অচেনা কবি❤,পর্ব-৩
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী❤
উনার ম্যাসেজ পেয়ে মনে হচ্ছে অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে গিয়েছি। তাই খুশির ঝিলিক আমার চোখে মুখে রোদের মত ভেসে উঠছে। এই মূহুর্তে নিজের মাঝে খানিকটা লজ্জা আর ভয়ও অনুভব করছি। একজন অপরিচিত মানুষের ম্যাসেজ পড়তে গিয়ে হাতও কেঁপে উঠছে আমার। সকল ভয় আর লজ্জাকে সঙ্গী করে ম্যাসেজ পড়তে শুরু করলাম,
“আমার মনে জেগেছে তীব্র বাসনা,
করব তোমার সাথে বার্তা আলাপ।
জবাব দিয়ে কি জানাবে তোমার সম্মতি?
দেবে কি গুঁজে মনে আমার,
ছোট্ট একটা সাদা গোলাপ?”
ম্যাসেজ পড়ে নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, “হায় আল্লাহ!” পরক্ষণে মুচকি হেসে বিড়বিড় করতে লাগলাম, “এ কীরকম মানুষ রে বাবা? কেবল মন্তব্য নয়, ম্যাসেজও ছন্দময়। কোনো কবি নয় তো উনি?”
ছোট্ট এই কবিতা শেষে উনি সালাম দিয়েছেন আর আমি সেই সালামের জবাব দিলাম, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
“ওহে অপরিচিতা কাব্যু,
এত সহজে উত্তরের প্রত্যাশা আমি করিনি।
তোমার লেখায় সৌন্দর্য খুঁজে ফিরে,
নিজের তীব্র ইচ্ছেকে আমি দমাতে পারিনি।”
উনার এমন কাব্যিক ম্যাসেজে আমি দোটানায় পড়ে যাচ্ছি বিধায় বললাম, “আমার কবিতা ভীষণ ভালো লাগে। তবে সাধারণ ভাবে কথাবার্তা বললে হয়ত ভালো হতো। আপনার কী মতামত?”
“ঠিক আছে মিস. কাব্যু।”
মিস্টার মিরাজের আমাকে কাব্যু সম্বোধন আমার মাঝে বিস্ময়ের সৃষ্টি করল। কৌতূহল নিয়ে তাই উনার কাছে জানতে ম্যাসেজ করলাম, “মিস. কাব্যু? কিন্তু আমার নাম তো কথা চৌধুরী।”
“আমি জানি, তোমার নাম কথা চৌধুরী কিন্তু আমি এই নামেই ডাকতে চাই।”
“সেটা কেন?”
“কারণ তোমার ছোটখাটো কাব্যিক লেখা এবং কবিতাগুলো আমার বেশ ভালো লেগেছে। তাছাড়া তুমি তো লিখতে ভালোবাসো। তাই কাব্যু বলে ডাকতে চাই।”
এবারও অবাক হলাম আমি আর জানতে চাইলাম, “আমি লিখতে ভালোবাসি, সেটা আপনি জানলেন কী করে?”
“এই যে মিস, এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। তুমি নিজেই তোমার বায়োতে লিখে রেখেছো যে, লিখতে ভালো লাগে তাই লেখার মাধ্যমে নিজের অনুভবের জগৎ টা তুলে ধরার সামান্য প্রয়াস আমার। কি? মনে পড়েছে?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আচ্ছা, আপনি কি কিছু বলতে চান?”
“হুম, সেজন্যই তো ম্যাসেজ দেওয়া।”
“তাহলে বলুন।”
“সেটা না হয় ধীরে ধীরেই বলবো, কেমন?”
“আচ্ছা, তাহলে এখন আসি। আল্লাহ হাফেজ।”
“খুব ব্যস্ত তুমি নাকি এখন বলবো না বলে অভিমান করছো?”
উনার ভাবনার সাথে আমার এখনকার ভাবনার কোনো মিল নেই আর সেটার প্রমাণ করতে বললাম, “না, না, সেরকম কিছু না। আমি অবসর আছি এখন। আর অভিমান করার মতো তো কিছু হয়নি। আসলে আপনি বললেন যে, ধীরে ধীরে বলবেন তাই ভাবলাম হয়ত কয়েকদিন সময় নিয়ে বলবেন।”
“হা হা হা।”
“হাসছেন কেন?” অবাক হয়ে।
“তোমার কথা শুনে।”
“ওহ।”
“প্রথম আলাপে ‘তুমি’ সম্বোধন করছি তাও তোমার অনুমতি ছাড়া। তুমি আবার রাগ করছো না তো?”
“না, না, রাগ কেন করবো?”
“উম, ‘কাব্যু’ নামে ডাকলে কোনো আপত্তি নেই তো আবার?”
“নাহ, এটাতেও আপত্তি নেই বরং আমি খুশি হয়েছি নতুন একটা নাম পেয়ে।”
“শুনে প্রসন্ন বোধ করছে আমার মন।”
কিঞ্চিৎ কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কবি, তাই না?”
“এটা কেন মনে হচ্ছে?”
“আপনার কথাবার্তার ধরন দেখে।”
“আমার কথাবার্তা কি প্রকাশ করছে, আমি একজন কবি?”
“জানি না, তবে ছন্দে ছন্দে কথা বলছিলেন তো তাই মনে হলো।”
“হা হা হা। ছন্দে ছন্দে কথা বললেই কি কবি হওয়া যায়?”
“জানি না, আসলে আমার সেটাও জানা নেই।”
“না, আমি কবি নই আর না লেখালেখি করি। তবে অন্যের লেখায় বড্ড আসক্ত।”
“সেটা কেমন?” বুঝতে না পেরে।
“গল্প, কবিতা, উপন্যাস আমার মনের খোরাক জোগায়। মাঝে মাঝে মনে হয় এগুলো ছাড়া বেঁচে থাকা দায়।”
“ও আচ্ছা।”
“জ্বী, আজকে এখানেই ইতি টানলাম কারন একদিনে সব জেনে গেলে জানার কৌতূহল হারিয়ে ফেলবে।”
“ঠিক আছে, আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
আলাপচারিতা শেষে এবার আপনমনে আমি বলে উঠলাম, “বেশ অদ্ভুত একজন মানুষ। নিজের সম্পর্কে জানাবেন তবে সেটা নাকি ধীরে ধীরে। আবার কবি নন অথচ ছন্দে ভরপুর তার কথাবার্তা।”
৬.
বিকেল সাড়ে চারটা। সবেমাত্র দুপুরের খাবার শেষ করে ফোন হাতে নিয়ে বসলাম। ‘অনেক ভালোবাসি তোমায়’ গল্পটার আজকের পর্ব লিখতে লিখতে এতো বেলা হয়ে গেল দুপুরের খাওয়া শেষ করতে। মা তো বকে বকে কান ঝালাপালা করে দিয়েছে। মা’র এতো বকা শুনেও খাচ্ছি না বলে শেষমেষ অসহ্য হয়ে মা নিজেই খাইয়ে দিলো। অবশ্য আমি মনে মনে খুব করে চেয়েছিলাম যেন মা নিজেই আমাকে খাইয়ে দেয়।
ফেইসবুকে ঢুকে প্রথমে কিছু মন্তব্যের উত্তর দিলাম এরপর ইনবক্সে এলাম। ইনবক্সে এসে মিরাজ মহাশয়ের ম্যাসেজ পেলাম, “আসসালামু আলাইকুম মিস. কাব্যু।”
‘মিস. কাব্যু’ নামটা দেখলে কেন যেন আমার ঠোঁটের কোণে হাসি রেখা ফুটে উঠে। এখনও মুচকি হেসে, আলতো হাতে টাইপ করছি, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
জবাব দিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছি উনার ম্যাসেজের আশায়। কিন্তু আমি হতাশ হলাম উনার থেকে কোনো ম্যাসেজ না পেয়ে আর বিড়বিড় করতে লাগলাম, “হয়ত উনি অনলাইনে নেই এখন। থাকলে নিশ্চয়ই জবাব দিতেন। আমি বরং একটা গান শুনি।”
প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে ইয়ারফোন খুঁজে এখন গান প্লে করে সেটা নিজ কানে গুঁজে দিলাম,
“একা দিন, ফাঁকা রাত নিভেছে আলো
তুই নেই, কেউ নেই লাগছে না ভালো।
একা দিন, ফাঁকা রাত নিভেছে আলো
তুই নেই, কেউ নেই লাগছে না ভালো।
তোর নাম না জানা অভিমানে,
কত দূরে ভাসা যায়?
আমি চাইছি তবু পারছি না তো
থামাতে আমায়।
একা দিন, ফাঁকা রাত নিভেছে আলো
তুই নেই, কেউ নেই লাগছে না ভালো।”
গানের আমি অনেক ভক্ত। সবকিছুতেই কানে আমার গানের সুর চাই। এতোটা গানের পাগল হওয়াটা ঠিক কী বেঠিক তা জানা নেই। তবে আমার মনের অবস্থা যাই থাকুক না কেন? গান মূহুর্তেই মনের রং বদলে দিতে পারে। যেমনঃ হাসিখুশির মূহুর্তে কখনও খুশিটা গাঢ় হতে থাকে আর কখনও কান্নায় রূপ নিতে থাকে, কখনও মনে মেঘ জমে থাকলে সেটাকে বৃষ্টিতে রূপান্তর করে নয়ত সূর্যের আগমন ঘটিয়ে রোদের তেজ বাড়াতে থাকে।
গানের তালে তালে ফোন স্ক্রোল করতে লাগলাম। হঠাৎ ফোনে টুং শব্দ হতে আমার চোখের আকার খানিকটা বড় হলো। ম্যাসেজ এসেছে আর সেটা চেক করি দেখি রাজ ভাইয়া লিখেছেন, “কী করছো?”
ঐ রাতে উনার সাথে কথা বলার পর অনেকদিন আর কথা হয়নি। সে-রাতে আমার ম্যাসেজের জবাবে উনি কিছুই লেখেননি বিধায় আমাকে নিজে থেকেও কোনো ম্যাসেজ দিতে হয়নি। উনার সাথে এমনিতেও আমার খুব একটা কথা হয় না।
আজকেও উনি একই ম্যাসেজ দিয়েছেন কিন্তু আমার ত্যাড়া উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না বিধায় জবাব দিলাম, “গান শুনছি।”
“কী গান?”
“একা দিন, ফাঁকা রাত নিভেছে আলো
তুই নেই, কেউ নেই লাগছে না ভালো।”
“ওহ, এটা পছন্দের গান?”
“হ্যাঁ, ভাইয়া। অনেক পছন্দ।”
“ওহ আচ্ছা, তা ফুপ্পি কোথায়? ফুপ্পিকে বলো একটু কষ্ট করে মাকে কল করতে।”
“ঠিক আছে ভাইয়া।”
মাকে খবরটা দিয়ে আবার ফোন হাতে নিলাম। ইনবক্সে উঁকি দিতে মিরাজ মহাশয়ের ম্যাসেজ পেলাম, “উত্তর পেয়ে পুলকিত হলাম। তা কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”
“হুম, ভালো আছি। কী করছো এখন?”
“গান শুনছিলাম। আপনি কী করছেন?”
“এই যে, তোমার সাথে আলাপচারিতা চলছে।”
আমি কিছু লিখতে যাবো তার আগে উনিই ম্যাসেজ দিলেন, “আচ্ছা কাব্যু, আমি কি তোমায় বিরক্ত করছি?”
“না, না, কবি সাহেব। আমি মোটেও বিরক্ত বোধ করছি না।”
“হা হা হা। এই কবি সাহেবটা আবার কে?”
“কেন? আপনি।”
“মিস. কাব্যু, আমি কোনো কবি নই আর সেটা তো কালকেই বললাম।”
“তা আমার মনে আছে বৈ কী।”
“তাহলে কবি বলার হেতু?”
“উম, আপনার ছন্দে ছন্দে বলা কথাগুলো আমার কাছে কবিতাই মনে হয় তাই আপনাকে কবি সাহেব বলে সম্বোধন করলাম।” মুচকি হেসে ম্যাসেজ পাঠালাম।
“ছন্দে ছন্দে কথা বললেই কবি হয়ে যায়?”
একটু ভেবে জবাব দিলাম, “এটা আমার জানা নেই সেটা তো আগেই বলেছি। তবে আপনি আমার কাছে কবি, অচেনা কবি।”
“বাহ! দারুণ বললে তো। ‘অচেনা কবি’ নামটার মাঝে কেমন যেন কবি কবি গন্ধ পাচ্ছি।”
আন্দাজে একটা কথা বললাম উনাকে, “আপনার নাক মনে হয় একটু খাঁড়া।”
“অদ্ভুত ব্যাপার! তুমি কী করে জানলে আমার নাক খাঁড়া?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “সেকি! সত্যিই বুঝি খাঁড়া নাক আপনার?”
“হুম, সত্যিই।”
আমি কথাটা উনাকে অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছিলাম কারণ উনি নাকি কীসের গন্ধ পাচ্ছেন। কিন্তু এটা সত্যি হবে সেটা ভাবতে পারিনি।
“কাকতালীয় ভাবে মিলে যাবে ভাবতে পারি নি।” আমি ম্যাসেজ করলাম।
“মিস. কাব্যু, আজকে তাহলে ইতি টানলাম। আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
ভেবেছিলাম আমাদের কথপোকথন হয়ত শেষ কিন্তু উনি আবার ম্যাসেজ দিলেন, “ওহ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।”
“জ্বী বলুন।”
“লেখার শেষে অহেতুক ডট ডট ব্যবহার করো না। এতে লেখার সৌন্দর্য নষ্ট হয়। যতিচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার করবে। কারন ভাবের বা অর্থের পরিস্ফুটনের দিকে লক্ষ্য রেখে যতিচিহ্নের প্রচলন করা হয়েছে। যতি বা ছেদ চিহ্নের প্রয়োজন না হলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যতি বা ছেদ চিহ্নের প্রবর্তন করতেন না। তোমার যতি চিহ্নের ব্যবহার যথাযথ নয়। তাই আমার উপদেশ এই যে, যতিচিহ্নের ব্যবহার ভালো ভাবে শিখে সেটার ব্যবহার করবে, কেমন?”
“জ্বী, চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ।”
“হুম।”
“আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।”
উনি আর কোনো উত্তর দিলেন না। আমি কিছু সময় অপেক্ষা করেছিলাম। ভেবেছিলাম, হয়ত কোনো ম্যাসেজ দিবেন কিন্তু দিলেন না। উনার কথা মতো ফোন রেখে বাংলা ব্যাকরণ বই নিয়ে বসলাম, যতি চিহ্নের নিয়ম নতুন করে শিখতে। আগেও পড়েছিলাম কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব ভুলে গিয়েছি। অভ্যাস না থাকার কারণে মানুষ সহজ জিনিসও ভুলে যায়।
চলবে…