অঙ্গারের নেশা,(৩০ দ্বিতীয় ও সর্বশেষ অংশ)
আকাশের রঙ আজ পরিষ্কার। গাছে গাছে নতুন ফুল ফুটেছে ৷ ফুটবেই তো আজ যে বসন্ত! বসন্তকাল জুড়েই তো নানা রঙের ফুল ফলালির ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে ওঠা। রাস্তায় লাল ফুল বিছিয়ে পড়ে আছে। প্রকৃতি নতুন রঙে সেজেগুজে নবাবী ভঙ্গিতে হাসলো যেনো। আহা! এই সুন্দর রূপে ডুবিয়েই ছাড়বে সবাইকে।
লাল রঙে সুসজ্জিত রূপের গাছটি দেখে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে আছে একটি ছোট মেয়ে। বয়স চার বছর। তার গায়েও যে লাল রঙের ফ্রক৷ মনে মনে সে কিছু একটা ভাবলো। ঠোঁট উল্টে গাছটিকে কিছু একটা শুধালো। নির্বোধ গাছটি কোনরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কয়েক কদম দূরে একটি গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা৷ মেয়েটি দৌড়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ানো মানুষটির কাছে গিয়ে নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে আঁকড়োমুঠোয় হাঁটু জড়িয়ে ধরলো। ব্যাক্তিটি তার হাঁটুতে স্পর্শ পেয়ে নিচের দিকে তাকালো ৷ মৃদু হেসে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলো ৷ নরম গাল দুটো হালকা টানতেই মেয়েটি ফুলে ফেঁপে থাকা গাল আরেকটু ফুলিয়ে আদো আদো কন্ঠে বললো-
‘বাব্বা! ‘
ব্যাক্তিটি মেয়েটির মতোন গাল ফুলিয়ে একই ভঙ্গিতে বললো –
‘কী হয়েছে বাব্বা? ‘
মেয়েটি সামনের গাছ করে বললো –
‘বাব্বা! ওতা কী গাচ?’
ব্যাক্তিটি আঙুল বরাবর তাকালো। লাল ও কমলা রঙের ফুলে ফেঁপে থাকা গাছটি দেখে বললো-
‘ওটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ‘
ছোট মেয়েটা আপনমনে উচ্চারণ করার চেষ্টা করলো –
‘ওওও আত্তা, কিত্নচূলা গাচ’
ব্যাক্তিটি হো হো করে হাসলো৷ মেয়ের মন রক্ষার্থে বললো-
‘হ্যা, সায়েশা মা ঠিক বলেছো ‘
মেয়েটি উৎফুল্ল হয়ে হাসলো। কিছুটা সময় থেমে বললো-
‘বাব্বা, আমলা পাপাল কাচে কখন যাবো? ‘
‘এই তো সায়েশা, আমার কলে কথা বলা শেষ। চলো এখনই যাবো এয়ারপোর্টে । ‘
‘আত্তা চলো ‘
ব্যাক্তিটি মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে দিলো। নিজেও ড্রাইভিং সিট বসে পড়লো। আধা ঘণ্টা পর এয়ারপোর্টের সামনে গাড়ি থামলো। নেমে আসলো ব্যাক্তিটি। পড়নে কোর্ট, চোখে কালো ফ্রেমের বেশ স্টাইলিং একটা চশমা। সায়েশা টুকুর টুকুর করে নামলো। দূর থেকে দেখলে বিদেশি কোনো পুতুল মনে হবে। ব্যাক্তিটি মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকলো। কিছুক্ষণ বাদেই আরেকজন ব্যাক্তি তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ালো। চিৎকার করে বললো –
‘আমি এসে গেছি সুফি! ‘
সুফিয়ান চকিতে সেদিকে তাকাতেই মুখে ছড়িয়ে পড়লো মুক্তোর মতো হাসি৷ বহু দিন পর বহু আকাঙ্খিত মানুষ। হ্যা, এটা সুফিয়ান। কেটে গেছে আজ চার বছর। কেটেছে সময়। পুরনো মানুষ অথচ নতুন রূপ। বহু মানুষ কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। আবার নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি হয়েছে। আজ সে একজন বাবা। সুফিয়ান হেসে সেদিকে দ্রুত পদে এগিয়ে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির সাথে কোলাকুলি করলো। সুফিয়ান আবেগি গলায় বললো –
‘ভালো আছিস ইভ? ‘
ইভানান মুখ নিচু করে হাসলো৷ সুফিয়ানের পাশে দাঁড়ানো ছোট পুতুলের মতো মেয়েটাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে সারামুখে চুমু খেলো। সায়েশাও গলা জড়িয়ে ইভানানের কাঁধে মুখ গুজলো। আদো আদো কন্ঠে অস্পষ্টতা নিয়ে বললো-
‘পাপা, তুমি দেলি কললে কেনো?’
ইভানানের চোখের পাপড়ি ভিজে উঠলো৷ বাম হাতে চোখ মুছে নিয়ে হাসি ফুটিয়ে বললো –
‘আর দেরি করবো না। এবার থেকে আমার সায়ু মা কে ছেড়ে কোথাও যাবো না ‘
সায়েশাও ইভানানের গালে আদর করে হাত বুলিয়ে কানের কাছে বললো-
‘আমাল গুড পাপা ‘
ইভানান সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘এতদিন ভালো ছিলাম নারে। এখন ভালো আছি, খুব ভালো আছি ‘
সুফিয়ান হেসে বললো –
‘এখন থেকে এভাবেই ভালো থাকবি। চল বাড়িতে চল। মা অপেক্ষা করছে। ‘
ইভানান সায়েশাকে নিয়ে পেছনের সিটে বসলো। সুফিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিতেই ইভানান বললো-
‘সাইরানকে নিয়ে আসলি না কেনো? ‘
‘সাইরান, তার ছোট বাবাকে পেয়েছে না! আজ আর সে কোথাও নড়বে না। তার ছোট বাবার আজ ছুটি। ‘
‘ওহহ’
ইভানান মলিন মুখে জিজ্ঞেস করলো –
‘সুফি, সে আমায় ক্ষমা করেছে তো? ‘
সুফিয়ান গম্ভীর গলায় বললো –
‘নিজেই জিজ্ঞেস করে নিস।’
ব্যস, এরপর সায়েশা আর ইভানানের কথা গাড়ির আনাচে কানাচে ভরে উঠলো ৷ সুফিয়ান গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো ৷ পথ অতিক্রম করতে এক ঘন্টা সময় লাগলো৷ বাড়িতে পৌঁছাতেই ইভানান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ পা থমকে গেলো। সুফিয়ান হেসে বললো ‘এত সংকোচ কিসের বলতো! ‘
ইভানান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। মিসেস অদিতি এসে দাঁড়াতেই ইভানান সালাম করলো৷ মিসেস অদিতি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন –
‘বেঁচে থাক বাবা। ভালো আছিস তো? ‘
ইভানান হেসে বললো –
‘ তোমাদের দেখে অনেক ভালো আছি। ‘
মিসেস অদিতি মৃদু হেসে সবাইকে ভেতরে নিয়ে আসলেন। রাহাত সাহেবও বেরিয়ে আসলেন। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে সোফায় বসলেন। সবাই নানান রকম কথায় মেতে উঠলো৷ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো এক সুশ্রী রূপের রমনী। হাতে পায়েস আর সন্দেশের ট্রে। পাক্কা গৃহিণী যেনো। সুফিয়ান সহ সবাই সেদিকে তাকালো। রমনীটি ট্রে টি-টেবিলে রেখে ইভানানকে বললো-
‘ সময় হলো তাহলে আপনার আসার! ‘
ইভানান অপরাধীর মতো মুখ কাচুমাচু করে হাসলো। নত মুখেই বললো-
‘কী করবো বলো! ওখানের কম্পানিতে আমি না থাকলেই কর্মচারীরা ঝামেলা পাকিয়ে ফেলে। ‘
রমনী আলতো হেসে সবাইকে পায়েসের বাটি তুলে দিলো। সুফিয়ান সেই রমনীকে মুগ্ধ চোখে দেখলো। এই কী সেই অবুঝ বউটা! যে অল্প কিছুতেই কেঁদে ভাসাতো। একটু ব্যাথাতেই কাতর হয়ে পড়তো। বিশ্বাসই হয়না এটা সেই প্রানেশা। তার প্রাণ। চার বছর আগের স্মৃতি হাতরালো সুফিয়ান। সেই দিনটি যেদিন প্রানেশাকে আরেকটু হলেই হারিয়ে ফেলতো সে।
বুক ধকধক করে ওঠে সেসব কিছু মনে করলে।
চার বছর আগে –
ইভানান প্রানেশার দিকে শুট করতেই সেটা লেগে যায় রেয়ানের বাহুতে। মূলত রেয়ান ইচ্ছে করেই প্রানেশাকে সরিয়ে দিয়েছে ৷ রেয়ানের চোখ মুখ ব্যাথায় লাল হয়ে উঠলো। সুফিয়ান দৌড়ে রেয়ানকে ধরলো। প্রানেশা ভয় পেয়ে চিৎকারে করে উঠলো। রেয়ানের রক্তাক্ত বাহুর দিকে তাকিয়ে নিচে বসে পড়লো। লেবার পেইন উঠেছে কিছু ক্ষণ আগে থেকেই। সারা শরীর ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে আছে। রেয়ান ব্যাথাকে পাত্তা না দিয়ে সুফিয়ানকে বললো-
‘সুফি ভাই, প্রানেশাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমার জন্য কম ক্ষতি হয়নি। এবার ভালো কিছু হোক। ‘
সুফিয়ান নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে রেয়ানের হাতে বেঁধে দিলো,প্রানেশার নিভু নিভু শরীরটা কোলে তুলে নিয়ে, বললো-
‘তুইও চল। তোরও ব্যান্ডেজ করা লাগবে। ‘
বাহিরের দিকে পা বাড়াতে নিয়েও ইভানানের দিকে ফিরলো। ইভানান কোনো কারণে মাথা চেপে ধরে আছে। মাথার রগ ফোলা ফোলা। সুফিয়ান অতকিছু খেয়াল না করে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো –
‘এবার তো তুই খুশি তাই না! এখন নিশ্চয়ই তোর খুব ভালো লাগছে। তোর বোনের মৃত্যুর পেছনে আমার কোনো হাত ছিলো না। কিন্তু আমার প্রাণের কিছু হলে দায়ী থাকবি তুই। তুই একটা খুনি হয়ে বাঁচবি সারাজীবন। কথায় কথায় বলিস, প্রাণকে ভালোবাসিস। অথচ, নিজের হাতেই শেষ করে দিলি। ‘
বলেই সুফিয়ান রেয়ান আর প্রানেশাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো৷ কেউ দেখলো না সেদিকে ইভানান মাথা চেপে নিচে বসে পড়লো। হাঁপাতে হাঁপাতে শ্বাস কষ্ট উঠে গেলো৷ পাশের মানিব্যাগ থেকে ঔষধ বের করে কোনমতে গিলে বিরবির করতে করতে নিজেও হাসপাতালের দিকে পা চালালো৷
সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছে অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে। হাত পা অনবরত কাপছে। বুকের অস্থিরতা ক্রমশই বেড়ে উঠছে। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে। প্রানেশার যদি কিছু হয় তাহলে এই জীবন আর রাখবে না সে। প্রাণ চলে গেলে দেহ পঁচতে বেশি সময় নেয় না। নিচ তলা থেকে দুর্বল পায়ে রেয়ান আসলো৷ সুফিয়ান দাঁড়াতে না পেরে সামনের একটা সিটে বসে পড়েছিলো। রেয়ান আচমকা সুফিয়ানের পা জড়িয়ে নিচে বসে পড়লো। হুহু করে কেঁদে উঠলো। সুফিয়ান তাকাতেই বললো-
‘আমাকে মেরে ফেলো সুফি ভাই। আমাকে মেরে ফেলো। আমি সত্যিই অধম। সত্যিই খুব খুব বোকা।
তুমি তো তুমিই। তোমার ভেতরের আত্মা আলোয় পরিপূর্ণ। আর আমার অন্ধকারে। সেই অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করতে না পেরে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম আর সেখানে থেকে যখন ইভ ভাই একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। আমার খুব আপন মনে হলো। বাবা বাড়িতে আসার পর মা সারাদিন চুপচাপ। তুমি তোমার লাইফে ব্যস্ত। আর আমিও ইন্ট্রোভার্ট। কাউকে নিজের মনের কথা জানাতেও পারিনি। নিজেকে তুলে ধরতে পারিনি। ইভ ভাই, আমাকে নিজের কাছে পুরো অন্যরকম করে তুলে ধরলো৷ আমি স্বার্থপর হয়ে উঠলাম। একবার যদি ভাবতাম, তুমি কখনো আমার খারাপ চাবেনা। তাহলে, এইসব হতো না। ‘
সুফিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে রেয়ানকে তুলে নিলো সামনে। রেয়ান ভাবলো হয়তো সুফিয়ান মারবে তাকে। কিন্তু তাকে স্তব্ধ করে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সুফিয়ানও বলো হয় কাঁদলো৷ গাল বেয়ে দুজনেরই অশ্রু ধরলো৷ সুফিয়ান রেয়ানের চাপকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো৷ চোখ মুছে বললো-
‘তোর একার দোষ ছিলো না রে। দোষটা আমাদের সবার। আমি নিজেকে নিয়ে এতো ডুবে ছিলাম যে আমার ছোট ভাইটাকে সময়ই দেইনি। তোকে একা ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ ভেবেছি তুই এভাবেই কম্ফোর্ট ফিল করিস। ‘
থেমে দীর্ঘ শ্বাসে বললো-
‘এসব বাদ। এবার কোনো কথা বলতে হলে সবার আগে আমার কাছে আসবি। ছোটরা তো ভুল করবেই শোধরানোর দায়িত্ব বড়দের। ‘
ইভানান বিমোহিত চোখে তাকিয়ে বললো-
‘সত্যিই সুফি ভাই, তোমার সাথে কাউকে মেলানো সম্ভব না। আমরা সবাই নিজেদের স্বার্থ খুঁজে বেরাই। আর তুমি সবার স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দাও। ‘
সুফিয়ান কিছু বলার আগেই অপারেশন থিয়েটারের ভেতর থেকে নার্স বেরিয়ে আসলো। সুফিয়ানের মুখ আবারও শুকিয়ে যাচ্ছে। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো –
‘সিস্টার, আমার প্রাণ ঠিক আছে তো? ‘
নার্স দ্রুত ভঙ্গিতে বললো –
‘আপনারা ‘O’ পজেটিভ ব্লাড খুঁজে আনুন। ব্লাড ব্যাংকে এই গ্রুপের রক্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্যাশেন্টের রক্তের প্রয়োজন ‘
সুফিয়ান চিন্তিত হয়ে ঘেমে জবজবে হয়ে গেলো। তার B+ রক্ত। কাউকে কল করতে ফোন করলো। রেয়ান থামিয়ে দিয়ে বললো-
‘ থামো ভাই, আমার O+ ভুলে গেছো? ‘
সুফিয়ান হাসতে নিয়েও থেমে গিয়ে বললো-
‘কিন্তু তোর কিছুক্ষণ আগেই গুলি লেগেছে। তুই কীভাবে! ‘
রেয়ান অনুরোধ গলায় বললো –
‘প্লিজ সুফি ভাই, আমি সেই পুরনো ক্ষত আবার আগের করতে পারবো না। কিন্তু, মলম তো দিতে পারি। রক্ত দিয়ে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। বাঁধা দিওনা ‘
সুফিয়ান চিন্তিত স্বরে বললো –
‘চেক আপ করে যদি দুর্বল আসে তাহলে আমি তোকে দিতে দিবো না ‘
রেয়ান সম্মতি দিয়ে নার্সের সঙ্গে রক্তের জন্য চেক- আপের জন্য। ডাক্তার বলেছিলো রেয়ানের শরীর অত্যন্ত দুর্বল কিন্তু রেয়ান ডাক্তারের হাত পায়ে ধরে সুফিয়ানকে এই কথা বলতে মানা করে জোর করে রক্ত দিলো। রক্ত দিয়ে বেরিয়ে এসে সুফিয়ানের পাশে বসলো। দুই ভাই পুরনো স্মৃতি চারণ করছিলো। এরই মাঝে ইভানান তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। সুফিয়ান ক্ষিপ্ত হয়ে ইভানানের গালে পরপর তিনটে চড় বসিয়ে দিলো। ইভানান নিচের তাকিয়ে কী যেনো অনবরত বলে যাচ্ছে। সে যেনো বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ইভানানকে চতুর্থ থাপ্পড়টি মারতে নিলেই একজন লোক সুফিয়ানকে বাঁধা দিলো। সুফিয়ানকে সরিয়ে দিলো। সুফিয়ান রেগেমেগে বললো-
‘কে আপনি! ‘
লোকটি অর্ধবয়স্ক। চুল হালকা পাক ধরানো। ইভানানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘একজন প্যাশেন্টের সঙ্গে হাসপাতালে আপনি মারামারি করছেন কেনো?’
সুফিয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘প্যাশেন্ট! ও প্যাশেন্ট নয় অপরাধী ও ‘
লোকটি কিছু বোঝার মতো করে বললো –
‘বুঝতে পেরেছি, আপনারা আমার সঙ্গে কেবিনে আসুন। আমি একজন কাউন্সিলর । ‘
সুফিয়ান আর রেয়ান কিছু বুঝতে পারলো না। লোকটার পেছনে কেবিনে গেলো। লোকটি পাশের আলমারি থেকে কিছু কাগজ ঘেটে নিজের চেয়ারে বসে পড়লো। সুফিয়ানের দিকে পেপার বাড়িয়ে দিয়ে বললো-
‘পেপারটা পড়ুন ‘
সুফিয়ান দ্রুত পেপারটা নিলো। তেমন কিছু না বুঝলেও প্যাশেন্টের জায়গায় যে ইভানানের নামটি দেখলো। সুফিয়ান কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই লোকটি থামিয়ে বললো –
‘ হ্যা , সে একজন মানসিক রোগী। তার মানসিক অসুস্থতা রয়েছে। অনেক আগে, একদিন আমার শরণাপন্ন হয়েছেন তিনি। তার মানসিক অবস্থা তখন খুব খারাপ। শুনেছিলাম, তার বোন মারা যাওয়ার পর থেকে সে রাতের বেলা ঘুমাতে পারে না। সব জায়গায় তার বোনকে দেখতে পায়। এটা এক ধরনের ডিসওর্ডার। প্রথম একমাস সে আমার কাছে চিকিৎসা করায়। কিন্তু সুস্থ হতে পারেননি। এটা ঠিক হতে অনেক সময় লাগে। বেশিরভাগ প্যাশেন্টরা একসময় সাইকো হয়ে ওঠে। তার আচরণে অন্য আট দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হলেও সে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। ‘
সুফিয়ান আর রেয়ান বড় একটা ধাক্কা খেলো। কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছেনা। সুফিয়ান হঠাৎ মনে করার মতো করে বললো –
‘এইজন্যই, অস্ট্রেলিয়ায় ওর সাথে থাকার সময় ও রাতের বেলা কী যেনো বিরবির করতো। জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতো না! ‘
‘হ্যা, এই ধরনের রোগীরা নিজেকে সবার আড়ালে রাখে। হঠাৎ হঠাৎ রেগে যায়, মাঝে মাঝে কী করে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনা। এরা ঠিক না হলে আশেপাশের মানুষের জন্য ক্ষতিকর। ‘
সুফিয়ান মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এ কেমন নিয়তি! কাউকেই যেনো দোষ দেয়া যায় না। সুফিয়ান কাউন্সিলরকে জিজ্ঞেস করলো –
‘এই রোগ ঠিক হতে কতদিন লাগবে?’
‘যদি নিয়মিত চিকিৎসা করানো হয়, আর প্রপার কেয়ার করা হয়। তাহলে, এক বছরের মধ্যে মোটামুটি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মূল চিকিৎসা চালিয়ে যেতে দুই তিন বছরের মতো লাগবে। ‘
সুফিয়ান তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। রেয়ান পিছুপিছু আসলো। দুজন অপারেশন থিয়েটারের সামনে আসতেই চেঁচামেচি শুনতে পেলো।
সুফিয়ান আর রেয়ান এগুতেই দেখলো নার্স ইভানানকে বকাঝকা করছে৷ ইভানানের হাতে ছোট সদ্য জন্মানো বাচ্চা মেয়েটা । ইভানান চেয়ারের পাশে হেলে বসে আছে। বাচ্চাটার হাত ধরে কিছু একটা বলছে অস্পষ্টতা নিয়ে। সুফিয়ান নার্সকে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বললো-
‘দেখুন তো,বাচ্চাকে নিয়ে জোড় করে বসে আছে। ‘
সুফিয়ান সেদিকে একবার তাকালো। ইভানান যে কোনো ক্ষতি করবেনা তা জানে সুফিয়ান। নার্সের কোলে আরেকটা বাচ্চা দেখতেই বললো –
‘এই বাচ্চাটা! ‘
নার্স এগিয়ে তোয়ালে পেচানো বাচ্চাটা সুফিয়ানের হাতে দিয়ে বললো –
‘এটাও আপনার বাচ্চা। আপনার ওয়াইফের টুইন হয়েছে। একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে। ‘
সুফিয়ান খুশিতে কেঁদে ফেললো৷ ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে সারা মুখে হাত দিয়ে আদর করলো। আবার কী মনে করে যেনো রেয়ানের হাতে বাচ্চাটা দিয়ে নার্সকে বললো –
‘আমার ওয়াইফ? ‘
নার্স মুচকি হেসে বললো –
‘তিনি সুস্থ আছেন। ভেতরেই শুয়ে আছেন। ‘
সুফিয়ান হেসে ভেতরে ঢুকে পড়লো। প্রানেশাকে নিয়ে এক সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরলো। প্রানেশাকে ইভানানের রোগের কথা জানাতেই সেও বললো বাড়িতে রেখেই ইভানানকে চিকিৎসা করাতে। কারণ, ইভানান বাচ্চা মেয়েটাকে নিজের কোল ছাড়া করতে চায়না৷ কিছুটা ঠিক হতেই সে নিজে থেকে নিজের চিকিৎসার জন্য অন্য দেশে চলে যায়। বাংলাদেশে থাকলে রোগ ঠিক হতে বেশি সময় লাগবে। নিজের মেয়ের মতোন ভালোবাসে সে বাচ্চাটাকে। নিজেই নাম রাখলো সায়েশা। সুফিয়ান আর প্রানেশাও ক্ষমা করে দিলো ইভানানকে। কারণ, একজন মানসিক রোগীর বোধ শক্তি কতটুকু তারা জানে। ক্ষমা করেনি শুধু রেয়ান। সে শুধু বলে -‘সে এতো মহান হতে পারবেনা। ইভানানের শাস্তি পাওয়া উচিত। ‘
কেউ তাকে কিছু বলেনি এই নিয়ে। বাচ্চা ছেলের নাম রাখা হয় সাইরান। সায়েশা সাইরানকে নিয়েই তাদের সুখী পরিবার।”
কারও ধাক্কায় অতীত থেকে বেরিয়ে আসলো সুফিয়ান। চারপাশে তাকাতেই দেখলো সব স্বাভাবিক।
হ্যা, আজ এই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিতে সবাইকেই অনেক বাঁধা পেরোতে হয়েছে। ধাক্কাটা সাইরান দিয়েছে। হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো-
‘বাবা! ছোট বাবা সেই কখন থেকে ফোনে কথা বলছে’
সুফিয়ান মৃদু হেসে সাইরানকে কোলে উঠিয়ে বসালো।
‘বলবেই তো বাবা, তুমি মন খারাপ করোনা। সব সময় তো তোমার সাথেই থাকে৷ এখন ছোট মাকে একটু সময় দেক ‘
‘ছোট মা কে বাবা? ‘
‘যার সাথে কয়েক দিন আগে তোমার ছোট বাবার বিয়ে ঠিক হলো। ‘
‘ওও, তালহা আন্তি! ‘
‘হ্যা, তালহা আন্টি ‘
সাইরান নিজের বয়স অনুযায়ী অনেক ম্যাচুয়ার্ড। সায়েশা যেমন তার ঠিক বিপরীত। জমজ ভাই-বোন হলেও চেহারা ছাড়া কোনো কিছুতেই মিল নেই। রেয়ানও আসলো। সবাই আড্ডায় মশগুলো। সুফিয়ান সুযোগ পেয়েই উঠে পড়লো। সবাই ব্যস্ত , তাই তার দিকে কোনো মনোযোগ নেই। প্রানেশা বাচ্চাদের খাবারের জিনিসপত্র ঠিক করছিলো। সুফিয়ান সেদিকে পানি খাওয়ার বাহানাতে প্রানেশার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো –
‘প্রাণ, উপরে এসো তো। ‘
প্রানেশা একবার তাকিয়ে নিজের কাজ করতে করতে বললো –
‘বুড়ো বয়সেও রঙঢঙের শেষ নেই। দুই বাচ্চার বাবা হয়েছেন আপনি! ‘
সুফিয়ান অভিমানী সুরে বললো –
‘সবার দিকেই খেয়াল থাকে তোমার। আমাকেই চোখে পড়ে না। আসতে হবে না তোমাকে হুহ! ‘
বলেই আওয়াজ করে গ্লাসটা রেখে হুড়মুড় করে উপরে উঠে গেলো৷ প্রানেশা মুচকি হেসে সেদিকে পা বাড়ালো। সে জানে লোকটা ঠিক তার জন্য অপেক্ষা করছে। উপরে চলে যেতেই, দুটো তৃষ্ণার্থ চোখ ভিজে উঠলো। ইভানানের বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো ভারী শ্বাস। একাকীত্ব যে কত ভয়ংকর! সজ্ঞানে পাপ না করলেও শাস্তি তো সে ঠিকই পাচ্ছে। সে যে এখনো ভালোবাসে তার স্রোতস্বিনীকে। বাকীটা জীবন সে তার স্রোতস্বিনীকেই ভালোবেসে যাবে। এভাবেই পুড়তে পুড়তে অঙ্গারে পরিণত হবে। কিন্তু নেশা কখনো তার হবে না।
সুফিয়ান দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলো। বসন্তের ঐশ্বরিক মাতাল হাওয়ায় মনের ভেতর বইছে শীতল শিহরণ। চোখ বন্ধ অবস্থাই বুঝতে পারলো তার প্রাণের আগমণ ঘটেছে। বুঝবে নাই বা কেনো! তার অর্ধাঙ্গিনীর শরীরের স্নিগ্ধ ঘ্রাণে সে ডুবেছে বহুবার। চেনা পরিচিত হয়ে উঠেছে কোমল ঘ্রাণের সঙ্গে। চোখ বুজেই প্রানেশাকে টেনে নিলো কাছে। দোলনা নড়ে উঠলো প্রানেশা সুফিয়ানের বুকে মাথা রেখে বললো –
‘ভালোবাসি খুব! ‘
সুফিয়ান হাসলো কিন্তু কিছু বললো না। প্রানেশার রাগ হলো। মানুষটা কখনোই বলে না,আমিও তোমাকে ভালোবাসি। তার বুঝি মানে লাগে না! প্রানেশা অভিমানী সুরে বললো –
‘ঠিকই তো আছে, আমি কে হই আপনার! ‘
সুফিয়ান প্রানেশার দিকে মাতাল চাহনি নিক্ষেপ করে মাদকীয় গলায় বললো –
প্রথম ভালোলাগা তুমি,
প্রথম ভালোবাসা তুমি,
শ্রাবণের প্রথম বৃষ্টি তুমি,
হারানো প্রেম তুমি, ফিরে পাওয়া সেই তুমি।
আমার গল্পের প্রথমাংশ তুমি,
শেষাংশের অধিকারিণী তুমি,
ভালোবাসায় পরাজিত সেনা আমি,
আর এই অঙ্গারের নেশা তুমি।
(সমাপ্ত)