে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিও।তোমাকে হারিয়ে বাঁচা সম্ভব নয় ‘

প্রানেশা এবার বুঝতে পারলো। জানালার উপর দাঁড়িয়ে থাকায় সুফিয়ান ভেবেছে সে আত্মহত্যা করতে চাইছিলো৷ কিন্তু, মুখে কিছু বললো না। কারণ এটাই সুযোগ সত্যি জানার। মুখে গম্ভীরতা নিয়ে বললো-
‘ কিন্তু আপনার মতো একজন মানুষের সাথে একসাথে সংসার করা সম্ভব না। ‘

সুফিয়ান বোধ হয় কয়েক বছর পর কাঁদল। সেই সময়ের কান্নার কারণও ছিলো তার প্রাণ আজও তাই।
প্রানেশার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-

‘ক্ষমা করে দাও প্রাণেশা। আমি ভীষণ রেগে গেছিলাম। আমি ভয়ে ছিলাম, যদি সত্যি শুনে তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাও!’

প্রানেশা সন্দেহ গলায় বললো –

‘এমন কী করেছেন আপনি? যা শুনলে আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো!’

সুফিয়ান নিষ্প্রাণ হয়ে বসে রইলো। দৃষ্টি নিচের দিকে। অপরাধীর মতোন মুখ থমথমে। প্রানেশা চুপ করে থেকে বললো-

‘ আপনি যদি আমায় আর ধোঁয়াশায় রাখেন আমি ছেড়ে চলে যাবো, আজই সব সত্যি বলবেন আপনি। আপনাকে আমার কসম’

সুফিয়ান চমকে উঠলো। হাত সরিয়ে বললো-

‘কসম করা গুণাহ প্রাণ! এসব আর বলবেনা ‘

‘ঠিক আছে। কিন্তু আপনি আজই সব সত্যি বলবেন ‘

সুফিয়ান লম্বা শ্বাস ফেলে বললো-
‘বলবো প্রাণ, সব বলবো। তুমি নিজের কোনো ক্ষতি করবে না। ‘

‘হুম’

সুফিয়ান আসার সময় খাবার নিয়ে এসেছিলো। হাতের পাস্তার প্লেটটা নিয়ে এক চামচ নিয়ে প্রানেশার মুখের সামনে নিয়ে বললো-

‘ আগে খাবারটা খাও, বিকেল হয়ে এলো । সকালেও কিছু খাওনি ‘

প্রানেশা বললো-
‘কিন্তু, সত্যিটা!’

‘বলবো,আগে খাও। তারপর ‘

‘আচ্ছা ‘

অর্ধেকটা খেতেই প্রানেশার মনে পড়লো সুফিয়ানও সকাল থেকে কিছু খায়নি। সুফিয়ান চামচ আবার মুখের সামনে ধরলে প্রানেশা বললো-

‘ আপনি খেয়েছেন?’

সুফিয়ান মলিন হেসে বললো –

‘আমি পরে খেয়ে নেবো ‘

প্রানেশা জেদি গলায় বললো –

‘না না, পেট ভরে গেছে। এটুকু আপনি খান ‘

সুফিয়ান হাত নিচে নামাতেই প্রানেশা খেয়াল করলো বাম হাতে সাদা ব্যান্ডেজ করা। হালকা ছোপ ছোপ রক্ত। প্রানেশা বললো-

‘এটা কী করে হলো?’

সুফিয়ান নিজের মুখে অল্প পাস্তা পুড়েছিলো। হাতের কথা শুনে চিবোতে চিবোতে বললো-

‘ যে হাত তোমায় আঘাত করে সে হাতকে আমি কী করে অক্ষত থাকতে দেই প্রাণ! ‘

প্রানেশা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো-

‘আপনি নিজেকে ইচ্ছে করে আঘাত করেছেন! ‘

সুফিয়ান হেসে উঠে চলে গেলো। প্লেট রেখে বললো-

‘চলো প্রাণ, আজ তোমার মনের সকল কৌতুহল, প্রশ্ন মেটাবো ‘

প্রানেশার হাত ধরে সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে গেলো। প্রানেশা সমুদ্র থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান গম্ভীর স্বরে বললো –

‘প্রাণ, তোমার ওয়াটার ফোবিয়া কী জন্মের পর থেকেই?’

‘নাহ,আমার জীবনের এক দূর্ঘটনায় এই ফোবিয়ার সৃষ্টি হয়’

সুফিয়ান প্রানেশার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘ সেটা শুধু তোমার জীবনের দূর্ঘটনা ছিলো না প্রাণ। আমার জীবনেরও একটা ঘটনা, সেটা না হলে হয়তো আমি তোমায় পেতাম না ‘

প্রানেশা হা করে থেকে বললো-
‘মানে! ‘

‘দূর্ঘটনাটা ঠিক কীভাবে, কোথায় হয়েছিলো মনে আছে তোমার? ‘

প্রানেশা বলতে শুরু করলো আজ থেকে চার বছর আগের ঘটনা-

‘ তখন আমার পরীক্ষার পর ছুটি চলছিলো। বয়স সবে মাত্র ১৭ বছর হয়েছে। সব বান্ধবীরা ঠিক করলাম পিকনিকে যাবো।সেখানে তিন দিনের দিন, নৌকা ভ্রমণে, হঠাৎ নৌকা থেকে আমি পড়ে যাই। সাঁতার না জানায় আরও ভয় পেয়ে যাই। তারপর কে বা কারা আমায় উদ্ধার করেছে আমি জানিনা, হুঁশ ফিরতেই নিজেকে হসপিটালের বেডে পাই ‘
কিছুটা থেমে বললো-‘ব্যস, এখানেই শেষ ‘

সুফিয়ান পাড়ের কিনারায় বসে আছে। উত্তাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘শেষ নয় প্রাণ। সেটা শুরু ছিলো, এক রক্তাক্ত ইতিহাসের শুরু, গল্পের শুরু। এক ভয়ংকর প্রেমের শুরু। ‘

তারপর প্রানেশার দিকে পেছনে তাকিয়ে বললো-

নীল সমুদ্রের কোলে করে এলে তুমি ভেসে,
মুখখানা ঢেকে ছিলো তোমার এলোকেশে।
ভালোবাসার গহীন কোণে হারিয়ে আমি আজ,
খুঁজে ফিরি বনে বনে তোমার নামের সাঁঝ।
আকাশেতে তারার মেলা, অঢেল আলোর ঘর
আজও ওঠে বুকের মাঝে তুমি নামক ঝড়।

চলবে…..

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৬

‘প্রাণ, যদি শোনো। আমি একজন খুনী, তাহলে তুমি কী আমায় ঘৃণা করবে!’

কথাটা ভীষণভাবে আকুতিভরা টলটলে শোনালো প্রানেশার কানে৷ প্রানেশা সুফিয়ানের ঠিক বাম পাশে হাঁটুতে মাথা দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে ছিলো। খুনের কথা শুনে প্রানেশার হয়তো এই মূহুর্তে আতংকিত হয়ে চেচামেচি করে ওঠার কথা অথচ সুফিয়ানের মায়া চোখের উপর তেমন কিছু বলতে পারলো না। শরীরের অর্ধাংশ বোধ হয় কেঁপে উঠলো। মাথা নাড়িয়ে বললো-

‘নাহ’

সুফিয়ান দুর্বধ্যে হাসলো। প্রানেশার ভেতরের হাসফাস টের পেলো। নির্লিপ্ততা নিয়ে মাথার নিচে দুই হাত ভাজ করে বালির উপর শুয়ে পড়লো৷ প্রানেশার তখন মনে হলো ” এটি সবচেয়ে সুন্দর চিত্র। রংতুলি হাতে থাকলে নিশ্চিত কাঁচা হাতেই একটা পেইন্ট করে ফেলা যেতো৷ এই যে সারা রাত ধরে ঘটা করে প্রবল বৃষ্টি হলো এখন এই ঠান্ডা বাতাসের মাঝে সূর্যর হালকা আলো, কেমন একটা মোমবাতির সোনালী আভার মতোন চিকচিক করছে৷ চিকচিকে সোনালী আভাটা নিজের রং দিয়ে সুফিয়ানকে সাজিয়ে দিতে চাচ্ছে। যদি এমন একটা থমথমে পরিবেশ না হতো, তবে এই মূহুর্তে আমি রোম্যান্টিক বনে যেতাম ” পরমুহূর্তেই ভাবলো ”ধুরর,যতসব উদ্ভট চিন্তা ”

সুফিয়ান সোনালী আকাশটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো আজ সব সত্যি উন্মুক্ত করে দেবে। তারপর যা হওয়ার হোক৷ প্রানেশা যেমন রিয়েক্টই করুক, কিন্তু ছেড়ে চলে যেতে দেবেনা। প্রানেশার দিকে তাকিয়ে বললো-

‘প্রাণ, রেয়ান তোমাকে কখনো ভালোবাসেনি ‘

প্রানেশা বিস্মিত ভঙ্গিতে বললো –

‘কী বলছেন এসব!’

‘আমি মিথ্যা বলিনা প্রাণ, আর একটা কথা কী জানো!তুমিও রেয়ানকে ভালোবাসোনি ‘

প্রানেশা এক মুহূর্তের জন্য থমকালো। চমকে উঠলো। অস্বীকার করে বললো –

‘আপনি কী করে জানবেন! আমি সত্যিই ভালোবাসতাম ‘

‘হাঃ হাঃ, তুমি খুব বোকা প্রাণ! এখন শোনো তুমি যা এতোদিন জানতে বা দেখতে সেসব কিছু তোমায় দেখানো হয়েছে। এক কথায় তোমার সাথে মাইন্ড কনট্রোল করা হয়েছে ‘

‘মানে! ‘

‘মানে হলো, তোমার জীবনের প্রথম পুরুষ আমিই ছিলাম আর শেষ পুরুষও আমিই থাকবো ‘

প্রানেশা কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলো না। সুফিয়ানের কাছে হামাগুড়ির মতোন দুই হাত এগিয়ে এলো৷ সুফিয়ান আড়চোখে একবার দেখে নিলো প্রানেশাকে। সুফিয়ান নিজের একটা হাত সামনে বাড়িয়ে দিলো। প্রানেশা সেই বাহুতে নির্দ্বিধায় মাথা এলিয়ে শুয়ে পড়লো। মাথার উপরে রংবেরঙের দুই একটা বিদেশি পাখি উড়ে বেরাচ্ছে। সূর্যর মতিগতি বোঝা বড় দায়। এই আলো ছড়িয়ে রাজার মতো আকাশকে দখল করছে তো আরেকবার মেঘের ভেলায় মুখ লুকোচ্ছে। সুফিয়ান প্রানেশার গায়ের উপরের ওরনা দিয়ে হাতে পেচিয়ে অযথাই নাড়াচাড়া করতে থাকলো। প্রানেশার উৎসুক দৃষ্টির দিকে তাক করে মনে করলো সেই সময়ের কথা-

‘এবারের প্রথম বিজয়ীর স্থান দখল করেছে ‘সুফিয়ান তেহজিব’ ‘

হাস্যজ্জল মুখভঙ্গিতে স্টুডেন্টদের মাঝে থেকে গিটার কাঁধে স্টেজে উঠে এলো সুফিয়ান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতা প্রতিবারের মতো এবারও প্রথম স্থান দখল করে নিলো সে। ট্রফি হাতে নেমে আসতেই বন্ধুরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বন্ধুদের চোখের মণি সুফিয়ান। বাহ্যিক ব্যবহার, কথাবার্তায় মুখভর্তি হাসি, সকলকে সম্মান এসব গুণ সবার চোখে তাকে উঁচু করেছে বহু গুনে৷ বন্ধুদের মাঝে দুইজনকে অনবরত খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে সুফিয়ান। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফায়েজ সুফিয়ানের চিন্তিত মুখভঙ্গি দেখে বললো-

‘কী মামা! প্রত্যেক বারের মতো এইবারও ছক্কা হাঁকাইলা। এখন কারে খুঁজো? ‘

সুফিয়ান হেসে বললো –

‘ ইভানান আর রেয়ান ‘

ফায়েজ ভ্রু কুচকে বললো-

‘ইভানান মনে হয় কিছুক্ষণের মাঝেই আইবো। এবারে ওর পেইন্টিংএ সবার নজর পড়সে। ‘ স্টেজের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘আরে ঐ যে দেখ! ‘

সুফিয়ান তাকাতেই দেখলো গ্রিন ফুল হাতা শার্টের হাতা গুটিয়ে ক্লাসিকাল ড্রেসআপে নেমে আসছে তার চাচাতো ভাই ইভানান৷ ছোট বেলা থেকেই দুজনের গভীর বন্ধুত্ব। একজন আরেকজনের প্রাণ। দুইজনের মধ্যে যদি কম্পিটিশন করা হয়, তাহলে বিচারক হিমশিম খেয়ে যাবে। সুফিয়ানের যেমন খাঁড়া নাক, গভীর কালো ঘোর লাগানো চোখ, পেটানো জিম করা বডি, গলায় মধুর সুর। ঠিক তেমনই ইভানানও কোনো অংশে কম নয়,তার আছে নীল সাগরের মতোন দুটি নয়ন, খাড়া কাটা কাটা চুল, ঠোঁটের উপরের খাঁজে একটা তিল সঙ্গে জাদুকরী হাতের আর্ট ৷ কারো সাথে যেন কারো তুলনা করা মুশকিল। শুধু একটা দিকই ইভানানের খারাপ, তা হলো চরিত্রদোষ। সুফিয়ান যেমন কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে ঠিক মতো দেখেনা, সেখানে ইভানান দশ পনেরো বার রুম ডেট করেছে । সুফিয়ানের দিকে এগিয়ে এসে ইভানান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো-

‘ভাই! কেমন আছিস ‘

‘এমন ভাবে বলছিস যেনো কয় যুগ পর দেখা হলো!দুইদিন আগেই তো বড় মার সঙ্গে দেখা করে এলাম’

‘তা ঠিক আছে, কিন্ত তোকে দুইদিন না দেখলে সব পানশে পানশে লাগেরে বেটা!’

সুফিয়ান প্রতুত্তরে হাসলো। ফায়েজ সুফিয়ান আর রেয়ানের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। গালে হাত দিয়ে দুইজনের দিকে সন্দেহ নজরে তাকিয়ে বললো-

‘কী ব্যাপার বলতো! তোরা দুইদিন আলাদা থাকতে পারোস না। এই! তোদের দুইজনের আবার সমস্যা টমস্যা নেই তো!’

সুফিয়ান আর ইভানান ইচ্ছেমতোন কিল ঘুষি মারলো ফায়েজের পিঠে৷ তারপর তিনজন একসাথে হেসে উঠলো৷ তাদের ফ্রেন্ড সার্কেল অনেক বড় হলেও তিনজন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কারণ বন্ধুত্বের শুরুটা স্কুল জীবনের। তিনজন যখন হাসি ঠাট্টায় মত্ত তখন হঠাৎ করে একটা ছেলে এসে সামনে দাঁড়ালো। হাতে এইচ. জি ওয়েলসের ‘ইনভিসিবল ম্যান’ বইটি৷ ঢোলা একটা প্যান্ট, চিকন কোমড়ের থেকে খুলবে খুলবে ভাব। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ভোঁতা নাক, গোলগাল মুখের সামনে থেকে বই সরাতেই সুফিয়ান আর ইভানানের দিকে তাকিয়ে বোকা হেঁসে বললো –

‘ কংগ্রাচুলেশনস, সুফি ভাই, ইভ ভাই ‘

সুফিয়ান হেসে ছেলেটার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো৷ ভাইটা তার বড্ড সহজ সরল। প্যাচগোছ বোঝে না। কেউ তার উপর জোড়দাঁড়ি করলেও বুঝি রাগ করবেনা। চুপচাপ মেনে নেবে৷ সারাদিন বই হাতে ঘুরে বেড়ায়। বইটা হাত থেকে নিয়ে ইভানান বললো-

‘হুহ! তুই কীরে রেয়ান! এই সারাদিন শুধু বই হাতে ঘুরে বেড়াস। এমন করলে চলবে, একটু কথাবার্তাও বল’

রেয়ান তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসলো৷ সুফিয়ান আর ইভানানের সম্পূর্ণ বিপরীতে রেয়ান। চেহারা একবারে খারাপ না হলেও সুন্দর বলা যাবেনা। ছোট বেলা থেকেই সহজ সরল বোকাসোকা। যে যা বোঝায় তা-ই বোঝে। কিন্তু খুব বেশি একটা কথা বলে না। একা একা থাকে, বই পড়ে ৷ স্মার্টনেসের ধারের কাছেও নেই। পিছনে থেকে জয় এলো আড্ডায় সামিল হতে। জয় খুবই ঠোঁট কাটা স্বভাবের। কোন পরিস্থিতিতে কী কথা বলতে হয় তা বোঝে না, ত্যাড়ামি করে। কারো পিঠপিছে কিছু বলেনা, একদম স্রেইট ফরওয়ার্ড। রেয়ানের হাতে সবসময়কার মতোন বই দেখে তাচ্ছিল্য হাসলো, গায়ের ঢোলা টিশার্ট একবার ফাজলামো করে টেনে দিয়ে রেয়ানের কাঁধে হাত রেখে তীর্যক ব্যাঙ্গ করে বললো –

‘রেয়ান, কিছু মনে করিস না। বড় ভাই হিসেবে বলি শোন। এই যে এমনিতেই মুখের গড়ন বেশি ভালো না। তার উপর আবার এমন মেয়েদের মতোন এই চশমা ঢোলা জামা কাপড় পড়িস। এমন হলে তো বউ পাবি না! আমরা সবাই বিয়ে করবো কিন্তু তোকে বিয়ে দেয়া লাগবে!’ বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। প্রথমের কথা গুলোতে তেমন কিছু না বললেও পরের কথাটা ঠিক বুঝতে পারলো না রেয়ান। বোকার মতো করে জিজ্ঞেস করলো ‘ আমাকে বিয়ে দিতে হবে মানে!’

জয় আবারও হাসলো। রেয়ানের মাথায় চাটি মেরে বললো- ‘গাধারে! এর মানে হচ্ছে আমরা বিয়ে করে বউ ঘরে আনবো। আর তোকে ঘরজামাই করে বউয়ের বাড়ি পাঠাতে হবে ‘

সবাই হাসত হাসতে গড়াগড়ি খেলেও সুফিয়ান কড়া কন্ঠে বললো –

‘জয়! আমি বলেছি না, এভাবে রেয়ুর সাথে কথা বলবি না। সবার নিজের একটা আলাদা ব্যাক্তিত্ব থাকে। রেয়ু যদি এভাবে কম্ফোর্ট ফিল করে তাহলে আমাদের এতো সমস্যা কোথায়! ‘

সুফিয়ান থাকতে চাইলেও সবাই টেনে নিয়ে গেলো ক্যান্টিনে। রেয়ান সবসময়ই এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সঙ্গে অভ্যস্ত । কিন্তু আজকের অপমানে ভেতরটা তেঁতো হয়ে উঠলো। সবকিছু চুপ করে সয়ে নিয়ে লাইব্রেরিতে যেতে নিলে দুইজনের ফিসফিস কানে এলো –
‘দেখসোস, কেমনে বোকা পাইয়া মদন বানায় রাখে ওরে! ‘
অপরপক্ষ থেকে একটা মেয়েলি ধ্বনি বললো-

‘ তা আর বলতে! আহারে বেচারা। সুফিয়ান আর ইভানান দুইজন তরতর বেগে উপরে উঠছে আর ওকে বোকা পেয়ে অবিচার করে যাচ্ছে ‘

রেয়ান কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলো। ভেতরের এতদিনকার আত্মবিশ্বাস নড়েচড়ে গেলো। চোখে বোধ হয় পানি জমছে৷ নাহ, সবাই ঠিকই বলে তার স্বভাবে মেয়েলিপনা আছে৷ তা-ই বোধহয় কেউ তাকে দুই পয়সার মূল্য দেয়না৷
_____________

‘জানো প্রাণ, আমরা সবাই মুভি দেখার সময় শুধু একজন ভিলেনকে দোষারোপ করি। তাকে গালমন্দ করি কিন্তু একবারও চিন্তা করিনা, সেই মানুষটার ভিলেন হওয়ার পেছনে থাকতে পারে এক বিস্তৃত ঘটনা। থাকতে পারে এক কষ্টদায়ক অতীত। শুধু প্রেম জীবনে প্রত্যাখ্যান পেয়েই যে কেউ ভেঙে গুড়িয়ে যাবে তা কিন্তু নয়, আশেপাশের মানুষের কটু মন্তব্যই যথেষ্ট একজনকে ডিপ্রেশনে ঠেলে দিতে। মানুষ যদি তার মুখের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারতো তাহলে, কারো নিজের জীবনের প্রতি এতো অনীহা জাগতো না! ‘

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here