অচেনা এক সময়
পর্ব – ৪ শেষ
সিনথিয়া
মৌলি সেদিন সন্ধ্যায় মাসফিক নাবিলের সঙ্গে দেখা করে বাসায় আসার পর মায়ের সঙ্গে বিয়ে বিষয় টা নিয়ে তেমন কোন কথা বলেনি। মা বারবার জানতে চেয়েছে কেমন দেখলি ছেলেটাকে?
মৌলি শুধু ভালো বলল আর তেমন কিছু বলেনি।
বেবি খালাও পরদিন এসে হাজির হয়েছিল মৌলি কি সিদ্ধান্ত নিল জানার জন্য।
ওর বড় ভাবি মোনার বোন রুনা আপাও সরাসরি তাকে ফোন দিয়েছিল। মৌলি রুনা আপাকে পরে ফোন দিব বলে এড়িয়ে গেছে।
রাতে মুনিয়া ফোন দিয়ে বলল, কি রে সবার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু কিছু তো বললি না ?
কি বলবো ?
এত হেঁয়ালি কেন করছিস মৌ ? তুই ভালো করেই জানিস আমি তোর কাছ থেকে কি শুনতে চাইছি।
মৌলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মুনিয়া আমি বুঝতে পারছি না আসলে আমি কি চাই?
মানে এই যে তিনজনের সঙ্গে দেখা করলি তাদের কাউকে তার পছন্দ হলো না ? মৌ কাউকে দেখে কথা বলে মনে হলো না তোর, হ্যা এর সঙ্গে তোর জীবন টা কাটানো যায়?
মৌলি চুপ করে আছে ।
চুপ করে আছিস কেন? আচ্ছা ঠিক আছে এদের পছন্দ না হলে আরো দেখ ! খালাম্মা তো বলল, তোর জন্য আরো কিছু প্রস্তাব আছে।
আমি আর কাউকে দেখতে চাইছি না।
তাহলে কি করতে চাইছিস মৌ ?
মৌলি মাসফিক এর শারীরিক সমস্যা টার কথা বলল মুনিয়াকে ।
কথাটা শুনে মুনিয়া একটু থমকে গেল।
আমাকে উনার অক্ষমতাটা যতটা না ভাবিয়েছে
তারচেয়ে বেশি চিন্তিত করছে তিনি তার পরিবারের কাছে এই কথাটা গোপন করেছেন!
কে তার অক্ষমতার কথা বলে বেড়াতে চায় বল মৌ ?
সেটা ঠিক আছে মুনিয়া কিন্তু তারপর উনার পরিবারের তো আমার উপর আশা করে থাকবে তখন তাদের সেই আশা আমি কিভাবে পূর্ণ করব সেটাই ভাবছি । তখন জটিলতা সৃষ্টি হবে না ?
সেই জন্যই সেলিব্রিটি হয়ে ও এত বছর অবিবাহিত লোকটা বুঝলি মৌ । তা না হলে দশ বছর আগে বউ মরে গেলে পুরুষ মানুষ বিয়ে না করে বসে থাকে নাকি !
কিন্তু জানিস লোকটা কে আমার পছন্দ হয়েছে। লোকটা সেলিব্রিটি হলেও খুব সাধারণ । আমাকে নিজের স্টারডাম দেখানোর চেষ্টা করেনি। আজকাল তো মানুষ পেজেটিভ, নেগেটিভ যেভাবেই বিখ্যাত হোক শোঅফ করতে পছন্দ করে। লোকটা সেরকম না !
তবে কি জানিস মৌ জীবনে সন্তান জিনিসটা অন্যরকম এক অনুভূতি।
তোকে কেউ মা ডাকে তার জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, নিরাপদ জায়গা তুই এটা ভাবলেই নিজের সকল না পাওয়া কষ্ট ভুলে যাওয়া যায় রে ।
তুই তো ভুলে আছিস !
সেটাই। তাই আমি বলছি সিদ্ধান্ত যা নিবি নিজেকে কোথায় দেখতে পছন্দ করবি সেভাবেই নিবি ঠিক আছে।
হুম।
এসব কথা বাদ দে মুনিয়া চল কোথাও ঘুরে আসি?
ঘুরতে যাব এখন ?
হুম দেখ মুনিয়া আমাদের জীবন টা, তুই সংসারের জন্য, ছেলের জন্য কোথাও যেতে পারিস না আর আমি মা কে একা রেখে কোথাও যেতে পারি না। জীবন টা এভাবে বন্দী থাকতে থাকতে একঘেয়ে হয়ে গেছে রে ।
মৌ তুই তো তবুও সকাল থেকে সন্ধ্যা অফিস করছিস দশটা মানুষের সঙ্গে মিশতে পারিস আমি তো চুলা টানা, বাজার করো, ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাও, তায়কোয়ান্দো ক্লাসে নিয়ে যাও , সন্ধ্যায় পড়তে বসাও , মাহমুদ আসলে তার এটা ওটা এগিয়ে দাও। সময় মত খেতে দাও। সারাদিন সব কাজ শেষে ক্লান্ত আমি কখনো কখনো মাহমুদের যেদিন ইচ্ছা হবে সেদিন আদরে মাখো মাখো হও এই তো জীবন আমার।
জীবন কি সত্যিই এটাই মুনিয়া ?
আমাদের দেশের সাতানব্বই টা মেয়ের জীবন চক্র এটাই । এর মাঝে অধিকাংশ ই এটাকেই জীবনের সব কিছু ধরে নেয় ।
তুই এভাবে বললে আর আমার বিয়ে করতে ইচ্ছা হবে না রে বলেই হেসে দিল মৌলি ।
ধুর তোর জীবন এমন হবে না দেখিস মৌ। তুই তো জীবনে একবার কষ্ট পেয়েছিস এবার যা হবে খুব ভালো হবে মিলিয়ে নিস আমার কথাটা। আর একটা কথা , মৌ আমাদের জীবন টা খুব ছোট রে। জীবনের বালি ঘড়ি কখন থেমে যায় আমরা কেউ জানি না তাই খুব বেশি সময় নিস না সিদ্ধান্ত নিতে ।
তাই ?
হুম। তবে সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে তোকে ঠিক সেই সময় টা তে ডিসিশনটা নিতে হবে তাহলেই হলো।
ঠিক আছে। যা ঘুমা মুনিয়া আগামীকাল আমার ছুটির দিন অফিস নেই কিন্তু তোর অফিস তো সপ্তাহে সাত দিনই ।
ভালো থাকিস মৌ।
মৌলি আর কারো সঙ্গে দেখা করবে না আপাতত, মা কে তাই বলেছে।
মা খুশি হয়ে বলল, তাহলে কাকে বিয়ে করছিস এদের মধ্যে থেকে? শোন ঐ খুনি বাবার ছেলের সাথে কিন্তু বিয়ে দিব না আমি।
মা ওর বাবা খুনি কিনা প্রমান হয় নাই ঠিক আছে এভাবে খুনি খুনি কাউকে বলাটা উচিত না।
আমি অতশত জানি না মৌ ।
তোমাকে জানতে হবে না আমি অফিসের কাজে কিছুদিন খুব ব্যস্ত থাকব জার্মানি থেকে ফ্রেক্ট্রি ভিজিট করতে আসবে এই সময়টা বিয়ে বিয়ে করে মাথা খাবে না আমার।
আমি তো শুধু মাথাই খাই , বিড়বিড় করে বললেন রওশন আরা।
এবং খালামনি কেও কথাটা বলে দিও।
মৌলি অফিসে খুব ব্যস্ত এর মধ্যে মুনিয়ার ফোন । সাধারণ দুপুরে মুনিয়া ফোন দেয় না ! মৌলি ফোন ধরলো , তাড়াতাড়ি বল কি বলবি ?
মৌ মৌ মৌ
কি হয়েছে এত উত্তেজিত কেন ?
আমরা সুন্দরবন যাচ্ছি !
বাঘ শিকার করতে ? হাসতে হাসতে বলল মৌলি ?
ফাজলামি করিস না ঘুরতে যাচ্ছি ।
এত জায়গা রেখে সুন্দরবন হঠাৎ !
প্রথমে খুলনাতে গিয়ে একটা বিয়ে খাব তারপর সেখান থেকে সুন্দরবন ট্রুর। বাবু এত এক্সাইটেড ওর আনন্দ দেখে আমার যে কি খুশি লাগছে।
কার বিয়ে খুলনাতে ?
মাহমুদের এক কলিগের।
ও । ভালো ঘুরে আয় । অনেক দিন বাহিরে কোথাও যাস না।
শোন মৌ এসে যেন শুনি তুই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস ঠিক আছে। আমার মন বলছে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই তুই সেই সঠিক সময়টা পাবি যে সময়ে নেয়া সিদ্ধান্ত সবচেয়ে পারফেক্ট হবে।
ইস রাখতো তোর ফিলোসফি মুনিয়া, বেড়াতে যাচ্ছিস যা আমি ফোন রাখব এখন খুব ব্যস্ত আছি।
ঠিক আছে ঠিক আছে রাখছি।
শোন ফেসবুকে ছবি আপলোড করিস দেখব ।
হুম। করব ।
সাবধানে থাকিস বাঘ কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের পছন্দ করে। মৌলি হো হো করে হাসছে।
বাঘ বুড়িদের পছন্দ করে না তুই আসলে একটা কথা ছিল তুই ইয়ং আছিস।
হয়েছে হয়েছে আমাকে আর ইয়ং বলতে হবে না।
ভালো থাকিস মৌ।
মুনিয়ার ফোন টা রেখে দেয়ার পর মৌলি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। খুব ভালো লাগছে তার অনেক দিন পর মুনিয়া এত খুশিতে ঝলমল করছে দেখে।
দুই দিন পর অফিসে একটা কনফারেন্স এ বসে ছিল দুপুরের দিকে। বারবার ফোন আসছে ওদের আরেক বন্ধু রাবেয়ার। মৌলি কেটে দিয়েছে। এখন ফোন ধরা যাবে না।
টানা তিন ঘণ্টা কনফারেন্স শেষ করে বের হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে রাবেয়া সহ আরো কয়েক জনের মিসড কল।
কি ব্যাপার এত গুলো মিসড কল কেন !
সে প্রথমে রাবেয়াকে কল দিল , বল রাবেয়া জরুরি কিছু আমি কনফারেন্স এ ছিলাম।
মৌলি, বলে রাবেয়া কেঁদে উঠলো।
কি হয়েছে রাবেয়া ?
মৌলি তুই খবরটা পাস নাই এখনো তাই না ?
কি খবর ? তাড়াতাড়ি বল আমার ভয় করছে ?
মৌলি মুনিয়ার এক্সিডেন্ট হয়েছে।
কি বলিস এসব কি হয়েছে মুনিয়ার?
মুনিয়া খুলনা গিয়েছিল সেখান থেকে সুন্দরবন যাচ্ছিল, পথে ওদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে ।
কি বলছিস ! চিৎকার দিয়ে উঠলো মৌলি। মুনিয়া কেমন আছে, মাহমুদ ভাই আর বাবু ?
মাহমুদ ভাইকে ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে এয়ার এম্বুলেন্সে করে , অবস্থা ভালো না।
মুনিয়া কোথায় রাবেয়া? চিৎকার দিয়ে উঠলো মৌলি।
কাঁপা কাঁপা গলায় রাবেয়া বলল, মুনিয়া আর বাবু স্পটডেড ।
রাবেয়ার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মৌলি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল অফিসের মেঝেতে।
আজ ছয়দিন হয় মৌলি শয্যাশায়ী। দুই দিন ওর কোন জ্ঞান ছিল না। রওশন আরা মেয়ের মাথার কাছে বসে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছেন বলে তাকে এই ঘরে আসতে দেয়া হচ্ছে না। এই বাড়িটাও যেন শোকের বাড়িতে পরিনত হয়েছে।
রাতের বেলা মৌলি মায়ের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে ওর বেবি খালা মায়ের পাশে বসে আছে।
রওশন আরা চোখের পানি মুছছেন।
বেবি, মেয়েটার পুরনো কষ্ট টা আবার ফিরে এসেছে রে। এত বছর পর আবার আগের মতো ভেঙে পড়েছে।
আপা মুনিয়া ওর সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। এমন একটা দিন নেই ওদের কথা হতো না । শপিং করতে যাওয়া, বাহিরে খেতে যাওয়া সব ই তো মুনিয়ার সঙ্গে। এত বড় একটা ঘটনা কিভাবে সহজ ভাবে নিবে মৌ বল ?
তন্ময় যখন চলে গেল তখন ওর বাবা ওকে সামলাতে পেরেছিল এবার আমি ওকে কিভাবে সামলাই বল তো , আমি নিজেই তো মনটাকে বুঝাতে পারছি না। কারো সঙ্গে কথা বলছে না মেয়েটা।
আপা কেঁদো না তোমার নিজের শরীর ই খারাপ।
কি প্রাণবন্ত ছটফটে একটা মেয়ে মুনিয়া । কি সুন্দর সাজানো গোছানো সংসার তার। সারাক্ষণ ছেলেকে নিয়ে, জামাইকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এতটুকু বয়স থেকে সংসারের সব দ্বায়িত্বপালন করছে।
সব শেষ হয়ে গেল। জামাইটাও আইসিইউতে বাঁচবে কিনা জানিনা।
মৌলি মায়ের ঘরের পাশ থেকে সরে এলো। নিজের ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। নভেম্বরের রাত বাহিরে হালকা হিম ।
মৌলি গায়ের ওড়নাটা জড়িয়ে নিল ভালো করে।
আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো বারান্দায় তারপর ঘরে ঢুকলো।
ল্যাপটপ টা অন করলো।
পুরনো ছবির ফোল্ডার টা ওপেন করলো। এসব ছবি অনেক অনেক বছর সে দেখে না।
তন্ময়ের ছবি এখানে।
হঠাৎ একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল। ছবিটা তাদের বিয়ের পর মুনিয়া মাহমুদ ভাই সহ তাদের বাসায় এসেছিল দাওয়াতে। খাবার টেবিলে বসা সবাই।
কি অদ্ভুদ এই ছবিটাতে থাকা তিনজন মানুষ আজ আর নেই। প্রথমে তন্ময়, তারপর বাবা, এবার মুনিয়া। ভালোবাসার মানুষ গুলো এভাবে ওকে ফেলে চলে যায় কেন ? ভালো সময় গুলো কেন নিমিষেই চলে যায় ?
সময় সব কিছু সময়ের হাতে বন্দী।
মৌলি মনে মনে বলল, ঠিক কথাই বলেছিলি তুই মুনিয়া জীবনের বালি ঘড়ি খুব তাড়াতাড়ি চলে।
মুনিয়ার সঙ্গে ফোনে শেষ কথা গুলো মনে হলো। মুনিয়া বলেছিল সঠিক সময়ে নেয়া সিদ্ধান্ত সঠিক ই হয় ।
মুনিয়া ল্যাপটপ টা অফ করে রেখে মোবাইল টা হাতে নিল। তারপর কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদল।
মনে মনে বলল, মুনিয়া সঠিক সময় কিনা জানিনা তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। কষ্ট একটাই তোকে জানাতে পারলাম না।
মোবাইল টা হাতে নিয়ে মৌলি রিজওয়ান কবির কে ফোন দিল ।
দুটো রিং হতেই রিজওয়ান ফোন ধরলো,
হ্যালো মৌলি কেমন আছেন ?
জ্বি আমি ভালো আছি।
আপনি কেমন আছেন?
আছি চলছে। কিন্তু
আপনার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে আপনি ভালো নেই মৌলি !
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মৌলি বলল, একটু ঠান্ডা লেগেছে তেমন কিছু না।
অসময়ে ফোন করার জন্য দুঃখিত,
আচ্ছা আগামীকাল কি আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন রিজওয়ান ?
পারব কখন ?
যখন আপনার সুবিধা হয় আমি ফ্রি আছি।
ঠিক আছে আমি আপনাকে জানাচ্ছি মৌলি।
আর একটা কথা আপনি সঙ্গে আপনার মেয়ে জুন কে নিয়ে আসবেন প্লিজ ! আমি ওর সঙ্গে পরিচিত হতে চাই।
রিজওয়ানের মনটা হঠাৎ ভালো লাগায় ভরে উঠলো। নিজেকে সামলে সে বলল, আমি আপনাকে জানাচ্ছি মৌলি ।
ফোন টা রেখে মৌলি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
কিছুক্ষণ পর রিজওয়ানের মেসেজ, আগামীকাল বিকেল চারটায় আপনাকে আপনার বাসা থেকে পিক করে নিব আমি আর জুন ।
মৌলি মোবাইলে তার আর মুনিয়ার ছবি বের করলো মনে মনে বলল , মুনিয়া আমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি তো ?
সমাপ্ত