অচেনা কবি❤,পর্ব-২

0
1407

অচেনা কবি❤,পর্ব-২
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী❤

চুলোয় হাড়ি চাপিয়ে রেখে এসেছেন বলে মা কিচেনে চলে গেলেন। রাজ ভাইয়াও দেরি করতে চান না বিধায় আমায় ডাকলেন, “কথামনি?”

“জ্বী ভাইয়া।”

“দরজাটা লাগাবে এসো।”

দরজার কাছাকাছি এসে উনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার দিকে ফিরে বলতে শুরু করলেন, “সারাদিন ফোনে ডুবে না থেকে একটু শরীরের যত্ন নাও। দিনদিন কঞ্চি বাঁশের মতো চেহারা হচ্ছে। এমন চলতে থাকলে তোমার জন্য ছেলে পাওয়া ইম্পসিবল হয়ে দাঁড়াবে।”

উনার অহেতুক জ্ঞানে নিজের মাঝে রাগ অনুভব করলাম। রাগটা চেপে ধরলেও নিরস গলায় প্রশ্ন করলাম, “গরু মেরে জুতো দান করার কোনো মানে হয়?”

“মানে?” বুঝতে না পেরে।

“আপনার বোনের জন্য যেই ব্যবহারটা করলেন আমার সাথে। এখন এইসব আদ্যিখেতার মানে কী?”

“আমি কী সবাইকে বলবো তোমার কান্ডকারখানার ব্যাপারে?”

“বলুন, বলে দিন। আমি এসব মোটেও ভয় পাই না। বললে আমি হয়ত দুই একদিন সবার বকুনি খাবো কিন্তু এতে আমার কিছুই হবে না। যা হওয়ার তা আপনার এবং আপনার বোনের হবে। আমি তো শুধু বলেছিলাম, ছবিটা সুন্দর হয়েছে। আমি কি জানতাম ঐ ছেলেটা আপনার বোনের কে হয়? বলুন আমায়।… সামান্য একটা কমেন্টের জন্য আপনি আমাকে কত কিছু বলেছেন।… শুনুন, আপনার বোনের কোনো কিছুতে আমি এখন আর নেই। কারণ আমাদের সম্পর্ক আপনার বোন নষ্ট করে দিয়েছে। আর আপনিও চাইলে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পারেন। যদিও আপনার সাথে আমার মাসেও একবার কথা হয় না, তবুও।”

আমি রাগের দরুন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও উনি বেশ শান্ত গলায় বললেন, “এতটা উত্তেজিত হওয়ার মত কিছুই করিনি আমি। হ্যাঁ, দোষ আমার ছিল এবং আমি তার জন্য সরিও বলেছিলাম কিন্তু তুমি…”

“এক মিনিট। আপনার কি মনে হয় সামান্য একটা সরিতে সাতখুন মাফ হয়ে যায়? আপনি আমাকে যা নয় তাই বলেছেন। কেন ভাইয়া? আমি আপনার বোনের কাজিন বলে? স্পৃহা আমার আপন বোন হলেও ওর প্রেম ভালোবাসায় আমি কোনো বাঁধা সৃষ্টি করতাম না। কারণ কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার হস্তক্ষেপ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। তবে মা বাবাকে অবশ্যই জানাতাম এবং তাদের সিদ্ধান্তের উপর বিষয়টা ছেড়ে দিতাম।”

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, “এই বয়সে এত পাকা পাকা কথা তোমায় কেউ বলতে বলেনি। বড় বোন হিসেবে তোমার কর্তব্য ছোট বোনকে এসব ব্যাপারে শাসন করা। কারণ এসব ভালোবাসা নয়, জাস্ট অ্যাট্রাকশন। আর বাবা মা কোনোদিনও এসবে অনুমতি দিবে না। বাবা মা’র যেমন সন্তানের উপর দায়িত্ব থাকে, তেমনি বড় ভাই বোনেরও ছোট ভাই বোনদের উপর দায়িত্ব থাকে।”

দাঁতে দাঁত চেপে, “আর কিছু বলার আছে আপনার?”

“হ্যাঁ।”

“বলুন।”

“ইউটিউবে সার্চ করে জেনে নিবে, কীভাবে ভদ্র হওয়া যায়? আসি এখন।” বলেই হনহন করে নেমে গেলেন সিঁড়ি ভেঙে। উনার এমন অপমানজনক কথায় রাগে ফুঁসে উঠলাম আমি, “আপনিও ইউটিউবে সার্চ করে জেনে নিবেন, কী করলে নিজের বোনকে দিতে না পারা জ্ঞান অন্য কাউকে দেওয়া থেকে বিরত থাকা যায়।” আমার কথা আমি ছাড়া আর কারোর কানে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ মা কিচেনে আর রাজ ভাইয়া জ্ঞান দিয়ে অতি দ্রুত চলে গেছেন।

৪.

“ওহে চাঁদবালিকা,
লেখনী তোমার পড়ে
মন্দ যে লাগছে না মোর।
আরো ভালো হবে আশা করি
লিখে যাও দিয়ে তোমার মন।”

আবারও উনার মন্তব্য পেয়ে হেসে উঠল আমার মন। মনের কোণে কত-শত প্রশ্নেরা উঁকি দিচ্ছে কিন্তু সেসবের উত্তর পাবো কোথায়? উত্তর পাবার তো ঝো নেই তাই কেবল মুচকি হেসে জবাব দিলাম, “শুকরিয়া ভাইয়া।”

এবারও উনি কোনো জবাব দিলেন না। উনার জবাব না দেওয়াটাও আমার মাঝে প্রশ্নের সৃষ্টি করতে শুরু করল। উনার মন্তব্য আর উনাকে ঘিরে ভাবতে শুরু করলাম কিন্তু হঠাৎ ফোনে ম্যাসেজের শব্দে ভাবনাটা উবে গেল। ম্যাসেজ চেক করে দেখি রাজ ভাইয়ার ম্যাসেজ, “কী করছো?”

ঠোঁটে টানটান হাসির রেখা সরে গিয়ে চোখে মুখে বিরক্তি ছেয়ে গেল৷ সেটা বুঝাতে জবাব দিলাম, “পালতু ছাগলের জন্য ঘাস কাটছি।”

“দিন দিন এমন বেয়াদব হচ্ছো কেন? ভালো একটা প্রশ্নের উত্তর কি ভালো করে দেওয়া যেত না? শান্ত হয়ে আছি বলে কি আমার রাগের কথা ভুলে গিয়েছো?”

ভাইয়ার কথায় ভুল নেই। আমি সত্যিই দিনদিন বদলে যাচ্ছি। আগে খুব শান্ত ও চুপচাপ ছিলাম কিন্তু ইদানীং অহেতুক রাগারাগি আর চেঁচামেচি করি৷ অহেতুক তর্কের মাঝে আনন্দ খুঁজে বেড়াই অথচ এই আমি এমন ছিলাম না। স্পৃহার সাথে মনমালিন্য এবং সেটা নিয়ে রাজ ভাইয়ার কাছে কথা শোনার পর থেকে আমি এমন বদলে গেছি।

ম্যাসেজ সীন করে জবাব দিচ্ছি না বলে উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বলছো না কেন?”

যা-ই হোক না কেন? উনি তো আমার চেয়ে বয়সে বড়। তাই ত্যাড়ামি না করে জবাব দিলাম, “বসে আছি।”

“এটা কি আগে বলা যেত না?”

উনার প্রশ্ন এবার আমার মুখখানা মলিন হয়ে গেল। ঠোঁট উল্টে টাইপ করলাম, “সরি ভাইয়া।”

“সামান্য একটা সরিতে কি সাতখুন মাফ হয়?”

পাঁজি লোক এবার আমার প্রশ্ন আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে। পরিচিত প্রশ্নের উত্তর জানা আছে বিধায় বললাম, “নাহ, হয় না।”

“তাহলে?”

অবাক হয়ে, “তাহলে কী?”

“রাতের খাবার খেয়েছো?”

হঠাৎ করে উনি প্রসঙ্গ কেন পাল্টে দিলেন বুঝতে পারলাম না। কিন্তু নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। তাই প্রতুত্তরে বললাম, “নাহ, এতো তাড়াতাড়ি খাওয়ার অভ্যাস নেই।”

“জানি খাওনি। আসলে বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না তো, তাই।”

“বলার মত কিছু না পেলে বকা দিন। এটার জন্য তো কোনো কারণের প্রয়োজন নেই।”

“কথামনি, তোমাকে তো আমি বলেছিলাম, স্পৃহার এসব কান্ডকারখানার ব্যাপারে জানতে পেরে আমার মাথা ঠিক ছিল না। তখন আমার মাথায় কেবল ঘুরছিল যে, তুমি তো ওর সাথে কথা বলো। তাই তুমি সব জানো এবং জেনে আমাদের কিছু জানিয়ে ছিলে না। এসব ভাবনাচিন্তার ফলে ভুলে গিয়েছিলাম, তোমার কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। আমার ভুলের জন্য তো আমি সরি বলেছি তবুও এমন কেন করো? দোষ আমার বলে তোমার এমন ধাঁচের কথায়ও আমি রাগ করতে পারি না।”

মনযোগ দিয়ে ভাইয়ার ম্যাসেজ পড়ে জবাব দিলাম, “ভাইয়া, আপনার কোনো দোষ নেই। বোনের ভালোর জন্য আপনি এমন করেছিলেন। এসব বাদ দিন কারণ আমারই দোষ আমি আপনার সাথে পচা ব্যবহার করছি৷ অনেক বকেছিলেন তো তাই খুব বাজে ব্যবহার করে ফেলছি। আমাকে ক্ষমা করবেন আর আমার পচা ব্যবহারগুলো ভুলে যাবেন দয়া করে। আমি এখন আসি ভাইয়া। মা ডাকছেন। আল্লাহ হাফেজ।”

ম্যাসেজ পাঠিয়ে সাথে সাথে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিলাম যেন উনার ম্যাসেজ এখন আমার ফোনে না আসে। উনাকে ম্যাসেজ করার মাঝে মা আমায় ডেকে ভালোই করেছেন। কারণ এখন আর উনার সাথে আলাপচারিতা চালিয়ে যাওয়ার মত কোনো শব্দ বা বাক্য আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ালাম। হাতের ফোনটা টেবিলে রেখে রুমের বাইরে পা বাড়ালাম মা’র উদ্দেশ্যে। খাবার রুমে মাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমায় ডেকেছো মা?”

“হ্যাঁ, তোর কাপড়গুলো নিয়ে যা। শুকিয়ে গেছে।”

“ঠিক আছে।”

৫.

আজকে খুব বৃষ্টি হয়েছিল শেষ বিকেলে। বৃষ্টির রেশ এখনও কাটেনি। বড্ড শীত শীত অনুভব করছি বলে এককাপ গ্রীন টি বানিয়ে সোফায় আয়েশ করে বসলাম। চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে ফোনটা হাতে নিয়ে নোটিফিকেশন চেক করতে লাগলাম। হঠাৎ মিরাজ নামটা চোখে পড়লো। আসলে উনার কমেন্টের আশায় নোটিফিকেশন চেক করছিলাম। অনেক প্রত্যাশিত কিছু পেয়ে ঠোঁটের কোণে আমার হাসি ফুটে উঠল। নোটিফিকেশন চেক করে দেখি, ষষ্ঠ পর্বেও যথারীতি তিনি ছন্দে ভরপুর মন্তব্য করেছেন,

“শব্দের সাথে শব্দ জুড়ে
লিখো যাহা তুমি,
তাহার মাঝে তোমায় খুঁজে
মনকে ভাসাই আমি।”

এভাবে একের পর ছন্দে ভরপুর মন্তব্য করে আমার কমেন্ট বক্স সাজিয়ে দিতেন মিস্টার মিরাজ। প্রতিটি পর্বে উনার এমন মন্তব্যে আমার আনন্দ যেন আকাশ ছুঁতে শুরু করল। ছন্দে ভরপুর মন্তব্যের পাশাপাশি উনি আমার লেখার ভুলত্রুটিও ধরে বুঝিয়ে দিতেন। ফলে আমি নিজের লেখায় সংশোধন করে লেখার মান বাড়ানোর দিকে নজর দিতে শুরু করি।

দুইদিন ধরে মিস্টার মিরাজের একটা ব্যাপার আমার চোখে পড়েছে। উনি আমার পোস্টে কেবল মন্তব্য করছেন কিন্তু কোনো রিয়েক্ট দিচ্ছেন না। আজকেরও পোস্টেও শুধু মন্তব্য পেয়েছি কিন্তু কোনো রিয়েক্ট পাইনি।

আমার পাঠকসংখ্যা যেহেতু খুবই কম। তাই আমি সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। উনাকে এবং উনার করা কাজগুলো নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করার মাঝে মা ডেকে বলল, “কথামনি, পিঠা বানিয়েছি। খাবি আয় তাড়াতাড়ি।”

পিঠার নাম শুনে ভরা পেটেও আমি খিদে অনুভব করলাম, “আসছি মা।”

চা অর্ধেক বাকি রেখে দিলাম পিঠা খাওয়ার আশায়। কোনোরকমে ফোন রেখে পিঠা খেতে দৌঁড় দিলাম। মা’র কাছে এসে দাঁড়াতে মা জানতে চাইলো, “এমন দৌড়ঝাঁপ করছিস কেন? পিঠা কি পালিয়ে যাবে?”

আস্ত একটা পুলি পিঠায় দাঁত বসিয়ে দিলাম। চিবোতে চিবোতে জবাব দিলাম, “যদি পালিয়ে যায়, তখন?”

মুখে পিঠার পরিমাণ এতোটাই বেশি যে চিবোতে এবং কথা বলতে আমার অসুবিধা হচ্ছে কিন্তু আমি তো এভাবেই খাবো আর কাউকে ভাগও দিবো না। অবশ্য ভাগ দেওয়ার মত তেমন কেউ নেইও। কারণ আমি বাবার একমাত্র সন্তান।

পিঠা খাওয়া শেষ করে রুমে চলে এলাম। টেবিলে আর বিছানায় ফোন খুঁজে কোথাও পেলাম না। হঠাৎ-ই মনে পড়লো ফোন তো সোফার উপরে রেখে পিঠা খেতে গিয়েছিলাম। তাই ড্রয়িংরুমে এসে ফোন হাতে সোফায় বসে পড়লাম।

যথারীতি পেইজে উঁকি দিলাম। আর যা দেখলাম, তারজন্যে আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। মিস্টার মিরাজ আমাকে ইনবক্স করেছেন। উনার ছন্দময় মন্তব্য দেখে আমার অনেক সাধ জেগেছিল উনার সাথে কথা বলার। কিন্তু উনি তো কমেন্ট বক্সেই আমার জবাব দেন না, সেখানে ইনবক্সে উনার থেকে জবাব আশা করা অনেকটা আঙ্গুর ফুলে কলা গাছ হওয়ার মতন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here